#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৮|
মেহের কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে আছে। ফায়াজ প্লেটে খাবার রাখছে, মেহের ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ খাবারসহ প্লেট মেহেরের হাতে দিল। ফায়াজ এ-সব কি করছে, কেন করছে? সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মেহের প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছে। ফায়াজ মেহেরকে চুপ দেখে বলল,
“তোমাকে কি খাইয়ে দিতে হবে? তুমি কি তাই চাইছো? তবে সরি আমি খাইয়ে দিতে পারব না। অত ঢং করতে পারব না।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে লজ্জা পেল। তারপর বলল,
“না মানে, এ-সব কেন? আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন কেন?”
ফায়াজ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“হোস্টেলের খাবার খেয়ে রোজ রোজ অসুস্থ হয়ে পড়ছো সেটা কি আমি জানি না? তুমি আর বাইরের খাবার খাবে না। আমি রোজ তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসব। নেও এখন এত কথা বলো না। চুপচাপ খাও।”
মেহের বুঝতে পারছে না কি করে খাবে ফায়াজের সামনে। গাড়িতে বসে ফায়াজের সামনে বসে খেতে ওকওয়ার্ড লাগছে। ফায়াজ বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে নেমে গেল। মেহের মুচকি হেসে খেতে শুরু করল।
.
মেহেরের জন্য ফায়াজ রোজ রোজ খাবার নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় হোস্টেলের সামনে খাবার নিয়ে যায়। মেহেরকে বাইরের খাবার খেতে দেয় না।
মেহের এখন ফায়াজের আনা খাবারই খায়।
.
মেহের, অনু আর সামিরা এক সাথে সিড়ি দিয়ে নামছে কথা বলতে বলতে। হটাৎ করে মেহের ছিটকে পড়ে গেল। সামিরা আর অনু মেহেরের নাম ধরে চিতকার করে মেহেরকে ধরে উঠালো। মেহের পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তাছাড়া ডান হাত মারাত্মক ভাবে কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে গড়িয়ে। হাতের কনুই ছিলেও গেছে। মেহের ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছে। কাটা-ছেঁড়া, রক্ত এগুলোকে মেহের মারাত্মক ভয় পায়। মেহেরকে ভার্সিটির মিনি হসপিটালে নিয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের জন্য একজন ডাক্তার নিয়োজিত আছে সব সময়ের জন্য। সেখানে কয়েকটা বেডও আছে। প্রাথমিক চিকিৎসার সব ব্যবস্থা আছে সেখানে।
মেহের টলমলে চোখে সামিরার হাত এক হাতে চেপে ধরে কাটা জায়গা দেখছে আর ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছে। ডাক্তার মেডিসিন বের করছে। মেহেরের খুব ভয় লাগছে।
ফায়াজ তার দু’চার জন বন্ধু নিয়ে ভেতরে ঢুকে। ফায়াজের দৃষ্টি প্রথমেই মেহেরের দিকে গেল। মেহেরের অসহায় ফেস দেখে ফায়াজের খুব কষ্ট হচ্ছে। মেহের ফায়াজকে দেখে চেহারা থেকে ব্যথাতুর ভাব সরিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
ফায়াজ মেহেরকে একবার দেখে সামিরাকে বলল,
“কি করে হলো এ-সব?”
সামিরা ফায়াজকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলল,
“ও হটাৎ করে পড়ে গেছে। কিভাবে পড়ল বুঝতে পারছি না। আমাদের সাথেই তো হাঁটছিল।”
ফায়াজ মেহেরের পাশে বসে বলল,
“দেখেশুনে সাবধানে হাঁটতে পারো না?”
