শেষ থেকে শুরু ২ পর্ব-২০

0
494

#শেষ_থেকে_শুরু_২🌸
#পর্ব_২০
#নন্দিনী_চৌধুরী

৩৬.
আগরবাতির ঘ্রাণ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে থাকা লাশ খাটিয়াটাও এখনো আছে হয়তো একটু পর এটা মসজিদে চলে যাবে। আজকের সূর্যটা তেমন আলো ছড়ায়নি হয়তো সেও বুঝতে পেরেছে কোথাও কারো আপনজন হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।

সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে মুগ্ধ তার পাশে বসে আছে মেহের। ওদের সামনের সোফায় বসে আছে সামিয়া ওর স্বামী আর মাহফুজ। সবাই চুপচাপ বসে আছে কারো মুখে কোনো কথা নেই। মৃত্যুটা স্বাভাবিক তবে এভাবে যে হঠ্যাৎ করে হবে কেউ ভাবেনি। সবাই এটাই ভেবে হতাসায় আছে সায়মার এবার কি হবে। সায়মা নিজের ঘরে নিজেকে ঘরবন্ধি করে রেখেছে। তার ভিতর আসতে আসতে একটা অনিশ্চিত জীবন বেড়ে উঠছে। যেই মরণব্যাধি রোগ ওর শরীলে সেটায় ও আর এই প্রানটাও ঝুঁকিতে আছে।

সায়মা নিজের রুমে জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবছে গতকাল রাতে আরিশ তার সাথে অনেকটা সময় কথা বলেছে। তার সাথে একসাথে বসে খেয়েছে। এই ৪মাস পর কাল রাতেই তারা এক সাথে খেয়েছে আর সেটাই যে শেষ খাওয়া ছিলো সেটা কেউ জানতোনা। তারপর দুজনের ঘুমাতে গেলো। কিন্তু আজকের সকালটা সায়মার দেখা হলেও আরিশের আর দেখা হলোনা। চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে গেলো সে। সায়মা যখন ডাকার পরেও আরিশ সাড়া দিলোনা সায়মা বুঝতে পারলো আরিশ চলে গেছে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। সায়মা সাথে সাথে বোনকে খবর দিলো। তারপর একে একে সবাই এলো। তারপর আরিশকে শেষ গোসল দেওয়া হলো তারপর দেওয়া হলো বিদায়। আচ্ছা পরোকালে কি ওদের দেখা হবে? জানেনা সায়মা সেটা।

চুপকরে মাথা নিচু করে বসে আছে মুগ্ধ। বুকের মাঝে কেনো জানি কষ্ট হচ্ছে ওর। দীর্ঘ একটা সময় এই লোকটার সাথে সে ছিলো। হয়তো এখন বিচ্ছেদ হয়েছে ঠিকি তবে মায়াটা রয়েগেছে। আরিশের ইচ্ছাটা রাখতে তাইতো ছুঁটে এসেছে মুগ্ধ। ঠিকই ওর লাশটাকে এসে দেখেছে ও। শেষ বিদায় ও জানিয়েছে। এই লোকটাকে আর কোনোদিন দেখা হবেনা।

মুগ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাথা উঠিয়ে চারিপাশটা দেখছে। এই ঘরেইতো একটা সংসার বেঁধেছিলো সে। কিন্তু আজ সব শেষ! মুগ্ধ উঠে সায়মার রুমে যায় এই সময়টা ওর জন্য খুব কষ্টের। মুগ্ধ মাস্ক পরে সায়মার রুমে আসে। সায়মা নিজ ভাবনায় থাকায় বুঝতে পারেনা যে কেউ ওর রুমে আসছে। মুগ্ধ এসে সায়মাকে ডাক দিলো,,,
মুগ্ধ:সায়মা!
কারো ডাকে হুস আসে সায়মার পিঁছনে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ এসেছে। মুগ্ধকে দেখে চোখ নামিয়ে নেয় সায়মা। কেন জানি লজ্জা লাগছে মুগ্ধের দিকে তাকাতে ওর।
মুগ্ধ গিয়ে সায়মার পাশে দাঁড়ায় আর বলে,
মুগ্ধ:ছোট থেকে তোকে আমি অনেক আদর ভালোবাসা দিয়েছি। কোনোদিন তোকে চাচাতো বোন ভাবিনি নিজের বোন ভেবেছি। তুই যদি একটা ভুল করতি তবে তোকে বাঁচিয়ে আমি সেটার মার খেতাম। আসতে আসতে তুই বড় হলি কিন্তু তোর মধ্য খারাপ দিক গুলো তৈরি হতে লাগে বেশি। আমাকে সয্য করতে পারতিনা এসব করতে বাধা দিতাম বলে। যেদিন তুই নেশা করেছিলি আমার সামনে সেদিন বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু চাচাকে কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। চাচা নিজেই দেখেফেলেছিলো এসব। তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো কত বলেছিলাম ফিরিয়ে আনতে। তুই তো এই রাগেই আমাকে আরিশের থেকে সরিয়েছিস তাইনা। এতে আমার আফসোস নেই। কেনো নেই জানিস কারণ এতে আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভালোবাসার শক্তি কম ছিলো। যাই হোক মানুষটা মারা গেছে তাকে নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। বলতে চাই তোকে,,,একটা প্রান এখন তোর ভেতরে। তোর সাথে সেও ঝুঁকিতে আছে। তোদের বাঁচানোর সব চেষ্টা আমরা করবো। তবে তুই আশা করি এবার ভালো হয়ে যাবি। অন্ততপক্ষে এই বাচ্চার কথা ভেবে হলেও।
মুগ্ধের কথায় সায়মা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। মুগ্ধের পা জরিয়ে ধরে হাইমাউ করে কাঁদতে লাগে আর বলতে থাকে,,,
সায়মা:আমাকে মাফ করে দেও আপু আমাকে মাফ করে দেও। আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি। এতো বড় পাপ করেছি যে আল্লাহ নিজেও আমার প্রতি নারাজ। আমি জেনা করেছি পরকিয়া করেছি এসবের কোনো ক্ষমা নেই আপু কোনো ক্ষমা নেই। আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমার স্বামীর হক তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছি এসবের শাস্তি আজ আমি পাচ্ছি। আমার কোনো মাফ নেই আমি জানি। তবুও বলছি আমায় মাফ করে দেও আপু।

