শেষ পাতায় তুমি পর্ব-২৪+২৫

0
3710

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৪|

“বাড়ি! কিসের বাড়ি? কার বাড়ি? আর আমি আপনার সাথে কেন যাব? কে আপনি?”
মেহের মাটির দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফায়াজের দিকে তাকাল।

ফায়াজের দিকে তাকাতেই মেহেরের কলিজা কেঁপে উঠল। ফায়াজ অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে।
মেহের সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। আর মনে মনে বলছে,
“আমি কি বেশী সাহস দেখিয়ে ফেললাম? আমাকে আবার পাব্লিক প্লেসে মারবে না তো?”
মেহের মনে মনে ভয়টা লুকাতে চাইলেও না চাইতেই ফেসে ঠিকি ফুটে উঠছে।

ফায়াজ মেহেরের হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি কে? ইউ ডোন্ট নো হু আই এম? আ’ম ইউর হাসব্যান্ড। স্টিল আ’ম ইউর হাসব্যান্ড। আমাদের ডিভোর্স হয় নি।”

মেহের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ফায়াজ আরো জোরে চেপে ধরল।
“বিয়ে হয়েছে? বিয়ে হলে না ডিভোর্স। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা বিয়ে না। সেটা ছিল চুক্তি। আর সেই চুক্তির মেয়াদ ছিল ৮মাস। ৫মাস আগেই যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ভুলে গেছেন? মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন। আর হাসব্যান্ড? কিসের হাসব্যান্ড? আবারও হাসব্যান্ডের দোহাই দিয়ে কি চাইছেন? কেন? কেন ফেরত চাইছেন?”

ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে বলল,
“কারণ আমি…”

মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই আবারও চোখ নামিয়ে নিল কোনো প্রশ্ন না করে।

ফায়াজ অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ শ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না। আমি শুধু জানি তুমি যাবে। তুমি আমার কাছে থাকবে।”

মেহের শান্ত কন্ঠে বলল,
“আমাকে কি আপনার পুতুল মনে হয়? আমি আপনার হাতের পুতুল? যেভাবে নাচাবেন আমি নেচে যাব? যখন ইচ্ছে হলো বিয়ে করে নিলেন। মানসিক শারীরিক টর্চার করলেন। তারপর যখন সেই ইচ্ছে মিটে গেল আমাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। তারপর আমি যখন আমার মতো লাইফ লিড করছি আপনি আবার নতুন করে আমার লাইফে উদয় হলেন। আবার নতুন কোনো খেলা খেলতে।”

ফায়াজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
“আমি নতুন করে কোনো খেলা খেলছি না। আমি শুধু চাইছি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। আমার কাছে রাখতে। আর সেটা আমার ওয়াইফ হিসেবে। আমি তোমাকে তোমার যোগ্য সম্মান দিতে চাইছি।”

মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“হটাৎ যোগ্য সম্মান দেওয়ার কথা ভাবছেন? বাহ! কিন্তু কেন? আমি চেয়েছি কোনো সম্মান? আমি শুধু মুক্তি চেয়েছি।”

ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কিন্তু আমি তোমাকে মুক্তি দেব না।”

“কিন্তু কেন? কেন দেবেন না?”

ফায়াজ অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এখনো বুঝতে পারছ না?”

মেহের নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,”না। আমি বুঝতে পারছি না। কারণ আপনাকে বুঝা বড় দায়। কেন ফেরত চাইছেন?”

