শুভ্র রঙের প্রেম পর্ব-২৯+৩০

0
1615

#শুভ্র_রঙের_প্রেম
লেখিকা-রুবাইদা হৃদি

পর্বঃ২৯
ঘরের কোণায় চুপটি মেরে বসে আছি৷ এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় দম ফাটা গরমেও আমার শরীরে ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে৷ কাঁপা হাতে চুল গুলো টেনে উঠে দাঁড়ালাম৷ আজ নয় দিন পার হয়ে গেলো৷ সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে উনার সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন৷ নিজেকে উন্মাদ লাগছে৷ রাফিন মামুর বাসায় গিয়েছে সেদিনের পর৷ নীতি আরিফ ভাইয়াদের বাসায় আর রাহাতের কোনো খোজ নেই উনার মতো৷ সব মিলিয়ে আমি অতিষ্ঠ৷ বুকের ভেতর শূন্যতা ভর করছে৷ কাঁপা হাতে আবারো ফোন দিলাম৷ বারবার এক কথা ভেসে আসছে৷ আমি মোবাইল ছুড়ে মেরে আবারো থম মেরে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলাম৷ মৃদু আওয়াজ তুলে বললাম,
–‘ কোথায় আপনি?? আমার যে দম ফেটে যাচ্ছে কষ্টে৷ ভার হয়ে আসছে হৃৎপিন্ড৷ আমি যে সহ্য করেও নুইয়ে যাচ্ছি বারেবারে৷ ‘
ঘরময় শব্দ ঘুরেফিরে বেড়ালো৷ মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠতেই দেখি ০৭ঃ১৩৷ চোখ মুছলাম৷
ভার্সিটির চত্ত্বরের আশেপাশে যাওয়া হয় না নীতির বিয়ের আগের থেকেই৷ সামনে এক্সাম! হয়তো ভার্সিটি গিয়ে যোগাযোগের ব্যাবস্থা হবে৷ চট করেই মনে হলো পরশ স্যার জানবেন উনার কি হয়েছে৷ আমি দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে ডুকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আম্মু সন্ধিহান গলায় বলল,
–‘ এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস? আর তোর মুখের হাল এমন কেন৷ ‘
আমি হাত দিয়ে মুখ ঘষে হালকা হাসার চেষ্টা করলাম৷ আম্মু স্বাভাবিক ভাবেই খাবার টেবিলে দিয়ে বলল,
–‘ খেয়ে যা৷ ‘
–‘ এসে খাবো আম্মু৷ রাফিন আসবে কবে? ‘
–‘ আজ ফিরবে৷ ‘
আম্মু চেয়ার টেনে বসে আমাকে ইশারা করলো কাছে যেতে৷ আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ডিম উঠিয়ে জোর করে মুখে দিয়ে বলল,
–‘ শুকিয়ে যাচ্ছিস দিন দিন৷ চেহারার বেহাল অবস্থা৷ কি নিয়ে এতো টেনশন তোর? ‘ আমি আম্মুর কথা শুনে কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম৷ আম্মু আমার চোখে পানি দেখে উঠে দাঁড়িয়ে একহাতে আঁকড়ে ধরে অস্থির কন্ঠে বলল,
–‘ কি হয়েছে মা? ‘ আম্মুর আদুরে ডাক শুনে আমি জড়িয়ে ধরলাম৷ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম৷ মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না৷ আম্মু অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেলো রাফিনের আওয়াজে৷ আমাকে ছেড়ে দিয়ে রাফিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
–‘ তোর তো বিকেলে আসার কথা ছিলো সবাইকে নিয়ে৷ ‘
–‘ ধূর, আমি পারবো না৷ খুদা লাগছে খেতে দাও তো৷ ‘
রাফিন ব্যাগ সোফায় ছুড়ে মেরে বলল৷ আমার দিকে এগিয়ে এসে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–‘ আম্মু তোমার মেয়েকে কি ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছো? ‘
–‘ রাফিন৷ ‘ আম্মু কড়া গলায় বলতেই ও আমলে না নিয়ে আমাকে খুঁচিয়ে বলল,
–‘ এখানে কি করিস রে? আর মুখ এমন অসহায় ভাব ধরে রেখেছিস কেন? শ্বশুর বাড়ি খেতে দেয় না? ‘
মেজাজ বিগড়ে আছে তার উপর ফালতু কথা শুনে ঘুরে ওর গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে দম ফেললাম৷ রাফিন উচ্চস্বরে, ‘ আপু ‘ বলে ডাকতেই আমি আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
–‘ আমি যাচ্ছি৷ ‘
বলেই ঘুরে দাঁড়াতেই দাদুন রিনরিনে স্বরে বলল,
–‘ ওকে মারলি কেন বোনু৷ ও তোর ছোট ভাই না? ‘
–‘ ছোটকে ছোটোর মতো থাকতে বলো দাদুন৷ ও মাত্রাতিরিক্ত কথা বলে৷ ‘
কাউকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম৷
রাফিনের চড়টা দরকার ছিলো৷ ও বেশি বড় বড় কথা বলে ইদানিং৷ সত্যি দরকার ছিলো? না আমার বিক্ষিপ্ত মনে জমে থাকা চাপা কষ্ট আর কিছুটা রাগ ওর উপর প্রয়োগ করলাম?
