শেষের পঙক্তি পর্ব-১৮+১৯

0
517

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৮
তূরের মামা-মামী তূরকে জোর করে এটা ওটা খাওয়াচ্ছেন। তাদের বড় বোনের সন্তানরা তো দেশে কালেভদ্রে আসে। তাই ছোট বোনের সন্তানদের অধিক যত্ন করেন। তূর আবার অনেক বছর পর নানুবাড়ি গেলো। মামীরা খাবার মুখে তুলে খাইয়ে পর্যন্ত দিচ্ছেন। তিন মামারা তাদের বউদের কার্যকলাপে মুগ্ধ। তূরের নানু বসে বসে বউদের নাতনীকে আদর যত্ন করা দেখছেন। তূর খেতে খেতে হাঁপিয়ে গিয়ে বলে,

–আর না মামি। আমি রাতে এমনিতে খুব কম খাই। আর তোমরা তো আমাকে খাইয়েই চলেছো। ইলিশ পছন্দ বলে এখনি চার-পাঁচ পিছ দিবে! দুই পিছ খেয়েছি ঢের আমার জন্য। আর দেশি মুরগীর কষাটা নিশ্চয়ই বড় মামি করেছো? ঝাল ঝাল আহা! ঢেঁড়শ ভাজিটাও অনেক মজা। আর এই ডিম ভুনা? আমাকে তোমরা ডিম খাওয়ানোর জন্য এতো উতলা হও কেনো বলোতো? বাসায় তোমাদের ননদটাও আমাকে দিনে দুই-তিনবার ডিম সিদ্ধ করে দেয়। আমি তো ডিম খাই তবে প্রতিদিন এতো খেতে ভালো লাগে না।

তূরের বড় মামী প্লেটে দেশি মুরগীর আরেক পিছ দিয়ে বললেন,
–তোরে কি বড়ো আপা খাওয়াতো না? তুই আরও শুকিয়ে গেছিস কেন? জাহিনরা তো মাশাআল্লাহ স্বাস্থবান। এই মেঝো ওরে আরও খাওয়া।

তূর অবাক হয়ে বলে,
–কি বলো! খালামনি আমাকে খাওয়ানোর জন্য কতো কিছু করতো তবে আমি সারাদিন ক্যাম্পাসেই থাকতাম। রাতে তার জোরাজোরিতে খেতে হতো অনেকটা।

তূরের মেঝো মামি ভাত মেখে খাওয়াচ্ছেন আর ছোটো মামি বাচ্চাদের কোলে নিয়ে তূরের খাওয়া দেখছেন তৃপ্তি নিয়ে। খাওয়া দাওয়ার পালা শেষে তূর ওর মামাতো বোনদের সাথে ঘুমাতে গেলো। নেট অন করার পর দেখলো অর্কদের সাথে যে মেসেঞ্জারে গ্রুপ আছে সেটাতে ওরা অনেকগুলো মেসেজ করেছে। এই গ্রুপে মিহাল, রিজভী ও তাইজুল নেই। তূর মেসেজগুলো পড়ে দেখলো না। তবে রাফি বাদে সবাই মেসেজ করে রেখেছে। একটা মেসেজ পড়ে বুঝলো সবাই মিহালকে নিয়ে হবে। তূর রিপ্লাই করার ইচ্ছা পোষণ করলো না।
মিহালকে সে অনেকটা ভালোবাসে বলেই অন্য কাউকে বিয়ে বা ভালোবাসা তূরের পক্ষে সম্ভব না মন থেকে। তূর জানে মিহালও তাকে ভালোবাসে। তূর নিজের ভাবনাকে আর গভীরে নিতে চাইলো না। তার ঘুম প্রয়োজন।