ফায়াজ কপালে আঙুল ঘষে আবার রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তারপর চেঁচিয়ে বলল,
“বিকজ আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনের ভেতর ঝড় বইছে। কি শুনল এটা? ফায়াজ কি বলল? ভালোবাসে? সত্যি না আবারও কোনো নাটক? কেন এই নাটক করছে?
ফায়াজ মেহেরের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে।
মেহের মুচকি হাসল। কিন্তু ওর ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে। কান্নাগুলো বাঁধ মানতে চাইছে না।
ফায়াজ মেহেরের মুখের ওই মুচকি হাসিটা ভালো চোখে দেখছে না। কেমন অদ্ভুত সেই হাসি।
“ভালোবাসা? আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আর মাহি আপু? তাকেও তো ভালোবাসেন।”

“ও আমার অতীত। আর আমি ওকে নয় সেই মুগ্ধ করা কন্ঠস্বরকে ভালোবেসে ছিলাম। যা তোমার ছিল মেহের। তুমি নিজেও জানো আমি ওকে ভালোবাসি না।”

“ভালোবাসা? আমাকে ভালোবাসার কথা বলার আগে হিসেব করে দেখুন আপনি আমার সাথে কি কি করেছেন। আপনার জন্য আমি কি কি হারিয়েছি। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আপনি জানতেন আমার বাবা আমাকে কতটা অপছন্দ করত আপনাকে বিয়ে করায়। সবটা জেনেও আমাকে সেই বাড়িতেই রেখে এলেন। একবার ভাবলেন না আমার কি হতে পারে। পাঁচ মাসে একটা বার আমার খোঁজ নিয়েছেন? প্রয়োজন মনে করেন নি। আল্লাহ জানে কোন প্রয়োজনে এসেছেন।”

ফায়াজ আবারও কিছু বলতে গেলে মেহের বলল,
“আপনার অনেক ক্ষমতা। আপনি চাইলেই আমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে ক্ষমা করি নি আর করবও না।”

ফায়াজ অসহায় ভাবে বলল,
“দোষ কি শুধু আমারই ছিল? হ্যাঁ আমি তোমার সাথে বড় অন্যায়টা করেছি। সব তো স্বীকার করেছি তোমার কাছে যাওয়ার আগে।”

“আপনার একার কথা বলে মাহি আপুকে ইন্ডিকেট করছেন? মাহি আপুকে বোন হিসেবে দূরে ঠেলতে পারি নি। ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি নি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ক্ষমা করি নি। এই যে আপনি আমার সাথে যা করেছেন সেটা জানার পর ফাইজা আপনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে? দেয় নি তো? রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা এত সহজ না। তাই পারে নি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ক্ষমা করেছে কি না জানি না। আমি আপনার কাছে ফিরতে চাই না। প্লিজ আমার উপর আর জুলুম করবেন না।” (হাত জোর করে কেঁদে দিয়ে)

ফায়াজ মেহেরের কান্না দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল। মেহেরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“মেহের প্লিজ কেঁদো না। তুমি যাবে না তো ঠিক আছে। যাওয়ার দরকার নেই। একদম দরকার নেই।” (পাগলের মতো করে)

মেহের ফায়াজের সামনে থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
“মেহের তুমি যাবে। অবশ্যই যাবে। তোমার ইচ্ছেতেই যাবে। আমাকে ভালোবেসে যাবে। সেদিন আমি তোমাকে নিয়ে যাব। এভাবে নয় বউ সাজিয়ে নিয়ে যাব। এটা আমার ভালোবাসার বিশ্বাস। করব না জোর। তবে তোমার পিছ ছাড়ব না। কারণ তুমি আমার অক্সিজেন।”

ফায়াজের আবেগ মাখা কথা শুনে মেহেরের কান্না পাচ্ছে। মন গলে যাচ্ছে।
কিন্তু মেহের স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে।

ফায়াজ মেহেরকে আবারো ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
“যাও। তবে মনে রেখো আমি তোমার পিছ ছাড়ছি না। তোমাকে আমার করেই ছাড়ব। আর হ্যাঁ সাবধান। তোমার উপর আমার নজর থাকবে।”

মেহের ওখান থেকে দৌড়ে লেডিস ওয়াশরুমে চলে গেল। তারপর বেসিন ধরে কাঁদতে লাগল। ফায়াজের বলা ভালোবাসার কথা বারবার কানে ভেসে আসছে। এতদিনের খাঁচায় শক্ত করে আটকে রাখা মনটা নরম হয়ে যাচ্ছে।
ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে।

মেহের হোস্টেলে ফিরে সামিরাকে সবটা বলল। সামিরা কনফিউজড হয়ে বসে আছে। মাথায় কিছু ঢুকছে না। ফায়াজ কি সত্যিই ভালোবাসে মেহেরকে? না কি অন্যকিছু।
সামিরা মাথা চুলকে বলল,
“এই মেহের যদি সত্যি সত্যিই ফায়াজ থুক্কু ফায়াজ নয় ফায়াজ দুলাভাই তোকে ভালোবাসে তবে কি হবে?”