ইশ! খুব কি লেগেছে৷ ওর কি দোষ৷ নানা অস্থিরতায় আরো অশান্তি লাগছে আমার৷
.
সূর্যের নরম রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস জুড়ে৷ বাতাসে আজ চিরচেনা গন্ধ গুলো পাচ্ছি না৷ বট গাছের নিচে আমাদের আড্ডার স্থান শূন্য৷ সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো৷ আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম হলের দিকে৷ কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম দারোয়ান চাচাকে৷ আমি জলদি উনার কাছে গিয়ে বললাম,
–‘ আসসালামু আলাইকুম চাচা,পরশ স্যার কোথায় জানেন? ‘
–‘ হে তো কোন কামে জানি গেছে৷ দুইদিন ধইরা আহে না৷ ‘
–‘ অহ! আমার হলের চাবিটা দিন চাচা৷ আর মান্নান স্যার কোথায় সেটা জানাতে পারবেন? ‘
–‘ অফিস রুমেই৷ ‘
.
.
সব ফর্ম ফিলাপ করে বেরিয়ে এলাম মান্নান স্যারের কক্ষ থেকে৷ নীতির বিয়ের আগের দিন জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় রেখে এসেছিলাম৷ দুই বছরের কত সৃতি ওই ছোট হল রুমটায়৷ আবারো কোনো প্রাণ প্রিয়ের থাকা হবে হলে, গল্পে আর মন খারাপের ভীর হবে অন্য কারো হাত ধরে৷ ক্যাম্পাসে হাজারো পদচারণ থাকলে আজ ফাঁকা৷ নীতিকে গিয়ে চড় মারতে ইচ্ছা হচ্ছে আর বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,’ এই মেয়ে এই! তোর জামাই ছাড়া হয় না? তুই সব ছেড়ে চলে আয় তো আবার আমরা একসাথে থাকবো,হাসবো,কাঁদবো৷ ‘
নিজের আজগুবি ভাবনায় ম্লান হাসলাম৷ ক্লাসে গিয়ে আবারও একরাশ মন খারাপ উড়ে এলো৷ ফোর্থ পিরিয়ড৷ স্নিগ্ধ স্যারের ইংরেজি ক্লাস৷ কিন্তু তার বদলে নতুন বয়স্ক স্যারের মুখ দেখেই আমি আবারো দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলাম৷ মাধবী বার কয়েক ডেকেছিলো তবে ওকে দেখলে আরো মন খারাপ হানা দেয়৷
–‘ মিস.হৃদি! আপনি আমাকে মিস করছেন বুঝি? ‘
নীতি মুখে হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ওকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই আমাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
–‘ রাগ করেছিস বাবু? ‘
–‘ ছাড় তো বিবাহিত মহিলা৷ তোর শরীর দিয়ে কেমন বিবাহিত গন্ধ আসছে৷ ‘
আমি নিজেও ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম৷ কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে ছেড়ে দিয়ে ওকে পরখ করে বললাম,
–‘ সুন্দর হয়ে গেছিস? কার‍ণ কি রে?? আরিফ ভাইয়া অতিরিক্ত সুন্দর হওয়ার মেডিসিন দিচ্ছে বুঝি? ‘
আমার কথা শুনে নীতির দু গাল লাল হয়ে উঠলো৷ আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
–‘ ছিঃ!কি সব বলিস তুই৷ ‘ আমি ওর কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলেও চুপ মেরে গেলাম মূহুর্তেই৷ আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে নীতি বিচলিত হয়ে বলল,
–‘ ঠিক আছিস তুই?’
–‘ আমি একদম ঠিক নেই নীতি৷ উনি….. ‘ কেঁদে উঠলাম আমি৷ ক্যাম্পাসের অনেকে ঘুরে তাকিয়ে দেখছে৷ নীতি আমাকে ধরে কোলাহল মুক্ত পরিবেশে নিয়ে ইটের অল্প উঁচু প্রাচীরের উপর বসিয়ে বলল,
–‘ কি হয়েছে? ‘
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–‘ উনি ফোন তুলছেন না নীতি৷ আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার৷ গত নয় টা দিন আমি টানা ফোন দিয়ে গেছি৷ নোমান ভাইয়ার কাছেও খোজ নেই তার৷ আর আদি ভাইয়ার নাম্বার নেই৷ এইদিকে পরশ স্যার ও নেই৷ আমি মরে যাবো নীতি৷ আমার শ্বাস উনি নিয়ে গেছেন৷ কোথায় উনি?? আমি যে থাকতে পারছি না৷ ‘
–‘ হুশ! ভাইয়া শুনলে বকবে আমাদের৷ এমন করে কান্না করে কেউ? ‘
নীতির কন্ঠ স্বাভাবিক৷ যেন কিছুই হয় নি৷ আমি অবাক চোখে তাকালাম৷ ও আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
–‘ আজ তোদের বাসায় যাবো৷ অনেক দিন আন্টির হাতের রান্না খাই না৷ ‘
আমি কান্না থামিয়ে দিয়ে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করলাম ওকে৷ এতোটা স্বাভাবিক কেন নীতি??