ডাক্তার স্যাভলন আর তুলো নিয়ে কাটা জায়গায় স্পর্শ করতেই মেহের “আহ” করে লাফিয়ে উঠল।
ফায়াজ বিচলিত হয়ে ডাক্তারকে বলল,
“আংকেল একটু আস্তে। দেখছেন তো ব্যথা পাচ্ছে।”
ডাক্তার হেসে বলল,
“বাবা আমি তো আস্তেই দিয়েছি। তুলোতে মেডিসিন দিয়েছি অন্য কিছু না। একটু ধরবেই।”
ফায়াজ মেহেরের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল যাতে না দেখে কাটাস্থানটা। মেহেরের হাতে আবারও ওষুধ দিতেই ও ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল। আর অন্য হাতে ফায়াজের টিশার্ট খামচে ধরে চোখের পানি ফেলছে। খুব জ্বলছে কাটা জায়গা গুলো।
ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে মেহের মাথা তুলে। ফায়াজ মেহেরের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“ব্যান্ডেজ করা শেষ। ভালো হয়ে যাবে।”
ডাক্তার ফায়াজের কথা শুনে বলল,
“ইঞ্জেকশন দিতে হবে। নয়তো ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইঞ্জেকশন দিলে দ্রুত সেরে উঠবে।”
ইঞ্জেকশনের কথা শুনে মেহের আবারও কেঁদে দিয়ে বলল,
“ফায়াজ, আমি ইঞ্জেকশন দেব না। আমার খুব ভয় লাগে। খুব ব্যথা লাগবে ইঞ্জেকশনে।”
ফায়াজ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না দিলে হয় না?”
ডাক্তার বলল,
“ইঞ্জেকশন নিয়ে রাখা ভালো। ওর জন্য ভালো হবে।”
মেহের সেটা শুনে দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে।
“আমি দেব না। বাস্।”
ফায়াজ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আংকেল আস্তে করে দেবেন। ব্যথা যেন না পায়।”
ফায়াজের বন্ধু মজা করে বলল,
“জি আংকেল, লাইলিকে দিলে মজনুর ব্যথা লাগবে। দেখছেন না এক জনের ব্যথায় অন্যজন কুকঁড়ে যাচ্ছে। তাই আস্তে করে দেবেন।”
ফায়াজ চোখ পাকিয়ে তাকাল। ওরা থেমে গেলেও মুখ চেপে হাসছে।
ফায়াজ বলল,
“সবাই ভীড় কমাও এখান থেকে। যাও যাও।”
একে একে সবাই বের হয়ে গেল। ফায়াজ ডাক্তারের দিকে তাকাল। তারপর ইশারা করল ইঞ্জেকশন দিতে। ফায়াজ মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেউ ইঞ্জেকশন দিবে না তোমাকে। কান্না থামাও।”
ডাক্তার মেহেরের হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করলে মেহের তাতিয়ে উঠে। সরতে নিলে ফায়াজ চেপে ধরে। ডাক্তারের কাজ শেষ। তিনি চলে গেলেন। মেহের শব্দ করে কেঁদে দিল। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে আর বিরবির করে বলছে,
“আপনি এত খারাপ কেন? খুব খারাপ। জোর করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন।”
ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আহারে! ফেচফেচ করে শুধু কাঁদতেই পারে। কাদুনি বউ আমার।”
ফায়াজ মেহেরকে নিয়ে বাইরে বের হচ্ছে ধীরে ধীরে। অনু আর সামিরা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামিরা ফায়াজকে বলল,
“ভাইয়া অনু বলছে কেউ হয়তো ওকে ফেলে দিয়েছে। ও পড়ে যায় নি।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দিল। মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“কেউ ফেলে নি। আমি নিজেই পড়ে গিয়েছি।”
তারপর অনুকে ইশারা করল চোখ দিয়ে।
ফায়াজ সেটা দেখে খেকিয়ে বলল,
“মেহের কি লুকাচ্ছো? সত্যি করে বলো।”
তারপর অনুকে বলল,
“ঘটনা খুলে বলো।”
অনু মেহেরের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল।
তারপর বলতে শুরু করল,
“আমরা যখন হাটঁছিলাম তখন একজন ইচ্ছে করেই মেহেরকে ধাক্কা মারে। এটা যে এক্সিডেন্ট নয় সেটা বুঝাই যাচ্ছিল। আমি দেখেছি।”
ফায়াজ কপাল কুচকে বলল,
“কে সে? কার এত বড় স্পর্ধা?”
অনু তাকে দেখে নি। তাই কনফিউজড হয়ে বলল,
“আমি তাকে চিনি না। আমাদের সিনিয়র হবে শিউর।”
ফায়াজ ডান হাতের কব্জি উল্টো করে অন্য হাতে চাপকে বলল,
“শিট! হু ইজ দ্যা ইডিয়ট?”