মেহের সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চিনিস না তুই উনাকে। উনি ভালো টালো বাসতে জানে না।”

সামিরা মেহেরের সাথে ঘেষে বসে কুশন কুলে নিয়ে বলল,
“বাট সত্যিই যদি বাসে? এমনও তো হতে পারে তোকে সত্যিই ভালোবাসে। আর তোর জন্যই ফিরে এসেছে। তাহলে? তুই তো উনাকে ভালোবাসিস। মুখে তুই যাই বলিস না কেন আমি জানি মনে মনে ভালোবাসিস। শুধু অভিমান জমে আছে। এই বল না?”

মেহের সামিরার কথার উত্তর না দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। সামিরা ওর কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল। ও নিজেও শুয়ে পড়ল।

মেহের চোখ বন্ধ করে বলল,
“তাহলে উনাকে প্রথমে উনার ভালোবাসাটা প্রমাণ করতে হবে।”

সামিরা লাফ দিয়ে উঠে বসল। মেহেরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেহের চোখ বন্ধ করে ফায়াজের মুখটা স্মরণ করল। ফায়াজের ছোঁয়া, ফায়াজের জড়িয়ে ধরা, ফায়াজের চুমু খাওয়া, ফায়াজের বলা প্রতিটি কথা। সব স্মরণ হচ্ছে। এগুলো মেহেরকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। শুধু এপাশ ওপাশ করছে। মেহের সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ঘুমাচ্ছে। মেহের উঠে বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

.

গভীর রাত। ফায়াজ ছাদে দাঁড়িয়ে ওয়াইনের বোতল চুমুক দিচ্ছে।
“তোমার অভিমানটা অযৌক্তিক না। এইবার আমি তোমার উপর জোর-জবরদস্তি করব না। কোনো প্রকার ব্ল্যাকমেইল করব না। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবেসে আমার জীবনে ফিরে এসো। আমাকে আমার মতোই ভালোবাসো। তবে তোমার সবটা জুড়ে শুধু আমার বসবাস থাকবে। আর কারো নয়।”

মেহের আর সামিরা এক সাথে কথা বলতে বলতে ভার্সিটিতে ঢুকল। সামিরা ফায়াজকে দেখে মেহেরকে ফিসফিস করে বলল ফায়াজ সামনে। মেহের সামনের দিকে তাকাল। ফায়াজকে দেখে আবারও চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ ওদের সামনে এসে বলল,
“সামিরা!!”

সামিরা ফায়াজের মুখে নিজের নাম শুনে মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“জি ভাইয়া।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
“তোমার বান্ধবীকে বলো এত সুন্দর করে ওই কাজল কালো চোখে কাজল যেন না লাগায়।”

সামিরা মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেহের এত সুন্দর করে আর কাজল লাগাবি না।”

মেহের সামিরার দিকে বোকার মতো চেয়ে আছে। মেহের ফিসফিস করে বলল,
“কেন লাগাব না?”

সামিরা ফায়াজকে প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া, মেহের জিজ্ঞেস করছে কেন লাগাবে না? ও কাজল লাগাবেই।”
মেহের চোখ বড়বড় করে সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ফায়াজকে কেন বলল এ-সব আর বাড়িয়েই বা কেন বলল?”