_______
সূর্য রশ্নির তেজস্বী কিরণে বিভাসিত ধরণী। বৈশাখ মাস পেরিয়ে জৈষ্ঠতে পদার্পণ করেছে প্রকৃতি কিন্তু নেই তেমন কোনো পরিবর্তন। ফল পাকা ছাড়া লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় না। তিন চার দিন পর রোজা শুরু। রোজার ঈদের সপ্তাহ দুয়েক পর তূর ফিরে যাবে আমেরিকায়। আমেরিকায় রোজা অনেক লম্বা। চার বছরে রোজার তুলনায় এবার একটু স্বস্থির হবে।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর তূরের বাবা বাড়ি ফিরলে তূর ওর বাবা-মায়ের রুমে যায়। তূরের বাবা ফ্রেশ হয়ে চা পান করছেন সাথে মোবাইলে নিউজ দেখছেন। তূরের মাও চা পান করছেন। তূরকে বসতে দেখে তূরের বাবা একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ব্যাস্ত। তূর ওর বাবাকে উদ্দেশ্যে ইতস্তত করে বলে,

–বাবা।

তূরের দিকে তাকায় তার বাবা। তূর আড়ষ্ট ভাবে বলে,
–আমি যদি কাউকে বিয়ে করতে চাই তবে কি তুমি তাকে মেনে নিবে?

তূরের বাবা চায়ের খালি কাপটা রাখলেন তারপর চশমাটা আরেকটু ঠেলে দিয়ে মেয়ের দিকে গভীরভাবে তাকালেন। তূর তার হাত কচলাচ্ছে। কাল রাতে মেসেজ গুলো না পড়লেও দুপুরে বাড়ি ফিরে সবগুলো পড়েছে। তূরের বাবা তূরকে কোনো প্রতিউত্তর করছে না যা তূরকে আরও অস্বস্তিতে ফেলছে। তূর বলে,

–বলো না বাবা?

তূরের বাবা শান্ত স্বরে বলেন,
–কি বলবো? তুমি যে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইবে না তা আমাদের জানা হয়ে গেছে। এখন নিজ থেকে যাকে বিয়ে করতে চাইবে করো।

তূরের খারাপ লাগলো। তূর কিছু না বলে উঠে চলে যায়। রমজান মাসে আল্লাহর কাছে সাফ মনে কিছু চাইলে আল্লাহ্ ফেরান না। ইবাদাতে তূর এক মাস কাটানোর চিন্তা করলো। দুটি মনের পার্থনা এক হলে দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এদিকে দুটি মন একে অপরকেই চায়।

________
ডাক্তার ইফতি তার বাবা-মাকে নীরার কথা জানায়। ইফতির বাবা-মা ছেলের সিদ্ধান্তে যারপরনাই খুশি। কম তো বছর পেরোলো না। দশ বছরের বেশি হলো। এবার যদি একটু সুখের মুখ দেখে হাসিখুশি থাকে তাদের ছেলে। ইফতির বাবা-মা নীরাকে দেখতে যেতে চান। রোজার আগেরদিন যাবেন ভাবলেন। ইফতি তূরের থেকে বাড়ির ঠিকানা নেয়। ইফতির বাবা-মায়ের নীরার ছবি দেখে পছন্দও হয়েছে।

তূর ওর বাবা-মাকে বলেছে নীরা ও ইফতির ব্যাপারে। তারা বড় মেয়ে রেখে মেঝো মেয়ের বিয়ে দিবেন কিনা ভাবছেন। সন্ধ্যার সময় উনারা আসলে তূর, তার মা ও চাচি মিলে আপ্যায়ন করছেন। নীরাকে নাফিহা ব্যাপারটা জানালে নীরা লজ্জায় নিজের রুমের দরজাই খুলছে না। ইফতির বাবা-মা এর সাথে তূরের বাবা-চাচা কথা বলছেন। ইফতি তূর্যকে নিয়ে বসে আছে। তূর্য ইফতিকে দেখে চারিপাশে ঘুরছিল তাই ইফতি পাশে নিয়ে বসে আছে। তূরের বাবা ইফতির বাবা-মাকে জানালেন, তার বড় মেয়ের বিয়ে হয় নি। এমতাবস্থায় মেঝো মেয়ের বিয়ে দিবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। ইফতির বাবা বিনয়ের সাথে বলেন,

–আপনার ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা বলবো না এখনই বিয়ে দিতে। রিং পড়িয়ে রাখতে পারি। তারপর আপনার বড় মেয়ের বিয়ের সময় বা পর ইফতি ও নীরার বিয়ে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আমার বোন ও বোন জামাই কয়েকদিন পর নীরাকে দেখতে আসবে। ওরা সঠিক সময়ে টিকিট পায় নি বলে রোজার পরই আসবে। নীরাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।

