#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২২|
পাখিরা কিচিরমিচির করে ভোরের জানান দিচ্ছে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটছে। জানালা ভেদ করে স্নিগ্ধ বাতাস আসছে। মেহের গ্রিলে হাত দিয়ে শুভ্র নির্মল আকাশ দেখতে। মাঝেমাঝে হালকা বাতাস এসে ওর চুলগুলো ছুয়ে দিচ্ছে।
প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষ করে জানালার পাশে এসে ১০-১৫মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটে তবেই আবার বিছানায় ফেরত যায়। কিন্তু আজ যাচ্ছে না। আজ আলো ফোটার পর সূর্য্যি মামা রোদের প্রখরতা বাড়িয়ে তুলছে তবুও মেহেরের নড়ার নাম নেই।
কারো হাতের স্পর্শে মেহের ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর হালকা হেসে বলল,
“কি রে সামিরা আজ এত সকাল সকাল উঠেছিস? ডেট-ফেট আছে নাকি?”
সামিরা চোখ ডলতে ডলতে বলল,
“তুই নামাজ পড়ার পর আর ঘুমাস নি তাই না?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আজকে ঘুম আসছিল না। তাই আর শুতে যাই নি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম।”
সামিরা মেহেরের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
“ঘুমের আর কি দোষ? এই কাঁদিস নি তো?”
মেহের হালকা হেসে বলল,
“এই আমি কাঁদব কেন? পাগল হয়েছিস?”
সামিরা নাক সরু করে চোখ ছোট ছোট করে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর হাত উঁচিয়ে বলল,
“ঠাটিয়ে মারব এক চড়। আমার সাথে অন্তত ঢং করিস না। আজ তোদের বিবাহ বার্ষিকী আমি জানি। তাই তো এমন পেত্নীর মতো মুখ করে বসে আছিস। কার জন্য মন খারাপ করিস? যে তোকে ফেলে বিদেশে গিয়ে সুখের জীবন কাটাচ্ছে৷ দেখ এ-সব বাদ দে। চিল মুডে থাক। চল আজ আমরা ঘুরতে যাব।”
মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই সামিরা বলল,
“নেকামো বাদ দে। রেডি হয়ে নিস। নয়তো তুলে নিয়ে যাব।”
সামিরা দুম করে আবারো শুয়ে পড়ল।
মেহের আবারো বাইরে তাকাল। তারপর ভাবছে,
“আসলেই তো কার জন্য মন খারাপ করছি আমি? যে আমাকে মুক্তি দিয়েছে? প্রয়োজন শেষে ফেলে চলে গেছে? যে আমার ছোট্ট অবুঝ মনের
নিষ্পাপ ভালোবাসার বিন্দুমাত্র দাম দেয় নি? আমি আর উনাকে ভেবে মন খারাপ করব না। চিল মেহের চিল।”
কেটে গেছে আরো চার মাস। এই চার মাসে মেহের মানুষের অপমান, অবহেলা সব মুখ বুঝে সহ্য করেছে। পরিবারেও ঠায় পায় নি। মেহেরের বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে মেহেরের ও-বাড়িতে জায়গা হবে না। নিজের পছন্দে এক জনকে বিয়ে করেছে। সে এখন ওকে ছেড়ে দিয়েছে। আবার এই বাড়িতে এসে উঠেছে। সমাজে মুখ দেখাবে কি করে। তাই অবশেষে হোস্টেলে উঠেছে। মাহি বলেছিল ওর বাড়িতে গিয়ে থাকতে কিন্তু মেহের সেই প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে। হোস্টেলেই থাকে চার মাস৷
।
ফাইজা এসে ফায়াজের আশেপাশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু ফায়াজের সেদিকে খেয়াল নেই। ফাইজা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ বালিশে মাথা দিয়ে সিলিংয়ের দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে আছে।
ফাইজা ফায়াজের পাশে গিয়ে বসতেই ফায়াজের ধ্যান ভাঙল।
ফায়াজ উঠে বসে বলল,
“আরে তুই? কখন এলি?”