_______________________________
বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা শীতল৷ আমরা প্রবেশ করতেই আম্মুকে দেখে নীতি সালাম দিলো৷ আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘ রুমে সব আছে তুমি ওকে নিয়ে যাও৷ আর আরিফ আসবে না?? ‘

–‘ অফিস শেষে আসবে আন্টি৷ ‘
আমি ওদের কথা শুনে ‘ থ ‘ মেরে দাঁড়িয়ে আছি৷ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
–‘ আরিফ ভাইয়া আসবে? আগে বললি না কেন আমায়! ‘
–‘ আম্মু,আব্বু ফোন দিচ্ছে৷ আর কি কি লাগবে বলে দেও তো৷ ‘
–‘ ফোন দিয়ে যা৷ আর তুই কোথাও যাবি না এখন অনেক কাজ বাকি৷ ‘
রাফিন ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা৷ ‘
আমি বিষ্ময় নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
–‘ বাড়িতে কি আজ? ‘
রাফিন মুখ ঘুরিয়ে বলল,
–‘ আম্মু কাউকে আমার সাথে কথা বলতে মানা করো৷ না হলে আজ কেলেংকারী হয়ে যাবে৷ ‘
ওর ভার মুখ দেখে সকালের কথা মনে হতেই আমি অসহায় চোখে তাকালাম৷ আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ কেউ তো বলো আমায়৷ ‘
নীতি আমার হাত টেনে আমার রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
–‘ অপেক্ষা করো রমণী৷ ‘
–‘ মানে?? ‘ আমার গলায় হাজারো প্রশ্নের ভীড়৷ এরা কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না৷ আমাকে টেনেটুনে নিয়ে এসেই রুম আটকিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পরলো নীতি৷ আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
–‘ হচ্ছে টা কি? ‘
–‘ তোমার বিয়ে৷ ‘ নীতি উঠে বসে আমার দিকে একটা ব্যাগ ছুড়ে মেরে বলল৷ আমি না চাইতেও ধরে বললাম,
–‘ এইটার মাঝে কি?’
–‘ খুলে দেখ৷ ‘
আমি দ্রুত হাতে ব্যাগ খুলে দেখলাম, সাদা আর মেরুন রঙের লেহেঙ্গা৷ সেই সাথে একটা চিরকুট৷ আমি লেহেঙ্গা হাত থেকে নামিয়ে চিরকুট খুলে দেখলাম,
চলবে….
~

