শুভ্র রঙের প্রেম পর্ব-২৭+২৮

0
1469

#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি

পর্বঃ২৭
বিয়ে বাড়ির ভরা আসরে শাড়ির কুঁচি ধরে দৌড়াচ্ছি৷ আশেপাশের কোনো দিকে মনোযোগ নেই আমার৷ হঠাৎ করেই পায়ে বেজে পরতে নিলেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলি ৷ মান সম্মান বিয়ে বাড়ির ধূলোর মধ্যে মিশে গেলো বোধহয়৷ আমার ভাবনা আবারো ভুল প্রমাণিত হয় শক্ত পুরুষালি হাতের ছোঁয়া কোমড়ে আঁকড়ে ধরতেই।আমি মুচকি হেসে উঠি চোখ বন্ধ করেই৷ উক্ত হাতের ছোঁয়া আমার পরিচিত আমার আপনজনের৷
–‘ পুরাই সিনেমা দোস্ত৷ ‘ রাহাতের বলা কথায় আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি একজোড়া রক্তচক্ষু আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি অনেকেই তাকিয়ে আছে সেই সাথে রাফিন৷ ও হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে৷ মূহুর্তেই উঠে দাঁড়াতে গেলে উনি উঠতে দিলেন না৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–‘ ভরা আসরে এইভাবে বাচ্চাদের মতো ছুটোছুটি কেন করছো?? মাথার বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে?? পরে গেলে কি হতো! ‘

–‘ আ…আসলে এই শাড়িটা নীতিকে দেওয়া দরকার জলদি৷ একটু পরেই তো হলুদের ফাংশন শুরু হবে৷ ‘

–‘ সামনে তাকিয়ে ভদ্র ভাবে হেঁটে যাবে৷ যাও৷ ‘ আমি পিটপিট চোখ করে তাকালাম৷ হলুদ আর লাল মিশ্রণের পাঞ্জাবি তে তাকে দারুণ দেখাচ্ছে৷ চুল গুলো সযত্নে সেট করা হলেও কিছু অবাধ্য সিল্কি চুল কঁপাল বেয়ে নেমে আছে৷ আমিও ঠিক ওই অবাধ্য চুল গুলোর মতো হাজার শাসন করলেও কথা একদম শোনা চলবে না টাইপ৷ আমি হাত ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে ঘুরেই আগের ন্যায় দৌড়ে গেলাম৷ সে বিষ্ময়ে ‘ হা ‘ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার হাসি পাচ্ছে প্রচুর৷ সন্ধ্যা থেকে চোখে-চোখে রাখছেন আমাকে উফফ!

আজ নীতির হলুদ সন্ধ্যা৷ তার বহু কাঙ্খিত মানুষটার সাথেই৷ সেদিন বিকেলে আরিফ ভাইয়ার মা কে নিয়ে আসলে নীতির মা না করেন নি৷ সেদিন রাতেই সব ঠিকঠাক হয় আর আগের ছেল পক্ষের কাছে ব্যাপারটা জানানো হলে তারা ভেজাল করলেও নীতির মা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে৷ ওর মামা এইজন্য বিয়েতে আসেন নি৷ তার ঠিক তিনদিন পর মানে আজ নীতি আর আরিফ ভাইয়ার হলুন সন্ধ্যা৷
আমাকে নীতি কাল নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে সাথে রাফিন, রাহাত, ফারিহা,মাধবী আর জান্নাত৷ আর আজ একটু আগে আমার সে এসেছে সাথে নোমান আর মিম ভাবি৷
নীতি অতিরিক্ত ব্ল্যাকমেইল করেই তাদের আনিয়েছে৷ সব ঠিকঠাক থাকলেও আমার ভয় হচ্ছে রাফিন কে নিয়ে৷ ও জহুরি চোখে আমাদের পরখ করে চলেছে৷ আমি সিউর ও বুঝতে পারলে উনার সামনে গিয়ে বলবে,
–‘ আপনি আমার উডবি দুলাভাই?যাক আলহামদুলিল্লাহ আমার ঘাড় থেকে পেত্নী আপনার ঘাড়ে গেলো তাহলে৷ ভাইয়া বলুন তো? ওই পেত্নীর প্রেমে পরলেন কি করে?? ‘
ভাবলেই কেমন লাগছে৷ আর সেও রাফিনের সাথে মিলে আমাকে হেনস্তা করবে এইটার ভুল নেই৷
ভেবেই বিরক্তি সূচক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীতির রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম৷
নীতি কাঁচা ফুলের গহনা দিয়ে ভারী সাজে বসে আছে সাথে মিম ভাবী আর জান্নাত৷ আমাকে অন্যমনস্ক দেখে জান্নাত বলল,
–‘ সব ঠিক আছে আপু?’