“অনেকক্ষণ। ১৫মিনিট তো হবেই। তুমি এতক্ষণ কোথায় হারিয়েছিলে? আমাকে দেখলেই না।”
ফায়াজ আমতা আমতা করছে।
“আসলে সরি রাগ করিস না৷ খেয়াল করি নি।”
“আর দরজা? ফ্ল্যাটের দরজা খোলা কেন? কেউ এসে কিছু নিয়ে চলে গেলেও তো টের পাবে না।”
ফায়াজ মাথা চুলকে বলল,
“বন্ধ করতে মনে নেই।”
ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“মনের আর দোষ কি?”
ফায়াজ চুপ করে গেল ফাইজার কথা শুনে।
“তুই কি আমার উপর এখনো রাগ করে আছিস?”
ফাইজা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আমি তোমার বোন। তাই বোন হিসেবে তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারি না। কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারব কি না আই ডোন্ট নো৷ আই রিয়েলি ডোন্ট নো।”
ফায়াজ আর কোনো কথা বলল না।
ফাইজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি যাচ্ছি। মম আমার জন্য টেনশন করবে। তাছাড়া আমার পড়াশোনা আছে। নিজের খেয়াল রেখো। আর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রাখবে মনে করে।”
ফায়াজ আবারও একা হয়ে গেল। নিজেকে বড্ড শূন্য মনে হয়। কিছুই ভালো লাগে না আজকাল।
.
মেহের সামিরার সাথে সারাদিন ঘুরেছে। সামিরার সাথে ঘুরাঘুরি করে মনটা হালকা লাগছে। হোস্টেলে ফিরে মেহের বিছানার উপর অনেক গুলো শপিং ব্যাগ দেখল। একজন এসে বলে গেল মেহেরের জন্য এসেছে এগুলো। মেহের শপিং ব্যাগের ভেতর একটা চিরকুট পেল।
রাগে মেহেরের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। শপিংগুলো হাতে নিয়ে মেহের গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল। সামিরা পেছনে থেকে অনেক বার ডাকল কিন্তু মেহের পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে গেল।
মেহের সোফার উপর ব্যাগগুলো রেখে বলল,
“এ-সব কি আপু? এগুলো কেন পাঠিয়েছো?”
মাহি শুয়ে ছিল। মেহেরকে দেখে ধীরে ধীরে উঠে বসল ভারী দেহ নিয়ে। মাহি বিছানা থেকে পেটে হাত দিয়ে নেমে বলল,
“কি হয়েছে? এগুলো ছুড়ে মারলি কেন?”
মেহের কটাক্ষ করে বলল,
“তুমি এগুলো কেন পাঠিয়েছো? আমি চেয়েছি তোমার কাছে?”
মাহি মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেহের আজকাল কত বদলে গেছে। কিভাবে কথা বলছে।
“কেন রে খুব অন্যায় করে ফেলেছি? বোন হিসেবে তোকে কিছু দিতে পারি না?”
মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“অনেক কিছুই তো দিয়েছো আর কত দিবে? আমার কিছুই নেই। পরিবার-পরিজন নেই, বাড়ি নেই কিছুই নেই। কেন নেই আপু? আমার বাবা-মা, আমার বাড়ি থাকতেও আমি হোস্টেলে থাকছি একা। কেন? কি অন্যায় করেছিলাম?”
মাহির গলা ধরে আসছে। কথা বলতে পারছে না। মাহি ঠোঁট কামড়ে বলল,
“নাহ তুই কোনো অন্যায় করিস নি। সব অন্যায়, সব পাপ আমার।”
মেহের চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে শাস্তি কেন আমি পাচ্ছি? তোমার সুখ-শান্তি, ঘর-সংসার, বাবা-মা, বাড়িঘর সব আছে৷ আমার কেন নেই? আমি একা কতদিন বাঁচব?”