মুগ্ধ সায়মার কাজে অবাক হয়। সায়মাকে উঠানোর চেষ্টা করছে মুগ্ধ।
মুগ্ধ:সায়মা উঠে দাঁড়া। এই অবস্থায় এভাবে ঝুঁকতে হয়না।
মুগ্ধ সায়মাকে কোনোভাবে উঠালো। তারপর শান্ত করলো সায়মাকে।
মুগ্ধ:আমি তোর উপড় রেগে নেই পাগলি। আমি আমার ভাগ্যোকে মেনে নিয়েছি। এখানে কারো কোনো দোষ নেই। তুই নিজেকে অপরাধী ভাবিস না আর।
মুগ্ধ সায়মাকে শান্ত করে নিচে নিয়ে আসলো। এরপর সামিয়া আর চাচাকে বুঝিয়ে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিলো সায়মাকে। মেহের আরিশের সব সম্পত্তি উইল বানিয়ে সায়মার মানে করে দিয়েছে। যাতে আগামীতে সায়মার চলতে সমস্যা না হয়।

সময় সমুদ্রের স্রতের মতো চলে যায়। আরিশ মারা গেছে ২সপ্তাহ পার হয়েগেছে। এর মাঝে মুগ্ধ গিয়ে সায়মাকে দেখে এসেছে। আগের কিছু মনে রেখে কষ্ট পেতে চায়না কেউ। তবে সব ভুলে যাওয়া কি সম্বভ? মুগ্ধ নিজের মনের কথা শুনতে গিয়ে বার বার মস্তিস্কের ভয়কে প্রধান্য দিয়ে দিচ্ছে। তাইতো এগোতে পারছেনা সাদাফের দিকে।

রুহি আর মেহেরের বিয়ে তারিখ ফালানো হবে খুব তাড়াতাড়ি। মেহেরের খুব ইচ্ছা ওর আর ওর বোনের বিয়ে এক সাথে হোক। কিন্তু মুগ্ধতো সাদাফের দিকে এগোতে পারছেনা। সাদাফের মা মেহেরের কাছে এসে হাত চেয়েছে মুগ্ধের জন্য। মেহের জানিয়েছে মুগ্ধের ইচ্ছাই সব হবে।

