#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৪২|
মেহের লিফটের সামনে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বিরক্তি নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াল। অফিসের তিনতলায় তূর্জের কেবিন। মেহের তূর্জের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মেহেরের ক্লান্ত লাগছে খুব।
মেহের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। ভেতরে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। চেয়ার খালি। মেহের পুরো রুমে চোখ বুলাল। তূর্জ জানালা দিয়ে একমনে আকাশ দেখছে।
মেহের দরজায় টুকা দিল। তূর্জ জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দরজার দিকে তাকাল। মেহেরকে দেখে এক প্রকার চমকে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ওর সামনে গিয়ে বলল,
“মেহের! তুমি এখানে এই শরীর নিয়ে কেন এসেছো?”
মেহের মলিন হেসে বলল,
“অফিসে এসেছি বসতে দেবেন না?”
“হ্যাঁ, আরে আস। ভেতরে এসে বস।”
মেহের ভেতরে গিয়ে বসে টেবিলের উপর থেকে পানি খেয়ে গলা ভেজাল। ওর অস্থির লাগছে খুব। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
তূর্জ কিছুক্ষণ মেহেরের উপর রাগ দেখাল এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আসার জন্য।
মেহের সব কথা রেখে বলল,
“ভাইয়া ফায়াজ বকবে যদি জানে আমি বাড়ির বাইরে বের হয়েছি।”
“আমি তো সেটাই বলছি বের হয়েছো কেন? তোমাকে বকাই উচিত।”
“আপনি জানেন না আমি কেন এসেছি?”
তূর্জ মেহেরের কথা শুনে নিজের দৃষ্টি লুকাল।
কথা এড়ানোর জন্য বলল,
“তুমি বাড়িতে চলে যাও। ফায়াজ তোমাকে না দেখতে পেলে রাগারাগি করবে।”
“ভাইয়া, আপুকে ক্ষমা করা যায় না?” মেহের অতি শান্ত কন্ঠে বলে তূর্জের দিকে এক রাশ আশা নিয়ে তাকাল।
তূর্জ মেহেরের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুমি পেরেছো? এতবড় অন্যায় কি ক্ষমা করা যায়?”
“ভাইয়া এটা ঠিক আমি সব সময় চাইতাম আপু সবাইকে সত্যিটা বলে দিক, সবাই অন্ধকারে না থাকুক কিন্তু এটা কখনো চাই নি আপুর সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হোক। হ্যা আপু অন্যায় করেছে তাই বলে আমি তার খারাপ চাইব না। আমি আপুকে মাফ করে দিয়েছি। ফায়াজকেও দিয়েছি। আপনিও প্লিজ…!”
তূর্জ মেহেরের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“যতটা সহজ ভাবে বলছো বিষয়টা কি এতটা সহজ? আমি মাহিকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি। ওর সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছি। আর আজ জানতে পারি আমার সাথে সম্পর্ক চলাকালীন অন্য আরেকজনের সঙ্গে…. সেটা রিয়েল অথবা ফেক হোক। আমি ভুলব কিভাবে? কি করে মনকে শান্তনা দেব? কি বুঝাবো?”
