শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৫০+৫১

0
3448

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫০|

ফায়াজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ফেসবুকে যাওয়া হয় নি। এখন সময় পেয়ে গ্যালারি থেকে ওদের বিয়ের সুন্দর সুন্দর পিকচার সিলেক্ট করে আপলোড দিচ্ছে।
মেহের লাগেজ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখছে। তবে মুখ ভার করে আছে। আজ ওদের বাড়িতে এসেছে, ওর তো খুশি হওয়ার কথা। তাহলে এভাবে মুখ ভার করে আছে কেন? মেহেরকে দেখে মনে হচ্ছে রাগে ফেটে যাচ্ছে। আর এই রাগটা একান্ত ফায়াজের জন্য। ফায়াজ চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না কি এমন করেছে।

ফায়াজ বিছানার উপরে ফোন রেখে লাগেজ থেকে শ্যাম্পু, লোশন, স্নো বের করে মেহেরের হাতের দিকে বাড়িয়ে দিল।
মেহের সেটা দেখে বলল,
“লাগবে না। আমি করে নিতে পারব।”

ফায়াজ ওগুলো রেখে দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোমার? ”

মেহের যেন এতক্ষণ এটাই শুনতে চাইছিল। প্রতিক্ষা করছিল কখন ফায়াজ জিজ্ঞেস করবে। হয়তো সবাই চায় তার প্রিয় মানুষটা তার মুখ দেখে বুঝুক তাকে। তার রাগ, অভিমান, মন খারাপ সবটা বুঝুক। নিজ থেকে পরম ভালোবাসায় জিজ্ঞেস করুক কি হয়েছে।

মেহের ফায়াজের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“কিছু না।”

মেহের চাইছে ফায়াজ জোর করুক, জানতে চাক কি হয়েছে। ফায়াজ তাই করল,
“তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু তো হয়েছে। কি হয়েছে?”

“বলব না।” ( নাক ফুলিয়ে)

ফায়াজ মেহেরের হাতের জিনিসপত্র রেখে মেহেরের দু-হাত ধরে বলল,
“কেন বলবে না? বলতে হবে। আমি কিছু করেছি?”

মেহের ফায়াজের দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ দেখিয়ে বলল,
“না,তুমি কি করবে? সব তো আমি করি। আমি ভারী পোশাক পরে এত কষ্ট করে পানি আনতে গেলাম আর উনি নিকিতার হাত থেকে পানি নিয়ে খেল। খেয়ে আবার মিষ্টি হেসে বলল ধন্যবাদ। আহা! তারপর রসিয়ে রসিয়ে গল্প শুরু করে দিল। আমার হাত ছাড়ো।”

ফায়াজ এইবার ঘটনা বুঝতে পারল। নিকিতা মেহেরের মামাতো বোন। বয়স ১৭-১৮ হবে। ছোট্ট একটা মেয়ে। ফায়াজকে পানি দিয়েছে আর ফায়াজ খেয়ে সৌজন্যমূলক আলতো হেসে ধন্যবাদ বলেছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল কোন ক্লাসে পড়? এটাই ওর অপরাধ।

ফায়াজ আলতো হেসে বলল,
“আরে পিচ্ছি কিউট একটা মেয়ে। হাতের কাছে গ্লাস এগিয়ে দিল। আমি না নিয়ে বসে থাকলে কেমন দেখায়?”

মেহের ব্যঙ্গ করে বলল,
“কিউউউট! বাহ! কিউট!”

ফায়াজ ব্যাপারটা এখন ধরতে পারল। মেহের রাগ নয় জেলাস ফিল করছে। ফায়াজ মেহেরকে রাগানোর জন্য বলল,
“হ্যাঁ কিউটই তো। চোখগুলো কত সুন্দর দেখেছো? রাজকন্যা একটা। এই রাজকন্যা একটা রাজপুত্রই পাবে দেখে নিও।”

মেহের ফায়াজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“তুমি বিয়ে করে নিলেই পারতে।”

হাতের কাজ ফেলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে লাইট অফ করে দিল।

ফায়াজ মেহেরের পাশে শুয়ে মেহেরের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“বিয়ে করতে পারতাম যদি তোমার সাথে বিয়েটা না হতো৷ আগে বলবা না তোমার এত কিউট একটা কাজিন আছে?”

