#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৪
বাম কাত হয়ে নির্ঝরের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে তরী শুয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে বন্ধ চোখে, ভারী গলায় নির্ঝর বলে উঠলো,
‘রাত বারোটার বেশি বাজে। এত দেরি হলো কেন?’
তরীর পিলে চমকে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। চোখ দুটো আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। নির্ঝর এখনো জেগে আছে? এত রাত হয়ে গেছে তবুও ঘুমায়নি? সর্বনাশ!
‘এতক্ষণ কি করছিলে নিচে?’
নির্ঝরের অতিশয় শীতল কন্ঠ। তবুও তরী এই কন্ঠের উত্তাপ টের পেল। যেই উত্তাপে তার শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে। সে খুব দ্রুত মস্তিষ্কে কথা সাজিয়ে নিল। কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই নির্ঝর এক লাফে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। তরীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ক্রেজি স্টুপিড! এত দেরি কেন হলো আসতে?’
তরী কেঁদে দিয়েছে প্রায়। অনেকদিন হলো নির্ঝর তাকে ধমকে ধমকে কথা বলে না। সে ভেবেছিল, পরিবর্তন হয়ে গেছে মানুষটা। তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু ঘটনা তো পুরো উল্টো। তবুও ভয়ে ভয়ে বলল,
‘একটু টিভি দেখছিলাম। আজ তো পড়া নেই! এমন করেন কেন?’
এই ‘কেন’-র উত্তর নির্ঝর চট করে দিতে পারলো না। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে কি করে বলবে যে এতক্ষণ ধরে সে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। গুমড়ে মরছিল! কতবার যে সিঁড়ির কাছে গিয়ে ফিরে এসেছে তা যদি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে এই মেয়ে জানতো বা একটু বোঝার চেষ্টা করতো!সে কিছু বলল না। ব্যথিত মন নিয়ে আগের জায়গা শুয়ে পড়লো। ডান হাতটা মাথার নিচে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
তরী সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে স্বাভাবিক হয়ে এলো। মনে সাহস নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘এখনো ঘুমাননি কেন আপনি?’
নির্ঝর উত্তর দিল না। তরী নিজে থেকে বলল,
‘এমন তো না যে আমায় রোজ জড়িয়ে ধরে ঘুমান। আজ আমি নেই বলে ঘুম আসছে না। ঘুমাননি কেন বলুন তো?’
নির্ঝর আর চুপ থাকতে পারলো না। মাথা ঘুরিয়ে তরীর দিকে শীতল একটা চাহনি দিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘মুখ দিয়ে যেন আর একটা ওয়ার্ড বের না হয়। ঘুমাচ্ছি আমি।’
‘কিন্তু আপনার চোখে মুখে ঘুমের বিন্দুমাত্র রেশ নেই। কেমন কাঠ কাঠ গলায় কথা বলছেন। স্পষ্ট সুর! কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। মনে হচ্ছে আগামী এক দশক অন্তত আপনার ঘুম হবে না। ঘুম আপনার থেকে সহস্র কোটি দূ…….’
‘শাট আপ! একদম চুপ!’
নির্ঝরের উঁচু কন্ঠস্বরে তরী ঘাবড়ে গেল না। আগের থেকে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘হাউ ফানি! আমাকে ধমকাচ্ছেন কেন?’
নির্ঝর হাত বাড়িয়ে তরীকে একটা শিক্ষা দিতে নিয়েও শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। হাতটা গুটিয়ে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলো। তরীর কন্ঠ আর শোনা গেল না। অথচ মনে মনে সে বার বার তরীকে কথা বলার অনুরোধ করলো। এই নিশুতি রাতে তরীর গম্ভীর কন্ঠের অগোছালো কথাবার্তা শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হতে নির্ঝরের শ্বাস আটকে আসার মতো হলো। বন্ধ চোখেই সে অনুভব করছে তরী তার খুব কাছে চলে এসেছে। দুজনের মাঝে কয়েক ইঞ্চি তফাৎ।
তরীর শ্বাস দ্রুততর হচ্ছে। তবুও আড়চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরকে নির্বিকার দেখে ইচ্ছে করে বাম হাতে কনুই দিয়ে পেটের কাছে গুঁতো দিল। ভুলবশত লেগেছে প্রমাণ করার জন্য খুব দ্রুত হাত সরিয়ে নিল।
সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর কপাল কুঁচকে বলল,
‘এত কাছে ঘেঁষাঘেষির কারণ কি?’