মেহের বুঝতে পারছে ব্যাপারটা তূর্জের জন্য কতটা কষ্টের।
তবুও বলল,”ভালোবাসার মানুষ শত ভুল করলেও তাকে মাফ করা যায়।”
“হয়তো যায়। কিন্তু আমি পারছি না।”
মেহের অনুনয়ের সুরে বলল,
“আপনাদের সম্পর্কের অবনতি আমি মেনে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এর মূলে আমি রয়েছি। অনেক অপরাধী লাগছে নিজেকে। তূর্জ ভাইয়া প্লিজ সব ভুলে আগের মতো হয়ে যান৷ আপু অনেক কষ্ট পাচ্ছে। খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। কান্নাকাটি করছে। আপু তো আপনাকে অনেক ভালোবাসে। ৬ বছরের প্রেমের পর বিয়ে। আপনাদের ভালোবাসাটা অনেক গভীর। মিশানের কথাটা ভাবুন। ওর জন্য হলেও আপুকে মাফ করুন।”
“মেহের, প্রথমত এতে তোমার কোন দোষ নেই তাই নিজেকে অপরাধী ভেব না। ঘটনাটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি খুবই আপসেট। তাই আমার সময় প্রয়োজন। তুমি বাড়িতে যাও। মিশানের খেয়াল রেখো।”
মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি সময় নিন। কিন্তু দেখবেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু যেন ঘটে না যায়।”
ফায়াজ বাড়িতে ফিরে মেহেরকে রুমে না পেয়ে ওর মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল বাইরে গেছে। ফায়াজ বুঝতে পারল ও তূর্জের সাথে কথা বলতে গেছে। ফায়াজের রাগে মাথায় আগুন জ্বলছে। এত বড় সাহস! এই অবস্থায় একা একা চলে গেছে।
“আজ আসুক, আমি ওর ঠ্যাং ভেঙে দেব৷ ডানা গজিয়েছে এ বাড়িতে এসে। ডানা কেটে আগামীকালই বাড়িতে নিয়ে যাব। তারপর দেখব উড়ে কিভাবে।”
ফায়াজ মেহেরের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেহেরের আসার নাম নেই। ফোন করেও পাচ্ছে না। তাই নিজেই বের হয়ে গেল মেহেরকে আনার জন্য।
মেহের অনেক ক্লান্তি নিয়ে রুমে ঢুকল। ফায়াজ নেই দেখে স্বস্তির নিশ্বাস নিল।
মেহের বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ভালো লাগছে না। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। মাহি আর তূর্জের শেষ পরিনতি কি হবে। মেহেরের পেটে কেমন ব্যথা হচ্ছে। মেহের উঠে বসে কামিজ তুলে পেট দেখছে। ওই সময় ফায়াজ রুমে ঢুকলে মেহের থতমত খেয়ে সাথে সাথে কামিজ নামিয়ে নিল।
ফায়াজ মেহেরের কাছে আসল। মেহের ফায়াজের দিকে আড়চোখে তাকাল।
ফায়াজ মেহেরের সামনে এসে শীতল কণ্ঠে বলল,
“তূর্জ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে কনফিউজড। ফায়াজকে কে বলল। ফায়াজ তো বাড়িতে ছিল না।
মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ।”
ফায়াজ হুট করে মেহেরের পাশে বসে ওর দুবাহু ঝাঁকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“কেন গিয়েছিলে? কাকে বলে গিয়েছিলে? আমি নিষেধ করি নি? তোমার তো দেখছি খুব সাহস বেড়েছে৷ আমি না বলার পরেও আমাকে না বলেই একা একা ড্যাংড্যাং করতে করতে চলে গেলে?”
মেহের চুপ করে আছে। ভয়ে চুপসে গেছে।
“ফাজিল মেয়ে, কথা বলছো না কেন? এদিক সেদিক যখন যেতে পারো তাহলে বাড়িতেও যেতে পারবে। আগামীকাল আমরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। রেডি থেকো।”
বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে মেহের চমকে গেল। তারপর বলল,
“বাড়ির এই অবস্থা। আর আমি চলে যাব? মাহি আপু আর তূর্জ… ”
ফায়াজ মেহেরকে ধমক দিয়ে বলল,
“আবার মাহি আর তূর্জ? তোমাকে কে বলেছে ওদের বিষয়ে নাক গলাতে? আরেকবার যদি ওদের নাম নিয়েছো তো তোমার মুখে তালা ঝুলিয়ে দেব। আগামীকাল বাড়িতে যাচ্ছি মাথায় ঢুকিয়ে নেও।”
“আপনার তো কিছু দায় দায়িত্ব আছে আমার পরিবারের প্রতি। আপনি এ-সব দায় এড়িয়ে যাবেন? কারো কথা ভাববেন না?”
মেহেরের কথাগুলো ফায়াজের রাগ আর বিরক্তি বাড়াচ্ছে। ফায়াজ কন্ঠে রাগের ঝাঝ বাড়িয়ে বলল,
“নো, কারো কথা ভাবার দরকার নেই। আমার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি তুমি আর তোমার সুস্থতা। অন্যের লাইফে দখল নেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আর তুমিও চেষ্টা করো না।(মেহেরের গাল চেপে ধরে)”
মেহেরের গাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আর ভালো লাগছে না আমার।”
মেহের কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আমি কি করেছি?”