অনু তো তাকে চিনে না।
“ভাইয়া একটা মেয়ে। তাকে আমি চিনি না বাট দেখলে চিনতে পারব।”
“গুড। ভেরি গুড।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“খুঁজতে শুরু করে দেও তাকে।”
মেহের চোখ বড়বড় করে ফায়াজের দিকে তাকাল। আর বেচারি অনু ফেসে গেছে। এখন সারাদিন ধরে খুঁজতে থাকো।
মেহের ফায়াজকে বলল,
“অনু কি এখন সারাদিন ওই মেয়েকে খোজঁবে? বাদ দিন না। যা হওয়ার হয়েছে।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে রাগী ফেস করে তাকিয়ে বলল,
“না বাদ দিব না। কেউ তোমাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিবে, তোমার এই হাল করবে আর আমি তাকে ছেড়ে দেব? কখনো না। তোমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে ওকে ততটা কষ্ট পেতে হবে। এত বড় সাহস ওই মেয়ের। ওকে আমি পাই একবার।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“পেলে কি করবেন হা? মেয়েদের গায়ে একদম হাত দিবেন না। এটা ব্যাড ম্যানার।”
“না গায়ে হাত দেব কেন? আমি কি পাগল নাকি?”
মেহের মিনমিন করে বলল,”সেরকমই। সাইকো একটা।”
ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
“তোমার জন্য।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে থমকে গেল।
ফায়াজ মেহেরকে গাড়িতে বসিয়ে বলল,
“তুমি কি আমাকে ক্ষমা করোনি এখনও? ফিরবে না আমার কাছে?”
মেহের জবাব দিল না। ফায়াজও ফোর্স করল না।
মেহের গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে যেতে নিয়ে থেমে গেল। তারপর ফায়াজের কাছে এসে বলল,
“আপনার মাথায় ঘোরতর প্রব্লেম আছে। খুব ভয়ংকর আপনি। কিন্তু তাতে আমার প্রব্লেম নেই। যদি কোন দিন মনে হয় আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন তাহলে আমি নিজেই আপনার কাছে ফিরব আপনার দেওয়া যেকোনো শর্তে।”
মেহের চলে যেতে নিলে ফায়াজ গাড়ি থেকে নেমে মেহেরের হাত ধরে বলল,
“আমার কোনো শর্ত নেই। তুমি যেদিন ফিরবে সেদিন আমার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে ফিরো তাহলেই হবে। আমি মানুষটা ভালোবাসার বড্ড কাঙাল। তাই চাই কেউ আমাকে এমন ভাবে ভালোবাসুক আমাকে ছাড়া যেন তার নিশ্বাস আটকে আসে।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে গাড়িতে ওঠে বলল,
“নিজের খেয়াল রেখো। আর আমি মেডিসিন পাঠিয়ে দেব। সময় মতো খেয়ে নিও।”
সে মেয়ের খোঁজ পেয়েছে অনু। বেচারি তাকে হন্য হয়ে খুজেছে এতদিন। সে হচ্ছে ফায়াজের ক্লাসমেট হিমি। সেই হিমি যে কি না মাহিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল ফায়াজকে প্রেমে পড়াতে পারবে না। হিমি ফায়াজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার ফেসে যতটা ভয় থাকার কথা ততটা নেই। এই অতি সামান্য ভয় দেখে মেহেরের আশ্চর্য লাগছে। একটা মেয়ে হিমির হাত ধরে রেখেছে। ফায়াজ ওর চারদিকে এক চক্কর দিয়ে বলল,
“হোয়াটস ইউর প্রব্লেম উইথ মেহের?”
হিমি মেহেরের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“কোনো সমস্যা নেই।”
ফায়াজ চেঁচিয়ে বলল,
“তাহলে ধাক্কা মেরেছো কেন?”
মেহের নরম স্বরে বলল,
“ফায়াজ বাদ দিন।”
ফায়াজ হিমির দিকে তাকাল। হিমির চোখে আগুন দেখতে পাচ্ছে। ফায়াজের ডাউট নেই কোনো। হিমি ওকে ইচ্ছে করেই ফেলেছে। ফায়াজ একটা ব্লেড নিয়ে ওর হাতে পুচ দিল। মেহের সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে চিতকার করল হিমির আগেই।
চলবে…..!