তরী ঠোঁট কামড়ে ধরলো। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘কোনো কারণ নেই। মাঝখানের কোলবালিশ নেই কেন আজ? এতদিনে কোলবালিশ ফেলে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন? ‘
‘হাউ ফানি! কোলবালিশ ফেলে দিবো কেন আমি? ইঁদুর কেটে তুলো বের করে ফেলেছে ওটার। তুলোতে আমার আবার এলার্জি আছে! সেজন্য সরিয়ে রেখেছি।’
‘তাই বুঝি?’
‘এই, তুমি এত কাছে আসছো কেন? কোলবালিশ সরিয়েছি বলে তুমি সুড়সুড় করে কাছে চলে আসবে?’
তরী মুচকি হেসে বলল,
‘বিছানার ওপাশ ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। আপনি পানি ঢেলে দিয়েছেন নিশ্চয়ই!’
‘কি?’
নির্ঝর এক লাফে উঠে বসলো। ভ্রুজোড়া কুঁচকে তরীর দিকে তাকালো। অন্যদিনের তুলনায় তরীর মুখটা আজ বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। নক্ষত্ররাজের মতো জ্বলজ্বল করছে। এত আলো, এত উজ্জ্বলতা কোথায় লুকিয়ে রাখে মেয়েটি? তরীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নির্ঝরের কুঁচকানো ভ্রু যুগল প্রসারিত হয়ে গেল। মুখে এসে ভর করলো একরাশ মুগ্ধতা। চোখের মণি তরীময় হয়ে উঠলো। আচমকা তরী মুখে হাত রেখে হাঁচি দিয়ে উঠতে নির্ঝরের ঘোর কাটে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তরী স্বাভাবিক হতে সে কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘বিছানা ভেজা? কোথায় ভেজা?’
তরী হাত দিয়ে তার ডান পাশে ইশারা করলো। নির্ঝর নিজের জায়গা থেকে সরলো না। তরীর উপর দিয়ে ওপাশে ঝুঁকে হাত দিয়ে বিছানা হাতড়ালো। শুকনো, খটখটে বেডশিট! পুনরায় তার কপাল কুঁচকে গেল। কিন্তু ক্ষণিক সময় পরে তরীর দুষ্টুমি ধরে ফেলল। তরীর উপর থেকে সরে এসে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল,
‘মিথ্যে বলছো কেন তরী?’
‘আপনি তো প্রতিনিয়ত আমার সাথে মিথ্যে বলেন। আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতে একগাদা মিথ্যা বলেছিলেন আপনি। রাতের বেলা লুকিয়ে আমার ছবি তুলে তবুও স্বীকার করেননি। সাথে কি তেজ! আমি জোর করতে উল্টো আমায় ধমকে থামিয়ে দিলেন। মানে মানুষ মিথ্যা এত কনফিডেন্ট নিয়ে কিভাবে বলে তা আপনাকে না দেখলে অজানা থাকতো।’
‘হাউ ফানি! মিথ্যা কখন বললাম? আমি সত্যি সেই রাতে ছবি তুলিনি।’
তরী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘আবার মিথ্যা বলছেন আপনি? আমার সেদিন রাতের ঘুমের ছবি আপনার ফোনে দেখেছি আমি।’
‘সেকি! কখন দেখেছ?’
নির্ঝরের ভয়ার্ত মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে তরীর মুখে ফিচেল হাসি ফুটে উঠলো। বিগত মাসগুলোতে নির্ঝর তাকে কখনো ফোন ধরতে দেয়নি। ফোনে গোপন রত্ন লুকানো আছে যেন এভাবে সবসময় তার থেকে লুকিয়ে রাখতো। ফোনের লক প্যাটার্ন পর্যন্ত জানতো না। আজ বিকেলবেলা নির্ঝর তার পাশে শুয়ে ফোন চালানোর সময় সে লুকিয়ে দেখেছে নির্ঝর তার ছবি দেখছে। তাও আবার সেদিন রাতের ছবি। সেই ড্রেস পরিহিত উষ্কখুষ্ক চুলের ঘুমন্ত ছবি। আর কিছু দেখতে পারেনি। নির্ঝর তার দিকে তাকাতে সে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার ভান ধরেছিল।
নির্ঝরের মুখে চিন্তার রেখা। তরী নিজের জড়তা কাটিয়ে ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,
‘আপনি সত্যি সত্যি সে রাতে আমায় চুমু খেয়েছিলেন?’
