শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৫৪+৫৫

0
3050

#শেষ_পাতায়_তুমি( Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫৪|

ফায়াজ ভার্সিটিতে অলরেডি হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছে। ওর বন্ধুরা, দলের ছেলেরা, ভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাইকে এক জায়গায় করেছে। একটা ভার্সিটি থেকে একটা মানুষ কি করে উধাও হয়ে যায় সেটা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করছে। ফায়াজ পুলিশকেও জানিয়েছে। পুলিশ ভার্সিটির পথে আছে। তারা প্রথমে ভার্সিটি থেকে তাদের কাজ শুরু করতে চায়।

তুষার ফায়াজকে অনেক চেষ্টার পর ঠান্ডা করেছে। জোর করে এক জায়গায় বসিয়ে রেখেছে। তুষার চাইছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে। অপারেটরকে ইনফর্ম করা হয়েছে।

মেহেরের মনে হচ্ছে ওয়াশরুমের পাশে যে তালা-বন্দ ঘরটা আছে ও সেখানেই আছে। মেহের দরজার সামনে গিয়ে কয়েকবার ধাক্কা মেরে ডাকাডাকি করেও সাড়া পেল না। তখনই মেহেরের মনে হলো এখন হয়তো ভার্সিটিতে কেউ নেই। জানালার দিকে তাকাল। বাইরে এখনো যথেষ্ট আলো আছে। তখনই মনে পড়ল ওর হাতে ঘড়ি আছে৷ মেহের দ্রুত হাতের দিকে তাকাল। ৫টা ৫৫ বাজে। এখনও সন্ধ্যা হতে ঢের বাকি। ৬টা ১০-১৫তে সন্ধ্যা হয়। মেহের আবারও দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু কারো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না।

সামিরা হাঁপাতে হাঁপাতে ভার্সিটিতে ঢুকেছে। ফায়াজ ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
সামিরাকে শ্বাস ফেলার ফুরসত দিল না।
“সামিরা, তুমি মেহেরকে শেষ কখন দেখেছো?”

সামিরা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,
“ক্লাস শেষে দুজন এক সাথে বের হয়েছি রুম থেকে। তারপর আমি তুষারের সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাসের দিকে যাই আর ও আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। ব্যাস এটুকুই।”

ফায়াজ সামিরার কথায় কোন আশার আলো দেখতে পেল না। ধপ করে বসে পড়ল। কপালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,
“মেহের, তুমি কোথায়?”

তুষার ফায়াজের পিঠে হাত রেখে বলল,
“চিন্তা করিস না পেয়ে যাব।”

ফায়াজের ফোন বেজে উঠল। ফাইজা কল করেছে। ফায়াজ দ্রুত কল রিসিভ করল যদি মেহের বাড়িতে যায় এই ভেবে।
“হ্যালো ফাইজা, মেহের বাড়িতে গিয়েছে?”

“না ভাইয়া। ভাবী আসে নি। ওর খোঁজ পেয়েছিস কি না সেটা জানার জন্য কল করেছি।”

ফায়াজ আবারও হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝতে পারছি না কোথায় চলে গেল? আমি কি করব, কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। তুই একটু ওর বাড়িতে কল করে দেখ। আর মাহিকেও কল করিস। অনেক সময় পাড় হয়ে গেছে। লুকানোর কিছু নেই।”

“আচ্ছা, ভাইয়া আমি খোঁজ নিচ্ছি। যেভাবেই হোক খোঁজে বের করার চেষ্টা কর।” ফাইজা কল কেটে দিল। ওর মা’কে ইশারায় বলল পাওয়া যায় নি। তারপর আবার মেহেরের বাড়িতে ফোন করছে।

মেহের দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ধাক্কা দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে গেছে। বড্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। একটু পানি খেতে পারলে ভালো হতো।
মেহের ভাবছে,
“আমাকে এখানে কে রেখে গেল? কেন রেখে গেল? আর রেখেই বা কোথায় চলে গেল? আর ভার্সিটিতে আছি কি-না সেটাও শিওর না। কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ঘরটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মেহেরের একটু একটু ভয় লাগছে। আগে অন্ধকারে প্রচুর ভয় পেত। এখন আগের মতো অত ভয় না পেলেও একটু ভয় তো পায়। মেহের পরক্ষনে ভাবছে,
“ফায়াজ! ও তো আমার জন্য অনেক টেনশন করছে। বাড়ির সবাই টেনশনে আছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ফায়াজ একটু শান্তি পাচ্ছে না। নিশ্চয়ই আমাকে পাগলের মতো খুঁজছে। ফায়াজ, তুমি কোথায়?”