#শুভ্র_রঙের_প্রেম
#রুবাইদা_হৃদি

পর্বঃ৩০
চোখের কার্ণিশ বেয়ে টুপটুপ করে নোনা পানি বেয়ে পরছে৷ চোখ উঁপচে আসছে কান্না৷ আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছি চিরকুটের দিকে৷ সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসা ময় বাক্য লেখা৷ আমি ঝাপসা চোখে আবারো পড়লাম,
এই মেয়ে,
তোমার কাঁদুনে স্বভাব হলো কি করে বলো তো??
আজও কাঁদছো?
ব্যাগে থাকা শুভ্র রঙ পরে শুভ্র পরী সেজে একছুটে চলে আসো তো৷
আমি কান্না চোখেই হাসলাম৷ চিরকুটাতে ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করতে গেলেও দেখি নীতি গালে হাত দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ আমি চোখের পানি মুছে মুখে থমথমে ভাব আনার চেষ্টা করে ওর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লাম,
–‘ আমার পেছনে এতো ষড়যন্ত্র কখন হলো? ‘
নীতি ভাবেলাসশীন ভাবে উত্তর দিলো,
–‘ আমি জানি না৷ ‘
–‘ তাহলে কে জানে? ‘
–‘ রাহাত আর রাফিন৷ ‘ আমি আড়চোখে তাকিয়ে শাসিয়ে বললাম,
–‘ তুই এইসবে নেই আমি একদম বিশ্বাস করি না।’

নীতি আমার কথা শুনে হাসছে।ওর হাসি দেখে শরীর জ্বলছে আমার। গত নয়টা দিন আমি কীভাবে কাটিয়েছি সেটা আমিই জানি।আমি বিরক্তি নিয়ে আবার বললাম,
–‘ এইসব কবে আর কখন হলো নীতি? ‘
–‘ জলদি লেহেঙ্গা পরে আয় দোস্ত। হাতে সময় নেই। ‘
–‘ সময় নেই কেন।আর উনার ফোন বন্ধ কেন? এমন সারপ্রাইজ আমার দরকার নেই যেখানে প্রতিটা মূহুর্ত আমার দম বন্ধকর অনুভূতি হয়। ‘
আমার কন্ঠে অভিমান মিশ্রিত।ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে নীতির দিকে থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়ে দেখি রাহাত ফোন দিচ্ছে। ওর নাম দেখে আগুনে ঘি ঢালার মতো জ্বলে উঠলাম আমি। ফোন রিসিভ করতেই ও হাসি কন্ঠে বলে উঠলো,

–‘ বিয়ার রঙ লাগছে দোস্ত। এই তোর বিয়ার রঙ লাল ? ধূর তোদের তো ইন্টারন্যাশনাল রঙ সাদা।সা….’