মাহি ওর হাত ধরে বলল,
“আমি কি করব মেহের? কি করব? সব অপরাধ আমার। আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আমি তোকে প্রথমেই বলেছিলাম আগুনে ঝাপ দিয়েছিস তুই। আমি নিষেধ করেছিলাম। আমি তোকে একবারও বলেছিলাম আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত তোকে করতে? আমি নিজেই সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি এখনো তোর জীবন ছাড়খার হওয়ার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করি। তিলতিল করে মরছি রোজ। কিন্তু আমি কি করব? কি করে সব ঠিক করব? আমি চাইলেই কি সব আগের মতো করতে পারব? পারব না। আর তাছাড়া আমার বেবি? আমি ওর কথা ভেবে কিছুই করতে পারছি না। কিন্তু তুই যদি চাস এতে তুই হ্যাপি থাকবি তবে সব করতে রাজি আছি।”
“তুমি আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার না করলেই আমি হ্যাপি থাকব।”
মেহের কথাটা বলে চলে গেল মাহির রুম থেকে।
মাহি বিছানায় বসে পড়ে মুখ চেপে কাঁদছে।
“আমি কি করলে তুই ভালো থাকবি মেহু? কি করে তোকে হ্যাপি রাখব? আমি তোর জীবনটা গুছিয়ে দিতে চাই। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এই মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে পারছি না।”
.
ফায়াজ জ্বরের ঘোরে বারবার মেহেরের নাম করছে। ফাইজা পট্টি দিচ্ছে ফায়াজের কপালে। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
“ভালোবাসার জ্বরে পুড়ে মরছে তবুও মুখে স্বীকার করবে না।”
.
ফায়াজ একটু সুস্থ হতেই ফাইজা ওর পাশে বসে বলল,
“ধরো তুমি শুনলে মেহের ভাবীর থুক্কু মেহেরের বিয়ে হচ্ছে তাহলে কেমন হবে?”
ফায়াজ ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি যা তা বলছিস বিয়ে কেন হবে?”
ফাইজা গালে হাত দিয়ে বলল,
“কেন হবে না ভাইয়া? ও কি কাউকে ভালোবাসতে পারে না? কাউকে বিয়ে করতে চাইতে পারে না?”
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“না পারে না। কারণ ও এখনো আমার ওয়াইফ।”
“বিদেশে বসে বসে স্বামীগিরি দেখাচ্ছে। তুমি এখানে বসে স্বামীগিরি দেখাও মনে মনে আর ও ওখানে বিয়ে-শাদি করে সংসার করুক অন্য কারো সাথে। তারপর বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করুক। তুমি দেশে ফিরলেই মামা মামা বলে ছুটে আসুক।”
ফায়াজ ধমকে উঠল।
“এই চুপ করবি তুই? ও কাউকে বিয়ে করতে পারে না।”
“কেন পারে না?”
“কারণ আমি ওকে ভা,,,।”
ফায়াজ চুপ করে গেল।
ফাইজা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ভায়ায়ায়া কি? বল বল।”
ফায়াজের বলেই দিল। আর পারছে না নিজের অনুভূতি থেকে ভাগতে।
“আমি ওকে ভালোবাসি।”
ফাইজা ওর গাল টেনে বলল,
“ওলে ওলে আমার ভাইটা লাইনে এসেছে৷ তো এখানে বসে না থেকে টিকেট কেটে বাড়ির পথে হাঁটা দেও থুক্কু উড়াল দেও। নয়তো তোমার পাখি উড়াল দিবে।”
.
ফায়াজ কাউকে কিছু না জানিয়েই দেশে ফিরেছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ভার্সিটিতে চলে যায়। ফায়াজের মনে টানটান উত্তেজনা। মেহেরকে দেখার পর কি হবে? ভার্সিটিতে যেতেই তুষারের সাথে দেখা। তুষার ফায়াজকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,
“আরে মামা, তুই কবে আসলি? কিছু জানালি না?”