ফায়াজ সবার সামনে শক্ত হয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে ফেলছে। মুমূর্ষু ব্যক্তির মতো ছটফট করছে। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছে মেহেরকে খোঁজে পেলে যদি জানতে পারে কেউ ওর দিকে হাত বাড়িয়েছে তবে তাকে ছাড়বে না।
ফায়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আর এখানে বসে বসে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি না। আমি যাচ্ছি মেহেরকে খোঁজতে।”

ফায়াজ দু’পা আগানোর পর তুষার এসে বলল,
“মেহের, ভার্সিটির ভেতরেই আছে।”

ফায়াজ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তুষারের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাল।
“হ্যা ফায়াজ, মেহের ভার্সিটিতেই আছে। ওকে আজ ভার্সিটি থেকে বের হতে দেখা যায় নি। গেটের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করা হয়েছে।”

ফায়াজ তুষারের কথা শুনে ভার্সিটির চারদিকে তাকাল। মেহের ওর আশেপাশেই আছে। এটা এতক্ষণ বুঝে নি কেন?
ফায়াজ এদিক সেদিক হেঁটে ভাঙা গলায় বলল,
“মেহের কোথায় তুমি?”

তুষার সবাইকে বলল,
“দলে ভাগ হয়ে যাও। ভার্সিটির প্রতিটি রুম, অডিটোরিয়াম, প্রতিটি কোনা, পুরো ক্যাম্পাস এমনি ওয়াশরুম সব তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকো।”
সবাই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করে দিল।
“ফায়াজ, চিন্তা করিস না। খুঁজে পাব। সবাই খুঁজছে তো।”

“আমিও যাচ্ছি। আমার ভয় হচ্ছে কোন বিপদ হয় নি তো?”

“ফায়াজ, কিছু হয় নি। সব ঠিক আছে। চল খুঁজি।”

এরিমধ্যে পুলিশ ফোর্স চলে এসেছে। উনারা পুরো ঘটনা শুনে অফিসার তল্লাশি করার অর্ডার দিল।

মেহের জানালার পাশ ঘেষে রাখা বেঞ্চগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। এগুলো যেভাবে রাখা হয়েছে তাতে ওর মতো মেয়ের পক্ষে সরানো সম্ভব না।

মেহের তবুও চেষ্টা করছে। হাল ছাড়ছে না। এখানে থেকে নিচটা দেখতে পেলেই বুঝতে পারবে কোথায় আছে। অন্তত ভার্সিটি হলে বুঝতে পারবে।
একটা বেঞ্চ মেহেরের পায়ের উপর পড়ল। ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। পা নড়াতে পারছে না। কোন ভাবে বেঞ্চটা সরিয়ে দেখল কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে।

পুকুর পাড়ের কিনারা ঘেষে একটা ব্যাগ ভাসতে দেখা গেল। পুরো পুকুরে টলটলে পরিষ্কার পানি। মনে হচ্ছে ব্যাগটা সদ্য ফেলা হয়েছে। একজন পুলিশের চোখে পড়ল। ব্যাগটা একটা লাঠি জোগাড় করে তুলে আনে। ব্যাগের ভেতরে একটা খাতা, দুইটা কলম, পেন্সিল, স্কেল, টিস্যু, ছোট মানি পার্স আর কিছু হিজাবের পিন পেল। দ্রুত ভেজা খাতাটা বের করল। তারপর সবাইকে ডাকল।

ফায়াজকে দেখিয়ে বলল,
“এগুলো এখানে পাওয়া গেছে। দেখুন তো চিনেন কি না।”
ফায়াজ মেহেরের প্রতিটা জিনিস চিনে। এই ব্যাগ নিয়েই আজ মেহের ওর সাথে এসেছে।
ফায়াজ সময় না নিয়েই বলল,
“এগুলো মেহেরের।”
সামিরা আতংকিত কন্ঠে বলল,
“এগুলো এখানে কেন? মেহের পানিতে পড়ে যায় নি তো? ও তো সাঁতার কাটতে পারে না।”