–‘ একদম ৷ কেন? ‘ আমি হাতের শাড়িটা মিম আপুর কাছে দিয়ে বললাম৷ নীতি আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে শাড়ি ধরে বলল,

–‘ দোস্ত,আজও সাদা? কেমন ম্যাটমেটে কালার দেখ তো৷ সবাই রঙিন ইভেন স্নিগ্ধ ভাইয়াও আর তুই সাদাতেই আটকে থাকবি৷ ‘

আমি নীতির হাত থেকে শাড়ি ছাড়িয়ে বললাম,
–‘ একদম ম্যাটমেটে বলবি না৷ আজ তোর বিয়ে না হলে গাল লাল করে দিতাম ফাজিল৷ তুই জানিস না? ‘সাদাতেই আমার বাস সাদাতেই আমার সর্বনাশ৷ ‘

–‘ তোমার সাদা শাড়ির প্রেমে আমার দুইমাত্র দেবর আশেপাশে সাদা ছাড়া আর কিছু চোখে দেখে না৷ সাদা প্রেম৷ ব্যাপারটা শুনে আমি প্রথম ভারী অবাক হয়েছিলাম৷ ‘
আমি হাসলাম৷ উত্তর কি দিবো খুজে পেলাম না৷ সাদা পরার পর শান্তি অনুভব হয় আর সেই শান্তির অনুভব আমার কাছের মানুষটা পর্যন্ত অব্যাহত এইটা ভেবেই তৃপ্তির হাসি আরো গাঢ় হলো মুখে৷

____________________________
–‘ তুই নাকি বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস? ‘
নীতিকে স্টেজে নিয়ে যাচ্ছিলাম এর মাঝে রাফিন পাশ ঘেষে ফিসফিস করে বলতেই আমি নীতির মাথার উপর ধরে রাখা ওড়নার এক কোণা ছেড়ে দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘ উড়ো খবর কোন হাওয়ায় ভাসে রে?? ‘

–‘ স্নিগ্ধ ভাইয়ার স্নিগ্ধময় হাওয়ায়৷

–‘ ত…তোকে বলেছে কে?? বেশি কথা বলিস ফাজিল৷ ‘

–‘ ভাইয়াটা অনেক ভালো তোর মতো পেত্নীর প্রেমে কি করে পরলো ভাববার বিষয়৷ ‘ রাফিন দাঁত বের করে হেসে বলতেই আমি ওর বাহুতে থাপ্পড় লাগিয়ে দিই৷ রাফিন হেসে চলছে৷ আমি রাগে সামনে এগিয়ে যেতেই ও পেছন থেকে বলল,
–‘ এই আপু! ‘

–‘ আজাইরা কথা বললে আবার মার খাবি রাফিন৷’

