#শেষ_পাতায়_তুমি( Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৫৬|
সকাল সকাল ফায়াজের মুড খারাপ। অফিসে যাবার জন্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে কফি খাচ্ছে। মেহের এসে ফাইজার পাশে বসল।
সকাল বেলায় থানা থেকে কল এসেছে অপরাধীকে এখনও ধরা যায় নি। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করে কিছু জানা যায় নি। কারণ অপরাধী সব কিছু প্লানিং করেই করেছে। পাকা খেলোয়াড় সে। সিসি ক্যামেরা অফ ছিল। তাই কিছু পাওয়া যায় নি। আর কাউকে সন্দেহও হচ্ছে না। অফিসারের মুখে এসব শুনে মন তিক্ততায় ভরে গেছে। মনে মনে অফিসারকে দু-চার গালি দিয়ে ফোন কেটে দেয়। ফায়াজ নিরিহ স্বভাবের মানুষ হলে পরিস্থিতি মেনে নিতো কিন্তু ও যে অস্থির প্রকৃতির মানুষ তাতে ধৈর্য ধারণ ওর কাম্য নয়। ওর মাথায় শুধু ওই ব্যক্তিকে মনের স্বাদ মিটিয়ে কি করে সাইজ করবে তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। এত সহজে সেদিনের ঘটনা ভোলার নয়। স্মৃতি থেকে কিছুতেই মুছবে না।
নাস্তার টেবিলে গরম খিচুড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মুরগী, গরুর মাংস ভোনা হয়েছে। সাথে ভাজা ইলিশ আর বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। মেহের চোখ বড়বড় করে সেদিকে চেয়ে আছে। এত পদের ভর্তা কে বানালো?
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“এত ভর্তা কে বানালো?”
ফাইজা উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
“মম বানিয়েছে। নাস্তার সবকিছুর আয়োজন মম করেছে৷ আর এই ভর্তাও নিজের হাতে বানিয়েছে। ইতালিতে প্রায়ই আমাকে বানিয়ে খাওয়াতো। আর আজ তোমার আর ভাইয়ার জন্য বানিয়েছে। খেয়ে দেখো খুব মজা।”
মেহের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা, তাই!”
ফায়াজ চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইজা আর মেহেরের গল্পের ইতি ঘটল। দুজনেই ফায়াজের আকস্মিক দাঁড়িয়ে যাওয়ার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টিই এক দিকে।
ফায়াজ কোর্ট পরে মেইনগেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওর মা রান্নাঘর থেকে বাটি নিয়ে আসছিলেন। ফায়াজকে এভাবে চলে যেতে দেখে দৃষ্টি স্থির করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফায়াজকে ডাকল। কিন্তু ফায়াজ ঘুরেও তাকাল না। মেজাজ খারাপ তার উপর ফাইজার এমন আহ্লাদী কথাবার্তায় মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেছে।
ততক্ষণে মেহেরও টেবিল ছেড়ে এসেছে। ফায়াজের মা মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরতার দৃষ্টি বুঝতে পেরে দ্রুত পায়ে বাড়ির বাইরে গেল। ফায়াজ গাড়ির দরজা খুলছে।
মেহের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“ফায়াজ, দাঁড়াও।”
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“কি হয়েছে? আমার অফিসে কাজ আছে। তাড়াতাড়ি বলো।”
“নাস্তা করবে না?”
“সময় নেই। অফিসে করে নেব।”
“সময় নেই না মা রান্না করেছে তাই খাবে না?”
ফায়াজ উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। মেহের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে গেল। ওর শাশুড়ী মা কাঁদছেন। ফাইজা আর ওর বাবা শান্তনা দিচ্ছে। মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাছে গেল।
চোখের পানি মুছে মেহেরের দিকে চেয়ে বলল,
“ফায়াজ আমাকে এখনো ঘৃণা করে তাই না মেহের? আমি চলে যাব। ছেলে যখন চায় না আমি থাকব না।”
মেহের পাশে বসে হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“কেন চলে যাবেন? এটা আপনার বাড়ি, আপনার সংসার। আবার চলে গেলে সেটা আপনার জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল হবে। যা আর কোনদিন শোধরাতে পারবেন না। পরিবারটা আবারও জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অপেক্ষা শুধু সময়ের। ধৈর্য ধরতে হবে।”
ফায়াজের বাবা বলল,
“মেহের ঠিক বলেছে ফাহমিদা। এতদিনের অভিমান কি সহজে শেষ হবার? সময় লাগবে। ভেঙে পড়ো না।”
দুপুরের দিকে মেহের ফায়াজকে ফোন করল। দু’বার রিং হবার পর ফায়াজ কল রিসিভ করল।
ফায়াজ রিসিভ করে হ্যালোও বলল না। মেহের ফায়াজের নীরবতায় নিজেও কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বলল,
“ফায়াজ খেয়েছো?”