ফায়াজ কথার উত্তরে বলল,
“এ-সব পরে হবে। এখন মেহের কোথায় সে খোঁজ কর।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। আমি খোঁজ লাগাচ্ছি।”
।
ফায়াজ মেহেরের ক্লাস রুমে গেল। কিন্তু ক্লাস রুমে দু’চার জন বসে আড্ডা দিচ্ছে। ক্লাস অফ। ফায়াজ একজনকে জিজ্ঞেস করল মেহের কোথায়। সে জানাল মেহের নাচের ক্লাসে থাকতে পারে।
ফায়াজ যেন ঝড়ের গতিতে নাচের ক্লাসে গেল। শরীর যেন কাঁপছে অজানা কারণে। ফায়াজ নাচের ক্লাসের দরজার সামনে গিয়ে দেখল সেখানে অনেক মেয়ে কোনো ছেলে নেই। একজনকে ডেকে বলল,
“এক্সকিউজ মি একটু দেখবেন মেহের নামে কেউ আছে কি না।”
“জি দেখছি।”
মেয়েটা পুরো রুমে জিজ্ঞেস করল মেহের বলে কেউ আছে কি না৷ কিন্তু কেউ নেই৷ মেয়েটা এসে জানাল মেহের নেই এখানে। তারপর বন্ধুরা মিলে পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিল কিন্তু মেহের নেই। ফায়াজ হতাশ হয়ে পড়ল। তারপর ফায়াজ মেয়েদের কমন রুমে গিয়েও খোঁজ নিল সেখানেও নেই। ফায়াজ কমন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে তুষারকে ফোন করে বলল,
“তোরা একটা মেয়েকে খোঁজে বের করতে পারছিস না? কি করছিস? আমার এই মুহুর্তে মেহেরকে চাই।”
“ভাই খুঁজছি। তুই রিলেক্স থাক।”
ফায়াজের বন্ধুরা মিলে পুরো ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, ক্লাস রুম সব তন্নতন্ন করে খুঁজছে।
ফায়াজ নিজের চুল মুঠ করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাগ লাগছে খুব৷ ইচ্ছে করছে সব গুড়িয়ে দিতে।
তখনই ফোন বেজে উঠল। ফায়াজের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।
মেহের লাইব্রেরীর বইয়ের সেল্ফ থেকে খুঁজে খুঁজে দুটো বই নিল। তারপর টেবিলের দিকে যাবে তখনই আবেগে মাখা কন্ঠস্বর কানে এল।
“মেহের!”
মেহের থমকে গেছে কন্ঠস্বরটা শুনে। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে হাত থেকে বই দুটো পড়ে গেল। শরীর কাঁপছে প্রচুর। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। নিচের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
ফায়াজ মেহেরের দিকে এগিয়ে গেল। মেঝে থেকে বই দুটো তুলতেই মেহের দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফায়াজও দৌড়ে পেছনে পেছনে গেল। সবাই মেহেরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল,
“মেহেরজান যতই পালাও না কেন এইবার আর ছাড়া পাবে না। ফায়াজের ঘৃণা আর হিংস্রতা দেখেছো আর এখন পাগলামি আর ভালোবাসা দেখবে। সো গেট রেডি বেবি।”
চলবে…..
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৩|
মেহেরের শরীর থরথর করে কাঁপছে। বিছানায় বসে আগে জোরে জোরে শ্বাস নিল। মনে হচ্ছে এতক্ষন শ্বাস আটকে ছিল। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দ্রুত ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে শেষ করে ফেলল। তারপর আবারো বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
মেহের লাইব্রেরী থেকে এক দৌড়ে ভার্সিটির গেটের বাইরে আসে তারপর একটা অটো ধরে সোজা হোস্টেলে। হোস্টেলের রুমের দরজাও বন্ধ করে নিয়েছে ভয়ে। ওর রুমমেট সামিরা ভার্সিটিতে। একা জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে।
দীর্ঘ ৫মাস পর ফায়াজকে দেখল আজ। মেহেরের চোখের সামনে বারবার লাইব্রেরীর দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। আর কানে বাজছে সেই সুর “মেহেরজান!”