সামিরার কথা শুনে ফায়াজের বুক ধুক করে উঠল। মেহের পানিতে পড়ে যেতে পারে সেটা এক মুহুর্তের জন্য মাথায় আসে নি। এখন ওর ও মনে হচ্ছে। ফায়াজ আতংকিত চোখে তুষারের দিকে তাকাল। তুষারের চোখেও ভয়, সংশয় স্পষ্ট। ফায়াজ সাহস হারিয়ে ফেলল। ধপ করে বসে পড়ল।
তারপর ঢোক গিলে বলল,
“না এটা হতে পারে না। মেহের অন্য কোথাও আছে। পানিতে পড়ে নি। ও তো বাচ্চা মেয়ে না। ও অন্য কোথাও আছে। ও জানে ওকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়, কতটা নিঃস্ব।”

ফায়াজ চিৎকার শুরু করে দিল। কাঁদতে কাঁদতে পাগলামি শুরু করে দিল। ওকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে। কিছু মানুষ পানিতে নেমে পড়েছে।
দূরে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে।

মেহের এতক্ষণের চেষ্টায় বেঞ্চ কিছুটা সরিয়ে জানালা অবধি আসতে সক্ষম হয়েছে। বেঞ্চ ধরে নিচের দিকে তাকাল। ওর চোখে মুখে খুশির ঝলক। হ্যাঁ এটা ওর ক্যাম্পাস। তিনতলা থেকে মাঠটা দেখতে পাচ্ছে। মেহের “কেউ আছো” বলে চিৎকার করছে কিন্তু তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মেহের জানালার কাচ খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে জ্যাম হয়ে গেছে। খুলছে না।

মেহের নেমে এলো। তারপর চারদিকে কিছু খুঁজছে। বেঞ্চের পা রাখার ভাঙা কাঠটা টেনে খুলে কাচে জোরে আঘাত করল। কয়েকবার আঘাত করার পর ভাঙতে সমর্থ হয়। মেহের ফাকা জায়গা দিয়ে আবারও সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। ওর খুব ভয় করছে এমন সুনশান নীরবতা। এই কোনার রুমে কেউ আসে না আর না বিল্ডিংয়ের এই কোনায় কেউ আসে।

কিছুক্ষণ পরে আলো হাতে একজনকে দেখতে পেয়ে মেহেরের মনে আশার আলো জ্বলে উঠল। মেহের তাকে ডাকছে কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে না। মেহের জোরে ডাকতে পারছে না। সে শক্তি ওর নেই। কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে কন্ঠস্বর। সে মনে হচ্ছে কিছু একটা খোঁজছে। না পেয়ে চলে যাচ্ছে। মেহেরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। চোখের সামনে এভাবে আশার তরী তীরে এসে ডুবে যাচ্ছে।

মেহের হটাৎ করে আবারো সাহসী হয়ে উঠল। নেমে পুরনো ইঁদুরে কাটা কাগজ এনে নিচে ছুড়ে মারে। বাতাসের বেগে অন্য দিকে চলে গেল। মেহের আবারো কাগজ তুলে তাতে ভাঙা কাচ রেখে ছুড়ে মারে।
উপর থেকে কিছু পড়ার শব্দে ছেলেটা চমকে উঠে। বলের মতো জড়ানো কাগজ দেখতে পায়। মেহের আবারো কাগজ তুলে নিচে ছুড়ে মারে। ছেলেটার মনে হচ্ছে উপর থেকে কেউ ফেলছে। উপরের দিকে তাকাল। কিন্তু অন্ধকারে তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। হাতের ফোনটা উপরের দিকে ধরল। সামান্য আলোতে কিছু বুঝতে পারছে না।

মেহের বুঝতে পারল ছেলেটা ওকে দেখতে পায় নি। তাই আবারও কাঠের টুকরো হাতে নিয়ে কাচে জোরে আঘাত করে। অনেকটা অংশ ভেঙে কিছুটা নিচে আর কিছুটা রুমে পড়ে। হুট করেই মেহেরের যেন অদম্য মনোবল চলে এলো। ওকে যেভাবেই হোক বুঝাতে হবে এখানে কেউ আছে।
ছেলেটা কাচের টুকরো ভাঙার শব্দে উপরে তাকায়। কাউকে দেখে নি তবে ওর মনে হচ্ছে কেউ আছে ওখানে আর কিছু বুঝাতে চাইছে।

ছেলেটা জোরে চিৎকার করে বলল,
“মেহের ভাবি, আপনি কি উপরে আছেন? সাড়া দিন।”

“আমি মেহের। সাহায্য করুন।”মেহেরের ক্ষীণস্বর কানে ভেসে এলো। কি বলল বুঝা যায় নি তবে কারো কন্ঠস্বর পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেটার চিৎকার শুনে দুজন দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে? পেয়েছিস?”