তূরের বাবা মুগ্ধ হলেন ইফতির বাবার বিনয়ে। তূরকে বলা হলো নীরাকে পরিপাটি করে নিয়ে আসতে। তূর তাই করলো। নীরা ও তূরকে একত্রে দেখে ইফতির মা উৎফুল্লতার সাথে বললেন,

–আমার আরেকটা ছেলে থাকলে আমি আপনার বড় মেয়েকেও চাইতাম। মাশাআল্লাহ আপনার তিন মেয়ে।

তূরের বাবা কিছুটা বিব্রত হন। তূরও হাসফাস করছে এখান থেকে যাওয়ার জন্য। বলা যায় না, ইফতির মা আবার তার কোনো আত্মীয়র জন্য তূরের বিয়ের সম্ভন্ধ নিয়ে আসে! নীরাকে দেখে উনারা কোনো প্রশ্ন করলেন না। ইফতি আগেই নীরার ব্যাপারে সবটা জানিয়েছিল। ইফতি নীরার লজ্জায় অবনত মুখশ্রী দেখে মুগ্ধ। সামান্য পরিপাটি হওয়াতেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রূপের সৌন্দর্য নয়! এটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা। ইফতির মা নীরার হাতে রিং পরিয়ে দেন। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন। ইফতি ও নীরাকে আলাদা কথা বলতে তূরের রুমের ব্যালকনিতে পাঠায়। দুইজন দুজনকে একাকি কথা বলতে গিয়ে নিশ্চুপ। কিয়ৎক্ষণ পর ইফতি নিরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠে,

–তুমি আমার অতীত মেনে নিতে পেরেছ? কারণ আমি চাই না ভবিষ্যতে সেটা নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। তোমার নাম নীরা বলে তোমাকে বিয়ে করছি, এমনটা ভেবো না। তুমি আমার মনের আঙিনায় প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছ বলেই তোমায় আমি নিজের অর্ধাঙ্গিনী করতে চাই। আমার কাজিন নীরার পর কেউ আমার মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। কেনো পারে নি সেটার কারণটাও আমার অজানা। এমন না যে কোনো রূপের অধিকারী কেউ আমার সামনে পরে নি! পরেছে। কিন্তু আমার মন সায় দেয় নি। তোমার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম।

নীরা নত মস্তকে সবটা শুনলো তারপর ইফতির চোখের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসির রেখা। নীরা বলে,

–হ্যাঁ, সবটা আমি ভেবেছি আর মেনেও নিয়েছি বলে আজ আমি আপনার নামে রিং পরেছি। মানতে না পারলে এই রিং (নিজের বাম হাতের রিং ফিঙ্গারকে দেখিয়ে) আমার আঙুলে উঠতো না।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৯
ইফতিরা চলে গেল। নীরার মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসির রেশ লেগেই আছে। নীরার মনে যেন বসন্তের রঙ লেগেছে। নীরা তূরের রুমের বারান্দা থেকে এখনও যায় নি। আঁধারের মাঝে নিচে জ্বালানো সোডিয়াম লাইট সাথে চন্দ্রমার প্রেমময় জোৎসনার আবছা আলোতে নীরা গুনগুন করতে থাকে,

“হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই(২)
দুইকে এক করি-না, আমি এককে করি দুই।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই
দুইকে এক করি-না, আমি এককে করি দুই।”

তূর শব্দহীন পায়ে এসে বারান্দার দরজার কাছে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। বোনের গুনগুন করা শুনছে। আড়াল থেকে তূর এবার বাকি লাইন গাইলো,

“আমার যত ইচ্ছে গুলো তোমার মনে জায়গা দিও,
তুমি ছাড়া আমার কেহ নাই।
তোমাকে আমি ভালোবাসি, থাকো না আজ কাছাকাছি, তোমার মাঝে আমাকে হারাই।
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই(২)”

নীরা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও তূরকে দেখে মুচকি হেসে একটু সরে বসে। তূর পাশে বসে। তারপর দুজনেই নিরব। নীরা তূরকে প্রশ্ন করলো,

–বাবা-মা তোর আগে আমায় বিয়ে দিবে আপু?