মেহের আনমনে ভাবছে,
“কেন এসেছেন উনি? এতদিন পরে কেন এসেছেন? আমি সত্যি উনাকে দেখেছি তো? না আমার ভ্রম ছিল? উনি আমাকে মেহেরজান বলে ডাকল তো? ভুল কি করে হতে পারে? আমি ঠিক শুনেছি। উনি আমাকে মেহেরজান বলে কেন ডাকবে?”
মেহেরের মাথা কাজ করছে না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ফায়াজ ওর কাছে আবার কি চায়?
🍂🍂
দুপুর ২টা। দরজায় অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে সামিরা। মেহেরের খোলার নাম নেই। সে তো ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে। অন্য দিকে তার খেয়াল নেই।
“মেহের, তুই ঠিক আছিস তো? আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে।” হটাৎ সামিরার কথা কানে ভেসে এল। মেহের দ্রুত উঠে দরজা খুলে দেয়। সামিরা কটাক্ষ করে কিছু বলতে যাবে তখনই মেহের ওকে জড়িয়ে ধরে। সামিরা তাজ্জব হয়ে যায়। তাছাড়া মেহেরের শরীর হালকা কাঁপছে।
সামিরা মেহেরকে সামনে এনে আতংকিত সুরে বলল,
“কি হয়েছে এমন করছিস কেন?”
মেহের কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ফায়ায়া,,,,জ!”
“ফায়াজ? ফায়াজ কি?”
মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি আজ উনাকে লাইব্রেরীতে দেখিছি। আমাকে ডেকেছিল।”
সামিরা কনফিউশন মিশ্রিত হালকা হেসে বলল,
“দূররর…. উনি আসবে কোথায় থেকে? আর কেন আসবে? তুই ভুল দেখেছিস। আর নয়তো তোর কল্পনা ছিল। উনি এলে ভার্সিটি এত ঠান্ডা থাকত। কখনোই না। আর আমি কিছুই জানতে পারতাম না। আমি তো আজ ক্যাম্পাসেই ছিলাম। কই ফায়াজ শব্দটাও কেউ বলে নি।”
মেহের সামিরার কথা শুনে বলল,
“আমি নিজে দেখেছি উনাকে। আমাকে নাম ধরে ডেকেছে। আমার খুব ভয় লাগছে। উনি ৫মাস পরে আমার কাছে কি চায়? আবার কোনো নতুন খেলা খেলতে আসে নি তো। আমার জীবনটা আবারো এলোমেলো করে দেবে না তো?”
সামিরা মেহেরকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“কিছুই হবে না। কারণ ফায়াজ আসে নি। ওগুলো তোর মনের ভুল ছিল।”
সামিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মেহেরকে বুঝাতে।
মেহের সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। দুপুরে সামিরার জোরাজুরিতে খেলেও রাতের খাবার খায় নি। মেহের ভুল দেখেছে সেটা মানতে পারছে না।
.
সামিরা আর মেহের হোস্টেলের ক্যান্টিন থেকে সকালের খাবার খেয়ে এসেছে। মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাঁধছে। সামিরা ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত। মেহের হটাৎ পেট ধরে বসে পড়ল।
“ও মাগো পেট ব্যথা করছে। আমি আর এই হোস্টেলেই থাকব না। কি পেট ব্যথা করছে।”
সামিরা ওর কাছে এসে বলল,
“পেট ব্যথা করছে কেন?”
