শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৩০+৩১

0
3622

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩০|

ফায়াজ মেহেরকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি এখানে দাঁড়াও।”
মেহের চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। ফায়াজ রবিনের দিকে আগাচ্ছে। ফায়াজের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেই আগুনে সামনের সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। রবিনও চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে মুখে ভয়ের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না।

ফায়াজ ওর কলার ধরে বলল,
“তুই নিজেও জানিস না তুই কি করেছিস। কত বড় ভুল করেছিস। জানলে তোর কলিজা কেঁপে উঠত এই কাজ করতে। তুই ফায়াজের কলিজায় হাত দিয়েছিস। বড় ভুল করে ফেলেছিস।”

ফায়াজ রবিনের কলার চেপে ধরেছে আর রবিনও কম যায় না। রবিনও ফায়াজের কলার চেপে ধরেছে।
“কি করবি তুই? হাহ!”

ফায়াজ ঘাড় কাত করে আবার সোজা করে ওর কলার ছেড়ে দিয়ে মৃদু হাসল। রবিন অবাক হয়ে ওর কান্ড দেখছে। ফায়াজ হটাৎ করে ওর নাক বরাবর ঘুষি মারল। রবিন আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে না পড়ে ছিটকে সরে যায়। ফায়াজ ওকে সুযোগ না দিয়ে তুলে ধরে দেয়ালে অনবরত ওর মাথা বাড়ি মারছে। মেহের ভয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফায়াজ রবিনকে গালিগালাজ করছে আর মারছে। কিন্তু সে সুযোগ বেশী সময় পায় নি। পুলিশ চলে এসেছে। রবিনকে পুলিশ জোর করে ফায়াজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

রবিন পুলিশের সাথে যেতে যেতে বলল,
“পুলিশ আমাকে বেশী দিন আটকে রাখতে পারবে না। আমি বের হয়ে আসব।”

ফায়াজের বন্ধুরা ওকে চেপে ধরে আছে। ফায়াজ তবুও বলল,
“শালা তুই বের হ। তারপর তোকে আমি কেটে কুটিকুটি করব। তোর চোখ তুলে নিব। তুই মেহেরের দিকে নজর দিয়েছিস।”

রবিন আর রবিনের সাথের ছেলেদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ প্রথমে ভেবেছিল হিমি কিছু করেছে। তাই ও ওর বন্ধুদের নিয়ে হিমির কাছে যাচ্ছিল। আর তখনই কেউ একজন ওকে ফোন করে। রবিনের দলে ওর একজন ইনফর্মার আছে। যে কি না রবিনের গতিবিধি লক্ষ্য রাখে। সন্দেহজনক কিছু হলে ফায়াজকে জানায়। ও ফায়াজকে জানিয়েছে মেহেরের কথা আর মেহেরের লোকেশন জানায় যার ফলে খুব শীঘ্রই মেহেরকে খোঁজে পায়।

ফায়াজের বন্ধু তুষার ওকে বলল,
“ভাই, এ-সব বাদ দে। ভাবীকে দেখ। কেমন ভয় পেয়ে আছে।”

ফায়াজ রবিনের ব্যাপারটা ছেড়ে মেহেরের দিকে নজর দিল। ফায়াজের রাগ লাগছে কারণ ও রবিনকে মন মতো ধোলাই করতে পারে নি। রবিনকে মেরে তৃপ্তি মিটে নি। ফায়াজ মেহেরের সামনে যায়। মেহের তখনও ফুপাচ্ছে।
ফায়াজ মেহেরের দুবাহু ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“দেব ঠাটিয়ে এক চড়? তোকে বলেছিলাম পাকনামি করতে? এত তেজ কেন তোর? তুই এত নির্বোধ কেন? ঘটে কি ছিটেফোঁটা বুদ্ধি নেই? গাধা একটা।”
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সামনে এভাবে অপমান করছে সেটা মেহেরের বড্ড লাগছে। মেহেরের কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যাচ্ছে। ফায়াজের আরো রাগ লাগছে। তাই ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ! কাঁদলে একদম মেরে ফেলব।”

মেহের সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দিল। ফায়াজের বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক এক করে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফায়াজ আবারো মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেহের শান্ত হয়ে গেল।
“তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো? তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?”
মেহের শান্ত হয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না।

.