নির্ঝর ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। অনবরত মাথা নেড়ে বলল,
‘অসম্ভব। আমি ওসব বাজে কাজ করিনি। জ্যোতি কি দেখতে কি দেখে ফেলেছে!’
‘চুমু খাওয়া বাজে কাজ?’
নির্ঝরের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। এই প্রথম অনুভব করলো সে সাহস হারিয়ে ফেলছে। ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এতটা দূর্বল তো সে কখনো ছিল না। তার চোখের সামনের এই মেয়েটি তার মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। তার কল্পলোকের সেই মেয়েটি, রোজ স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি তার মনে তীব্র ভয়ের সৃষ্টি করছে। এতগুলো বছর লুকিয়ে রাখা অনুভূতির কাছে ধরা পড়বার ভয়!
নির্ঝর সটান নিজের জায়গা শুয়ে পড়লো। আড়চোখে তরীর দিকে তাকাতে দুজনের দৃষ্টি একে অপরে নিবদ্ধ হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একলাফে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। গায়ের ঢিলেঢালা টিশার্ট টেনেটুনে বলল,
‘অনেক রাত হয়েছে তরী। দুই মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ো!’
বলে সে দ্রুতপায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে কাচ টেনে গ্রিলের উপর ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাঁসফাঁস করতে করতে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো জয়ের হাসি, তৃপ্তির হাসি, প্রশান্তির হাসি। এতগুলো বছর ধরে বুকের মাঝে, মনের মণিকোঠায় স্বযত্নে আগলে রাখা তার তরীরানির চোখে সে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছে। একটু নয়, অল্প নয়! অনেক বেশি ভালোবাসা দেখেছে সে। নির্ঝর চোখ খুলল। গ্রিল দিয়ে হাত টপকিয়ে ওপাশের অন্ধকার ধরার চেষ্টা করলো। হঠাৎ বেলকনির আবছা অন্ধকার ছাপিয়ে মিহি একটা কন্ঠ ভেসে এলো। নির্ঝরের বুকের ভেতর সুখের দোলা দিয়ে গেল। প্রথমবারের মতো নিজেকে বড্ড বেশি অগোছালো মনে হলো।
তরী ধীরপায়ে নির্ঝরের পাশে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে বলল,
‘একা একা অন্ধকার বিলাস করা যায়?’
নির্ঝর সহসা উত্তর দিল না। দুজন নিরবে একে অপরের বুকের ধুকপুকানির শব্দ শুনে গেল যেন। কয়েক মুহূর্ত পর নির্ঝর তরীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। গ্রিলের উপর রাখা তরীর হাতের উপর নিজের বাম হাত রাখলো। তরী হাত সরিয়ে নিল না। আবার নিরবতা! আবারও এই নিরবতার বেড়াজাল নির্ঝর ভেঙে ফেলল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘আমি তোমায় ভালোবাসি তরী! অনেক আগে থেকে। কতটা আগে থেকে তুমি কল্পনা করতে পারবে না।’
নির্ঝরের ধরা গলায় বলা ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনে তরীর শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মনে হলো নির্ঝরের মুখ নিঃসৃত বাক্যের চেয়ে সুমিষ্ট কিছু আর পৃথিবীতে নেই। জীবনে প্রথম বারের সতো চোখের কোণে আনন্দের অশ্রুর আভাস পেল। নির্ঝরের হাতটা চেপে ধরে সে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আবছা অন্ধকারে তরীর লজ্জা মিশ্রিত মুখ নির্ঝরের দৃষ্টি এড়াল না। তরীর নত মাথা, ঠোঁটের কোণের লজ্জা মিশ্রিত হাসি দেখে সে আর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আচমকা দু পা এগিয়ে এসে তরীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল।
তরীর হাতদুটো নির্ঝরের পিঠে বিচরণ করছে। বিড়াল ছানার মতো সে নির্ঝরের বুকে লুকিয়ে রয়েছে। বহু প্রতীক্ষার পর যেন সে এ বুকে আশ্রয় পেল। তার মনে হচ্ছে এ বুকের চেয়ে নিরাপদ স্থান, সুখের জায়গা, প্রশান্তির জায়গা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। তার চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাসি। সে ভেজা গাল দুটো নির্ঝরের বুকের টিশার্টে মুছে ফেলল। নির্ঝরের হাতদুটো শক্ত হাতে তাকে বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরে আছে। একটু ঢিল দিলে যেন সে পালিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর তরী নিজের ঘাড়ের খোলা অংশে পানির ফোঁটার অস্তিত্ব পেল। নির্ঝরের শরীরের কাঁপুনি টের পেয়ে সে বিস্মিত হলো। নির্ঝরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সে বিস্ময় নিয়ে মুখপানে তাকাল। নির্ঝরের মুখে জলের ধারা দেখে সে অবাক হয়ে বলল,
‘আপনি কাঁদছেন? কেন?’