আমি সামনে ঘুরেই বললাম৷ ও দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে জ্ঞানী ব্যাক্তিদের মতো বলল,
–‘ তোমার শুভ্র রঙের প্রেমের ইতিহাস দিয়ে আমি উপন্যাস রচণা করবো৷ সেইটা পৃথীবির কোণায় কোণায় শুভ্র ভালোবাসা সৃষ্টি করবে৷ আর হ্যাঁ,
আমি রাজি স্নিগ্ধ ভাইয়ার জুতো চুরি করার জন্য তাই জোর কদমে এগিয়ে যাও৷ ‘
ও বলেই হাসতে হাসতে রাহাতের দিকে চলে গেলো৷ আমি দাঁড়িয়ে আছি ওর দিকে তাকিয়েই৷ মূহুর্তেই মন নেচে উঠলো৷ তাকে পাওয়ার সব আশা আবারো রাতের জোনাকির মতো ঝিলমিল করে উঠলো চারপাশে৷

বিয়ে বাড়ির পরিবেশ মানেই হই-চই আর মনের কোণায় প্রজাতির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ৷ তবে আমার মনে কোণায় গালির বহর৷ স্টেজেই সবাই আরিফ ভাইয়া আর নীতিকে নিয়ে ডান্স করছে আর আমি বসে বসে দেখছি৷ তার মূল কারণ আপনাদের স্নিগ্ধ৷ সে ওই ভীড়ে আমাকে যেতেই দিবে না৷ আরিফ ভাইয়ার ছেলে ফ্রেন্ড গুলা অতিরিক্ত করছে৷ সেও থম মেরে বসে আছে৷ আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম সে পাত্তা দিলো না৷ থমথমে মুখেই জবাব দিলো,
–‘ ওখানে যাওয়ার আশা ছেড়ে দেও৷ দেখো কতো পরিমাণের বিশৃঙ্খলা ওখানে৷ আমি রিস্ক নিতে চাই না৷ ‘

–‘ আমিও যাচ্ছি না৷ ‘ মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলাম৷ নীতির বিয়েতে কতো প্ল্যান ছিলো আমার যা সব ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো এই মানুষটার জন্য৷ ইশ! আফসোসের সীমা নেই আমার৷
–‘ আমাদের বিয়ের সময় এতো কড়া হলে আমি আপনাকে বিয়েই করবো না৷ ‘

–‘ তারপর? ‘
আমি নিজের বলা কথায় বোকা বনে গেলাম৷ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ উনি বললাম,
–‘ আই বেডলি নিড ইউ৷ ‘
তার একটা কথায় শ্বাস আটকে এলো আমার৷ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে আবারো চুপ মেরে বসে রইলাম৷ সে আলতো হাতে আমার হাত ধরে বলল,
–‘নদীর পাশে যাবে? ‘

–‘ এখানে কোথায় পাবো নদী! ‘
উনি সরু চোখে তাকালেন আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
–‘ যেতে চাও কিনা বলো? ‘

–‘ ওদের বলে আসি৷ ‘

–‘ বলতে হবে না আমি রাহাত আর রাফিনকে ম্যাসেজ করে দিচ্ছি তুমি আমার সাথে৷ ‘
আমি আরেকদফা অবাক হলাম৷ এর মাঝে রাফিনের সাথে নাম্বার আদান প্রদান হয়ে গেছে৷ সব আমাকে ফেলে রেখেই এগিয়ে চলেছে আর আমি এক জায়গায় তাকে ভেবেই দাঁড়িয়ে আছি৷ এইবার তোমাকে ফার্স্ট হতেই হবে৷

ঝিরিঝিরি বাতাসের তোড়ে অন্ধকারেও সব হেলেদুলে উঠছে৷ দূরের ঘাটে পারাপারের নৌকা বাধা সেটাও বাতাদের তালে দুলে উঠছে৷ তার থেকে দূরের নৌকা থেকে বৈঠার আর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ চারিপাশ মুখরিত করে তুলেছে৷ আমার শরীর থেকে বেলীফুল আর গোলাপের তীব্র সুমিষ্ট সুবাস নদীর হাওয়ায় মিলিয়ে আবার ফিরে ফিরে আসছে৷ উনার শরীরের হলুদ পাঞ্জাবি টা রাতের আঁধারেও স্পষ্ট৷ আমি সামনে গিয়ে দু’হাত মেলে দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম৷ সে ঘুরে তাকিয়ে বলল,

