শেষটাও সুন্দর হয় পর্ব-০২

0
956

#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#একসাথে_কাটানোকিছু_মিষ্টি_সময়
#আমিনা_আফরোজ
# পর্ব:-০২

রাতের দ্বি-প্রহর। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু অবিরত ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ শুনা যাচ্ছে । শীতের রাতে বাহিরের প্রকৃতি ইতিমধ্যেই ঢেকে গেছে শুভ্র কুয়াশার চাদরে। আকাশে আজ মস্ত বড় পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে।
সেই সাথে বইছে মৃদু মন্দ শীতল হাওয়া। চারিদিক চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। যেন আজ পথের ধারে চাঁদের হাট বসেছে। আর সেই হাটে সবাই লুটে নিচ্ছে ঝলমলে জোৎস্নার আলো। আমি তখন সেই সময় চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম দূরের পথের বাঁকে, যেখানে না বলা কিছু কথারা লুকিয়ে আছে ।

ঝিরঝিরি মৃদু হাওয়া আসছে আমাদের নির্ধারিত সিটে। আমি তখনও জেগে রয়েছি। আমার পাশেই বসেছে অথৈ । ট্রেনে ওঠার পরে হালকা মৃদু বাতাসে সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে ও। বাবা-মাও ঘুমিয়ে পড়েছে মিনিট দশেক আগে। একা একা জানালার পাশে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বলেই জানালার পাশ থেকে ওঠে ধীরে ধীরে পা ফেলে সোজা চলে গেলাম ট্রেনের দরজার সামনে। বেশ রাত হয়ে গেছে বিধায় ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী তখন পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে।

ট্রেনের দরজার সম্মুখ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসের গতি তখন অনেক। দমকা সেই হাওয়ার তোড়ে আমার লম্বা খোলা চুলগুলো উড়ে চলেছে বাঁধন হীন ভাবে। আমি তখনো তাকিয়ে আছি দূর সীমান্তের পানে। এমন সময় একজন আগুন্তক এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। পরনে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় ঝাগড়া কালো চুল আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আমার মতো তিনিও নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের অপরূপ প্রকৃতির দিকে । প্রায় মিনিট পনেরো এভাবেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে। একজন থেকে অপর জনের দুরুত্ব খুব বেশি ছিল না, আবার খুব একটা ঘনিষ্ঠ ভাবেও দাঁড়িয়ে ছিলাম না আমরা। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে ভরাট এক পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।

–” এত রাতে একা একটি মেয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে এখানে আছেন , ভয় করছে না আপনার?”

কন্ঠস্বরটি শুনেই মুখ ফিরিয়ে তাকালাম তার দিকে। গম্ভীর স্বরে বললাম,

–” সে তো আপনিও একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন এখানে। আপনার ভয় করছে না বুঝি?”

আমার কথায় আগন্তুক লোকটি মুচকি হেসে বলে ওঠলেন,

–” আমাদের ছেলেদের মাঝে জন্মগতভাবেই কিছু সাহস থাকে বুঝলেন তো।”

–” মেয়েদের মাঝে বুঝি সে সাহস নেই?”

–” উহু নেই। মেয়েরা কখনো লজ্জাবতী তো কখনো কোমলমতি আবার কখনো বা অভিমানীনী হয় তবে তারা কখনো সাহসী হয় না।”

–” এইটা কি আপনার সঙ্গা নাকি?”

–” উহু এইটা সাহিত্যের ভাষা। ”

–” তো আপনার সাহিত্যের ভাষায় মেয়েদের আর কি কি বলে শুনি।”

–” সাহিত্যে মেয়েদের বলে প্রেয়সী, বলে প্রিয়তমা আবার কখনো বলে রাগিনী। ”

–” আমাকে আপনার সাহিত্যের ভাষায় কি বলে মনে হচ্ছে এখন?”

লোকটি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

–” সত্যি বলবো নাকি মিথ্যা বলবো?”

–” আগে নাহয় মিথ্যা দিয়েই শুরু করুন, সত্যিটা না হয় অন্তিম পাতায় শুনলাম।”

–” যদি মিথ্যে বলি তবে এখন আপনাকে এলোকেশি লাগছে, যার এলোমেলো চুলে যে কেউ হারিয়ে যাবে ক্ষনিকের মাঝেই।”

–” তাই বুঝি।”

আগন্তুক লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,

–” নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ
তিমির নেমেছে সবে
দক্ষিনা হাওয়ায় , এলোকেশি চুলে
মাতিয়া রাখিয়াছো তারে।”
~আমিনা আফরোজ

লোকটির কথা শুনে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। দুজনেরই দৃষ্টি ছিল একে অপরের দিকে। এভাবেই কেটে যায় মিনিট পাঁচেক সময়। আমি তখনো সেই মানুষটির পানে তাকিয়ে আছি। আচমকা লোকটি হেসে আমার থেকে দূরে দাঁড়ালেন। অতঃপর চোখের মোটা ফ্রেমের চশমটা হাত দিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে রাশ ভারী কন্ঠে বলে ওঠলেন,

–” এখানে এভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাউকে পাগল না করে ভেতরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ”

কথাগুলো বলেই পিছন ফিরে ট্রেনের ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। আমিও তগনোই বলে ওঠলাম,

–” সত্যিটা না বলেই চলে যাচ্ছেন?”