নির্ঝর দ্রুত তরীকে পেছন রেখে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘হাউ ফানি! কাঁদবো কেন আমি? আমাকে নিজের মতো ন্যাকা মনে হয়?’
‘এই একদম কথা ঘোরাবেন না। আমি আপনার চোখে পানি দেখেছি।’
‘পেট ব্যথা করছে আমার তরী!’
তরী কপাল কুঁচকে সন্দেহ নিয়ে বলল,
‘খবর হয় আমার আর পেট ব্যথা করে আপনার? এত ভালোবাসেন আমায়?’
নির্ঝর যেন আরেক দফা চমক পেল। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল,
‘তোমার খবর মানে? সেকি? কখন থেকে?’
‘বিকেল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর টের পেয়েছি। আপনার থেকে লুকিয়ে বেডশিট চেঞ্জ করেছি।’
‘আমার থেকে লুকিয়ে করতে হবে কেন? এবার তো প্রথম নয়। এখন বলো, কেমন লাগছে? ঠিক আছো তুমি? পেট ব্যথা করে?’
‘না! সন্ধ্যায় হালকা ব্যথা ছিল। এখন সুস্থ।’
নির্ঝর দুশ্চিন্তা নিয়ে তরীর দিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করলো। তরীর দু কাঁধে হাত রেখে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘সত্যি বলছো তো?’
‘হুঁ! একদম ফিট!’
নির্ঝরের চেহারা থেকে তবুও দুশ্চিন্তা সরলো না। সে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তরীর দিকে চেয়ে রইলো। তরী বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল যে সে সত্যি ঠিক আছে। নিশ্চিত হওয়ার পর নির্ঝরের মুখ হাসি হাসি হলো। হঠাৎ করে তার হাসি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সে শব্দ করে শরীর দুলিয়ে হাসি শুরু করলো। তার হাসিতে মুক্তো ঝরছে যেন। তরী মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো। বিয়ের প্রায় মাস পাঁচেকের মধ্যে এই প্রথম সে নির্ঝরের মুখে এত হাসি দেখছে। পরিপূর্ণ হাসি। ইশ! হাসলে মানুষটাকে কি যে সুন্দর লাগে! সে হাসি মুখে বলল,
‘হাসছেন কেন আপনি?’
নির্ঝর হাসতে হাসতে বলল,
‘হাউ ফানি! ইচ্ছে করে অসুস্থ হয়ে পড়েছ তাই তো?’
তরী ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘হাউ বজ্জাত! এসব হরমোনাল ক্রিয়াকলাপ। আমি কি করতে পারি?’