ছেলেটা উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
“উপরে মেহের ভাবি আছেন৷ আমার তাই মনে হচ্ছে। কারণ কেউ জানালার কাচ ভেঙেছে। আর এই কাগজগুলো ফেলেছে। বারবার ফেলছে। আর একটা কন্ঠস্বর শুনেছি।”

ওর কথা শুনে হৈ-চৈ পড়ে গেল পুরো ক্যাম্পাসে। ফায়াজের কানেও পৌছালো। ফায়াজ কারো অপেক্ষা না করে দৌড়ে উপরে যাচ্ছে। মেহের সেখানেই নির্জীব শরীর নিয়ে বসে আছে। ওরা চলে গেল কোথায়? মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না।

দরজায় লাথি মারছে কেউ। আর কিছুটা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। মেহের চমকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অন্ধকার ঘর ওকে চেপে ধরেছে। কিছুই দেখতে পারছে না।
ফায়াজ চাবির জন্য অপেক্ষা করতে পারছে না তাই লাথি মারছে। সবাই মিলে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর দরজা ভাঙতে পারে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফায়াজ ফ্ল্যাশলাইট অন করে স্ফীত সুরে বলল,
“মেহের!”

এই “মেহের” শব্দটা মেহেরের কানে মধুর সুর হয়ে বাজছে। হৃদয়ে কম্পন শুরু করেছে। আলোড়িত হচ্ছে চারদিক৷ ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। ফায়াজ মৃদু আলোতে মেহেরের মলিন মুখটা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল। অনেক সাধনার পর কোন কিছু পেলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছে। খুশির জোয়ারে ভাসছে। পেয়েছে তার মেহেরজানকে।

ফায়াজ দৌড়ে গিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাঁধন শক্ত হচ্ছে। যাতে আর ছেড়ে যেতে না পারে। মেহের কিছু বলতে পারছে বা। সে শক্তি ওর নেই। তবে অনুভব করছে। সুখানুভব। শরীরের সমস্ত ভার নিশ্চিন্তে ফায়াজের উপর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল।

চলবে.…..

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৫৫|

ফায়াজ পাজা কোলে মেহেরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। ওরা ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছিল মেহেরের জন্য। মেহেরকে কোলে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফাইজা আর ওর মা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো।
“ভাইয়া ভাবির কি হয়েছে?”

ফায়াজ উপরে যেতে যেতে বলল,
“সেন্স হারিয়েছে। ডাক্তার ডাক।”

ফায়াজ রুমে নিয়ে মেহেরকে শুইয়ে দিল। ফায়াজের পেছনে পেছনে তুষার, সামিরা আর ফায়াজের মা ঢুকল। ফায়াজ জগ থেকে পানি নিয়ে মেহেরের চোখে-মুখে পানি ছিটা দিল।

তবুও মেহেরের সেন্স ফিরছে না। ফাইজা ফোন করতে করতে ঘরে ঢুকল।
“ভাইয়া ডাক্তার আসতেছে।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল তারপর আবারও পানি ছিটা দিল ওর চোখে-মুখে। মেহের নড়ে-চড়ে উঠে। সেটা দেখে সবাই এগিয়ে এল। মেহের ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখ খুলেই ফায়াজকে দেখতে পেল।
ক্লান্তস্বরে বলল,
“ফায়াজ!”

ফায়াজ মেহেরের পাশে বসে বলল,
“হ্যাঁ বলো।”

মেহের আরেকটু নড়ে-চড়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে বলল,
“আমি বাড়িতে?”

