শেষের পঙক্তি পর্ব-০১

0
994

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

এয়ারপোর্টের বহিরাগমন গেইটে এসে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটিকে দেখে তূরের হৃৎপিন্ডের গতি যেন দ্রুততর বে’গে কম্পিত হচ্ছে! যেন মনে হচ্ছে এখনি বক্ষ গহ্বরের পঞ্চম পাঁজরের ফাঁক থেকে ছি*টকে বেরিয়ে আসবে। নানারকম উদ্ভট চিন্তা-ধারা তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। তূর যেই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্থানেই কিয়ৎক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রয়। বহু সময় প্রতীক্ষার পর প্রিয় মানুষটাকে দেখায় তৃষ্ণার্ত আঁখিযুগল ছলছল করে উঠেছে তার। একজনের জোড়ালো ডাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফেরে তূর। তূরের সামনে রাফি ও অর্ক এসে দাঁড়ায়। রাফি ও অর্ক যখন দেখে তূর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তখন ওরা দুইজন সামনে এগিয়ে যায়। অর্ক তূরের মাথায় টো*কা দিয়ে বলে,

–কী রে কোথায় হারিয়ে গেলি? চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!

তূর কোন বাক্যব্যয় না করে অর্কদের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাফি ও অর্ক তূরের বড়ো বড়ো দুইটা লাগেজ নিয়ে নেয় হাতে। মিহাল রিজভির সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তূর, অর্ক ও রাফি ওদের কাছে যায়। তূর মিহালকে দেখে নিজের আঁখিযুগল আড়ালে মুছে নেয় অতি সন্তর্পণে। রিজভি তূরকে দেখে বলে উঠে,

–হ্যালো! আমি রিজভী। মিহালের ইউনিভার্সিটির বন্ধু ও রাফির সেই ছোটোবেলার বন্ধু। নাইস টু মিট ইউ।

তূর ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে জবাব দেয়,
–আমি তূরফা। নাইস টু মিট ইউ টু।

তূর এবার রিজভীর পাশে দাঁড়ানো মিহালের দিকে তাকায়। ফর্সা গড়নের ছেলেটিকে ভোরের সদ্য পরিস্ফুটিত আলোয় আরো স্নিগ্ধ লাগছে। মিহাল নিজের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–কেমন আছো তূর?

তূর মিহালের আঁখিদ্বয়ের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কতোটা প্রাণোচ্ছলতা তার চোখে। খুব কি ভালো আছে সে? খুব সুখে আছে সে তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে তাই না? তাহলে কি আমার দূরে চলে যাওয়াটা যুক্তিগত ছিল? দেশে ফিরে আসাটা কি তবে বোকামি?
এতসব প্রশ্ন তার মনের মাঝে উঁকিঝুঁকি করছে। তূর মলিন হেসে বলে,

–খুব একটা মন্দ না। আল্লাহ্ ভালোই রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?

মিহাল তূরের প্রতিউত্তরের বিনিময়ে তূরের মতো মলিন হাসি দেয়। তারপর বলে,
–আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

তারপর দুই জনেই চুপ হয়ে যায়। দুইজন যে নিজেদের মধ্যে একরাশ অস্বস্তিতে আছে তা দুইজনের মুখশ্রীতে দৃশ্যমান। রাফি পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি নিয়ে এসে ওদেরকে তাড়া দিয়ে বলে,

–পরে কথা বলিস তোরা। এখন গাড়িতে উঠ। গার্ডরা ঝামেলা করবে। জলদি উঠ। গাড়িতে উঠে চার বছরের জমানো সব কথার ঝুরি নিয়ে বসিস।

ওরা চারজন গাড়িতে উঠে। তূর ফ্রন্টে বসে আর মিহাল, অর্ক ও রিজভি ব্যাক সিটে বসে।

চার বছর পর তূর নিজের মাতৃভূমিতে পা রাখলো। চার বছর সে ভিনদেশে অনেক অচেনা মানুষের সাথে উঠা বসা করেছে। অচেনা শহরে গুটিকয় চেনা মানুষই ছিল তার পরিচিত। অচেনা মানুষের ভীড়ে নিজের অতি আপনজনদের অভাব প্রতিক্ষণে অনুভব করলেও রাত্রির শেষ প্রহরে একজনকে কারনে অকারনে ভীষণ ভাবে অনুভব করতো এবং করে। তাকে ছাড়া যেন জীবনের শেষ পঙক্তি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। কিন্তু আফসোস! তূরের হয়তো কোনো অস্তিত্বই নেই সেই মানুষটির জীবনের কোনো একটিও পঙক্তিতেও!

তূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির উইন্ডো নামিয়ে বাহিরের দৃশ্য অবলোকন করছে। নিকুঞ্জের এরিয়াটা খুব সুন্দর। গাছ-গাছালি লাগানো তার সাথে লেক। ভোর সকাল হওয়ায় শিতল আবহাওয়া স্নিগ্ধতার পরিচয় দেয়। রাস্তায় জ্যাম নেই এখন। ভোর ৫.৩০ টার কিছুটা সময় বেশি বাজে। নিকুঞ্জের পর কুড়িল ফ্লাইওভার হয়ে হাতিরঝিল আসবে। হাতিরঝিলের ব্রিজে অনেক অম্লিন স্মৃতি রয়েছে প্রাণের বন্ধুদের সাথে। অল্প সময়ই ঠিক তবে স্মৃতি গুলো মনের মাঝে স্মরণীয় হয়ে গেঁথে আছে। তূর হঠাৎ করে বলে উঠে,

–রাফি, গাড়ি থামা!