–‘ আই ওয়ান্না টাচ ইউ৷ ‘ আমি হাত নামিয়ে চমকে উঠে তাকালাম৷ সে নির্লিপ্ত হাসলো৷ তবে তার সহজ স্বীকারোক্তি আমি মেনে নিতে পারছি না৷ হঠাৎ এমন ইচ্ছা কেন সেটাও ভাবতে পারছি না৷ আমি উত্তর না দেওয়াতে সে আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো৷ আমি ভড়কে সামনে পা বাড়াতেই সে চট করে আমার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘ এই শুভ্রতায় রাঙা শুভ্র পরী,
আমি তোমার সব কিছুতে নিজেকে কেন খুজে পাই বলতে পারবে??
আমার সব কিছুতে কেন তোমার নামের দখলে বলতে পারবে??
উইল ইউ ম্যারি মি?? ইউ উইল বি মাই হার্ট..! আই উইল,বিকজ আই ওয়ান্না ইউ৷
আই মিস ইউ everywhere…I really miss you a lot Everytime! every moment….
ইউ ছে,ইউ উইল বি মাইন… ‘
আমি স্তব্ধ! শরীরের প্রত্যেকটা শিরায় শিরায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ তার প্রত্যেক টা কথা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরেফিরে জানান দিচ্ছে,
–‘ ইয়েস আই উইল৷ ‘
তবে সেটা মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো না৷ আমি ফ্রিজড হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ সে আবার বলল,
–‘ শুনছো তুমি?
আমি ভালোবাসি তোমায়৷ মা য়ের পর আমি তোমায় ভরসা করি ভালোবাসি৷ খুব ভালোবাসি৷ এতোটা ভালোবাসি প্রতি নামাজে দোয়া করি,
আমরা যেন পাশাপাশি কবরে থাকতে পারি৷ এক সাথে যেন মর‍তে পারি৷ সত্যি বলছি,তোমার কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না আর না তোমাকে পৃথীবিতে রেখে যেতে পারবো৷ আমি স্বার্থপর৷ আমি ভালোবাসতে চাই জনম জনম আর সেটার মাঝে কোনো স্বার্থ নেই৷ ‘
আমি কেঁদে উঠলাম শব্দ করে৷ তার বলা আওয়ার গুলো বিক্ষিপ্ত করে তুলছে আমায়৷ আমি ঘুরে তাকালাম৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে৷ ছেড়ে দিলেও যেন হারিয়ে না যায়৷
তার বুকে মাথা রেখেই বললাম,
–‘ আমি চাই আপনাকে নিজের করে৷ আমি চাই আপনাকে আপন করে৷ ‘
সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ ঠান্ডা শীতল কন্ঠে বললেন,
–‘ আর একটা দিন তারপর সব তুমি যুক্ত সম্পূর্ণ আমার হবে৷ তবে….’
আমি মাথা উঠালাম না৷ ধীর কন্ঠে বললাম,
–‘ তবে কি? ‘
চলবে…

#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি

পর্বঃ২৮
রাতের আকাশে আজ তারা নেই৷ নেই কোনো আলো-আঁধারের খেলা৷ নিস্তব্ধ প্রেমিকের ন্যায় শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন উনি৷ বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দ গুলো আমি সযত্নে তুলে নিচ্ছি৷ সে আবেগ মাখা কন্ঠে বলল,
–‘ জাস্ট বারো দিন তারপরেই আমি ফিরে আসবো৷ ‘

–‘ না গেলে হয় না?? আপনি বলেছেন আর একটা দিন..! ‘

–‘ একটু আগেই মেইল এসেছে কাল দশটা নাগাদ যেতে হবে৷ আমি ভেবেছিলাম কাল বিকেলে তোমার বাসায় যাবো৷ ‘ বলেই তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন উনি৷ আমি মাথা ঠেকিয়ে রেখেই প্রশ্ন করলাম আবার,
–‘ না গেলে হয় না?? ‘