“হ্যাঁ তুমি বাড়িতে। আর একদম সেফ আছো। ভয় পেও না। তুমি একদম সেফ।”

ফাইজা কথা বলতে এলে ফায়াজ ইশারা করে না করল। ফাইজা থেমে গেল। মেহের অনেক ক্লান্ত এখন কিছু না জিজ্ঞেস করাই শ্রেয়।
ফায়াজ ফাইজাকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সবাই একটু বাইরে গেলে ভালো হত।”

ওরা একে একে সবাই বাইরে চলে গেল। ফায়াজ দরজাটা বন্ধ করে মেহেরের কাছে এলো।
ফায়াজ মেহেরের কাছে যেতেই মেহের জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কে জানি আমাকে ওই ঘরে আঁটকে রেখেছিল। আমি…. ”

“হিসসস! কথা বলো না৷ কিছু বলতে হবে না। তুমি এখন চুপ করে শুয়ে থাকো। আমি পরে সব শুনব। এখন রেস্ট নেও।”

মেহের খুক খুক করে কেশে উঠে। ফায়াজ পানি নিয়ে আসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। মেহের পানি খেয়ে ম্লান কন্ঠে বলল,
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”

ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে মায়া কাজ করছে। ক্ষুধা তো লাগবেই দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি।
“আমি বলছি খাবারের কথা। তুমি শুয়ে থাকো আমি আসছি।”

ফায়াজ মেহেরের খাবারের কথা বলতে ঘর থেকে বের হলো। ফাইজা ডাক্তার নিয়ে ফায়াজের ঘরের দিকে আসছে। ফায়াজ দেখতে পেয়ে বলল,
“এসে পড়েছেন? আসুন আমার সাথে। ফাইজা মেহেরের খাবারের কথা বল।”

“ভাইয়া, মম খাবার নিয়ে আসতেছে।”

ফায়াজ আর কথা বাড়াল না। ডাক্তার মেহেরকে চেকাপ করে বলল,
“স্ট্রেস থেকে এমন হয়েছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

ফায়াজের বন্ধুরা বিদায় নিয়েছে। মেহেরের বাবা-মা থেকে গেছে। মেয়ের এই অবস্থায় তারা যেতে পারেন নি। মেহের খেয়ে একটু ঘুমিয়েছে।
ফায়াজের খেতে ইচ্ছে করছে না। কে, কি করেছে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই। ওর রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। কে এমন সাহস করল কিছুই বুঝতে পারছে না।

ফায়াজ ঘুমন্ত মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। ঘুমের মধ্যেও ওর মুখটা ক্লান্ত লাগছে। কেমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ফায়াজ ধীরে ধীরে মেহেরের কাছে গেল। মেহেরের চোখে-মুখে চুমু খেল। আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
সারা শরীর যেন কাঁপছে। আজ ওর প্রাণভোমরাকে হারানোর ভয়ে আতংকিত হয়েছিল। সত্যিই যদি হারিয়ে ফেলত তাহলে কি হতো ভাবতে পারছে না। নিশ্বাস নিতে পারছে না। চোখে পানি টলমল করছে। গলার কাছে স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

মেহের ফায়াজের পিঠে হাত রেখে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”

মেহেরের জাগ্রত কন্ঠ শুনে ফায়াজ মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেহের বাঁধা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে তরল পদার্থের অনুভব করে মেহের নড়ে উঠল।
“ফায়াজ, কাঁদছো কেন? আমি তো ঠিক আছি। কিছু হয় নি আমার। আর তোমার পাশেই আছি, তোমার বুকে। তবে কাঁদছো কেন?”

ফায়াজ কথা বলতে পারছে না। নীরব কান্নায় হটাৎ করে ফায়াজের ফ্যাসফ্যাস শব্দ ভেসে আসছে।
মেহের আবারও বলল,
“তুমি আমার কথা শুনছো না কেন? আমিও কিন্তু এখন কেঁদে ফেলব। আমাকে বলো আমি নাকি অযথা ভ্যা ভ্যা করি। কাদুনি মেয়ে। তবে তুমি এখন বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন?”

ফায়াজ মাথা তুলে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজের পুরো মুখে পানির ছাপ পড়ে গেছে। চোখের পাপড়িগুলো ভিজে ভার হয়ে গেছে।
“মেহের অনেক ভয় পেয়েছি আজ। এর আগে আমি এত ভয় পাই নি। কাছের মানুষের মৃত্যু কতটা ভয়ংকর অনুভূতি সৃষ্টি করে আজ বুঝেছি।”

মেহের অবাক হয়ে বলল,
“আমি তো মরে যাই নি। বেঁচে আছি।”

ফায়াজ চোখ মুছে বলল,
“পুকুরে তোমার ব্যাগ পাওয়া গেছে। ওরা বলছিলো তুমি পুকুরে….
ফায়াজের গলা জড়িয়ে এলো। পরের টুকু বলতে পারল না।

মেহের ফায়াজের কথা শুনে বলল,
” পড়ে মরে গেছি?”