–‘ তোর মুখ ভাঙার ব্যবস্থা আমি করছি হারামি। সাহস কি করে হয় আমাকে না জানিয়ে উনার দলে যাওয়ার। উনি কে তোর ? আমি আগে না সে আগে ? তুই আমার সামনে আয় মেরে ফেলবো একদম। ‘

–‘ আমার গুরু,প্রমের প্রশিক্ষক,আমার সাদা রঙের দুলাভাই,তোর সিল লাগাইনা জামাই,আমার ভবিষ্যৎ ভাগ্নে-ভাগ্নির একমাত্র বাপ।’
ফোনের লাউড স্পিকারের জন্য নীতির কানে কথা গুলো যেতেই ও হো হো করে হেসে উঠে। আমার কান ঝিমঝিম করছে এতো বিশ্লেষণ শুনে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম ,
–‘ তোর আর তোর প্রেমের প্রশিক্ষক এর দুনিয়া হারাম করে দিবো।’
জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
–‘ উনি কি তোর পাশে আছে ?’
–‘ তোর উনার হাতেই মোবাইল।’
রাহাতের কথা শুনে ফোন কেটে দিলাম আমি। ফোন কাটতেই আবারো সশব্দে বেজে উঠলো। অনেক দিন অনেকটা সময় পর আজ ‘ তোমার একান্ত আপনজন ‘ নামটা জ্বল জ্বল করছে। টানা নয় বার ফোন বেজেই চলেছে আর আমি তৃপ্তির হাসি নিয়ে দেখে চলেছি। আজ থেকে শুরু আপনাকে ইগ্নর করা। আমিও বুঝাবো দূরে থাকার কষ্ট।
.

স্টোনের আর গোল্ডেন সুতার কাজ করা সাদা মেরুন কম্বিনেশনের ভারী লেহেঙ্গা পরে রাফিনের আর জান্নাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রাগী চেহারা নিয়ে। ওদের চোখে-মুখে পালাই পালাই ভাব। মনে হচ্ছে, চোর চুরি করেছে নিজের বাড়িতে। আমি আয়নায় আবার নিজেকে দেখে নীতির দিকে তাকিয়ে বললাম,
–‘ নেক্সট টাইম তোর মেয়ের বিয়েতে এই পার্লারেই সাজার ব্যবস্থা করবো।’

নীতি উত্তর না দিয়ে দু দিকে মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলতেই আমি হাতে বেলী ফুলের মালা টা জড়িয়ে রাফিন আর জান্নাতকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
–‘ শুরু থেকে এক এক করে সবটা বল। ‘

–‘ সকালের চড়ের দাগ না শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটা কথাও বলবো না। ‘
রাফিন গালে হাত দিয়ে বলল। আমি মুচকি হাসলাম।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
–‘ ফাহিম দের সাথে গলায় গলায় ভাব হয়েছে তাই , না ? ‘
রাফিন ঢোক গিললো। ও অসহায় চোখে নীতির দিকে তাকালো। ও ইশারায় কিছু বলার আগে আমি ঘুরে রাগী স্বরে বললাম,
–‘ একদম টু শব্দ করবি না।’
–‘ আপু আমার কথা শোনো ।’ জান্নাত ভয়ে ভয়ে বললো। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই ও চুপসে গেলো। রাফিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘ বলতেছি তো। তোর চোখ নামা। কেমন ভয় ভয় লাগে। ‘

আমি হেসে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বসে পরলাম সাইডে রাখা চেয়ারে। রাফিন বলল,

সেদিন ভোর তোকে কোলে করে নীতি আপুদের বাসায় দিয়ে আমাকে আর রাহাত ভাইয়াকে নিয়ে চলে আসেন মিরপুর। সেদিন ভাইয়ার সিলেট যাওয়ার ডেট বিকেলে ছিলো।আমাকে আর রাহাত ভাইয়াকে সব বলেছিলেন সন্ধ্যা সময়। তারপরে দশটার দিকে পরশ স্যার আর ফুঁপিকে নিয়ে হাজির হয় আমাদের বাসায়। আম্মু ,দাদুন আর আব্বু সবাই বাসায় ছিলো। আমি ভাইয়াদের নিয়ে আসতেই সবাই অবাক হয়েছিলো অনেক। পরে পরশ স্যার তোর আর ভাইয়ার বিয়ের কথা তুলেন।
আম্মু-আব্বু নীরব বসে ছিলো অনেকক্ষণ।ভাইয়া নির্লিপ্ত ভাবে হাসি মুখ নিয়ে বলে,