–‘ এই নিয়ে পাঁচ বার প্রশ্ন করলে৷ ‘

–‘ কেন যাবেন৷ বারো দিন৷ ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ ‘

–‘ আমি তিনটা বছর দম বন্ধ করেই ছিলাম৷ ‘

–‘ খোঁটা দিচ্ছেন?? ‘ আমি মাথা উঠিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম৷ সে উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন৷ হাসির শব্দ নদীর বাঁকে হারিয়ে যেতেই দূরের নৌকা থেকে ভেসে এলো,
‘ আমায় ভাসাইলি রে…
আমায় ডুবাইলি রে…..
অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে…….. ‘

আমি আবারো উনার বুকে মাথা রাখলাম৷ আজ সংকোচ হলেও তার কিছুদিনের জন্য ছেড়ে যাওয়াটা মানতে পারছি না আমি৷ সে আমায় ছেড়ে দিয়ে মাটির উপর বসে পরলো৷ আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম৷ সে তার পাশে বসতে ইশারা করলেও আমি বুঝেও সামনে তাকিয়ে রইলাম৷ সে আমার উপেক্ষা দেখে হাতে টান দিতেই টাল সামলাতে না পেরে উনার পাশেই বসে পরলাম৷ মুখ দিয়ে ‘ উফ ‘ শব্দ বের হতেই বিচলিত গলায় বললেন,
–‘ সর‍্যি, সর‍্যি! খুব ব্যথা পেয়েছ? ‘

–‘ না৷ এইভাবে কেউ টান দেয়৷ আরেকটু হলেই নির্ঘাত ব্যথা পেতাম৷ ‘ আমি গোমড়া মুখ করে বললাম৷ সে আমার শাড়ির আঁচল যত্নে ঠিক করে দিয়ে বলল,
–‘ আমি আছি তো৷ ‘
–‘ হ্যাঁ,এই জন্যই তো কাল চলে যাবেন৷ ‘
–‘ আমার স্বপ্ন ওইটা৷ একটা এনজিও গঠন করার ক্ষেত্রে অনেক টাকা ডোনেশনের দরকার হয়৷ আর ওই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিপার্টমেন্টের হেড আমাকে নিজে ডেকেছেন সিলেট ওইখানে তাদের হেড অফিসে। পাঁচটা ডেটে মিটিং বারবার আসা যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব তার উপর আরেকটা কোম্পানি থেকে ডিল ফাইনাল করবে বলেছে ওইখানের মিটিং৷ টাইমের ব্যাপার আছে অনেক৷ প্রেজেন্টেশনের ব্যাপার সাথে ট্রাস্টের ঝামেলাও আছে৷ তাই ঠিক করেছি সব কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসবো না৷ তুমি ভাবো,কতো এতিম বাচ্চারা সেল্টার পাবে৷ তারা অসহায়! ওদের দেখে আমার প্রচন্ড মায়া হয় আর সেই মায়া থেকেই ছোট বেলা থেকে ভেবেছি বড় হয়ে ওদের জন্য কিছু করবো৷ সেই স্বপ্ন আমার হাতের মুঠোয়৷ ওদের কথা ভাবলে আমি শান্তি পাই৷ বর্তমান সত্তর জন বাচ্চা আমার দায়িত্বে রয়েছে৷ এনজিও গঠন হলে ওরা শান্তি মতো বাঁচতে পারবে সেই সাথে আরো হাজারো বাচ্চা আশ্রয় পাবে৷ ছোট ছোট উদ্যোগের মাধ্যেমেই তো আমরা এক এক করে হাজার হয়ে ওদের মাথার ছাদ হতে পারবো৷ ‘
টলমল চোখে পরখ করে দেখলাম উনায়৷ মানুষের হাজারো পরিকল্পনা থাকে নিজেকে নিয়ে আর তার অসহায়দের নিয়ে৷ সে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি তার দিকে৷ আচ্ছা অতিরিক্ত ভালো মানুষ গুলোকে কি সম্মোধন করা যায়?? এর উত্তর আমার কাছে নেই৷ তবে বুক ভরে শান্তির নিঃশ্বাস নিলাম৷ উনার আশেপাশের সর্বক্ষেত্র উনার মতোই স্নিগ্ধতা বিরাজ করে৷