মেহেরের আর সহ্য হচ্ছে না। ফায়াজ বুঝতে পারছে না ওর কষ্ট হচ্ছে। কেন এ-সব বলে কষ্ট দিচ্ছে? সাথে রাগও হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে ওর চুলগুলো সব ছিড়ে ফেলতে।
মেহেরের রিয়েকশন না পেয়ে ফায়াজ বলল,
“কি গো ঘুমিয়ে পড়েছো? আমার তো ঘুম আসছে না। নিকিতাও কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নয়তো ওর সাথে গল্প করা যেত।”

মেহের উঠে বসে ফায়াজকে ধাক্কা মেরে ওর চুলগুলো টেনে ধরল। ফায়াজ চিৎকার করে উঠল। ফায়াজ ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হটাৎ করে এই মেয়ের শরীরে এত শক্তি কোথায় থেকে আসে কে জানে?
“মেহের, চুল ছাড়ো। আরে সব ছিড়ে ফেলছো তো। আমি তো মজা করছিলাম। আর মজা করব না। সত্যি বলছি।”

মেহের তবুও ছাড়ছে না।
“প্লিজ, জান আমার। আহহ। মরে যাব তো।”

মেহের ফায়াজের চুল ছেড়ে দিয়ে আবারও শুয়ে পড়ল অপর পাশ ঘুরে। ফায়াজ যেন মরতে মরতে বাচল। মাথাটা পুরো ধরে গেছে। চুলের গোড়ায় গোড়ায় ব্যথা করছে। ফায়াজ নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের কোন রিয়েকশন দিচ্ছে না। রাগ এখনো কমে নি। রাগে শরীর কাঁপছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
“মেহের, আমি মজা করেছি। নিকিতা একটা বাচ্চা মেয়ে। ও তোমার বোন, আমারও বোন। আর আমি কি জানতাম তুমি পানি এনেছো? জানলে আমি আমার মেহেরজানের হাত থেকে পানি না খেয়ে অন্যের হাত থেকে খাব? ইম্পসিবল। তুমি রেগে যাচ্ছিলে তাই তোমাকে রাগানোর জন্য আরো মজা করেছি। আমার এত কিউট একটা বউ থাকতে কাউকে লাগবে না।”

মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল।
“এমন মজা করবে না। ভাল্লাগে না।”

“হ্যাঁ মজা স্বরুপ আমার চুলগুলো শেষ করে ফেলেছে। আমার এত স্বাদের চুল।”

“বেশ করেছি। আর কখনো এমন ফাজলামো করলে টাক বানিয়ে ফেলব।”

বিয়ে উপলক্ষে ফাইজা এ বাড়িতে সপ্তাহ খানেক থাকার পর আজ দুদিন ধরে মায়ের কাছে। সকালে ফোন করে জানিয়েছে বিকেল বেলায় আসছে। মেহের কিচেনে গিয়ে রান্নাবান্নার আয়োজন দেখে এল। ফাইজা দুপুরের খাবারের পরেই চলে আসবে। মেহেরের টেনশন হচ্ছে খুব। কারণ ফাইজা মেহেরকে আজ আসার কারণটা জানিয়েছে। আর ওর কারণটা জানার পর থেকেই মাথায় টেনশন ভর করেছে।

মেহের ঠিক করল ফায়াজের বিষয়টা হালকার উপর জানিয়ে রাখবে। যেন উল্টা পালটা রিয়েক্ট না করে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ফায়াজ বাড়িতেই আছে। মেহের গোসল করতে যাবার আগে ফায়াজের পাশে বসে। ফায়াজ সোফায় আধশোয়া অবস্থায় টিভি দেখছে।
মেহের বসে ফায়াজকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। এভাবে চুপচাপ বসে থাকায় বিষয়টা ফায়াজের চোখে পড়ল।
“কিছু বলবে?”

মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ তোমাকে কিছু বলার ছিল।”

ফায়াজ মেহেরকে নিজের কাছে টেনে বলল,
“তাহলে বলছো না কেন?”

মেহের আবারও আমতা আমতা করছে। ফায়াজের পূর্ণ মনোযোগ মেহেরের দিকে। মেহের বলল,
“ফাইজা আসছে জানো তো। আর ফাইজা এসে যদি বলে ও আর মা এখন থেকে এখানে থাকবে তাহলে?”

ফায়াজের ফেসের রঙ পালটে গেল। ফাইজা এখানে থাকবে এ নিয়ে ফায়াজের বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। ফায়াজ বরং চায় ফাইজা সব সময় ওদের সাথে থাকুক। কিন্তু ওর মা?

“ফাইজাকে আগেও বলেছি এখানে থাকতে। এ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু উনি আসবে না।”

“ফায়াজ, এটা মা’য়েরও বাড়ি। তাই তুমি তাকে বাঁধা দিতে পারো না।”

ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“বউ বউয়ের মতো থাকো। এতো ঘেটো না। আমাকে জোর করিয়ে কেউ কিছু করাতে পারবে না। গট ইট?”( ঝারি মেরে)
ফায়াজের এমন ব্যবহার মেহেরের ভালো লাগল না। কোন কথা না বলে গোসল করতে চলে গেল। ফায়াজ রাগে গজগজ করতে করতে টিভি বন্ধ করে বের হয়ে গেল রুম থেকে।

মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে আর ভাবছে ফাইজা যখন ফায়াজের সামনে এ কথা বলবে তখন ফায়াজের কি রিয়েকশন হবে।
ফায়াজ মেহেরকে চুল ঝাড়তে দেখে এগিয়ে এল। তখন ঝারি মেরেছে নিশ্চয়ই মন খারাপ। ফায়াজ মেহেরের ভেজা চুলে হাত দিতেই মেহের চুল ঝাড়াা বন্ধ করে দিল। ফায়াজ মেহেরের ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেল। মেহের কোন রিয়েকশন দিচ্ছে না। ফায়াজ আবারও চুমু খেল। তবুও মেহের চুপ। ফায়াজ মেহেরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” কি হয়েছে? ”

মেহের তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি হবে? বউ বউয়ের মতো আচরণ করছি। চুপচাপ স্বামীর ইচ্ছে মেনে নিচ্ছি।”

“মেহের!”

মেহের তোয়ালে রেখে ঘর রেখে বের হয়ে গেল। ফায়াজ পেছনে থেকে বারবার চিৎকার করে মেহেরকে ডাকল। কিন্তু দাঁড়ায় নি।

.

মেহের, ফাইজা আর ওর বাবা এক সাথে বসে কথা বলছে। ফাইজা বারবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে। মেহের মুচকি হাসল। যার মানে সাহস হারিয়েও না। বলে ফেল।
“পাপা, আমি আজ তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।”

হটাৎ করে মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে চমকে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে।
ফাইজা বাবার চমকানো মুখকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
“তোমার আর মমের দেখা হয়েছে এবং তোমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে সেটা আমি জানি। আমি এও জানি তোমরা আবারো একসাথে থাকতে চাও। তোমাদের দু’জনেরই বয়স হয়েছে। তোমরা নিঃসঙ্গতায় ভুগছো। একে অপরকে প্রয়োজন। তোমাদের সমস্যার কারণে এতগুলো বছর আলাদা থেকেছি কিন্তু আর পারছি না। প্লিজ পাপা তোমরা আবারো এক হয়ে যাও৷ এভাবে আর কতদিন? ১৬টা বছর কেটে গেছে। দুজন দুজনকে অনুভব করে কষ্ট পেয়েছো। তবুও দূরে থেকেছো। কেন? আমি এখানে থাকতে চাই। আমি চাই তোমরা আবারও এক সাথে থাকো। আমি আমার পরিবারের সাথে থাকতে চাই। যেখানে আমি বাবা-মা, ভাই-ভাবী সবাইকে নিয়ে থাকব।”

ফাইজার কথায় উত্তর দিচ্ছেন না সাফায়েত নওয়াজ খান। তিনিও চান ভাঙা পরিবারটা আবারও জোড়া লাগুক। খিলখিলিয়ে হেসে উঠুক তার পরিবারটা।
ফাইজা মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের ফাইজার দৃষ্টি দেখে বলল,
“বাবা, সবকিছু আপনার হাতে। আপনি চাইলেই সব ঠিক করতে পারেন। ফাইজা এখানে থাকতে চায়। ওর নিজের বাড়ি থাকতে কেন অন্য দেশে পড়ে থাকবে?”