“কেন আবার? আল্লাহ জানে এরা কি রান্না করেছে। খেতে না খেতেই অ্যাটাক। কি পেট ব্যথা করছে।”
সামিরা ভ্রু কুচকে বলল,
“আমিও তো খেয়েছি। তোরই কেন পেট ব্যথা হয়?”
মেহের মুখ ভার করে বলল,
“জানি না। আমি বাইরের খাবার তেমন খেতাম না আগে। পাঁচ মাস ধরে খেতে হচ্ছে। কিন্তু অভ্যাস করতে পারছি না হয়তো। নয়তো পেট ব্যথা কেন হবে?”
“তাহলে আজ আর যেতে হবে না। তুই রেস্ট কর। ওষুধ খেয়ে নে।”
মেহের পেটের ব্যথায় ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। সহ্য করতে পারছে না।
“আমি আজ যেতেও পারব না সামিরা। তুই যা।”
সামিরা মেহেরকে নিজের খেয়াল রাখতে বলে চলে গেল।
সামিরা যেতেই মেহের পেটে বালিশ চেপে ধরে। আর মনে মনে অথোরিটিকে গালাগাল করছে।
।
ফায়াজ ক্যাম্পাসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটিতে মেহেরের খোঁজ করে জানতে পারে মেহের আজ আসে নি। তাই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সিগারেট টেনে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। মেহের ওকে ইচ্ছে করে এভয়েড করছে। রাগে ফুসফুস করছে ফায়াজ।
।
সামিরা হোস্টেলে ফিরে মেহেরকে শুয়ে থাকতে দেখে। মেহেরের কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা মাপল। না জ্বর নেই। মেহের চোখ খুলল। সামিরাকে দেখে উঠে বসল।
“চলে এসেছিস?”
সামিরা বিচলিত হয়ে বলল,
“শুয়ে আছিস কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। আসলে ভালো লাগছে না তাই শুয়ে আছি।”
সামিরা কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল।
.
মাগরিবের নামাজ পড়ে মেহের জায়নামাজ ভাজ করছে। মেহেরের চোখ গেল খোলা জানালার দিকে। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে আসছে আর জানালা খোলা। মেহের সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। মেহের জায়নামাজ রেখে জানালা বন্ধ করার জন্য জানালার বাইরে হাত বাড়াল। আর তখন চোখ পড়ল রাস্তার ওপারে। মেহের চোখ ডলে আবারও তাকাল। তারপর দ্রুত জানালার পাশ থেকে সরে এল।
আতংকিত হয়ে সামিরার কাছে গিয়ে বলল,
“আমি দিবাস্বপ্ন দেখি হাহ? এই রাতেও আমি দিবাস্বপ্ন দেখি?”
সামিরা কিছু না বুঝতে পেরে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি বলছিস? কিছুই বুঝতে পারছি না। ঝেড়ে কাশ যক্ষা রোগীর মতো খকখক না করে।”
মেহের সামিরার হাত ধরে টেনে জানালার পাশে নিয়ে গেল। তারপর আঙুল দিয়ে রাস্তার ওপারে দেখাল।
ফায়াজ রাস্তাজুড়ে পাইচারি করছে আর বারবার হোস্টেলের গেটের দিকে তাকাচ্ছে। দুতলা থেকে নিয়নবাতির আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফায়াজকে।
মেহের দ্রুত জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল।
মেহের সামিরার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সামিরা কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“মেহের আমি আজ ভার্সিটিতে গিয়েই জেনেছি ফায়াজ এসেছে। উনি অনুর কাছে তোর খোঁজও করেছিল। আমি তোকে কিছু বলি নি তুই টেনশন করবি তাই।”
মেহের ওড়না খামচে ধরে রেখেছে। মাথা কাজ করছে না।
“আমার খোঁজ কেন করছে সামিরা? কি চায় আমার কাছে? ৮মাস সংসার সংসার খেলে উনার মন ভরে নি? এতদিন প্রায় ৫মাস পরে উনার কি মনে হলো? কি মনে করে আমার খোঁজ করছেন? আর কি চাওয়ার আছে? উনার জন্য আমার পুরো লাইফ হেল হয়ে গেছে। সব হারিয়ে ফেলেছি। আমি নিজের মতো আছি। হয়তো খুব ভালো নেই কিন্তু আছি তো। জানি না মন আমার কেন এত কু ডাকছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার জন্য আরও ঝড়-ঝঞ্ঝা অপেক্ষা করছে।”
সামিরা ওকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস। কিছুই হবে না।”
মেহের সামিরার হাত ধরে বলল,
“এই যদি উনি হোস্টেলের ভেতরে চলে আসে? তাহলে কি হবে?”