____________________________

রাতের আঁধারে গাড়ি ছুটছে নীতিদের বাসার উদ্দেশ্যে৷ আমি চোখ ঘুরিয়ে বললাম,
— ‘ সকাল পর্যন্ত থাকি আমি? ‘
–‘ উঁহু! তোমার ঘুম প্র‍য়োজন এখন৷ আর আলো ফুঁটতে আরো এক ঘন্টা বাকি৷ ‘
–‘ আপনার ও তো ঘুমের প্রয়োজন! ‘ আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলাম৷ উনি মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে৷ গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিয়ে বললেন,

–‘ আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমাও৷ নীতির বাসার সামনে আসলে ডেকে দিবো৷ ‘

–‘ আমি জেগে থাকবো৷ ভাবেন তো কত দিন দেখা হবে না৷ ‘

উনি হাসলেন৷ আমার মাথা নিজেই তার কাঁধে রাখলেন৷ তারপর রসিকতা করে বললেন,
–‘ জেগে কি করবে? তুমি তো চোখ খুলে রাখতেই পারছো না৷ ‘
ঘুমে চোখে একদম লেগে আসলেও আমি টান টান করে চোখ খুলে তাকিয়ে আছি৷ কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
–‘ দিনে চারবার ফোন দিবেন৷ ‘
–‘ আচ্ছা দিবো৷ ‘
–‘ আমার জন্য প্রতিদিন শুভ্র রাঙা চিরকুট লিখবেন৷ ‘
–‘ হু, সেটা প্রতিনিয়ত লেখি৷ ‘
–‘ একদম ডিপ্রেশড হবেন না৷ যখন খারাপ লাগবে চোখ বন্ধ করে নিজের অস্তিত্ব খুজবেন৷ ‘
–‘ আমার অস্তিত্ব তোমাতে বিলীন করে রেখে যাচ্ছি৷ মন খারাপ হলে না হয় তুমি দূর থেকেই আগলে রেখো৷ ‘
তার মোহনীয় কথার রেশে আমার ঘুম ছুটে পালালো৷ আমি মাথা উঠিয়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকালাম৷ আবারো ধপ করে তার কাঁধে মাথা রেখে চুপিসারে বসে রইলাম৷ শরীরের প্রত্যেকটা কোণে ভালোবাসার রঙ ফুঁটছে৷
বাইরে সোডিয়ামের সাদা আলো আর ফাঁকা রাস্তা সাথে প্রিয়জনের ভরসার কাঁধ এর চেয়ে সুখের মূহুর্ত দুনিয়ায় আছে?? উঁহু! নেই৷
ঘুম গুলো অবাধ্যতা মেনে ছুটে আসছে এক এক করে৷ জেগে থাকার হাজার চেষ্টা করেও কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাই নি৷ তবে কঁপালে উষ্ণ ছোয়া পেতেই নড়েচড়ে বসে মুচকি হেসে উঠলাম৷ উনি বিড়বিড় করে আমার কানের কাছে এসে বললেন,
” কিছু সম্পর্ক একদম পবিত্র আর সেটা হচ্ছে স্বচ্ছ মনের প্রেমের সম্পর্ক আর তার নাম শুভ্র রঙের প্রেম।”
.
ঘুম থেকে উঠেই দেখি চার জোড়া চোখ আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে৷ আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে চাইলে নীতি হাত শক্ত করে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল,
–‘ কাল সারারাত রোম্যান্স করে ফিরলি কখন হারামি?? ‘
–‘ আমি রুমে কি করে?? গাড়িতে ছিলাম তো৷ ‘ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই জান্নাত আমার পাশে বসে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
–‘ কেন তোমাকে বহন করার মানুষ আছে তো সেই দিয়ে গেছে৷ আর আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে,
সকাল আটটার আগে যেন ওকে কেউ ডাক না দেয়৷ ‘
জান্নাতের বলার ধরণ দেখে রুমে হাসির রোল পরে গেলো৷
–‘ কে সে? হৃদি আমি না তোর ক্লোজ ফ্রেন্ড৷ তোর ভালোবাসার মানুষটার নাম আমার বলবি না?? ‘