ফায়াজ মেহেরের একদম কাছে এসে বলল,
“ওই চোখে কাজল লাগালে মাতাল হয়ে যাই। তারপর কিছু করে বসলে দোষারোপ করতে পারবে না।”

মেহের চোখ বড়বড় করে তাকাল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। সামিরার দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসিটা দমিয়ে রাখছে।
মেহের হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ফায়াজ মুচকি হাসছে। সামিরা মেহেরের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। সামিরা মেহেরের সামনে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি যেন থামিয়ে রাখতেই পারছে না। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে সামিরার হাসি দেখে। মেহের সামিরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর হনহন করে ক্লাস রুমে গেল।
মেহের ফায়াজকে মনে মনে গালি দিচ্ছে।
“এই ব্যাটা তো দেখছি আস্ত লুইচ্চা। ছিহ! উনাকে তো কখনো এমন মনে হয় নি। নিজেকে কি মনে করে? দেখতে একটু সুন্দর হয়েছে তো কি হয়েছে? আমার মাথা কিনে নিয়েছে? আর আজেবাজে কথা বললে না উনার কোরিয়ান হিরোদের মতো সিল্কি চুলগুলো কেটে দেব।”
মেহের আবার আঙুল কামড়ে ভাবছে “এ আমার দ্বারা সম্ভব না। উনি আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে।”

মেহের ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেটের দিকে যাচ্ছে। সামিরার সাথে রাগ করেছে। আজ একাই যাবে।
“এই হিজাব কুইন।”
ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে মেহের দাঁড়িয়ে গেল। ফায়াজ আবার কেন ডাকছে? মেহের ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। তারপর আবার দ্রুত হাঁটতে লাগল। ফায়াজ দৌড়ে ওর কাছে এসে বলল,
“তোমাকে ডাকছি না। দাঁড়াচ্ছো না কেন? ফাজিল মেয়ে।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে থ। ফাজিল মেয়ে বলল। মেহের নাক ফুলিয়ে রেখেছে।
সেদিকে ফায়াজের চোখ পড়তেই বলল,
“আবার নাক ফুলায়। ইয়া আল্লাহ এই মেয়ে আমাকে পাগল করে ছাড়বে।”
ফায়াজ পকেট থেকে রুমাল বের করে মেহেরের সামনে গিয়ে ওর লেটকে যাওয়া কাজল মুছে দিচ্ছে। মেহের হা হয়ে ওর কান্ড দেখছে। তারপর আবার চারপাশে তাকাল। কত মানুষ চারদিকে। মেহের সরতে নিলে ফায়াজ ধমকে বলল,
“চুপ করে দাঁড়াও। নাচানাচি করছো কেন?”

কাজল মুছা শেষ হতেই ফায়াজ হালকা হেসে বলল,
“নাও গো সুইটহার্ট। সাবধানে যেও। লাভ ইউ।”

ফায়াজ চলে গেছে। মেহের তখনও দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। ফায়াজ কি করছে?

চলবে…..!

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৫|

ভার্সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। মেহের নাচ, গান দুটোতেই পার্টিসিপ্যাট করবে। মেহের নাচটা শখের বশে শিখলেও কখনো কোথাও ট্রাই করে নি। বাড়িতে নিজের ঘরে, বাবা-মায়ের সামনে, আপুর সাথে, কাজিন আর বান্ধবীদের সামনে পার্টিসিপ্যাট করেছে। কিন্তু আজ প্রথম ভার্সিটিতে গানের সাথে সাথে নাচও করবে। কেন করবে নিজেও জানে না। এখন অনুশীলন করতে যাচ্ছে।

“আমার কি কপাল। সবার রুমালে প্রেমিকার অথবা বউয়ের লিপস্টিকসহ ঠোঁটের ছাপ থাকে আর আমার রুমালে আমার বউয়ের চোখের কাজলের কালি। কি কপাল দেখেছিস শান।”
ফায়াজ ওর বন্ধু শান আর তুষারের মাঝে বসে ওদের দুজনের কাঁধে দুহাত তুলে বসে আছে। মেহের ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের কথা শুনে মেহেরের হাসি পাচ্ছে। মেহের মিটমিট করে হাসছে আর হাঁটছে।
ফায়াজ ওদের ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওর যেন হার্টবিট মিস হয়ে গেল। তারপর বুকে হাত দিয়ে বলল,
“মাই গড।”

তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটা কি দেখলাম আমি? মেহেরজান হাসলো? স্বপ্ন দেখলাম না কি?”