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৯|
মেহের সেই কখন থাকে ফেচফেচ কেঁদেই যাচ্ছে। ফায়াজ পকেট থেকে রুমাল বের করে মেহেরের সামনে ধরল। মেহের রুমাল না নিয়ে হাত দিয়েই চোখের পানি মুছছে। ফায়াজের খুব অদ্ভুত লাগে মেহেরকে।ও পুরো দিন দুনিয়া ভুলে কাঁদতে বসে। মনে হয় ৪-৫বছরের বাচ্চা৷ তাকে ঘন্টাখানেক ধরে বায়না করার মতো কেঁদে যেতেই হবে।
ফায়াজ হিমির হাতে পুচ দেওয়ার পরে হিমি অন্য হাতে কাটা হাত চেপে ধরল। ফায়াজ ওকে হাজারো জেরা করে কিছুই জানতে পারল না। হিমির এক কথা ও ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে নি। ফায়াজ মেহেরের জন্য আরো কড়াকড়ি হতে পারে নি। নয়তো এমন থেরাপি দিত বাপ বাপ করে পালাত। কিন্তু মেহেরের কান্নাকাটিতে অতিষ্ট হয়ে হিমিকে ছেড়ে দেয়।
ফায়াজও জেদ করে পকেটে রুমাল রেখে দিল।
“আপনি বড্ড নিষ্ঠুর৷ একটা মানুষ কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? আপনার একটু মায়া হলো না?”
মেহের হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল।
মেহেরের কথা শুনে ফায়াজের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগের নাকের ডগা লাল হয়ে যাচ্ছে যার আভা গালেও ছড়িয়ে পড়ছে। চোখ লাল করে বলল,
“হ্যাঁ আমি নিষ্ঠুর। মায়া হয় নি ওর প্রতি। কেন মায়া হবে? ওর কি তোমার প্রতি মায়া হয়েছিল? তোমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট ওর প্রাপ্য।”
মেহের নিচু স্বরে বলল,
“আপুটা তো ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয় নি। জাস্ট এক্সিডেন্ট।”
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“সবাইকে নিজের মতো সরল মনে করো না। দুনিয়াটা আর সরলদের নেই। আর না দূর্বলদের।”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল।
ফায়াজ নিজেকে শান্ত করে নরম সুরে বলল,
“মেয়েটা ইচ্ছে করে করেছে। আমি মানুষ চিনি। ওর আমার অথবা তোমার প্রতি কোনো বিশেষ কারণে প্রচন্ড ক্ষোভ আর ঘৃণা রয়েছে। আমি ওর চোখ দেখেছি। ভয়ংকর দৃষ্টি আর ক্ষোভ দেখেছি।”
মেহের ভেবে পাচ্ছে না যাকে চিনে না তার সাথে কিসের শত্রুতা।
“উনি যদি আপনার নামে কমপ্লেইন করে?”
ফায়াজ আলতো হেসে বলল,” ওর বফের বারোটা বাজাব।”
“যদি বফ না থাকে? তবে কি করবেন?”
ফায়াজ গম্ভীরমুখে বলল,
“ওর সাহস হবে না। যদি সাহস করে করুক। আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার ভয় তোমাকে নিয়ে। কেউ আমার দূর্বলতা হিসেবে তোমাকে চিহ্নিত করে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়? এই ভয়টা আমাকে গ্রাস করে ফেলছে দিন দিন।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ মেহেরের ভয়ার্ত চেহারা দেখে বলল,
“আরে তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি থাকতে কেউ তোমার ছায়াও মারাতে পারবে না। ভয় পেও না। আমি আছি তো।”
ফায়াজ মনে মনে নিজেকেই গালাগাল দিচ্ছে। এই ভীতু মেয়েকে কেন এ-সব বলতে গেল। এখন তো ভয়ে ভয়ে দিন রাত পার করবে।
.