‘অনেক কিছু করতে পারো। আপাতত একটা চুমু দিতে পারো।’
নির্ঝরের সহজ কন্ঠে তরী ঈষৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। বুকের ভেতর বয়ে চলা পুরনো ঝড়ের বেগ বেড়ে গেল। সে লজ্জা পেয়ে সরে যেতে নিতে নির্ঝর খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। তরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দীর্ঘক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আবছা অন্ধকারের চাদরে নক্ষত্রের মতো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। সে গভীর মায়া নিয়ে তরীর দিকে চেয়ে রইলো।
একটা সময় তরীর নত করে রাখা মুখটা থুতনি ধরে উঁচু করলো। তরীর দুগালের পাশের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল।গভীর দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে আদরমাখা কন্ঠে বলল,
‘তরীরানি! আমি অনুভূতির ব্যাপারে ভীষণ অগোছালো। কখনো নিজের অনুভূতি গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না। আমি জানি না তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসি! কিন্তু গত সাত বছর যাবৎ তোমায় নিয়ে লেখা আমার ডায়েরির প্রতিটি পাতা, শেষ হয়ে আসা কলমের কালি, ক্ষীণ আলোর টেবিল ল্যাম্প আর নিশুতি রাত জানে তোমায় কতটা ভালোবাসি! আমার ফোনের গ্যালারি, ল্যাপটপ আর ক্যামেরা জানে তোমায় কতটা ভালোবাসি। আমার প্রতিটি শেষ রাতের স্বপ্ন, কল্পনার শহর আর অবচেতন মন জানে তোমায় কতটা ভালোবাসি! তোমায় কতটা ভালোবাসি জানতে চাইলে আমার চোখকে জিগ্যেস করতে পারো। আমার এই দু-চোখ গত সাত বছরে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেছে। তোমায় কতটা ভালোবাসি, জানতে চাইলে জিগ্যেস করতে পারো, আমার ঠোঁটকে! কত সহস্র বার তোমার ছবিতে চুমু খেয়েছে সেটা শুধু ঠোঁটযুগল জানে। জিগ্যেস করতে পারো আমার হৃদয়কে, আমার মনকে। যেখানে এক সেকেন্ডের জন্যও অন্য কোনকিছুর ঠাঁই ছিল না। সবটা জুড়ে শুধু তুমি ছিলে। আমার এই সম্পূর্ণ আমিটাই তো তুমি নামক তরীতে ভেসে চলেছে বছরের পর বছর ধরে। আমার ভালোবাসার নদীতে। যে ভালবাসার নদীর শেষ নেই! কূল কিনারা নেই! অনির্ণেয়যোগ্য গভীরতার এই নদী শুধুমাত্র আমার তরীরানির জন্য! আমার তরীরানি!’
নির্ঝর থামলো। তরী ছলছল দৃষ্টি মেলে সামনের এই মোহনীয় মানুষটার দিকে চেয়ে রয়েছে। এতদিন বহু চেষ্টার পরো মানুষটার হৃদয় অবধি পৌঁছাতে পারেনি।এতদিন ভেবেছিল, কিছুতেই বোধ হয় মানুষটার হৃদয় অবধি পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু তার বসবাস যে মানুষটার হৃদয়ে, আগে থেকে হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছে, নতুন করে কি করে পৌঁছাবে! ভেজা দৃষ্টি মেলে সে নির্ঝরের আরো নিকটে গেল।
(চলবে……)
#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৫ (বোনাস পার্ট)
ভেজা দৃষ্টি মেলে তরী নির্ঝরের আরো নিকটে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ডান হাতটা উঁচিয়ে নির্ঝরের গাল স্পর্শ করলো। মানুষটাকে এখনো সে ভীষণ ভয় পায় আবার ভালোবাসে! তবে ভয় আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য করলে ভালোবাসার পাল্লা ভারী হবে। সেখান থেকে সাহস নিয়ে সে ভয়ানক একটা কাজ করতে চাইলো। পায়ের উপর ভর দিয়ে সে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে নির্ঝরের নাক পর্যন্ত এলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ঝরের বাম গাল চেপে ধরে ডান গালে নরম ঠোঁটযুগল ছোঁয়াল। নির্ঝরের অবাক হয়ে যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে হুশ ফিরে তার। লজ্জা পেয়ে সরে আসতে নিতে বাঁধা পেল। নির্ঝর এক হাতে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিল।
তরীর নত মাথা। চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে। মুখের উপর রংধনুর মতো লজ্জার রেখা ভেসে উঠছে। আবছা আলোয় তার সে মুখপানে চেয়ে নির্ঝর ঘোর লাগা কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
‘চোখ খুলো তো তরীরানি!’
তরী তার থেকেও নিচু স্বরে বলল,
‘না!’
‘কেন? আমার উদ্দেশ্য সৎ! আমি জাস্ট তোমার চোখের রঙ পরখ করবো। এতদিন ভালো করে দেখা হয়নি।’
‘অন্ধকারে চোখের রঙ দেখা যায় বুঝি?’