শান দাঁড়িয়ে ফায়াজের পিঠে হাত দিয়ে বলল,
“আরে না স্বপ্ন না। ভাবি সত্যিই হেসেছে।”

ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“তুই দেখেছিস? তোকে কে দেখতে বলেছে? আর দেখবি না খবরদার।”

শান হাত তুলে বলল,
“ওকে ভাই আর দেখব না। কখনো দেখব না।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে। যতদূর দেখা যাচ্ছে দেখেই যাচ্ছে।
“কি সুন্দর তোমার হাসি। অদ্ভুত সুন্দর। এর আগে কখনো তোমাকে ভালো করে দেখি নি। তাই তোমার এই হাসির সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয় নি।”

ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যার দৃষ্টিকোন থেকে প্রিয় অথবা প্রিয়ার সবটাই ভালো লাগে। তার হাসি, তার কথা বলা, তার হাঁটা-চলা সবটা।ব্যক্তির ছোট ছোট ক্ষুতগুলোও অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ধরা পড়ে চোখে। ফায়াজ আর মেহের দূরে থেকেও যেন কাছাকাছি অনুভূতি দ্বারা।

মেহের নাচের ক্লাসে গিয়ে থ। ওর নাম
নেই লিষ্টে। স্যারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারল মেহের না-কি নামই দেয় নি। কিন্তু মেহেরের স্পষ্ট মনে আছে ও সামিরার সাথে গান আর নাচ দুটোরই ফ্রম ফিলাপ করেছে। তাহলে কি হলো?
মেহের রুম থেকে বের হয়ে গেল। সামিরা ওর পেছনে পেছনে।
“মেহের তুই তো নাম দিয়েছিস। তাহলে লিষ্ট থেকে বাদ পড়লি কিভাবে? ”

“বাদ পড়ি নি। বাদ পড়ানো হয়েছে।”

সামিরা অবাক হয়ে বলল,
“মানে?”

মেহের দাঁড়িয়ে গেল। তারপর সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বুঝিস নি এখনো? ফায়াজ করেছে এ-সব। ও আমার ফ্রম সরিয়ে দিয়েছে। কত্ত খারাপ দেখেছিস?” (কাঁদো কাঁদো হয়ে)

সামিরা মৃদু হেসে বলল,
“খারাপের কি হলো? জিজু চায় তোর নাচ শুধু উনি দেখবেন। অন্য কেউ না। কত্ত প্রেম দেখেছিস।”

মেহের সামিরার দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ সরু সরু করে তাকাল।

ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আর সিগারেট ফুকছে। সামিরা ফায়াজকে দেখতে পেয়ে মেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে জোরে জোরে ফায়াজকে ডাকছে।
“ফায়াজ ভাই, মেহের আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।”

মেহের চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে সামিরার দিকে। ফায়াজ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর এক পা আগাল। মেহের হাত ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“একটা থাপ্পড় মারব। মিথ্যা,,,।

মেহের আর কিছু বলতে পারল না। মুখে হাত চেপে এক পাশে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গরগর করে বমি করে দিল। সামিরা দৌড়ে গিয়ে ওকে পানি দিল। ফায়াজ হাতের সিগারেটের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছুড়ে ফেলে দিল। মেহের বমি করে চোখে মুখে পানি দিয়ে বসে পড়ল ঘাসের উপর।

ফায়াজ মেহেরের কাছে গিয়ে পাগলের মতো করছে।
” মেহের খুব খারাপ লাগছে? চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”
ফায়াজ হাত বাড়াতেই মেহের বলল,
“দূরে সরুন। গন্ধটা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

সামিরা মেহেরকে দাঁড় করিয়ে ফায়াজকে বলল,
“আপনার তো জানার কথা মেহেরের সিগারেটে সমস্যা হয়।”
ফায়াজ মাথা নিঁচু করে নিল। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কখনো সিগারেট খাবে না।

.