ফ্রেশমুডে মেহের ক্লাস শেষে বারান্দা দিয়ে লাইব্রেরীতে যাচ্ছে। মৃদুস্বরে গুনগুন করছে। তখনই নিচ থেকে হৈ-চৈ, চেচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মেহের দাঁড়িয়ে যায়। বারান্দা দিয়ে নিচটা দেখার চেষ্টা করে। দূরে একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। মেহের বুঝতে পারছে না মাঠের কোনায় এত জটলা কেন? এত মানুষ কি করছে? আর কিসেরই বা এত চেচামেচি। মেহের লাইব্রেরীতে না গিয়ে সিড়ি ধরে দুতলা থেকে নিচে নামছে দ্রুত। জটলার কিছুটা কাছে যেতেই সামিরা ওর হাত ধরে।
মেহের সামিরাকে দেখে বলল,” কি রে! কি হলো?”
সামিরা শুকনো মুখে বলল,
“কোথাও যাচ্ছিস?”
“ওখানে এত ভীড় কিসের? দেখতে যাচ্ছি। কিসের ভীড় জানিস কিছু?”
“না। ওখানে যেতে হবে না। চল ক্ষুধা পেয়েছে ক্যান্টিনে যাই।”
“তুই যা। আমি গিয়ে কি করব? আমি তো বাইরের খাবার খাই না। আমি দেখি ওখানে কি হচ্ছে।”
মেহের সেদিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মারামারি হচ্ছে। আচ্ছা ফায়াজ নেই তো ওখানে? মেহেরের মনে নানান প্রশ্ন জড়োসড়ো হচ্ছে।
সামিরা মেহেরকে যাওয়া থেকে আটকাতে ব্যর্থ হলো। তাই ও বাধ্য হয়ে মেহেরের পেছনে পেছনে গেল। মেহের দূর থেকেই দেখতে পেল ফায়াজের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে আর ফায়াজ একাই একটা ছেলেকে মারছে। ছেলেটা মাটিতে পড়ে আকুতি মিনুতি করছে কিন্তু না ফায়াজ ওকে ছাড়ছে আর না কেউ ওকে সাহায্য করছে। ফায়াজ এলোপাতাড়ি লাথি মারছে আর কি যেন বলছে। ফায়াজের চোখ যেন জলন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রচন্ড রাগ নিয়েই মারছে সেটা বুঝা যাচ্ছে।
সামিরা মেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মেহের বলল,
“দেখ কতটা নিষ্টুরভাবে ছেলেটাকে মারছে। একটু দয়া মায়া নেই। আসলে কিছু মানুষ নিষ্টুর হয়েই জন্মায়। কিছু মানুষ কখনো শুধরায় না।”
মেহের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ছেলেটার মার সহ্য করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ফায়াজকে কিছু বলতে আবার ভয়ও পাচ্ছে। তাই কাঁদছে।
সামিরা মেহেরকে শান্তনা দিচ্ছে। মেহের কেঁদেই যাচ্ছে।
“মেহের চল এখান থেকে।”
“কেউ আটকাচ্ছে না কেন?” মেহের কান্নারত অবস্থায় বলল।
“কে আটকাবে? কে মার খেতে যাবে ইচ্ছে করে।”
মেহের আবার ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ছেলেটার কলার ধরে দাঁড় করাল। ছেলেটা দাঁড়াতে পারছে না। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। ফায়াজ হিংস্র বাঘের মতো আচরণ করছে। ছেলেটা কি যেন বলছে। নিশ্চয়ই বলছে ছেড়ে দিতে।
মেহেরের খুব মায়া হচ্ছে ছেলেটার জন্য। কিন্তু নিজের ভীতু মানসিকতার জন্য কিছুই করতে পারছে না।
তাই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
.
“রবিন ভাই, ফায়াজ আমার বন্ধুকে মেরেছে। খুব খারাপ অবস্থা ওর। ছেলেটাকে মেরে কি অবস্থা করেছে। এখন আইসিওতে আছে। ভাই আপনি এর বিচার করুন। কিছু করুন।”
একটা ছেলে ফায়াজের বিপরীত দলের লিডার রাসেলকে বলল।
রাসেল সবটা শুনে বলল,
“ঘটনা খুলে বল। কেন, কিভাবে ঘটেছে এ-সব।”
ছেলেটা সব খুলে বলল। তারপর রাসেল ওর দলবল নিয়ে হসপিটালে গেল ওই ছেলেটাকে দেখতে যাকে ফায়াজ মেরেছে। ছেলেটাকে দূর থেকে দেখে বলল,
“ফায়াজের খুব বাড় বেড়েছে তাই না? ওকে কাবু করার রাস্তা পেয়ে গেছি। ওর জিএফ।” তারপর বিশ্রীভাবে হাসি দিল।
পরের দিন মেহের ভার্সিটিতে যেতেই ফায়াজ ওর কাছে আসতেই মেহের ওকে এড়িয়ে যেতে নিলে ফায়াজ রাস্তা আঁটকে নেয়।
“হোয়াটস ইউর প্রব্লেম?”