ফায়াজ মেহেরকে পানির বোতলের খাপ খুলে এগিয়ে দিল। মেহের কাঁপা কাঁপা হাতে বোতল নিল। মেহেরের ভয়টা কাটে নি। তাই শরীরের কাঁপুনি কমছে না। মেহের পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। এক হাতে তখনও হিজাব ধরে রেখেছে।

ফায়াজ নিজের ফোনটা বের করে বলল,
“আমি ক্যামেরা অন করে তোমার সামনে ধরছি। হিজাবটা ঠিক করে পরে নেও।”

মেহের মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। ফায়াজ ওর সামনে ফোনের ক্যামেরা অন করে ধরল। মেহের একে একে হিজাবের পিনগুলো খুলে পাশের টেবিলের উপর রাখছে। তারপর পুরো হিজাবটা খুলে ফেলল। হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধেছিল চুলগুলো খুলে খুলে গেছে। মেহের চুলগুলো একেবারে খুলে ফেলল। মেহের সব সময় হিজাব পরে তাই এতদিন মেহেরের চুল দেখার সৌভাগ্য হয় নি। মেহেরের পিঠের নিচ অবধি চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। মেহেরকে এভাবে দেখে বেশ মোহনীয় লাগছে। ফায়াজ ছোট খাটো ঢোক গিলল।
মেহের চুলের খোঁপা করে হিজাব পরে নিল। ফায়াজের হাত ব্যথা হয়ে গেছে ফোন ধরে রাখতে রাখতে।
ফায়াজ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলল,
“তুমি আমার সাথে বাড়িতে যাবে।”

মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আমি হোস্টেলে যাব। হোস্টেলে না ফিরলে অথোরিটি মা কে ফোন করে বলবে আমি হোস্টেলে ফিরি নি। তখন মা চিন্তা করবে খুব। আর আমি যদি বলি আপনার বাড়িতে আছি তাহলে মা রাগ করতে পারে। বাবা উপর নারাজ আর মা-ও যদি নারাজ হয় তাহলে মানতে পারব না।”

“কিন্তু আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।”

“হোস্টেলে থাকব। একা কই?”

ফায়াজ আর কথা বাড়াল না। মেহেরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। মেহেরকে হোস্টেলে পৌছে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল। ফায়াজের ভালো লাগছে না মেহেরের চলে যাওয়া।

মেহের ফ্রেশ হয়ে এলো। ওর ভয়টা এখনো কাটেনি। আজ ওর জীবনের সব চেয়ে ভয়ানক দিনটা কেটেছে।
এমন দিন জীবনে যাতে দু’বার না আসে তাই দোয়া করছে। এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করল। নিজের সম্মানের হেফাজত কামনা করল। নামাজ পড়ে মনটা একটু শান্ত লাগছে। মেহের জায়নামাজ রেখে জানালা খোলে দিল। খোলা হাওয়া প্রয়োজন। ওর মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ফায়াজ কি করে জানল ও কোথায় আছে আর ওকে কি করে খোঁজে পেল?
মেহের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই একটা গাড়ি দেখল আর গাড়ির উপর একজন বসে আছে। মেহের ভালো করে দেখল এটা ফায়াজ।
“ফায়াজ এখনও এখানে বসে আছে?”
সামিরা ওর পেছনে এসে দাঁড়াল।

“ফায়াজ ভাই সেই কখন থাকে এখানে বসে আছে। এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে? ভাইয়াকে একটা ফোন কর।”

মেহের ফোন এনে ফায়াজকে ফোন করল। ফায়াজ ফোনে মেহেরের নাম দেখে উপরের দিকে তাকাল। জানালার পাশে কাউকে দেখতে পেল। নিশ্চয়ই মেহের। ফায়াজ কল রিসিভ করে বলল,
“কি হয়েছে মেহের? কোনো সমস্যা?”

মেহের শুকনো মুখে বলল,
“না ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই। আপনি এখানে কি করছেন?”

“কিছুনা। এমনিতেই বসে আছি।”

মেহের বুঝতে পারছে ফায়াজ ওর জন্য টেনশন করছে।
“আমি হোস্টেলে আছি। আর ওদের তো পুলিশ নিয়ে গেছে। তাহলে টেনশন করছেন কেন?”

ফায়াজ কি বলবে, কি করে বলবে ওর মন অশান্ত হয়ে আছে।
“ভয়, টেনশন কোনোটাই পাচ্ছি না। আমি এমনিতেই বসে আছি।”

“বসে থাকতে হবে না। আপনি বাড়িতে চলে যান। সারাদিন খাওয়া দাওয়া নেই। বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নিন।”

“কিছুক্ষণ পরে চলে যাব।”

“ফায়াজ, প্লিজ। চলে যান। রাতের বেলায়…

ফায়াজ ধমকে উঠল,
” চুপ করো। তোমার কোনো সমস্যা আমার বসে থাকায়? তুমি নিজেও যাবে না আমার সাথে আবার আমাকেও থাকতে দিবে না। আমি থাকব। যতক্ষণ ইচ্ছে থাকব।”
ফায়াজ খট করে ফোন কেটে দিল। মেহের অসহায় ফেস করে নাক ফুলিয়ে তাকাল। সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেটে দিয়েছেন। সাথে ধমকি দিয়েছেন।”

মেহের নিচের দিকে একবার তাকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল।