ফায়াজ চোখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরে বলল,
“আমি তো আজ কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমিই জানি। অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ছাড়া আমার আমি বলতে কিছু নেই। দীর্ঘ সময় পর কাউকে নিজের ভেবেছি, ভালোবেসেছি। মেহের তুমি যে আমার কি সেটা তুমিও জানো না। অনেক অসহায় লাগছিল যখন তোমার জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। বাইরে শক্ত থাকলেও ভেতরটা খা খা করছিল। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।”

ফায়াজ চোখের পানি মুছে বলল,
“কখনো হারিয়ে যেও না মেহের সইতে পারব না। আজ আমি অনুভব করেছি ভুমিহীন আমি বাঁচতে পারব না। পাগল হয়ে যাব। ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমার কিছু নেই।”

ফায়াজের কান্না দেখে মেহেরও কাঁদছে। ফায়াজকে বলল,
“চুপ করো। এসব বলো না।”

ফায়াজ চোখের পানি মুছল। কিছুদিন যাবত শুধু কাঁদতেই হচ্ছে। ওর সামনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে না কেঁদে উপায় নেই। কত বছরের জমানো কান্না কে জানে!

ফায়াজ চোখের পানি মুছে মেহেরকে একটু সরিয়ে বলল,
“কি হয়েছিল? কিভাবে ওই ঘরে আঁটকে গিয়েছিলে? আর ওই ঘরে কেন গিয়েছিলে? আমার জানামতে ও ঘর সব সময় বন্ধ থাকে।”

মেহের থমথমে মুখে বলল,
“আমি যাই নি। কেউ নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কে নিয়েছে জানি না।”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে চমকে তাকাল। কিছুই বুঝতে পারছে না। এতক্ষণ তো ভেবেছে কোন ভাবে আটকা পড়েছিল।
“মানে? কে নিবে? আর কেন?”

মেহের দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলল,
“সত্যিই জানি না। আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। মুখে পানি দিচ্ছিলাম। পেছনে কেউ একজন ছিল কিন্তু আয়নায় পানি ছিল তাই চেহেরা বুঝতে পারি নি। দেখার জন্য পেছনে ঘুরতেই মুখে স্পে করে। তারপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফিরে ওই বদ্ধ ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করি। তবে অদ্ভুত বিষয় আমি যেমন ছিলাম তেমনই নিজেকে পেয়েছি। শরীরে মাটি, ময়লা কিংবা হাত-পা বাঁধা ছিল না। আর ভার্সিটির ওই রুমে আটকে রেখে এলো কেন? কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ফায়াজও বুঝতে পারছে না। কেউ কেন ওকে ভার্সিটির একটা রুমে আঁটকে রেখে আসবে? ফায়াজের মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।
উঠে বসে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“যে কাজটা করেছে ঠিক করে নি। এর মাশুল দিতে হবে। আমাকে আর তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ভয়ানক মাশুল দিতে হবে। এর হিসেব আমি চুকিয়ে নেব অপেক্ষা শুধু ওকে খুঁজে পাবার। সেটা তো আমি খুঁজে নেব।”

মেহের কোন প্রতিউত্তর করল না। কে এই কাজটা করেছে এবং কেন করেছে সেটা ওর ও জানা প্রয়োজন।

সকাল সকাল পুলিশ এসে হাজির। ড্রয়িংরুমে পুরো পরিবারের ভীড়। মেহের পুলিশকে বরাবরই ভয় পায়। ওদের সামনে যেতে ভয় লাগছে। মেহেরের পাশে ফাইজা বসে আছে। ফায়াজ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের নার্ভাস লাগছে।

“আপনার সাথে কি হয়েছিল বলুন তো?”
গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে মেহেরের বুক কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় শর্টকাট করে পুরো ঘটনা বলল।

অফিসার মেহেরের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল,
“আপনি তাকে দেখেন নি?”

“জি না।”

“ছেলে না মেয়ে ছিল তাও জানেন না?”