ফায়াজ আবার মেহেরের দিকে ঘুরে বলল,
“কি করেছো বুঝতে পারো নি? জামা তুলে পেট দেখছিলে কেন?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে দমে গেল। তারপর দৃষ্টি লুকিয়ে মিনমিন করে বলল,
“এমনি দেখছিলাম কতটা শুকিয়েছে।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
মেহের তাই বলল,
“সত্যি বলছি। শুধু দেখছিলাম। আর কিছু না। আমি আর যাব না তূর্জ ভাইয়ার কাছে। আপনাকে না বলেও কোথাও যাব না। সত্যি বলছি।”( মুখ ইনোসেন্ট করে)
ফায়াজ এই মেয়েটার উপর রাগ করে থাকবে কিভাবে? এই ফেস দেখলে সবার মন নরম হয়ে যাবে।
ফায়াজ মেহেরের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” মেহের, তোমার জন্য আমার কতটা টেনশন হয় তুমি বুঝো না? তুমি সুস্থ থাকতে তাহলে আমি কিছুই বলতাম না। কয়েকদিন আগে তোমার অপারেশন হয়েছে। যদি এখন কোন সমস্যা হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছে কেয়ারফুল থাকতে। তোমার হসপিটালে থাকতে ভালো লাগছিল না, অস্থির হয়ে পড়েছিলে তাই চলে এসেছি। কিন্তু ডাক্তার বারবার বলেছে কেয়ারফুল থাকতে। আর তুমি কি করছো?”
মেহের ভাবছে ঠিকই তো। ডাক্তার বলেছে কেয়ারফুল থাকতে। আর এখন কেমন ব্যথা অনুভব হচ্ছে৷
“আর করব না। আমি এখন পুরোপুরি কেয়ারফুল থাকব।”
মেহেরের মা খুব আপসেট হয়ে আছে। মেহের তূর্জের সাথে কথা বলেও কিছু করতে পারল না। তাই মেহেরের বাবাকে বলল,
“মাহির জন্য টেনশন হচ্ছে?”
ওর বাবা বলল,
“শুধু কি মাহি? মেহেরের জন্যও টেনশন করা শুরু করে দেও।”
ওর মা বুঝতে না পেরে বলল,
“মেহের! কেন?”
ওর বাবা চেঁচিয়ে বলল,
“ওই ছেলে, তোমার মেয়েকে ক্ষোভের বশে বিয়ে করেছে। ও তোমার মেয়েকে ভালো রাখবে? মাহির অন্যায়, ভুল দেখছো আর ফায়াজ? ও কতবড় ধুরন্ধর ছেলে দেখেছো? আমি ওকে এই বাড়িতে সহ্য করতে পারছি না। আমি কোন ভরসায় ওর হাতে মেহেরকে তুলে দেব?”
মেহেরের মা বিষয়টা ভেবে দেখে নি। মেহেরের বাবার কথা ফেলে দেওয়ার মত না।
চলবে….!
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৪৩|
জানালার কাচ ভেদ করে পূর্ণ চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। নিশাচর পাখিরা মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে। শু শু বাতাসে পর্দা নড়ছে। মেহেরের চোখে ঘুম নেই। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। পাশে ফায়াজ ঘুমাচ্ছে কিন্তু ওকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। ফায়াজ শরীর খারাপের কথা শুনলে রাগের পাশাপাশি অস্থির হয়ে পড়বে।
মেহের হাজার চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছে না
মাঝেমধ্যে অদ্ভুৎ চিন্তাভাবনা মাথায় ভর করছে। মেহের আর না পেরে ফায়াজকে ধাক্কা মারল।
এক ধাক্কায় ফায়াজ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। বসতেই চোখের ঘুম উবে গেল। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে মেহের? শরীর খারাপ লাগছে?”