ফাইজা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“পাপা, প্লিজ। আমি এখানে থাকতে চাই। প্লিজ। মমও চায়। আমি চাই তুমি মমকে ফিরিয়ে আনো। আমরা আবারো এক সাথে থাকব।”

“যে চলে গেছে সে আবার ফিরে আসতে চায় কেন? সেদিন যাওয়ার আগে তো ভাবে নি।”
ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে সবাই সেদিকে তাকাল। ফায়াজ সিড়ির রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ফায়াজ ওদের কাছে এসে বলল,
“ফাইজা, তুই এখানে থাকতে পারিস। তোকে আগেও বলেছি। কিন্তু উনাকে আমি এই বাড়িতে দেখতে চাই না। এতবছর পর কিসের টানে ফিরতে চায়? কেন ফিরতে চায়? আমার সুখ সহ্য হচ্ছে না তাই?”

ফাইজা দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, পুরনো কথা ভুলে যাও। আর এমন মা নেই যে সন্তানের সুখ সহ্য করতে পারে না। ওসব বলে নিজেকে ছোট করো না। মমকে মাফ করে দেও। মম তোমাকে ছাড়া কি ভালো ছিল? আমি দেখেছি মম তোমার জন্য কেমন করেছে। কতটা ছটফট করেছে। কতটা কেঁদেছে।”

“ফাইজা ওসব বাদ দে। আমাকে বুঝাতে আসিস না। উনি আমার কথা ভাবে নি। আমি তার ছেলে। ৯ বছরের ছেলেকে রেখে যে মা চলে যেতে পারে সে মা নামের কলঙ্ক। তাকে আমি মা মনে করি না। তার মা হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই। তোর ইচ্ছে হলে আসবি, থাকবি। কিন্তু উনি যেন এ বাড়িতে না আসে। উনি যদি আসে তবে এ বাড়িতে আগুন জ্বলবে। তোর একা আসতে ইচ্ছে না হলে আসবি না।”

ফায়াজের বাবা ওর কথা শুনে ধমকে বলল,
“ফায়াজ, ফাইজা তোমার বোন। আমার মেয়ে। এটা ওরও বাড়ি। এখানে ওরও অধিকার আছে। ভুলে যেও না।”

ফাইজা চোখ মুখ লাল করে চিৎকার করে বলল,
“যথেষ্ট হয়েছে ভাইয়া। যথেষ্ট হয়েছে। তোমার বাড়ি, তোমার ঘর। সব তোমার। তাই সিদ্ধান্ত তোমার। আমি কে? ঠিক আছে আসব না। তোমার বাড়িতে আমি কিংবা আমার মম কেউ আসব না। তুমি একাই সুখে থাকো। থাকো। যে দেশে ভাইয়ের বোনের সুখের চেয়ে নিজের জেদ বেশী হয় সেদেশে আমি থাকতে চাই না। সে ভাই আমার লাগবে না। আমি ইতালিতে ভালো থাকব। থাকো তুমি। আর কখনো আসব না এই দেশে।”

ফাইজার বাবা আহত সুরে বলল,
“ফাইজা! তুমি ওর কথা ধরছো কেন? ওর কথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিও না।”

“না পাপা। আমি কারো কথা ধরছি না। আমি রিয়েলিটি তুলে ধরলাম। আমি যাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে হলে ইতালি গিয়ে আমাকে দেখে এসো। কেউ যেন ভাইয়ের দাবী নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে।”
ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বের হয়ে গেল। ওর বাবা অনেক বার ডাকল কিন্তু থামল না। মেহের ফাইজার পেছনে পেছনে গেল।