তূর নিঃশব্দে হাসে। তূর নীরাকে বলে,
–জানি না। এসব রাখ। তুই তোর রুমে যা। তোর ফোন বাজছে শোনলাম। জলদি যা। দেখ ডাক্তার ইফতি ফোন করেছে বোধহয়!

তূর শেষের কথাটা দাঁত কে’লি’য়ে বলে। নীরা লজ্জা পেয়ে তূরের বাহুতে আলতো আ’ঘা’ত করে চলে যায়। তূর মুচকি হাসে তারপর ছন্দ কাটে,

“মন উদাসী হোক কিছুটা তার, কিছুটা আমার।
স্বপ্ননীল রংধনু ভালোবাসার ছটায় রাঙুক।
একটু অভিমান, একটু অভিলাষ,
দূরত্বে ভালোবাসা বাড়ুক।”
[তিথী]
___________
রমজান মাস এসে শেষের দিকে। তূরের মিহালের সাথে দেখা হয় নি। দেখা না হলেও মাঝেমধ্যে দুজনের ফেসবুক ডে তে দেখা যায়, অদৃশ্য সম্ভোদন। “কাল্পনিক সে” কে নিয়ে তূরের আর “তৃষ্ণার্ত প্রেমিক তার প্রেয়সীকে” নিয়ে মিহাল। দুজনের এরূপ সম্ভোদনে বন্ধুমহল বি’র’ক্ত আবার আবেগে আপ্লুত। বন্ধুমহলের সকলের ইচ্ছে করে দুটোকে ধরে বেঁধে রি*মা-ন্ডে নিতে। যাতে করে দুজনে নিজেদের মনের যত রা’গ-অভিমান, কস্ট উগলে দেয় নিজেদের সামনে।
রমজানের শেষের দিকে বন্ধুদের সাথে ইফতার পার্টির আয়োজন চলছে। তূর মিহালকে দেখেও যেন দেখছে না। তূরের ভাবটা এমন যে, “কে আপনি? কোথা থেকে এসেছেন?”
মিহাল উসখুস করছে তূরের সাথে একটু কথা বলার কিন্তু পেরে উঠছে না। মিহালের আগের কথা না বলার স্বভাবটা যেন ঝেঁকে বসেছে তার উপর। মিহাল রাফির সাথে বসে আছে। রাফির পাশে অর্ক আর মিহালের পাশে রিজভী। মিহাল নিজের নজর নিবদ্ধ করেছে সামনে কিছুটা দূরে বসা তূরের মুখপানে। অর্ক রাফিকে টপকে মিহালের পিঠে ঘু*ষি দেয়। মিহাল অর্কর দিকে ভ্রঁ কুঁচকে তাকালে অর্ক রা’গী দৃষ্টিতে ইশারা করে। মিহাল সেটা দেখে অসহায়ের মতো ইশারা করে। বাকিরাও মিহালকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মিহাল তূরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–তূর। ইফতারের পর একটু কথা আছে।

তূর এক পলক তাকিয়ে আবার আজানের অপেক্ষা করতে থাকে। রাফি ওদের একজনের বা’ঘ ও বি’ড়া-লের স্বভাব দেখে নিজেই গলা ঝেড়ে বলে,

–তূর আপা, আপনি কী খুব রাগ করেছেন? আপা আপনি আমাদের সাথেও কথা বলতেছেন না ঠিক মতো। কিছু হইছে আপা?

তূর বেজায় রে’গে গেলো। তূর নাক ফুলিয়ে বলে,
–মি’র-জা’ফরগিড়ি করার সময় মনে থাকে না তোদের? আমার ফ্রেন্ড হয়ে কেমনে আমার বিপক্ষে ষ’ড়য’ন্ত্র করিস?