মেহের গোঙানির সুরে বলল,
“পেটে হালকা ব্যথা হচ্ছে।”
মেহেরের যতটা না ব্যথা করছে তার চেয়ে বেশি ভয় লাগছে। ভয়ের জন্য ব্যথাটা সামান্য হলেও সামান্য মনে হচ্ছে না।
ব্যথা করছে শুনে ফায়াজের বুক কেঁপে উঠছে। ফায়াজ দ্রুত ফোন নিয়ে কাউকে ফোন করে বিরক্তি নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল।
তারপর বিড়বিড় করে বলল,
“রাত ৩টা বাজছে। তাই কেউ ফোন তুলছে না। এতরাতে এখন আমি কি করব? কাকে ডাকব?”
মেহের ফায়াজকে জিজ্ঞেস করল,
“কা’কে ফোন করছেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে অসহায় ফেস করে বলল,
“ডাক্তারকে কিন্তু ফোন তুলছে না। দাঁড়াও অন্য ডাক্তারকে ফোন করছি।”
ফায়াজ সেখানেও ব্যর্থ হল। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে।
মেহের বলল,
“এত রাতে কি ডাক্তাররা জেগে থাকে? আর আপনি ডাক্তারকে ফোন করছেন কেন? আমার এমনিতেই একটু ব্যথা করছে আর ঘুমও আসছে না।”
ফায়াজ মেহেরের কথা না শুনে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মেহের বুঝতে পারল না ফায়াজ হুট করে কোথায় যাচ্ছে। মেহের অনেক বার ডেকেও পাত্তা পেল না।
ফায়াজ মেহেরের বাবা-মায়ের রুমে নক করল। মেহেরে মা কিছুক্ষণ পরে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলল। ফায়াজকে দেখে চমকে গেল। ফায়াজকে দেখে মনটা কু ডেকে উঠছে। এতরাতে ফায়াজ এখানে কেন? কিছু হয়েছে? কি হয়েছে? মেহের, ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয় নি তো? ওর কিছু না হলে ফায়াজ এখানে কেন?
মেহেরের মা ফায়াজের ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কি হয়েছে, বাবা? মেহের…
ফায়াজ কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ মেহেরের শরীর খারাপ লাগছে। ডাক্তার পাচ্ছি না। কি করব বুঝতে পারছি না।”
মেহেরের বাবার ঘুমটা কাচা ছিল দরজায় নক করায় আর এখন ওদের কথা কানে আসায় ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল। ওঠে বসে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে এসেছে। চোখে চশমা পরে মেহেরের মায়ের বিপরীতের মানুষটি দেখার চেষ্টা করছে।
ফায়াজকে দেখে ওঠে এলেন। মেহেরের মা আর কথা না বাড়িয়ে মেহেরের রুমের দিকে পা বাড়াল। ফায়াজও মেহেরের কাছে যাচ্ছে। মেহেরের বাবা কিছু না বুঝলে পেরে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের পেছনে পেছনে মেহেরের রুমের দিকে গেল।
মেহেরের মা রুমে গিয়ে ওকে বিছানার মাঝখানে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখল। তিনি দৌড়ে মেহেরের কাছে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে মেহের?”
মেহের কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“একটু ব্যথা করছে।”
ততক্ষণে মেহেরের বাবা রুমে প্রবেশ করেছে। আর ওদের কথা শুনে বুঝতে পারল মেহেরের সমস্যা হয়েছে। মেহেরের মা এটা সেটা করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেহেরের অসুস্থতা কমানোর জন্য।
ফায়াজ মেহেরের মায়ের উপর রাগ ঝেড়ে বলল,
“আপনারা কোন আক্কেলে ওকে তূর্জের অফিসে পাঠালেন? আপনারা জানতেন ও অসুস্থ। তবুও কি করে ওকে একা ছাড়তে পারলেন? ও একা একা এতটা পথ জার্নি করে এসেছে। আমি জানতাম এমন কিছু হবে।”
মেহেরের মা আমতা আমতা করে বলল,
“ওকে নিষেধ করেছিলাম শুনে নি। বলেছিলাম আমি সাথে যাই কিন্তু ও জেদ করছিল।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তারপর আবারও কড়া গলায় বলল,
“জেদ করেছিল? ঠাস ঠাস করে দু’গালে বসিয়ে দিতে পারলেন না? এই শরীরে জেদ করে কিভাবে?”