রাফি তূরের কথায় অবাক হয়। সে গাড়ি চালানো অবস্থায় বলে,
–এই মাঝ রাস্তায়? এখানে কি করবি? এতো সকালে এখানে কি করবি? আঙ্কেল আন্টি তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

তূর উদাসীন কন্ঠে বলে,
–আমার অপেক্ষা! তারা আমাকে এখন আমেরিকা থেকে আসতে মানা করেছিল। তারা নাকি দুই মাসের মধ্যে আমেরিকা যাবে। আমি অনেকটা জোর জবরদস্তি করে বাংলাদেশে এসেছি। বাড়িতে পরে যাব। এখন তুই হয় এখানে গাড়ি থামাবি নয়তো হাতিরঝিল হয়ে নিকেতন যাবি। নাদিয়া, ফাইজা, লিরা, জারিন, রণক, তাওহীদ, আসফি এদেরকে আসতে বল। আজকে সারা দিন আড্ডা হবে।

অর্ক গম্ভীর স্বরে বলে,
–তোর আজকে রেস্ট করা উচিত। লং জার্নি করে এসেছিস। কালকে নাহয় আয়। এমনিতেও কালকে ওরা সবাই ক্যাম্পাসে আসবে।

তূর নাকচ করে বলে,
–না! আমি বাড়ি যাবো না এখন। আমেরিকা থেকে আসার সময় আব্বু-আম্মুর সাথে ফোনে অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। এখন টায়ার্ড অবস্থায় বাড়ি গেলে আমি শান্তি পাবো না। প্লিজ ওদের আসতে বল।

মিহাল এতক্ষণ সব শুনছিল। এবার মিহাল বলে,
–তোমার রেস্ট করা দরকার তূর। পরে আরো টায়ার্ড হয়ে যাবে। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তো।

তূরের হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হলো। মিহালকে দেখলেই তার মন অস্থির হয় বটে পরক্ষণেই যখনই মিহালের কোন কথার মাঝে সে অন্য কাউকে নিজ মনে বুঝতে থাকে তখন প্রচণ্ড কষ্টে তার রাগ লাগে। যেই কারণে তার দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল! আজ সেই কারণটাই তার সামনে বারবার কড়া নারছে।

তূর রুঢ় ভাবে বলে,
–আমি তোমাকে আসতে বলি নি মিহাল! আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে আমার পরিবারকেও আমি নিষেধ করেছি কারণ আমি রাস্তার মধ্যে তাঁদের কোনো কথা শুনতে চাচ্ছিলাম না। আমি জাস্ট অর্ক ও রাফিকে আসতে বলেছিলাম। বাকিদের সারপ্রাইজ দিবো তাই বলি নি। এখন ওদের আসতে বলছি। আর তোমার প্রবলেম হলে তুমি চলে যেতে পারো। তোমার তো হাজারটা কাজ! আমি তোমাকে এখানে থাকতেও বলি নি। প্রবলেম হলে চলে যাও। তোমার জীবনে বিশেষ কারো গুরুত্ব আমি বুঝি। অহেতুক আমার জন্য সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। এতো কষ্ট করে ভোর সকালে নিজের ঘুম নষ্ট করে আমাকে রিসিভ করতে এসেছো তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি সত্যি এতোটা আশা করি নি।

মিহাল চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। মিহাল তৎক্ষণাৎ রাফিকে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–গাড়ি থামাও রাফি। আমি নামবো।

রাফি এবার লুকিং মিররে রিজভীকে ইশারা করে। রিজভী মিহালকে বলে,
–দোস্ত, দেখ তূর তো বললোই ওর ফ্যামিলির সাথে ওর কথা কাটাকাটি হয়েছে। এখন এজন্যই ও যেতে চাইছে না। পরে আঙ্কেল-আন্টি ফোন করলেই যাবে। তুই রেগে যাস না। বাদ দে।

মিহাল রাগী দৃষ্টিতে তাকায় রিজভীর দিকে। রিজভী রাত তিনটা বাজে আর্জেন্ট ফোন করে বলাতে এসেছে। এমনকি এয়ারপোর্টে আসার আগেও জানতো না কোথায় ও কেনো যাচ্ছে। রিজভী মিহালকে ইশারাতে শান্ত হতে বলে। মিহাল হাত মুঠ করে শক্ত হয়ে বসে আছে এখন। এই ভোর সকালে এসব কথাবার্তা তার সহ্য হচ্ছে না। না হবারই কথা। অহেতুক কথা শুনবে কেনো? আর কি এমন খা*রাপ কথা বলেছিল সে যে তূর এভাবে তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ করলো!

মিহালকে এভাবে বলতে চায় নি তূর। প্রচণ্ড খারাপ লাগছে তার। নেত্রপল্লব ভিজে উঠছে বারংবার। বাহিরের দিকে নজর সরিয়ে সে চোখ মুছে নেয় আবার লুকিং মিররে দেখে মিহালও লুকিং মিররে তাকিয়ে আছে। মিহালের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেনো রাগের আভাষ। সত্য বলতে, তূর যে দেশে এসেই মিহালের মুখোমুখি হবে তা তূর ভাবতেও পারে নি। এই মানুষটার মুখোমুখি না হওয়ার জন্য এতো দূরে চলে গিয়েছিল। সবকিছু পেছোনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। তূর নিজের মনে ভাবে,

“সে কি বোঝে না কিছু! নাকি বুঝেও না বোঝার মতো করে থাকে!”

মিহাল এদিকে নিজের মনে ভাবে,
“আমাকে বিনাদোষে কেনো দোষি বানায় সে? আমার কি করার আছে এতে! সবকিছুর জন্য সে আমাকেই দায়ি করে সে। যেখানে আমার কিছু করার নেই।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,