ফায়াজ মেহেরের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“অনুষ্ঠানের দিনে পরবে।”

মেহের প্যাকেট খুলে লাল রঙের শাড়ি দেখতে পেল, সোনালী পাড়। শাড়িটা দেখে মেহেরের চোখ জুড়িয়ে গেল। মেহের শাড়িটা হাতে নিয়ে বলল,
“আমি শাড়ি পরব না। নিন আপনার শাড়ি।”
মেহের শাড়ি ফেরত দিতেই ফায়াজ নিয়ে নিল।
তারপর বলল,
“ঠিক আছে। পরতে হবে না। তুমি ওইদিন আসার পর আমি নিজ হাতে তোমাকে পরিয়ে দেব।”

মেহের ঢোক গিলে ফায়াজের দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“পরিয়ে দিবেন মানে কি?”

“মানে সুন্দর করে যত্ন করে পরিয়ে দেব৷ যদি সেটা সবার সামনে,,।”

মেহের ফায়াজের কথা শেষ না হতেই ওর হাত থেকে নিয়ে নিল। তারপর দৃষ্টি নত করে বলল,
“ঠিক আছে আমি পরব।”

ফায়াজ মুচকি হাসল। মেহের ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে কিছু বলছে।
ফায়াজ সেটা দেখে বলল,
“আবারও মনে মনে গালাগাল করছো? তোমার পুরনো অভ্যাস গেল না?”

মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকাল। ফায়াজ পুরনো কথা মনে রেখেছে। মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আপনি আমার ফ্রম কি করেছেন?”

ফায়াজ ভ্রু চুলকে বলল,
“সত্যিটা জেনে গেছো? তাহলে শুনো তুমি এত মানুষের সামনে নাঁচবে না। তুমি নিজেও চাও না। তবে জানি না কেন নাম দিয়েছো। শুধু এটুকু জানি তুমি নাঁচবে না।”

মেহের আর কিছু বলল না। ফায়াজ এটা করেছে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছে।
মেহের মনে মনে ঠিক করল ও কিছুই করবে না। না গান আর না নাচ। ফায়াজের দেওয়া শাড়িটা নিয়ে চলে এল।

মেহেরের ফোন বাজছে কখন থেকে। মেহের ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দ্রুত কল রিসিভ করল। মেহেরের মা ফোন করেছে। মেহের ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেহেরের মা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“মেহের মাহির ছেলে হয়েছে। তুই আসবি?”

মেহেরের মনের রাগ অভিমান ওর বোনের প্রতি বোনের ছেলের প্রতি না। মেহেরের খুব ভালো লাগছে যে ও খালা হয়ে গেছে। মেহেরও দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“আসব না মানে? আমি আসছি। এখুনি আসছি।”

মেহের ফোন কেটে দ্রুত রেডি হয়ে নিল। সাথে সামিরাকেও নিল।
মাহি ছেলেকে দেখে কেঁদে দিয়ে গালে হাত রেখে বলল,
“তোর মা খুব পঁচা জানিস তো। সে ভালো মেয়ে, ভালো বোন, ভালো স্ত্রীও হতে পারে নি। কিন্তু ভালো মা হবে। দেখিস।”

মেহের দরজায় উঁকি দিয়ে মাহি আর বাবুকে একসাথে দেখল। মাহি বাবুকে বিরবির করে কি জানি বলছে।
মেহের ভেতরে ঢুকতেই মাহি মৃদু হাসল। মেহের মাহির দিকে না তাকিয়ে বাবুর দিকে তাকাল। তারপর কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেল। কিছুক্ষণ আদর করল।

মাহি মেহেরকে দেখছে। তারপর বলল,
“শুনলাম ফায়াজ না কি ফিরে এসেছে?”