“আরে উনি ভেতরে কি করে আসবে? এটা গার্লস হোস্টেল। যে কেউ এলাও না।”
“তুই তো উনার ক্ষমতা সম্পর্কে জানিস। উনি চাইলে সব পারেন।”
“হ্যাঁ, তা পারে কিন্তু উনি যেহেতু এতক্ষণ আসে নি তাই মনে হচ্ছে না আর আসবে। বি কুল।”
মেহের বিরবির করে বলল,”আর কুল।”
ফায়াজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায় না৷ এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে আরো পারবে।
………………..
মেহের ভার্সিটিতে যাবে না যাবে না করেও সামিরার জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু সামিরাকে বলেছে ওকে ছেড়ে যেন কোথাও না যায়। মেহের ভয়ে ভয়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকল।
সামিরার হাত চেপে ধরতেই সামিরা বলল,
“ফেস করতে শিখ। এভাবে আর কত লুকিয়ে থাকতে পারবি?”
সামিরা হাত ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মেহের কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকে প্রথমে যতদূর চোখ যায় ক্যাম্পাস দেখছে। তারপর কোনোদিক না দেখে সোজা ক্লাসরুমের দিকে হাঁটছে। ক্লাসরুমের সামনে এসেই শ্বাস ফেলল জোরে। ক্লাস রুমের ভেতরে গিয়ে পেছনের ছিটে বসে পড়ল।
ক্লাস চলছে। লেকচার চলছে। কিন্তু সেদিকে মেহেরের খেয়াল নেই। ফলশ্রুতিতে মেহেরকে ক্লাস থেকে বের করে দিল।
মেহের রাগে হেঁটেই চলেছে। কোনো দিক তাকাচ্ছে না। এই প্রথম ক্লাস থেকে বিতাড়িত হতে হলো। লজ্জায় মেহেরের মাথা কাটা যাচ্ছে।
হটাৎ মেহের থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সামনে ফায়াজ দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের ফায়াজকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
ফায়াজ ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ফায়াজ যতই এগিয়ে আসছে ওর হৃদপিন্ডের গতি ততই বেড়ে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
ফায়াজ ওর সামনে এসে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরল। মেহেরের পুরো দুনিয়া যেন থমকে গেল। একদম যেন ফ্রিজড হয়ে গেছে। ফায়াজ মেহেরকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলছে। যেন কতকালের যন্ত্রণা মিটিয়ে নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। মেহের ফায়াজকে সরাতে পারছে না। ফায়াজকে আজ যেন অচেনা মনে হচ্ছে। আর ওর শরীরের ঘ্রাণ যেন ওকে মাতাল করে দিচ্ছে।
ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে মেহেরকে ছেড়ে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে। মেহেরের চোখের পাতা ভেজা৷ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ মেহেরের থুতনি ধরে উঁচু করে মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে আছে। ও মেহেরের গালে ঠোঁট ছুয়াতেই মেহের নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। মেহের ফায়াজের দিকে একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিল। ভেতরে ভেতরে উত্তাল ঢেউ বইছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“মেহের বাড়ি ফিরে চলো। আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই।”
মেহের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেল। ওর দৃষ্টি শান্ত নয়। ফায়াজ বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে।
চলবে…!