৪মাস পর,,,,,,
সাদাফ রেডি হচ্ছে মুগ্ধের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য। মুগ্ধ গতকাল রাতে তাকে দেখা করার জন্য কল দিয়েছে। ৪মাস আগে মুগ্ধ ওদের বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছে। মুগ্ধ নিজেকে সময় দিতে চায়। নিজেকে একটু একান্ত রাখতে চায় তাই ওর এমন সিদ্ধান্ত। সাদাফ এই সিদ্ধান্তে কোনো অমত করেনি। এক বাক্যে রাজী হয়েছে। সাদাফ রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলো মুগ্ধের বলা জায়গায় যাওয়ার জন্য। ঘন্টা খানেকের ভিতরে পৌঁছে গেলো সে সেই জায়গায়। জায়গাটা একটা নদীর পারে। এখানেই আসতে বলেছে মুগ্ধ সাদাফকে। সাদাফ এখানে এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মুগ্ধের। কিছু সময় পর পিঁছন থেকে একটা কাঙ্খিত কন্ঠের আওয়াজ পেলো সে পিঁছনে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো সাদাফ। কারণ তার সামনে মুগ্ধ দাঁড়িয়ে তবে এক নতুন রূপে।
মুগ্ধ একটা কালো রং এর শাড়ি পরেছে দুই হাত ভর্তি কালো চুড়ি। চুলগুলো খোপা করা। একদম সাজ নেই কোনো। এতেই মুগ্ধকে একদম মায়ামই লাগছে সাদাফের কাছে।
মুগ্ধ সাদাফের দিকে এগিয়ে আসলো।
মুগ্ধ:বেশি সময় অপেক্ষা করালাম নাকি?
মুগ্ধের প্রশ্নে সাদাফের হুস আসলো। সাদাফ হাঁসি দিয়ে বললো,
সাদাফ:এমন অপরূপ একজন নারীকে দেখার জন্য আকি যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে রাজী আছি। এই অপেক্ষার মাঝেও একটা ভালোলাগা আছে।
মুগ্ধ সাদাফের কথা শুনে মিষ্টি হাঁসি দিলো।
সাদাফ:তো কি বলার জন্য আসতে বললা?
মুগ্ধ: হুম বলছি আসুন ওদিকে যাই।
সাদাফ মুগ্ধ পাশাপাশি হাঁটছে। মুগ্ধ সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
মুগ্ধ:আমি যখন ছোট তখন আমার মা বাবা দুজনে মারা যায়। তারা মারা যাওয়ার পর আমাকে আমার চাচ্চু তার কাছে নিয়ে আসে। বাবার ভালোবাসা কোনো কমতি সে রাখেনি যতটা পেরেছে দিয়েছে। কিন্তু আমার চাচি আমাকে ভালোবাসতে পারেনি সেখানে অবশ্য তার দোষ নেই। তার সাথে যা হয়েছিলো এরপর এটা স্বাভাবিক। আমার ভাইকে আমার মামা নিয়ে গেলো তাই ভাইয়ের ভালোবাসাটা ছোট বেলায় পাইনি। মা ভাইয়ের ভালোবাসার অভাবটা অনেক ছিলো। এরপর বড় হলাম গেলাম স্বামীর ঘরে ভেবেছিলাম স্বামী আমাকে অনেক ভালোবাসবে কিন্তু না সেখানেও কপাল আমার খারাপ। ভেংগে গেলো স্বামীর ঘরটাও। এতে আমি তার দোষ দেবোনা। কারণ মানুষটা এই দুনিয়াতেই নেই। একটা নারীর জীবনে মাতৃত্বের সুখ অনেক বড়। আমার কপালে সেই সুখটাও ছিলোনা।
কিন্তু আমি যেদিন প্রাপ্তিকে আমার কোলে নেই সেদিন নিজেকে অনেক সুখি মনে হয়েছিলো। প্রাপ্তির মুখ থেকে প্রথম মা ডাকটা আমাকে অনেক আনন্দিত করেছিলো। প্রাপ্তিকে একদম নিজের মেয়ে মনে হতো। এরপর আপনার আমাকে ভালোবাসার কথাটা বলা। কেন জানি আপনাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করতো। কিন্তু অতীতের কথা ভাবলেই ভয় করতো। তাই নিজেকে নিজের সময় দেওয়া আপনার থেকে দূরে থেকে দেখছিলাম আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা।

বিশ্বাস করুন প্রতিটা মূহূর্তে আপনার কথা ভাবতাম। মনে হতো খুব কাছের কিছু দূরে রেখে এসেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার মনে আপনি গেঁথে গেছেন। হ্যাঁ ভালোবেসে ফেলেছি আমিও আপনাকে। আমার জীবনের একটা নতুন শুরু করতে চাই আমি আপনার সাথে সাদাফ সাহেব। আমার জীবনের শেষ থেকে শুরু হবেন কি আপনি?
আমি প্রিয়া আপুর জায়গা নয়। আমি আমার নিজের একটা জায়গা করতে চাই আপনার মনে।

এতোক্ষন মুগ্ধের বলা প্রতিটা কথা সাদাফ মন দিয়ে শুনছিলো। প্রতিটা কথায় মুগ্ধের কষ্ট গুলো অনুভোব করছিলো। সাদাফের তো শুধু প্রিয়াকে হারানোর কষ্ট ছিলো। কিন্তু মুগ্ধের কষ্ট তার থেকেও বেশি। সাদাফ এবার মুগ্ধকে জরিয়ে নিলো নিজের সাথে। মুগ্ধের মাথাটা সাদাফের বুকে। সাদাফ মুগ্ধের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,,,

সাদাফ:আমার মনে তুমি অনেক আগেই নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছো। সেই জায়গায় তোমার নাম খোদাই হয়েগেছে অনেক আগেই। আমার অতীতকে আমি ভুলতে পারবোনা কারণ সেও আমার ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু এখন তুমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। আর আমি আমার বর্তমানকে এখন শুধু ভালোবাসি। শুধু তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবেসে যাবো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি কোনোদিন কাঁদতে দেবোনা। তোমার বিশ্বাস ভাংগার মতো এমন কোনো কাজ আমি করবোনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি মুগ্ধ। এই ভালোবাসার পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই।

আজ অবশেষে তাদের মিলন হলো। আজ তাদের মিলন দেখে আশে পাশের গাছ গুলো হাঁসছে পাখি গুলো গান গাইছে। নদীর পানি খুশিতে ঢেউ দিচ্ছে। আজ একটা নতুন শেষ থেকে শুরু হচ্ছে।

#চলবে