“জি না।”

অফিসার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল,
“এটা কি করে হতে পারে? আপনার পেছনে ছিল আর আপনি বলতেই পারেন না তিনি ছেলে না মেয়ে।”

মেহের ঢোক গিলে বলল,
“আমি শুধু একটা ঝাপসা অববয় দেখেছি। ভালো করে দেখার আগেই চোখে স্পে মারে।”

অফিসার সন্দেহ নিয়ে বলল,
“বিষয়টা এত দ্রুত হয়েছে যে আপনি তাকে দেখেন ই নি? ঘুরলেন অথচ দেখলেন না? এমন নয়তো আপনি জানেন কিন্তু বলছেন না।”

মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কেন বলব না?”

“কারণ আপনি তাকে বাঁচাতে চাইছেন। সে আপনার পরিচিত কেউ।”

মেহের এমন উত্তরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। প্রায়ই কাঁদো কাঁদো অবস্থা।
ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
“জি না। আমি তাকে দেখি নি।”

অফিসার তবুও সন্দেহ নিয়ে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“ভয় পাবেন না। যদি জেনে থাকেন সে যে তবে তার নামটা বলুন।”

মেহের জবাব দেওয়ার আগেই ফায়াজ সামনে এগিয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে চুটকি বাজিয়ে বলল,
“আউট। যথেষ্ট ইনভেস্টিগেশন করেছেন। এখন যেতে পারেন।”

অফিসার ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সবার দিকে এক বার তাকিয়ে গাম্ভীর্যের সঙ্গে ফায়াজকে বলল,
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। আমি আইনের লোক।”

ফায়াজের রাগে শরীর জ্বলছে। চোখ-মুখ লাল করে বলল,
“তাতে হয়েছে টা কি? মাথা কিনে নিয়েছেন?”

মেহের বড়বড় চোখ করে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে। ফাইজা ফিসফিস করে বলছে, ভাইয়া ঠিক করেছে। এই ব্যাটার মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে।”

ফায়াজ আবারও বলল,
“ইনভেস্টিগেশনের নামে তামাশা শুরু করে দিয়েছেন আবার আসছে আইনের লোক।”

ফায়াজের বাবা ফায়াজকে ধমকে বলল,
“চুপ করো। রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বলো।”

“বাবা কি রেস্পেক্ট দেব? বারবার কি একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। মেহের যখন একবার বলেছে যে দেখেনি ব্যাস দেখেনি। সারাটা দিন একটা অন্ধকার ঘরে বন্দী ছিল। অনেক চেষ্টার পর সেখানে থেকে বের হতে পেরেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর উনি কিসব বলে যাচ্ছেন। উনারা খুঁজে বের করতে পারছে না উল্টো পালটা প্রশ্ন করে ইনভেস্টিগেশন দেখাচ্ছে। স্ট্রেঞ্জ।”

অফিসার দমে গিয়ে বলল,
“আপনার ধারণা ভুল। আমরা আমাদের কাজ করছি। খুব শীঘ্রই অপরাধীকে খুঁজে পাব।”

ফায়াজ মনে মনে বলছে,
“না পেলে তোর খবর আছে। শুধু বড়বড় কথা।”

অফিসার যাওয়ার পর মেহেরকে বলল,
“তোমার কিছুদিন বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ওকে পাওয়া যাক তারপর আবার ভার্সিটিতে যাবে।”

মেহের আপত্তি জানাল না। ও নিজেও যেতে সাহস করছে না।
ফাইজা ফোন ঘাটতে ঘাটতে নিজের রুমে যাচ্ছে।
ফায়াজ ফাইজাকেও উদ্দেশ্য করে বলল,
“ফাইজা!”

ফাইজা ফায়াজের ডাকে সাড়া দিতে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
“কি ভাইয়া?”

“তোরও বাইরে যাওয়া বন্ধ। এদিক সেদিক উড়াউড়ি করা যাবে না। বাড়িতেই থাকবি।”

ফাইজার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
“আমি? আমি কেন?”

ফায়াজ ফোন বের করে তুষারের নাম্বারে ডায়েল করতে করতে বলল,
“বের হলে ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখব।”

ফাইজা অসহায় ফেস করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে।

তুষার ফায়াজের কাছে সব ঘটনা শুনে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে এসবের পেছনে ভয় দেখানো ছাড়া অন্য আর কোন ইনটেনশন ছিল না। নয়তো মেহেরের কোন ক্ষতি করে নি। ভার্সিটির রুমেই আটকে রাখল। অদ্ভুত না?”

“হ্যাঁ। অদ্ভুত। কিন্তু কে এমন করল? তাকে আমার চাই। যেকোনো মূল্যে চাই।”

চলবে…..