‘ জানি না আপনারা মানবেন কি না ? তবে আপনাদের সম্মতিতেই আমি হৃদিকে চাই।আমি সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো। শেষ সময়টুকু অবধি।আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন একজন মানুষ হিসেবে। যে আপনার সম্পদ নিতে চায় নিজের ব্যক্তিগত ভালোবাসা হিসেবে।তাকে আমি ভালোবাসি। আমার সৃষ্টিকর্তার পর আমি দুটো মানুষকে আমি ভালোবাসি নিজের থেকে বেশি।আমি আপনাদের বিশ্বাস করতে বলছি না শুধু বলছি সুযোগ দিতে বলছি। ‘

ভাইয়ার সহজ স্বীকারোক্তিতে আম্মু পারে কান্না করে দিতে।আব্বু থম মেরে বসেছিলো। আর দাদুন তো ভাইয়াকে দেখে বলেছিলো,

‘ বিয়ে হলে তোমার সাথেই হবে আমার বোনুর। আর কেউ না মানলে বিয়া দিমুই না কারো সাথে। এইটা আমার আদেশ রেজাউল। ‘

আব্বু মুখ কাঁচুমাচু করলেও আম্মুর রাজি হওয়াতে সব ঠিক হয়েছে।
আমি আর রাহাত ভাইয়া একপ্রকার নেচেছিলাম। ভাইয়া বলেন, তার সিলেট যাওয়া লাগবে আর কাজের বর্ণনা দেন।ব্যাস সব ঠিক হলো। আর তোকে না জানানোর আইডিয়া ভাইয়ার। এই সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না।

–‘ বাকি কথা বাসর ঘরে হবে। ‘ রাফিনের কথার মাঝে নীতি দাঁত বের করে হেসে বলে উঠলো।

___________________

বুকের মাঝে হাতুড়ি পিটা শব্দ হচ্ছে। কিছু মূহুর্তেই বাসার ছাদে জমজমাট পরিবেশ। লাইটিং এর আলোয় ভরে উঠেছে সব। হাতে গোণা কয়েক জন চেনা আর অচেনা মুখের ভেতর আমি খুজে চলেছি আমার তাকে। যার অপেক্ষায় আমি মরছি প্রত্যেকটা মূহুর্ত। চাঁপা কথা আর হাসা-হাসির শব্দ গুলো কেমন ভালোলাগার ছোঁয়া আছে। আমার মনে হচ্ছে,আমি সুখের স্বপ্ন দেখছি যা অনন্ত কাল ধরে চলবে।
আমার অবাধ্য মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বসে আছি। জান্নাত আর নীতি পাশে বসে কথা বলছে উনাত ব্যাপারে।
আমি বারেবারে মিইয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকটা মূহুর্ত যার আশায় ছিলাম আজ সেই দিন আমার হাতের কাছে বহু কাছে। আমি শ্বাস বন্ধ করে বসে আছি।
প্রায় অনেকটা সময় পর বাতাসে সেই চির পরিচিত সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। আবারও সেই দম বন্ধ করা পরিবেশ। আমার পাশে সে এসে দাঁড়ালো আমি মাথা তুলে তাকানোর সাহস পেলাম না।
সে অতি সপ্তপর্ণে আমার হাত মুঠোয় নিয়ে নিলো।হৃৎপিন্ডের গতি হু হু করে বেড়ে উঠছে। সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
‘ আমি এসেছি
তোমার কাছে
হাজারো ভালোবাসা গুলো বলতে
আর যত্ন করে রাখা হাজারো
শুভ্র রঙের প্রেম নিয়ে। ‘

চলবে…