ফাইজা গাড়িতে ওঠে বসেছে। মেহের অনুরোধ করছে বারবার।
“ফাইজা, যেও না প্লিজ। আমি কথা বলব ফায়াজের সাথে।”

ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভাবী তুমি পারবে না। আমি জানি ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তোমার কথা রাখে। কিন্তু এই বিষয়টা অন্যরকম। ভাইয়া শুনবে না। আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম আজ। ভাইয়া আমার স্বপ্নটা চুরমার করে দিল ভাবি। আমি আসছি। ভুল করলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

ফাইজা চলে গেল। ফাইজার বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এভাবে চলে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না। ফাইজা আর ওর মা’কে জোর করে এ বাড়িতে আনতে পারেন। বাড়িটা তার। কিন্তু তিনি জানেন এটা করলে ফায়াজ বাড়ি ছাড়বে। এক দিক গড়তে গিয়ে আরেক দিক ভাঙবে?

মেহের ঘরের দরজা খুলে দেখে ফায়াজ সোফার পাশে মেঝেতে বসে আছে। ওর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। মেহের আর ভেতরে ঢুকল না। ফায়াজকে বিব্রত করতে চায় না। কিছু সময়ের জন্য একা ছেড়ে দিল। ফায়াজের বাবার ঘরের দিকে গেল।

চলবে…!

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫১|

রাত বাড়ছে। ফায়াজ বিছানায় শুয়ে গভীর ভাবে কিছু ভাবছে। চোখ বন্ধ। কপালে হাত দিয়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। মেহের ফায়াজকে খাওয়ার কথা বললে ফায়াজের ক্ষিধে নেই জানিয়েছে। মেহের ফায়াজের কথা শুনে দরজা বন্ধ করে দিল। ফায়াজ মেহেরের দরজা বন্ধ করার শব্দে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মেহের জানতো ফায়াজ খাবে না। তবুও জিজ্ঞেস করেছে। ওর নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছে নেই। বিকেল বেলায় যে ঘটনা ঘটেছে তাতে খাবার মুখে রুচবে না। মেহের সার্ভেন্টকে বলে এসেছে সময় মতো ফায়াজের বাবাকে খাবার দিয়ে দিতে।

মেহের ফায়াজের পাশে গিয়ে বসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
“ফাইজার কথায় কষ্ট পেয়েছো?”

ফায়াজ শুধু জোরে শ্বাস ফেলল কোন জবাব দিল না। মেহের ফায়াজের কাছ থেকে জবাবের আশা ছেড়ে দিল।
ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ওর আর ওর ভাইকে দরকার নেই।”
ফায়াজের আহত সুরে বলা কথাটা মেহেরের বুকে গিয়ে লাগল।

“ফায়াজ, তুমি ওর কথাটা ধরলে কিন্তু কোন সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছে সেটা দেখলে না? ফাইজা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটাও তো কষ্ট পেয়েছে আজ। ওর স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। তাই নিজেকে সামলাতে পারে নি। তাই ইমোশনাল হয়ে বলে ফেলেছে। ওর কথায় মন খারাপ করো না।”

ফায়াজ মেহেরের কোলে মাথা রাখল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি আজ ওকে খুব কষ্ট দিয়েছি। হয়তো আজ আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।”