মেহের দৃষ্টি নত করে হাতজোড় করে বলল,
“সরে যান প্লিজ। আমি এখন আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।”
“মেহের, কি হয়েছে তোমার?” ফায়াজ বিচলিত হয়ে বলল।
মেহের জবাব না দিয়ে আবারও গেইট দিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজ ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে।
“মেহের কি হয়েছে? আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন? আমার রাগ লাগছে খুব। আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।”
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে বলল,
“আমি আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছি কারণ আমি আপনাকে ভয় পাই। বুঝতে পারছেন? ভয় পাই। গতকালের ঘটনা আমি ভুলতে পারছি না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। আমাকে একা ছেড়ে দিন।”
ফায়াজ বুঝতে পারল মেহের গতকালের মারামারি দেখে ফেলেছে। এইজন্য গতকাল থেকেই এড়িয়ে যাচ্ছে৷
মেহের আকুতিভরা কন্ঠে বলল,
“প্লিজ। আমার পেছনে আসবেন না।”
মেহের একা একাই হেঁটে যাচ্ছে। ফায়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মেহের কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। শুধু হেঁটে যাচ্ছে।
.
মেহের সেই সকাল থেকে পার্কের এই বেঞ্চিতে বসে আছে। সূর্যটা মাথার উপরে কড়াভাবে রোদ দিচ্ছে। ঘেমে গেছে প্রচন্ড। মুখটাও মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে৷ এই কাঠফাটা দুপুরের রোদে পার্কে কেউ নেই। ও একাই বসে আছে। মেহের হটাৎ কেমন একটা শব্দ পেয়ে ঘাবড়ে গেল। ভয় ভয় লাগছে একা এখানে।
“আমার এখন উঠা উচিত। এখানে আর বসে থাকা উচিত না।”
মেহের পাশে রাখা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দাঁড়াতেই কেউ ওর মুখটা চেপে ধরল। মেহের ছুটার জন্য ছটফট করছে। হটাৎ ওর ছটফটানো শরীর নীরব হয়ে গেল। ঢলে পড়ল।
।
ফায়াজ মেহেরকে হন্ন হয়ে খোঁজছে। সামিরার কাছে জেনেছে মেহের হোস্টেলে যায় নি। এমন কি ওর ফোনটাও বন্ধ। ও বাড়িতে কিংবা বোনের বাড়িতেও যায় নি। মেহেরকে খোঁজে না পেয়ে ফায়াজের মাথা নষ্ট। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
“কেন আমি ওকে একা যেতে দিলাম? কেন দিলাম? কেন ওকে আটকালাম না? তাহলে তো মেহের হারিয়ে যেত না। ও কোথায় আছে? কেমন আছে? মেহের কোথায় তুমি?”
ফায়াজ দু’হাতে মুখ চেপে ধরে বসে পড়ল।
ওর বন্ধুরা ওকে শান্তনা দিচ্ছে।
“ফায়াজ তুই যদি ভেঙে পড়িস তাহলে ওকে খোঁজে বের করবি কিভাবে? মেহের ঠিক আছে। ওকে আমরা পেয়ে যাব।”
।
মেহের চোখ খুলে নিজেকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবিষ্কার করল। মেহের এই অন্ধকারে এক টুকরো আলোর সন্ধান করছে। মেহের নড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু তার পায়ে আর হাতে বাঁধন অনুভব করছে। মেহেরের পার্কের ঘটনা মনে পড়ে গেল। কেউ ওর মুখ চেপে ধরেছিল। মেহেরের মনে কু ডাকছে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। খুব খারাপ ঘটনা। এই বিদঘুটে অন্ধকারে মেহেরের খুব ভয় লাগছে।
মেহের চিতকার করে বলল,
“ফায়াজ! ফায়াজ! কোথাও আপনি? আমার অন্ধকার খুব ভয় লাগে।”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেহেরের খুব ভয় লাগছে। মেহের কেঁদে দিল।
“আমার খুব ভয় লাগছে।”
মেহেরের গলা শুকিয়ে এসেছে। তৃষ্ণা পেয়েছে খুব। একটু পানি খাওয়া দরকার।
হটাৎ লাইট জ্বলে উঠল। এই অন্ধকারে আলোর ঝলকানিতে মেহেরের চোখ তাতিয়ে গেল। মেহের চোখ বন্ধ করে নিল তীব্র আলোর ঝাপটায়। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে অপরিচিত একটা লোককে দেখে ওর কলিজা শুকিয়ে এল। এখন আর গলায় তেষ্টা নেই।
লোকটা বিশ্রীভাবে ওকে দেখছে। মেহের ভয়ে লেপ্টে আছে।
“আহারে! এভাবে বেঁধে রেখেছে তোমাকে?”