মেহেরের বাবা ফায়াজের সুরে সুর মিলিয়ে বলল,
“ঠিকি তো ও জেদ করল আর ওকে যেতে দিলে? একের পর এক সমস্যা না বাঁধালে নয়?”
ফায়াজ তারপর বলল,
“আর ও কেন গিয়েছে? ও গিয়ে কি করতে পারবে? কি করতে পেরেছে? কেউ যদি সমাধান করতে পারে সেটা মাহি আর তূর্জ নিজে। ওরা না চাইলে ওর কি করার আছে? অদ্ভুত। এখন আমি এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাই? কেউ ফোন তুলছে না। এখন আমি কি করব? মাথায় কিছু ঢুকছে না।” ( অস্থির হয়ে পাইচারি করতে করতে)
মেহেরের বাবাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মাহি চেচামেচি শুনে অনেকক্ষণ ধরে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফায়াজের কথা শুনে আর ভেতরে ঢুকতে পারল না। নিজেকে ওদের মাঝে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। ওর জন্য মেহের তূর্জের অফিসে গিয়েছে। ওর জন্য অসুস্থ হয়েছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেই মাহি ভেতরে ঢুকল। তারপর মেহেরকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। মেহের সব খুলে বলল। তারপর মেহের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফায়াজ মেহেরের পাশে বসে বলল,
“মেহের চলো হসপিটালে যাই। সেখানে ট্রিটমেন্ট করার জন্য কাউকে না কাউকে পেয়ে যাব।”
মেহের আতংকিত হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। মেহেরের বাবা বলল,
“মেহের, তোর কি বেশি অসুস্থ লাগছে? তাহলে…!
মেহের দ্রুত বলল,” না, এখন আমি কোথাও যাব না।”
মাহি ফোন রেখে মেহেরের পাশে এসে বলল,
“নেটে আমি কিছু তথ্য পেয়েছি। আপাতত সেগুলো ট্রাই করে দেখা যেতে পারে।”
মেহের মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
।
ফায়াজ গম্ভীরমুখে বসে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর ভাবে কিছু ভাবছে আর নয়তো রাগ পুষিয়ে রাখছে।
সকালে ডাক্তার এসেছিল মেহেরকে দেখতে। নতুন করে কিছু মেডিসিন দিয়েছে। আর বলেছে দু-তিন দিন একদম ফুল রেস্ট নিতে। ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। ফুল বেড রেস্ট। অতিরিক্ত নড়াচড়া, হাঁটাচলা ওর ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মেহের শুয়ে শুয়ে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ কি করছে, কি ভাবছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
মেহের ফায়াজকে বলল,
“আপনার কি হয়েছে? এভাবে কি ভাবছেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল,
“মেহের, তোমার সবার কথা ভাবার সময় আছে। কিন্তু তোমার নিজের বিশেষ করে আমার কথা ভাবার বিন্দুমাত্র সময় নেই। আমি কত হতভাগা দেখেছো?”
ফায়াজের কথা শুনে মেহেরের বুক ছ্যাৎ করে উঠল। মেহের বলল,
“এভাবে বলছেন কেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে ঘুরে বলল,
“তুমি কি আমার কথা ভাবো?”
মেহের সময় না নিয়েই বলল,”হ্যা ভাবি। ভাবব না কেন?”
ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আসলেই কি তাই? যদি ভাবতে তাহলে এমন একটা কাজ কি করে করলে? আমি না বলার পরেও কেন গেলে? তুমি একবার ভাবলে না তোমার অসুস্থতা আমার উপর কি পরিমাণ প্রভাব ফেলে? তুমি এটা ভাবো না তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কি হবে? আমার কে আছে মেহের?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিল।
মাহি রেডি হয়ে নিয়েছে। আর অপেক্ষা করবে না তূর্জের ফেরার। ও তূর্জের সাথে সরাসরি কথা বলবে। এভাবে আর পারছে না। সব জিনিসপত্র গুছিয়ে লাগেজ রেডি করে নিল। ওকে গোছাতে দেখে ওর মা জিজ্ঞেস করল,
“কি রে কি করছিস? সব লাগেজে ঢুকাচ্ছিস কেন?”