“ফায়াজ, এভাবে বলো না। রক্তের সম্পর্ক কখনও শেষ হয় না। তোমাকে একটা কথা বলি ঠান্ডা মাথায় শোন। এটা ফাইজারও বাড়ি। ওর এখানে পূর্ণ অধিকার আছে। তোমার মায়েরও বাড়ি এটা। এই বাড়ির প্রকৃত মালিক তোমার বাবা। আর তোমার বাবার সাথে বৈবাহিক সূত্রে তোমার মা এ বাড়িতে এসেছে। এটা তারও বাড়ি। এখানে সে তার সংসার সাজিয়েছে। কতগুলো বছর থেকেছে। তার অধিকার আছে এ বাড়িতে। তুমি আর ফাইজা তাদের সন্তান। উত্তরাধিকারী সূত্রে তোমরা এ বাড়িতে থাকার অধিকার পেয়েছো। সেক্ষেত্রে তুমি আর ফাইজা উভয়েই সম-অধিকারী। এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশী কারো অধিকার থাকে সেটা তোমার বাবা-মায়ের। তোমার মা এ বাড়িতে আসতে চাইলে তুমি কিংবা আমি তাকে বাঁধা দিতে পারি না। এমনকি তোমার বাবাও না। তোমার মা-বাবা একে অপরকে ভালোবাসে। তারা এতটা দিন দূরে থেকেছে কিন্তু একে অপরকে এখনো ভালোবাসে। তারা আবারও এক সাথে থাকতে চায়। বয়স হয়েছে তাদের। আর কতকাল একা থাকবে? সন্তান হিসেবে তোমার কি উচিত হবে তাদের এক সাথে থাকার পথে বাঁধা হওয়ার? আর ফাইজা ওর কথা ভাবো। বাচ্চা বয়স থেকে মা’য়ের সাথে থাকছে। বাবাকে পায় নি। ওর তো বাবাকে প্রয়োজন। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। ক’দিন পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। মেয়েটা চাইছে ওর পরিবারের সাথে থাকতে। ভাই হিসেবে তোমার কি উচিত না ওর ইচ্ছেগুলো পূরণ করার?”

ফায়াজ কিছু ভাবছে। তারপর বলল,
“ঠিক আছে। ওরা আসুক এ বাড়িতে। তোমাকে নিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাব।”

প্রথম কথাগুলো শুনে মেহের খুশি হলেও শেষের লাইন শুনে মুখ শুকিয়ে গেল।
ফায়াজ এমন কিছু বলবে ভাবতেও পারে নি।
“ফায়াজ আমরা কোথায় যাব? এটা তোমারও বাড়ি। এখানে তুমি ছোট থেকে বড় হয়েছো। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা চলে গেলে বাবা কত কষ্ট পাবে ভেবেছো? আর ফাইজা? ও তো শুধু বাবাকেই চায়নি, আমাদেরকেউ চায়। এসব ভাবনা একদম মাথায় এনো না। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আমি একা একা কোথায় গিয়ে থাকব?”

ফায়াজ উঠে বসে। বিমর্ষচিত্তে বলল,
“আমি অনেক চেষ্টা করেছি সব মেনে নিতে কিন্তু পারছি না। আমি কি করে ভুলে যাব সেদিন আমাকে রেখে চলে গিয়েছিল। তারপর ১৬টা বছর কেটে গেছে।”

ফায়াজ কষ্ট পাচ্ছে তবুও মেহের জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছিল সেদিন?”

ফায়াজ তিন আংগুল দিয়ে কপাল ঘষে বলল,
“আমি আর ফাইজা স্কুল থেকে সবে বাড়িতে ঢুকেছি। উপরে থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবা-মা উচ্চস্বরে ঝগড়া করছিলেন। কাজের লোকেরা সব সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল আর কানাঘুষা করছিল। আমাদের দেখে একে একে সবাই চলে গেল। আমি আর ফাইজা কিছুক্ষণ পর উপরে গেলাম। মা লাগেজ গোছাচ্ছেন। আমাদের দেখে বলল,
,” আজ আমরা বড় মামার বাসায় যাচ্ছি। তখন শুধু ছোট মামা ইতালি থাকতেন। বড় মামা দেশেই ছিলেন। আমাদের গায়ে তখনও স্কুল ড্রেস। কাঁধে ব্যাগ। মা এক হাতে লাগেজ আর আরেক হাতে ফাইজাকে ধরে বলল,
“চলো।”

কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ফাইজা ৫ বছরের আর আমি ৯ বছরের। মায়ের সাথে যাচ্ছিলাম৷ বাবা কোথায় থেকে এসে মায়ের কাছ থেকে ছু মেরে ফাইজাকে ছাড়িয়ে নিজের হাতে ফাইজার হাত আবদ্ধ করে নিল। আর অপর হাতে আমার হাত।
তারপর চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি আমার ছেলে-মেয়েদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? যাওয়ার হয় একা যাও।”