লোকটা মেহেরের বাঁধন খুলে নিল।
তারপর বলল,
“আমি রবিন। ফায়াজ! তোমার বয়ফ্রেন্ডের সব চেয়ে বড় শত্রু।”
মেহের উনার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। সব চেয়ে বড় শত্রু। তাহলে এখন ওর কি হবে?
এই লোক ওকে এখানে কেন এনেছে?
মেহের উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে বলল,
“ফায়াজ আমার বয়ফ্রেন্ড না।”
রবিনও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাহলে কি তোমার? তুমি ওর রক্ষিতা না কি?” বিশ্রীভাবে হাসল।
মেহেরের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে উনার কথা শুনে।
বিস্ফোরিত চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হি ইজ মাই হাসব্যান্ড।”
রবিন মেহেরের কথা শুনে বিষম খেল। ফায়াজ বিয়ে করেছে আর ও জানে না! এই মেয়েটা ফায়াজের ওয়াইফ!
“আরে বাহ! তাহলে তো আরো ভালো হলো। এতো দেখছি ফায়াজের মতোই ঝাঝ।”
রবিন মেহেরের দিকে এগুতেই মেহের পিছিয়ে গেল। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা গলায় বলল,”আপনি আমার দিকে আসছেন কেন?”
“আরে তোমার হাসব্যান্ড আমাকে এতবড় সারপ্রাইজ দিল আর আমি ওকে কোনো গিফট দেব না? ওকেও সারপ্রাইজ গিফট দেব।”
রবিন মেহেরের একদম কাছে চলে যাচ্ছে। মেহের দেয়ালের সাথে মিশে চোখ বন্ধ করে এক পাশে ঘুরে আছে। রবিন মেহেরের হিজাব ধরে টান মারল। মেহের চিতকার করে অন্যদিকে ছিটকে চলে গেল। হিজাবের এক পাশ ছুটে গেছে। মেহের হাতে ছুটে যাওয়া পাশটা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে লেপ্টে চোখ বন্ধ করে কাঁদছে আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছে। রবিন আবারো মেহেরের হিজাব ধরতেই মেহের চিতকার করে বলল,”ফায়াজ! কোথায় আপনি?”
“তোমার ফায়াজ ভাতঘুম দিচ্ছে। তাই ওর নাম জপ করে লাভ নেই।”
মেহেরের মনে হচ্ছে আজ আর ও নিজেকে এই পশুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আজ ওর শরীরে ধর্ষিতার ট্যাগ লেগে যাবে। আজ ওর জীবনের শেষ দিন। মেহের জোরে জোরে কাঁদছে আর হিজাব ধরে রেখেছে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। আর রবিনও হিজাব খোলার চেষ্টা করছে।
তখনই ফায়াজের কন্ঠস্বর ভেসে এল। ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে রবিনের পিলে চমকে গেলেও মেহের শুকনো মরুভূমির মধ্যে এক সাগর জলের সন্ধান পেল। হাজারো আশারা উঁকি দিচ্ছে।
রবিন মেহেরের হিজাব ছেড়ে দিয়ে ফায়াজের দিকে ঘুরল। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেছে। কেঁদেই যাচ্ছে। ফায়াজ দৌড়ে মেহেরের কাছে যেতেই মেহের ফায়াজের বুকে ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে তখনও। ফায়াজ মেহেরকে দু’হাতে আগলে রবিনের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল৷
চলবে……!