মাহি লাগেজে সব রাখতে রাখতে বলল,
“আমি বাড়িতে যাচ্ছি। কতদিন আর এখানে থাকব?”
ওর মা ওকে বাঁধা দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাহি বলল,
“মা খাবার দেও। খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব।”
মাহি দুপুরের খাবার খেয়েই বেড়িয়ে পড়ল।
তূর্জ গাড়ির শব্দে ল্যাপটপ রেখে বারান্দায় গেল। ওর মনে হচ্ছে মাহি এসেছে। তূর্জ দ্রুত নিচে গেল। দরজায় কলিং বেল বাজলে কাউকে খুলতে নিষেধ করল। তূর্জ দরজা খুলতে গেল। মাহি মনে মনে ভয় পাচ্ছে। ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে জানে না। বুক ঢিপঢিপ করছে। তূর্জ দরজা খুলে মাহির দিকে তাকাল। মাহি তূর্জের দিকে চেয়ে আছে। কতদিন পর তূর্জকে দেখল। মাহি কোন কথা বলছে না।
তূর্জ নিরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি! তুমি এখানে কেন?”
মাহি ওর কথা শুনে একটুও অবাক হলো না।
“কি বলছো তূর্জ আমি বাড়িতে আসব না?”
“কিসের বাড়ি? কিসের ঘর? যা তুমি ধোঁকা দিয়ে বানিয়েছো? তুমি সে ঘরের কথা বলছো?”
“তূর্জ ঘটনাটা আমি ইচ্ছে করে ঘটাই নি।”
“তুমি আমাকে এতদিন ধোকার মধ্যে রেখেছো। তুমি আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করো নি অথচ এটা সামান্য ঘটনা না। তুমি সবার বিশ্বাস, ভরসা, অনুভূতি, ভালোবাসা নিয়ে খেলেছো। আমার সাথে এটা তুমি কি করে করলে? আমি সব সময় তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি আর তুমি? মাহি আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না৷ যখনই মনে হয় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর এখন তোমাকে দেখে সবকিছু আবারও নতুন করে মনে পড়ছে। তুমি আমাকে ভেঙে ফেলেছো। আ’ম ফিনিশড।”
“তূর্জ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি তোমাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব।”
“পারব না। আমি পারব না তোমাকে ক্ষমা করতে। এত বছরের চেনা মানুষটা হুট করে অচেনা হয়ে গেল। তাকে আমি কি করে মাফ করে দেব?”
মাহি মিশানকে দেখিয়ে বলল,
“তূর্জ আমার কথা না ভাবো মিশানের কথা…।”
তূর্জ মিশানের দিকে তাকাল। মিশানকে কোলে নিয়ে আদর করল। তারপর বলল,
“ভেবে ফেলেছি। মিশানের কথাই ভাবছি। মিশান ওর বাবার কাছে থাকবে। ওর বাবা ওর পুরো খেয়াল রাখবে। ইউ কেন গো নাও।”
মাহি অবাক হয়ে তূর্জের দিকে চেয়ে আছে।
“তূর্জ কি বলছো তুমি? মিশানকে দেও আমার কাছে।”
তূর্জ চিতকার করে বলল,
“খবরদার, ওকে ছোবার চেষ্টা করবে না। একজন ঠক-প্রতারক কিছুতেই আমার বাচ্চার মা হতে পারে না। এখান থেকে যাও৷”
মাহি এতবছরে তূর্জকে এতটা রাগ করতে দেখে নি। না এত চিৎকার করতে দেখেছে। মাহি ঘাবড়ে গেল।
তারপর বলল,
“তূর্জ তোমার মাথা ঠিক নেই তাই এ-সব বলছো। মিশান আমাকে ছাড়া এক মিনিট থাকতে পারবে না। মা, কোথায়? আমি মা’য়ের সা…
“মাহি, তোমার এই কুকৃর্তির কথা আমি কাউকে জানাই নি। কারণ এতে আমি ছোট হব। কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। সো প্লিজ এখানে সিনক্রিয়েট করো না। চলে যাও। এ বাড়িতে, আমার জীবনে আর তোমার জায়গা নেই।”
তূর্জ ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। মাহি কয়েক বার দরজায় ধাক্কা দিল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
চলবে…..!