‘বাহ্যিা চোখ দিয়ে দেখবো তোমায় কে বললো গো? মনের চোখ দিয়ে দেখবো। চোখ খুলো তো।’
তরী লজ্জায় চোখ খুলতে পারলো না। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। সে ভেবে রেখেছে এই চোখ আর এ জীবনে খুলবে না। নির্ঝরের চোখে চোখ রাখবে না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর তাকে লজ্জা নামক বাণ দিয়ে মেরে ফেলবে। নির্ঝর মুচকি হেসে মুখটা নিচু করলো। তরীর কপালে অধর চুম্বন দিতে সে কেঁপে উঠলো। ঝটপট চোখ খুলতে নির্ঝরের দৃষ্টিতে ঘায়েল হয়ে গেল। হারিয়ে গেল দুজন দুজনার চোখের মাঝেতে।
কিছু মুগ্ধকর মুহূর্ত কেটে গেল। নির্ঝরের বাহুডোরে আবদ্ধ থাকা তরীর শরীর হালকা নড়ে উঠলো। নির্ঝর চোখ ছোট ছোট করে ফু দিল তরীর মুখে। সঙ্গে সঙ্গে তরী চোখ বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মিনিট সে মুখের দিকে চেয়ে পুনরায় মুখটা নিচু করলো। তরীর পাতলা ঠোঁটযুগলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। বুকের নদীতে বয়ে চলা অকস্মাৎ ঢেউ থামাতে সে তিন-চার সেকেন্ড সময় নিয়ে তরীর নিচের ঠোঁটে চুমু খেল।
নির্ঝরের বুকের ঝড় থেমে গেল। সে হাত ঢিলে করতে তরী কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বাম হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে আবার দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। অযথা মাথার খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চুলে হাত দিতে নির্ঝর পুনরায় এগিয়ে এলো। তরীর হাত ধরে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘উঁহু! ওভাবে নয়।’
তরীর হাত থেমে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ওভাবে নয় কিভাবে? আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি চুল বাঁধতে পারি না?’
‘মহারানী। কখন বললাম যে আপনি চুল বাঁধতে পারেন না? আপনি সব পারেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া।’
তরী কৌতূহল নিয়ে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকালো। কোন জিনিসটা সে পারে না? জানতেই হবে! সেটা আগে শিখতে হবে। সে ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের উত্তরের অপেক্ষা করছে। কিন্তু নির্ঝর নিশ্চুপ রয়েছে। তার অস্থিরতা ভীষণ উপভোগ করছে। তরী ধুম করে নির্ঝরের বুকে কিল বসিয়ে দিল। নির্ঝর সঙ্গে সঙ্গে বুকে হাত চেপে হেসে ফেলল। তরী কপাল কুঁচকে বলল,
‘কোন জিনিস পারি না আমি?’
‘বলবো না। গেস করো!’
‘আপনি বলবেন নাকি বলবেন না?’
‘একটু চিন্তা করো তুমি!’
‘বুঝতে পেরেছি। আপনি বুঝাতে চাইছেন যে আমি পড়াশোনা পারি না। ফেল্টুস আমি। তাই তো?’
নির্ঝর শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
‘সিরিয়াসলি! আমি পড়াশোনা বুঝিয়েছি? এটা মনে হলো তোমার?’
‘তাহলে বলুন না স্পেসিফিক কোন জিনিসটা আমি পারি না?’
তরীর অধৈর্যতা দেখে নিরবে হাসি থামাল নির্ঝর। তরীর খোলা চুলগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে নেড়েচেড়ে বলল,
‘শুধু আমায় ভালোবাসতে পারো না। বাকিসব পারো তুমি।’
‘কে বলেছে আপনাকে ভালোবাসতে পারি না? বাসি তো!’
‘কি বাসো?’
তরী লজ্জায় পুনরায় মাথা নত করলো। দু হাতে ওড়নার ঝুলন্ত অংশ চেপে ধরে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোঁটা শুরু করলো। নির্ঝর আর অপেক্ষা করলো না। এক ঝটকায় তরীকে কোলে তুলে নিল। তরী চমকে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,
‘কোলে তুলছেন কেন?’
‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে হবে না?’
‘অহ, হ্যাঁ! ঠিক আছে। নিচে নামান, হে-হেঁটে যাই আমি!’