তিনি আমার কথা শুনে আবারো পিছন ফিরে বললেন,

–” সত্যিটা না হয় আজ অজানাই থাক। যদি জীবনের অন্তিম পাতায় আবার কখনো আমাদের দেখা হয় সেদিন না হয় বলবো।”

–” না আপনি আমার নাম জানেন আর না আমি আপনার পরিচিত। কোন এক নিশি রাতে আপনি আমাকে দেখছেন , আমাকে আপনার জীবনের অন্তিম পাতায় চিনতে পারবেন তো?”

–” আপনাকে ভুললে তবে তো চেনার কথা আসতো। আপনাকেই যখন ভুলবো না তখন না চিনে উপায় আছে কি?”

–” আচ্ছা আমাকে মনেই বা রাখবেন কিভাবে?”

–” আপনার এলোকেশি চুল , গায়ে বেলি ফুলের সুমিষ্টি সুগন্ধি আর আপনার মায়াবী কন্ঠস্বর এই তিনটি নিজেই চিনিয়ে দিবে আপনাকে। আজ চলি তাহলে । জীবনের কোন এক অন্তিম পাতায় আবারো দেখা হচ্ছে দুজনের।”

লোকটি চলে যাবার পর আমিও আর বেশিক্ষণ থাকি নি সেখানে । একা একা ভালো লাগছিল না আমার। কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। দূরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে তখন জ্বলে ওঠেছে জোনাকির আলো। আমি দরজা থেকে ওঠে আমার নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। বাবা-মা, অথৈ তখনো ঘুমে। আমিও এবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

সকালের মিষ্টি আলোয় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। আমাদের ট্রেনটা তখন কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে থেমেছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মা-বাবা ব্যাগগুলো সাজিয়ে একে একে হাতে নিচ্ছে । বাবা দুইটা ব্যাগ আর আমরা তিনজনে তিনটে ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। ট্রেনে তখন হুলস্থুল কান্ড। সবাই ছুটোছুটি করে ট্রেন থেকে নামতে ব্যস্ত। কে যে কাকে পিছনে ফেলে নামছে তার ঠিক নেই। তবে আমার দৃষ্টি কিন্তু তাদের দিকে নেই। আমি এই ভিড়ের মাঝে খুঁজে চলেছি এক জোড়া মোটা ফ্রেমের চশমা। কিন্তু আমার নজরে তা এখনো তিনি পড়েন নি। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে চলে এলাম ফুপুর বাসায়। ফুপুরা তখন জেগেই ছিলেন। বাবাকে দেখে তো ফুফু কেঁদে একাকার। আমরা সবার সাথে দেখা করে চলে এলাম নিজ নিজ ঘরে। আমার ঠাঁই হলো অহনার ঘরে। অহনা তখনো কুম্ভকর্নের মতো ঘুমাচ্ছিল। আমি চুপি চুপি অহনার কাছে বসে ওর চোখের পাতার টেনে খুলে দিলাম। অহনার ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গেছে। আমাকে পাশে বসে থাকতে দেখে হাতের বালিশ দিয়েই কয়েকটা মারল আমার পিঠে। আমি তো গো বেচারি। চুপচাপ মাইর খেলাম অহনার হাতে। তারপর দুই বোন মিলে বসে গেলাম গল্পের ঝুড়ি নিয়ে।

এভাবেই আনন্দের স্রোতে কেটে গেছে দুই দিন। আজ আমাদের বই মেলায় ঘুরতে যাওয়ার কথা। সকাল থেকেই আমি নীল রঙের শাড়ি পড়ে বসে আছি। মাথায় পড়েছি বেলি ফুলের গাজরা। অহনা পড়েছে আকাশি রঙের শাড়ি আর আমার মতোই চুলে লাগিয়েছি বেলি ফুলের গাজরা। পরিবারের সবাই যাচ্ছে বইমেলায়। যখন বই মেলায় পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে। আমি আর অহনা দুজনে একস্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখছি । এমন সময় আমার চোখ আটকে গেল দূরের একটা স্টলে। যেখানে চেয়ারে বসে একজন সুদর্শন পুরুষ হেসে হেসে অন্য কারো সাথে কথা বলছেন। লোকটি আমার পরিচিত শুধু পরিচিতই নয় যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি গত দুই দিন ধরে। অহনা ইশারায় তাকে দেখাতেই বলে ওঠলো,

–” তুই জানিস কে ওনি?”

–” আরে জানার সময় পেলাম কখন, তার আগেই তো জনি কাব্যিক কথা বলে চলে গেলেন?”

–” ওনি আরশান মাহমুদ নিদ্র। একজন জনপ্রিয় লেখক তিনি।”

–” বাহ নামের সাথে সাথে দেখি গুনটাও অনেক ভালো। চল দেখা করে আসি।”

–” আরে দাড়া। ওনি তো কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারেন না। তুই নিশ্চিত তো ইনিই তোর সেই ট্রেনওয়ালা ?”

–” এই তোর কি আমরা চোখ খারাপ বলে মনে হয় । চল তোকে এখনি প্রমান করে দিচ্ছি।”

কথাগুলো বলেই অহনাকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম স্টলের দিকে। স্টলের সামনে তখন অনেক ভীর । তবুও সবাইকে ঠেলে-ঠুলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে।

চলবে।