রাত ১১টা। মেহের বিরক্তি নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ তখনও বসে আছে। যায় নি। সামিরাও দাঁড়িয়ে আছে ওর সাথে। সামিরা মাথা চুলকে বলল,
“ফায়াজ ভাইয়ের বন্ধুকে ফোন করি। উনি ফেসবুকে এক্টিভ আছেন। উনারা এসে ফায়াজ ভাইয়াকে নিয়ে যাক।”

সামিরা ফায়াজের বন্ধুকে সব জানাল। ওরা সাড়ে ১১টা নাগাদ সেখানে পৌছাল। তারপর ফায়াজকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। ফায়াজ গাড়িতে বসে আছে। মেহেরকে ফোন করল। মেহের ফোন রিসিভ করতেই বলল,
“তুমি ভয় পেও না। যদি কোনো সমস্যা হয় আনাকে ফোন করবে। আর একদম ভয় পাবে না। তুমি একদম সেইফ আছো। আমি সকালে তোমাকে নিতে আসব। ভয় পাবে না কিন্তু। ওকে?”

মেহের বুঝতে পারছে না ফায়াজ ওকে বলছে না কি নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে।
“আচ্ছা আপনি বাড়িতে যান। সমস্যা হলে ফোন করব।”

“আচ্ছা। সাবধানে থেকো।”

ফায়াজ ফোন কেটে ওর বন্ধুকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামাতেই ফায়াজ গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজ চোখের পানি মুছছে। ও কেন বের হয়ে গেল সেটা দেখতে তুষার বের হলো।
তুষার ওর কাছে যেতেই দেখল ফায়াজ চোখের পানি মুছছে। এই প্রথম ফায়াজকে কাঁদতে দেখছে। তুষার ওর কাঁধে হাত রাখতে ফায়াজ ওকে জড়িয়ে শব্দ করে কাঁদছে।
“ফায়াজ কি করছিস? কাঁদছিস কেন? মেহের তো ঠিক আছে এখন।”

“যদি মেহেরের কিছু হয়ে যেত? আমি কি করে বাঁচতাম বলতে পারিস? আমার হাত-পা এখনো কাঁপছে। আমার মন এখনো অশান্ত হয়ে আছে। ঝড় বইছে ওই ঘটনা মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠছে৷”

ফায়াজ তুষারকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে চিতকার করে কাঁদছে। তুষার ওকে থামানোর চেষ্টা করছে না।
“কাদ ফায়াজ তুই। কেঁদে নিজের অতীত মুছে দে। ভালোবেসে ভালো ভাবে বাঁচ।”

ফায়াজ সেই ভোর থেকে মেহেরের হোস্টেলের সামনে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। মেহের গেট দিয়ে বের হতেই ফায়াজ গাড়ি থেকে বের হয়ে শুকনো মুখে গাড়ির দরজা খুলে দিল। মেহের কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে। ফায়াজের চুল এলোমেলো। চেহেরা ফ্যাকাসে। চোখগুলো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সারারাত ঘুমায় নি বুঝাই যাচ্ছে।

মেহের ফায়াজকে বারবার কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না। ভার্সিটির গেটে পৌছাতেই ফায়াজ টিফিন বক্স খুলে মেহেরকে দিল আর নিজেও নাস্তা করে নিল।
মেহের গাড়ি থেকে নেমে ফায়াজের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আপনি আমার খোঁজ পেলেন কিভাবে?”

“লোক ছিল জানানোর।”

“কিন্তু ওরা আমাকে কেন?”

“আসলে আমি যাকে মেরেছিলাম তার বন্ধুর কোনো এক ভাই হয় রবিন। রবিন আমার উপর প্রতিশোধ নিতে তোমাকে…!”

মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা। যা ভেবেছিলাম। আপনি পাপ করবেন আর আমাকে সেই পাপের ফল ভুগতে হবে? আপনি যা খুশি করে বেড়াবেন তার দায় আমি কেন নেব? আমার দোষটা কোথায়? ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যদি আমার কিছু হয়ে যেত? তার দায় কে নিত? বলুন? উত্তর দিন। আমি আপনার স্ত্রী তাই বলে আমাকে আপনার অন্যায়ের শাস্তি পেতে হবে? আপনি মারামারি করবেন, মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলবেন। তার তো কিছু প্রতিদান দিতেই হবে। আর তার প্রতিদান আমি দেব? আপনি কখনো বদলাবেন না তাই না?”

ফায়াজ মেহেরের কথার উত্তর দিল না। সারা-রাত ঘুমায় নি। শরীর ক্লান্ত লাগছে খুব। মাথাটাও ধরেছে খুব।

চলবে..

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩১|

মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”

ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।

“কাউকে খুঁজছ?”

মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”

তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”

মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”

“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”

ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”

তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”

মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”

তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”

মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।

সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।

তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”

মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।

তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?

মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।

মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”

ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”

ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”

মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”

ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”

ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”

ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”

মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।

ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”

মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”

“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”

মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”

ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।

ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”

মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”

ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।

ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”

ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”

পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”

ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।

ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”

“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)

“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”

মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”

“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”

“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।

চলবে…..!..