‘ডিঙিরানী চুপ! আমাকে আমার কাজ করতে দাও।’
বেলকনি থেকে রুমে ঢুকে নির্ঝর পা দিয়ে কাচ ঠেলে দিল। চেয়ার টেনে তরীকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল। ব্রাশ হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে নিল। তরী বাঁধা দিল না।
তরীর মাঝারি সাইজের চুল এখন। বিয়ের আগে অনেক যত্ন করে সে চুল বড় করেছিল। কোমড় ছাড়িয়ে গিয়েছিল চুলে। কিন্তু বিয়ের পর নির্ঝর চুলের নিচ থেকে কিছু অংশ কেটে দিয়েছে। কারণ একটা না, অনেকগুলো। সে শাওয়ার শেষ করে চুল ভালোমতো শুকায় না, মাথায় নিয়মিত ব্রাশ করে না, চুল বাঁধে না ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কারণ এই চুলের ভাড়ে সে নাকি দিনদিন চিকন হয়ে যাচ্ছে। এরকম আরো অনেক অজুহাত দেখিয়ে নির্ঝর তার লম্বা বিঁনুনি ধরে কেটে দিয়েছিল।
তরীর ঘন কৃষ্ণ চুলের মাঝে নির্ঝর হারিয়ে ফেলল নিজেকে। চুলে মুখ ডুবিয়ে সে গন্ধ নিল। সময়ের কথা মনে পড়তে সে দ্রুত চুল বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তরীকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এত রাত জাগলে অারো বেশি অসুস্থ হয়ে পরবে। সে চুলগুলো তিন ভাগ করে বিঁনুনি পাকানোর চেষ্টা করলো।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও প্যাঁচ গুলো ঠিকমতো দিতে পারলো না। বিগত মাসগুলোতে সে লুকিয়ে তরীর চুল বাঁধা দেখেছে। তখন বিঁনুনি পাকানো পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সাধ্য কাজ মনে হয়েছে। কিন্তু জিনিসটা মোটেই সহজ নয়। নির্ঝরের অবস্থা বুঝতে পেরে তরী নিজে থেকে বলল,
‘আমি বেঁধে ফেলি। আপনাকে করতে হবে না।’
‘আমি নিয়ত যখন করেছি, বিঁনুনি গেঁথেই ছাড়বো। ‘
তরী একটু হাসলো। বহুক্ষণ বহু কসরত করে নির্ঝর চুলগুলো দড়ির মতো পেঁচাতে সম্ভব হলো। রাজ্য জয়ের হাসি দিয়ে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘তরী! দেখেছ কত সুন্দর করে করতে পেরেছি আমি।’
তরী বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। বিঁনুনি টা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো সে। যখন তখন খুলে যাবে হয়তো। তবুও বুকে কি যে ভালো লাগা! কত যে মুগ্ধতা! সে পুলকিত মনে উঠে দাঁড়াতে নির্ঝর আবার তাকে কোলে তুলে নিল।
বিছানার দিকে এগিয়ে তরীকে একপাশে শুইয়ে দিল নির্ঝর। মাথার নিচে বালিশ ঠিকঠাক দিয়ে পাশ থেকে ব্লাঙ্কেট তুলে গায়ে জড়িয়ে দিল। তরীর দিকে ঝুঁকে বলল,
‘ক্ষুধা লেগেছে? এত রাত অবধি জেগেছিলে। কিছু খাবে?’
তরী এদিক ওদিক মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। তার চোখের মণি চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রুমে দিনের মতো আলো। এই আলোতে নির্ঝরের চোখে চোখ পড়লে সর্বনাশ। তার এখনো কেন জানি মনে হচ্ছে ওপাশের বেলকনির ঘটনাগুলো নিছক স্বপ্ন। যা সে জেগে জেগে দেখছে। অথবা সম্পূর্ণ অংশ কল্পনা! কপালে নির্ঝরের হাতের স্পর্শ পেতে সে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলো। কি অদ্ভুত অনুভূতি। নির্ঝর কনফার্ম হওয়ার জন্য বলে উঠলো,
‘সত্যি ক্ষুধা লাগেনি তো?’
‘নাহ।’
‘লাইট বন্ধ করবো? নাকি জ্বালানো থাকবে?’
‘বন্ধ থাক!’