–‘ তোমার একমাত্র চোখের ভালোবাসা আর কে..! ‘ নীতি বিড়বিড় করে বলল মাধবীর কথা শুনে৷ মাধবী না শুনে বলল,
–‘ কিছু বলছিস নীতি??’
মাধবীর প্রশ্নে সবাই হেসে উঠলো৷ ও ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বোকার মতো আমাদের সাথে হাসিতে তাল মিলাচ্ছে৷ আমি নীতিকে আলতো ধাক্কা মেরে উঠে বসে বললাম,
–‘ এ ই তোর না বিয়ে এখানে গোয়েন্দাগিরি কেন করছিস? ‘
ও আমার দিকে হেলে বসে রাগী গলায় বলল,
–‘ আমার বিয়েতে তোর অধিকার নেই৷ তুই আমাকে একা রেখে কি ভাবে পারলি চুপিচুপি রোম্যান্স করতে৷ ‘
আমি সরু চোখে তাকিয়ে মারতে উদ্যত হলেও থেমে গিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললাম,
–‘ তোকে বলেছে? উনার ভালো লাগছিলো না তাই শান্ত পরিবেশে গিয়েছিলাম৷ ‘

–‘ হ্যাঁ,হ্যাঁ জানি আমরা৷ আর সাফাই গাইতে হবে না৷ তবে কাল আমাকে একা রেখে যাওয়া একদম ঠিক হয় নি তোর৷ ‘

–‘ বাসর ঘরেও নিয়ে যাবি আমাকে? ‘ আমি দুষ্টুমি করে বললাম৷ নীতি কিছু বলার আগেই আন্টি হুরমুর করে ঢুকে বললেন,
–‘ গোসল করিস নি এখনো?? পার্লার থেকে লোক আসবে একটু পরেই জলদি কর৷ এতো সব একা সামলাই কি করে৷ হৃদি,জান্নাত, মিম,মাধবী তোমরা ওকে সব সামলিয়ে দিয়ো৷ ‘
মিম আপু মিষ্টি হেসে বলল,
–‘ আপনি চিন্তা করবেন না আমরা আছি৷ ‘
আন্টি আবারো দ্রুত বেরিয়ে গেলেন৷ আমি আড়চোখে নীতির দিকে তাকালাম৷ ওর চোখের কোণায় পানি চিকচিক করছে৷ কিছু পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু হারাতে হয় এইটা বাস্তবতা৷ তবে সব কিছুর ভিত্তিতে সুখের ঠিকানা সব কষ্ট মুছে দেয়৷
আমি উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম৷ কাল রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে রুমে এসে দিয়ে গেছে ভাবলেই শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে৷ চারদিকে সুখ সুখ অনুভূতি ঘিরে ধরছে এক এক করে….!