রাফি সেন্টি ইমোজির মতো করে হাসি দেয়। তূর চোখ ছোট ছোট করে বলে,
–হাসিস না। দেখিস তুই সিঙ্গেল ম*র-বি। আর অর্ক? তোর বউ হবে দ*জ্জা-লনী। তোরে সারাদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে।

অর্ক চোখ বড় বড় করে কিছু বলতে নিবে তখনই আজান হয়। ওরা ইফতার শুরু করে। ইফতারের পর তূরকে মিহাল আবার ডাকে আস্তে করে। তূর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে লিরাদের সাথে। জারিন তূরকে বলে,

–দোস্ত, ডাকছে তো। যা না। বেচারার মুখটা শুকায়ে গেছে দেখ।

তূর জারিনের দিকে ভ্রঁ উঁচিয়ে তাকায় তারপর মিহালের দিকে তাকায়। মিহাল আসলেই অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তূর বাঁকা হেসে বলে,
–রোজা রাখছে তো। তাই চোখ-মুখ তোর কাছে শুকনো শুকনো লাগছে। তাছাড়া বা-ঘকে বি*ড়া-লে কনভার্ট হতে দেখে আমার খুশি খুশি ফিল হচ্ছে। ভাবা যায়! রাগী ইন্ট্রোভার্ট মিহাল এখন অসহায়ের মতো চেয়ে আছে! শান্তি লাগছে জানিস? চার বছর আমি এর থেকে হাজার গুন কস্ট পেয়েছি। তবে আমি তাকে বেশি কস্ট দিবো না। একটু তার অসহায় নজর দেখতে মজা লাগছে।

ফাইজা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
–এদিকে তুই যে দুই বছরের মতো ফেসবুক ডিএক্টিভ করে রেখেছিলি সেটা? তুই চলে যাবার পর রাফি রিজভীর মাধ্যমে মিহালের সাথে যোগাযোগ করে অনেক কস্ট করে। রিজভী যে মিহালের বন্ধু তা রাফি যখন জানতে পারে তখনই যোগাযোগ করে। মিহাল তোর মে’ন্টাল ট্রমার কথা শোনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ততোদিনে মিহাল বুঝে গিয়েছিল তোকে সে খুব ভালোবাসে। এরপর তোর সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তুই তো আমাদের কারও সাথে যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক ছিলি না। এরপর দুই বছর পর তুই ফেসবুক এক্টিভ করলে মিহাল মানা করে তোকে ভার্চুয়ালে কিছু জানাতে।

তূর বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
–আমি ফেসবুকে ছিলাম না ছয় মাসের জন্য। তারপর অন্য অ্যাকাউন্ট দিয়ে ছিলাম। ফে’ক ছিল সেটা। যাইহোক, আমি মিহালকে মেনে নিবো তবে তাকে কনফিউশনে রাখতে চাই রোজা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত।

মিহাল তূরকে আবারও ডাকে। তূর এবার যায়। মিহাল তূরকে একটা চকলেট বক্স দেয় যাতে ক্যাটবেরি চকলেটের প্রতিটা ভেরিয়েশন একটা করে আছে সাথে ডার্ক চকলেট ও বলের মতো চকলেটও আছে। তূরের চকলেট পছন্দ অনেক। তূরের চোখে-মুখে লুকিয়িত খুশির ছাঁপ। মিহালের সামনে তাও মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। তূরকে অবাক করে দিয়ে মিহাল তূরকে একটা শাড়ির বক্স গিফট করে যাতে বেনারসি আছে। তূর এবার হতভম্ব হয়ে মিহালের দিকে তাকায়। মিহাল হেসে মাথা চুলকিয়ে বলে,

–শাড়িটা মায়ের পক্ষ থেকে।

তূর তো আরও অবাক হয়। মিহালের মা তো তানজিনাকে মিহালের বউ করার জন্য উতলা ছিলেন। তানজিনার সাথে বিয়ে ভেঙে যাবার পর তো উনার তার ছেলের উপর ও তূরের উপর রাগ হয়ে থাকার কথা! তূর অবাক হয়েই প্রশ্ন করে,

–তোমার মা আমার উপর রেগে নেই?