মা আবারও ফাইজাকে নিজের কাছে নিতে চাইলে বাবা সরিয়ে ফেলেন। ফাইজা ছোট মানুষ। এসব দেখে,আতংকিত হয়ে পড়ে কেঁদে ফেলে। সবার দৃষ্টি ফাইজার দিকে।
ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি মামা বাসায় যাব।”

ও তখনও ঝগড়া ব্যাপারটা বুঝে নি। ও মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছে।
আমার কিছুটা হলেও বুঝ হয়েছে। ফাইজা কাঁদায় বাবা ওর হাত ছেড়ে দেয়। মা ফাইজার হাত ধরে আমার দিকে তাকাল। বাবা আমার হাত ধরে ফেলল। তারপর বলল,
“ফাইজা বাচ্চা মানুষ তাই যেতে দিলাম। কিন্তু ফায়াজ তোমার সাথে যাবে না।”

আমি তো আর ফাইজার মতো কাঁদতে পারি না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মায়ের দিকে করুন ভাবে চেয়ে ছিলাম। মা আর বাবার সাথে তর্ক করল না। চলে গেল।
সেদিন আমি সারাদিন কেঁদেছি। স্কুল ড্রেসও চেঞ্জ করি নি, খাই নি পর্যন্ত। কয়েকদিন কেটে যাবার পরেও মা আসে নি। ফাইজাকে খুব মনে পড়ত। ফাইজা আমার ভীষণ বাদুক ছিল। সারাক্ষণ আমার পেছনে পেছনে ঘুরত। ওকে মারলেও কারো কাছে বিচার দিতো না। কখনই চাইতো না কেউ আমাকে বকুনি দিক।
বাবা মা’কে ফিরিয়ে আনে নি আর মা-ও ফিরেনি। একটু বড় হওয়ার পর মা আমাকে ফোন করে বলত তার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি যাই নি। এতদিন একা থেকেছি একাই থাকতে পারব। একাই থেকেছি। বাবাকে তো দেখোই সে বাড়ি তো দূর এই দেশেই থাকে না তেমন। সেটা ভালো মনে হয়েছে সেটাই করেছি। কেউ যেমন আদর করার জন্য ছিল না তেমনি শাসন করারও কেউ ছিল না। কেউ ছিল না বলার মতো এটা করো না, এটা খারাপ কাজ। এটা বলো না, এটা খারাপ কথা। কেউ বলে নি এটা করো, এটা ভালো কাজ। কেউ বলে নি কারো সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। ভালো-মন্দের তফাত বুঝি নি। বুঝানোর কেউ ছিল না। যেটা ভালো মনে হয়েছে করেছি। সারাদিন বাড়িতে একা থাকতাম। সবাই বলতো আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কষ্ট পেতাম। যেটুকু সময় স্কুলে থেকেছি বন্ধুদের সাথে উল্টা-পাল্টা কাজ করেছি। সবাইকে প্রচন্ড জ্বালিয়েছি। এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ফায়াজ তৈরি হয়েছি। কি করতাম আমি? আমি কতটা কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছি আমি জানি মেহের। আমি সে দিন গুলো ভুলতে পারি না। হাজার চেষ্টা করেও পারি না। আমার প্রাচুর্য ছিল কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করেছি। কত কেঁদেছি। উনি পারতো না তখন ফিরতে?”
(ফায়াজ কাঁদছে।)
মেহেরের বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। এই মুহুর্তে ফায়াজের চাওয়ার চেয়ে বড় চাওয়া ওর কাছে আর কিছুই নেই। ফায়াজের কষ্ট সহ্য করতে পারছে না।
“ফায়াজ ঠিক আছে কান্না থামাও। প্লিজ কেঁদো না। তোমার যেটা ইচ্ছে করছে না সেটা তোমাকে করতে হবে না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। কেঁদো না।”
মেহের ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল। এমন শক্ত মনের মানুষ এভাবে কাঁদছে সেটা সহ্য করতে পারছে না। ফায়াজও মেহেরকে দু’হাতে আগলে নিল।

চলবে….