আমি ব্যস্ত চোখে রাফিনকে খুজে চলেছি৷ কাল রাতের পর থেকে ওর সাথে আর দেখাই হয় নি৷ এর মাঝে রাহাত ও লাপাত্তা৷ দুইজনকে অনবরত ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না৷ আমি ডার্ক রেড কালারের লেহেঙ্গার ওড়না সেট করতে করতে জান্নাতকে প্রশ্ন করলাম,
–‘ রাফিন আর রাহাত কোথায় জানিস?? ‘

–‘ স্নিগ্ধ ভাইয়ার সাথে বেরিয়েছে তোমাকে রেখে যাওয়ার পরেই৷ ‘
ওর কথা শুনে কঁপালে চিন্তার ভাজ পরলো৷ আমি কিছু বলার জন্য ঘুরে তাকিয়ে দেখি জান্নাত চোখে কাজল লাগাচ্ছে আর কাঁদছে৷ ফর্সা চোখ-মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম৷ রাফিন ওর সমান হলে আমার ভাইয়ের বউ করে রেখে দিতাম এই পিচ্চিটাকে৷ বাট আফসোস সে আমার জা হতে চায়৷ আদি ভাইয়া গম্ভীর আর একরোখা মানুষ শুধু ফ্যামিলি আর ফ্রেন্ডসদের সাথে মজার মানুষ৷ জান্নাতের সাথে তার সূক্ষ্ম একটা সম্পর্ক হলে মন্দ হয় না৷ ভেবেই কাজল ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আমি পরিয়ে দিলাম৷ ও মিষ্টি হাসতেই গাল টেনে দিলাম৷
.
.
নীতির বিয়ে সম্পূর্ণ হলো কিছুক্ষণ পূর্বেই৷ রাফিন আর রাহাত দুপুর নাগাদ ফিরেছে৷ ওরা কোথায় গিয়েছিলি জিজ্ঞেস করেলেই কথা এড়িয়ে যাচ্ছে৷ নীতিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ওদের আর ঘাটলাম না৷
নীতি অনবরত কান্না করছে৷ ইশ! বিদায় বড্ড কষ্টের৷ আরিফ ভাই সমানতালে সামলিয়ে যাচ্ছে একজন দায়িত্বশীল স্বামীর মতো৷ কষ্টের ছাপ ছাপিয়ে যাবে ভালোবাসার কাছে৷ আমি নীতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম৷ এখন সীমাবদ্ধতা আমাদের মাঝে৷ আর কখনো উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরে বেড়ানো হবে না, একসাথে থাকা হবে না ভাবলেই কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে৷ আমি ওকে ছাড়িয়ে আরিফ ভাইয়ার কাছে দিয়ে চলে এলাম৷ সাথে আমরা সবাই৷ নোমান আর মিম আপু দুপুরে বেরিয়ে গেছেন৷ সবার চোখ মুখে বিষন্নতার ছায়া৷ তপ্ত দীর্ঘশ্বাস গুলো ঘর বন্ধী বেড়াজালে আটকে যাবে৷ সব কিছু মিলিয়ে আমার এখন তাকে প্রয়োজন৷
ব্যস্ততায় উনাকে ফোন দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি৷
গাড়িতে বসে ফোন অন করতেই দেখি অনেক গুলো কল৷ আমি দ্রুত হাতে ফোন দিতেই ওইপাশে চট করে রিসিভ হলো কানে নিতেই সে ক্লান্ত গলায় বলল,
–‘ দিন শেষে শুভ্র পরীর তার প্রেমে মাতোয়ারা পাগলাটে প্রেমিকের কথা মনে পড়লো বুঝি?’

আমি হালকা হেসে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
–‘ হু! আপনি ঠিক ভাবে গিয়েছেন? ভালো আছেন? ‘

ওইপাশে নীরবতা আমি ভয় পেয়ে বললাম,

–‘ আপনি ঠিক আছেন তো৷ ‘
কোনো উত্তর আসলো না৷ আমার ভয় লাগা শুরু হলো৷ বিচলিত গলায় আবার প্রশ্ন করলাম,
–‘ শুনছেন আপনি?? কথা বলছেন না কেন৷ আমার টেনশন হচ্ছে৷ এই ঠিক আছেন তো?? ‘

–‘ আমি ঠিক নেই৷ একদম ঠিক নেই৷ আমার ছুটে তোমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছা হচ্ছে…!’
আমি ফোন শক্ত করে চেঁপে ধরে রাখলাম অনেকটা সময়………
চলবে….