মিহাল চোখে হাসে। তারপর বলে,
–উহু। ছিল তবে এখন নেই। সব ক্রেডিট আব্বু, আপু ও দুলাভাইয়ের। এতোদিন তারা যে কিভাবে মাকে বুঝিয়েছে জানি না। আমাকে পরশুদিন মার্কেট থেকে এসে হাতে এই শাড়ির বক্স ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা যেনো তার হবু পুত্রবধুর কাছে পৌঁছে দেই। মায়ের কথাতে আমিও অনেকটা অবাক হয়েছিলাম। তানজিনার সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পর আমিও মায়ের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না। বিয়ে ভেঙেছে একমাস হতে চলল। মাও খাবার দেয়া ছাড়া কথা বলতেন না। খারাপ লাগতো অনেক জানো। যাইহোক, মায়ের দেয়া উপহার কী তুমি নিবে?

তূর লাজুক হাসে তারপর বলে,
–আন্টিকে বলো, সে নিজেই যেনো এটা আমায় দেয়। তাতে আমার খুশি আরও দ্বিগুন হবে। সে দেওয়া মানে আমার পরিবারকেও সম্মত করা।

তূর চকলেটের বক্স নিয়ে মুচকি হেসে চলে আসে। নাদিয়া, লিরারা তূরের হাতে চকলেটের বক্স দেখে দাঁত কে’লি’য়ে ভাগ নিতে আসছিল। তূর ওদের মুখ ভে’ঙচি দিয়ে বক্স সরিয়ে নেয়।

আরও কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ওরা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হয়। তূর মিহালের সাথে যাচ্ছে। দুজনে একদম নিরব কোনো এক অদৃশ্য কারণে। চুপচাপ থাকতে থাকতে গন্তব্য এসে যায়। তূর বাসায় পৌঁছে সবার আগে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। চকলেটের বক্স খুললে এক ফালি সাদা কাগজের টুকরোতে গোটা অক্ষরে লেখা,

“হাসিতে তার মুক্তঝরা,
কান্নায় তার সাগর শুকায়।
তার অনুরাগের অতলে,
আজও আমি কূল-কিনারার খোঁজে।”
[তিথী]

অধর এলিয়ে সুখের হাসি অম্লিন থাক।

_________

তানজিনার জুন মাস থেকে কানাডার ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হবে। তানজিনা ইতোমধ্যে নিজের ভার্সিটির থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে। সারাদিন বাসায় থাকে এখন সে। ইনায়া বাসায় আসলেই যা একটু কথা হয়। ভিসা পেয়ে গেলে তানজিনা চলে যাবে কানাডা।
এদিকে প্রফেসর আরিফের মা প্রফেসর আরিফের বিয়ের জন্য বলছে। বিয়ের কনে প্রফেসর আরিফের খালাতো বোন। যে কি-না অসুস্থ। প্রফেসের আরিফের খালাতো বোনের দুইটা কিডনিরই ৮০% ড্যামেজ। শরীর অনেকটা দুর্বল তাই চারটা ডায়ালাইসিস করা হয় মাসে আর ঔষুধ তো আছেই। মেয়েটার নাম প্রমিতি। ছোট থেকেই সে তার খালাতো ভাইকে পছন্দ করে। অসুস্থ মেয়েটার ইচ্ছে সে তার খালাতো ভাই আরিফের বউ হবে। প্রমিতির বয়স ২০। এই কম বয়সেই সে নিজের মধ্যে বিশাল রোগের আক্রমণে জর্জরিত। প্রফেসর আরিফের কাছে যখন প্রমিতি হসপিটালের বিছানায় শুয়ে হাত ধরে বলেছিল,

“বিয়ে করবে আমায়? বেশিদিন তোমায় জ্বালাবো না তো। চলে যাবো ওই দূর আকাশে। শেষ সময়ে আমার জীবনের শেষ পঙক্তিটুকু হবে?”

প্রফেসর আরিফ এরপর রাজি হয়। শেষ রোজার দিন ইফতারের পর ওদের বিয়ে হবে। প্রফেসর আরিফ তার নিজের মনে আদৌতেও কারও জন্য কিছু আছে কি-না জানে না। কিন্তু প্রমিতির ভালোবাসা আগ্রাহ্য করতে পারে নি।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।