তরী অল্প ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো। পেছন ঘুরে দেয়ালের সুইচের দিকে এগিয়ে যেতে তরী আড়চোখে নির্ঝরের সর্বাঙ্গে নজর বুলাল। মানুষটার গায়ে ছাই রঙা ঢিলেঢালা ট্রাউজার আর গাঢ় সবুজ রঙের টিশার্ট। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। উন্মুক্ত ফর্সা বাহু কেমন উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে থাকা অবস্থায় রুম অন্ধকার হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেলকনির সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। যার বেশিরভাগ আলো রুমে এসে পড়েছে। নির্ঝর ঘুরে দাঁড়াতে সে দ্রুত মাথা সোজা করে চোখ বন্ধ করলো।
তরীর পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে নির্ঝর শুয়ে পড়লো। টান টান হয়ে শুয়ে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ। এ হাসি কখনো ফিকে হবে না। তার প্রতিনিয়ত হাসির কারণ যেই মেয়েটি সে তো এখন তার পাশে, তার কাছে। তার খুব কাছে! তরীকে নিজের পাশে পেয়েছে, বউ করতে পেরেছে এতেই তার জীবন ধন্য। তরীর একটু আধটু স্পর্শে সে পাগলপ্রায়। সে মুখ ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকাল।
তরী উসখুস করছে। একটুপর পর কাত ঘুরছে। গায়ের ব্লাঙ্কেট একবার ফেলে দিচ্ছে তো একবার গায়ে জড়াচ্ছে। নির্ঝর কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ্য করে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘পেট ব্যথা করছে তরী? এমন নড়াচড়া করছে কেন?’
তরী ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘পেট ব্যথা করে না।’
‘তাহলে?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘সে কি! শুধু শুধু ঘুম আসবে না কেন? ঘুম তো আসবে আসবে, সাথে তার বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে আসবে। নিশ্চয়ই তুমি মাথার নিচে বালিশ দাওনি।’
‘মাথার নিচে বালিশ আছে। আপনি নিজ হাতে দিয়ে দিয়েছেন।’
‘তাই তো! তাহলে ঘুম আসছে না কেন?’
তরী উত্তর দিল না। সে কাত ঘুরে চিৎ হলো। নির্ঝর হঠাৎ নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আমার হাতটা ধার দিতে পারি। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি,এখানে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম চলে আসবে।’
‘আর যদি না আসে?’
‘নৌকারানী! এই নির্ঝর শাহরিয়ারের কোনো কথা কখনো অবিশ্বাস করতে হয় না। যারা অবিশ্বাস করে তারা ঠকে যায়। পুরো হাতে আমি ঘুমনাশক স্প্রে করেছি। মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম চলে আসবে। না আসলে হাত কেটে ফেলবো।’
তরী ফিক করে হেসে ফেলল। একটুপর আড়ষ্টতা নিয়ে এগিয়ে এলো। বালিশ রেখে নির্ঝরের হাতের উপর মাথা রাখলো। নির্ঝর হাতটা সামান্য গুটিয়ে তরীকে আরো একটু কাছে নিয়ে আসলো। বাম হাতে তরীর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
‘চোখ বন্ধ করো তো এবার।’
তরীর শ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। তার সে ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে নির্ঝর অযাচিত হাসছে। তরী তার বুকের কাছে কেমন বিশ্বাস হতে চায় না। মুচকি হেসে সে তরীর ডান হাত উঁচু করে তার উল্টোপিঠে চুমু খেল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘ঠিক অতোটা ভালোবাসার দরকার নেই আমার! তুমি শুধু তোমায় আমার মতো করে ভালোবাসতে দিয়ো। আমার মতো করে আগলে রাখতে দিয়ো প্রিয়। ব্যস এইটুকুই!’
______________
ভোরবেলা গাড়ির বিশ্রী হর্ণের শব্দে নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। কাছে কোথাও অনবরত গাড়ির হর্ণ বেজে যাচ্ছে। দোতলা থেকেও সেগুলো যেন কানের মধ্যে ঢুকে যায়। সে রোজকার মতো বন্ধ চোখে উঠতে নিতে বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব করলো। বিস্ময় নিয়ে দ্রুত চোখ খুলতে মুখের উপর একরাশ চুলের অস্তিত্ব টের পেল। বাম হাতে চুলগুলো সাবধানে সরিয়ে নিল। মাথা উঁচু করতে নাকে চিরপরিচিত গন্ধ এসে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
(চলবে….)