মেহের ওর প্রশ্ন শুনে থমকে গেল।
তারপর বলল,
“হ্যাঁ, তো?”

মাহি কিভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“তোর সাথে ওর কথা হয় নি? ”

মেহের হালকা হাসল প্রতিউত্তরে।
“এসেছে তার খবর যখন পেয়েছো। কিছু বলেছে কি না, কথা হয়েছে কি না তাও জানার কথা।”

মাহি আর কোনো কথা বলল না। কারণ মাহি জানে মেহের ঠিক বলছে। মাহি সব খবর জানে।

মেহের তার পরের দিন ভার্সিটি মিস দিয়ে হসপিটালে গিয়েছে মাহির ছেলেকে দেখতে। হাতে অনেকগুলো ব্যাগ। মাহির ছেলের জন্য অনেক কিছু কিনে এনেছে। ছোট ছোট জামাকাপড়। খেলনাও এনেছে। জানে এতটুকু বাচ্চা খেলতে পারে না তবুও নিয়ে এসেছে।
ফায়াজ আজ মেহেরকে পায় নি ভার্সিটিতে। ফায়াজ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। আজ মেহেরকে দেখে ছাড়বে। এতবড় সাহস ভার্সিটিতে আসে নি। ফায়াজকে কষ্ট দিচ্ছে।

ফায়াজ মেহেরের হোস্টেলের সামনে যেতেই মেহেরকে ভেতরে ঢুকতে দেখে। মেহের ঢুকতে যাবে তখনই ফায়াজ ওকে ডাকল। ভেতরে ঢুকবে না ফায়াজের সামনে যাবে বুঝতে পারছে না। এসব ভাবাভাবির মাঝেই ফায়াজ আবারও ডাকল।

মেহের বাধ্য হয়ে ফায়াজের গাড়ির সামনে গেল। ফায়াজ গাড়ির দরজা খুলে মেহেরকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর নিজের কোলের উপরে বসাল। মেহের সরার জন্য দস্তাদস্তি করছে বের হওয়ার জন্য। ফায়াজ ওকে চেপে ধরে বলল,
“সারাদিন কই ছিলে? কোথায় ঘুরঘুর করছিলে? আমার ফোন রিসিভ করো নি কেন?”

মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“হসপিটালে ছিলাম।”

ফায়াজ হসপিটালের কথা শুনে বলল,
“কেন? শরীর খারাপ না কি তোমার?”

“না আসলে আপুর বেবি হয়েছে।” (নিচুস্বরে)

ফায়াজ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“তাই না কি? আমার প্রমোশন হয়ে গেছে। খালু হয়ে গেছি।”

মেহের ফায়াজের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। ভাবল কি আর হলো কি। ভেবেছিল ফায়াজ মন খারাপ করবে কিন্তু না। মেহের চুপ করে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
“ফোন তুলো নি কেন? আমাকে ছটফট করাতে তোমার ভালো লাগে?”

মেহের কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,
“ছাড়ুন আমি যাব।”

“আরেকটু দেখতে দেও।”

“দেখেই তো যাচ্ছেন। আমি কি আইসক্রিম না চকলেট এভাবে তাকিয়ে আছেন?”

“তার চেয়ে লোভাতুর কিছু।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেল। চোখে মুখে লজ্জা নিয়ে বলল,
“আপনার দেখা শেষ? ”

“তোমাকে দেখে আমার মন ভরে না।”

“এত মন ভরাতে হবে না। আমাকে যেতে দিন।”

“মন না ভরলে তো মরে যাব।”

মেহেরের বিরক্ত লাগছে। বিরক্ত নিয়ে বলল,
“তাহলে মরে যান।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে মেহেরকে ছেড়ে দিল। মেহের ছাড়া পেয়ে হেঁটে হেঁটে ভেতরে চলে গেল।
মেহের যেতে যেতে ভাবছে, “মুখ ফস্কে এটা কি বলে ফেলল?”
ওর খুব খারাপ লাগছে। এই কথাটা বলা একদম ঠিক হয় নি।

চলবে…..