মেহেরের শুকনো মুখে বলা কথাটা ফায়াজের হৃদয়ে শীতল অনুভূতি বইয়ে দিল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
“না, খাবো। কাজ ছিল একটু।”
মেহের বুঝতে পারছে না এত বেলা পর্যন্ত কি এমন কাজ।
“আচ্ছা খেয়ে ফোন করো। খেয়ে নেও তাড়াতাড়ি প্লিজ।”
ফায়াজ ছোট করে হুম বলল। মেহের ফোন কেটে দিল। ফায়াজ তবুও ফোনে কান পেতে রাখল। তারপর কান থেকে ফোন নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
।
ফায়াজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়িতে ফিরছে। ভেতরে ঢুকার সময় খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে আসল। যেন বাড়ির ভেতরে উৎসব চলছে।
ফায়াজ ভেতরে এসে দেখে মেহের আর ফাইজা কিছু একটা নিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশে ওর মাও বসে হাসছে। কিন্তু ওদের মতো না। মৃদু ভাবে হাসছে। ফায়াজ মায়ের সে হাসি এক পলক দেখে চোখ সরিয়ে নিল। ফায়াজের মা ছেলেকে দেখে হাসি থামিয়ে দিল। ফাইজা আর মেহের তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফায়াজকে উপরে যেতে দেখল।
।
রাতে ডিনার শেষে ফায়াজ ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। কাজে মন বসাতে পারছে না। ও ছোট থেকেই এমন। যতক্ষণ পর্যন্ত মনের মতো কিছু না হয় শান্তি নেই। এখনও তাই।
মেহের ফায়াজকে উসখুস করতে দেখে বলল,
“কি হয়েছে মুখ ভার করে রেখেছো কেন?”
ফায়াজ উত্তর দিল না। মেহের দুপা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কষ্ট পাচ্ছো তো? কি দরকার ছিল সকালে অমন একটা কাজ করার? তুমি জানো মা কত কষ্ট পেয়েছে?”
ফায়াজ মেহেরকে একবার চোখ তুলে দেখল। কিন্তু কিছু বলল না।
মেহের আবারও বলল,
“তুমি যদি ভেবে থাকো উনাকে এ বাড়িতে এনে কষ্ট দেবে তাহলে ঠিক করো নি। তোমার মা উনি।”
ফায়াজ ল্যাপটপ অফ করে উঠে দাঁড়াল। মেহেরের বরাবর দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে গম্ভীর ভাবে বলল,
“তুমি কি উনার জন্য আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছো? আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইছো?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ তখনও ওর দিকে বাজপাখির দৃষ্টি দিয়ে আছে। মেহের আলতো করে চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ সেভাবেই চেয়ে আছে। হয়তো উত্তর জানতে চাইছে। মেহের থমথমে মুখে বলল,
“ঠিক আছে এ নিয়ে আমি আর কখনো কোন কথা বলব না।”
মেহেরের চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এখনি অশ্রু হয়ে ঝড়বে।
ফায়াজের মা বাইরে থেকে সবটা শুনল। তিনি এসেছিলেন মেহেরের কাছে। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে সবটা শুনে সেখান থেকেই ফেরত গেল।
মেহের বারবার চেয়েও নিজের জলভর্তি টলমলে চোখ আড়াল করতে পারছে না। ফায়াজ যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে আর চেয়ে আছে তাতে নিজেকে আড়াল করার জো নাই।
“এই যে কিছু বললেই চোখে পানি এসে পড়ে। কিছুই বলা যাবে না। শাসন করা যাবে না, কড়াভাবে কথা বলা যাবে না। ডু ইউ হেভ এনি আইডিয়া আমি কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি? কি চলছে আমার ভেতর? সে খোঁজ রেখেছো?”
এ-সব শুনে মেহেরের চোখের পানি আহ্লাদী হয়ে গেল। চোখের পাতা ভিজিয়ে পানি পড়ছে। ফায়াজ ওকে বকছে যে। মেহের একটু সরে যেতে নিল। ফায়াজ ওর হাত চেপে ধরে।
“তুমি কাঁদছো কেন? আমি কাঁদার মতো কি বললাম? আমি তোমাকে বকাবকি করেছি? সিম্পল ভাবে কয়েকটা কথা বলেছি। আমি কি দুটো কথা বলতে পারব না?”
মেহের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজের আর সাধ্য নেই মেহেরের উপর রাগ করে কিংবা দু-চারটা কড়া গলায় কথা বলে।
“আচ্ছা ঠিক আছে। আর বকব না।”
ফায়াজ মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সকাল থেকেই কেমন ব্যবহার করে যাচ্ছো। ভালো করে কথা বলছো না। এখন মুখ ভার করে বসে আছো। আর আমার উপর রাগ ঝাড়ছো।”
ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি জানো না মেহের আমি কতটা প্রেশারে আছি। কতটা টেন্স আছি। পুলিশ এখনো খুঁজে বের করতে পারে নি কালপিটটাকে।”
মেহের শান্তনা দিয়ে বলল,
“পেয়ে যাবে। চিন্তা করছো কেন?”
“পেয়ে যাবে? কবে পাবে?”
মেহের কনফিউজড হয়ে বলল,
“আমি কি করে বলব?”
ফায়াজ কটাক্ষ দেখিয়ে বলল,
“তাহলে বলো না। সবার একি কথা পেয়ে যাবে। কিন্তু কবে? কেউ জানে না। না জানলে বলার কি দরকার? আমি শান্তনা চেয়েছি?”
মেহের বুঝতে পারছে পাগল ক্ষেপেছে।
“আমি জানি তোমার টেন্সের কিছুটা কারণ আমি। কিন্তু আমি কি করব? কি করতে পারি?”
ফায়াজ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“তুমি কি করতে পারো। হ্যা তাই তো। তুমি পারো শুধু আমার মা-বোনের সাথা আড্ডা দিতে।”
“কি অদ্ভুত কথাবার্তা! আমি আজকাল বাড়িতেই থাকি। আর বাড়িতে থাকলে বাড়ির মানুষের সাথে মিশতেই হবে। তুমি আমাকে কারো সাথে মিশতে মানা করছো?”
ফায়াজ কন্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা এনে বলল,
“না। আমি তা বলি নি। আমি এসেছি আমাকে দেখো নি? অবশ্যই দেখেছো। জলজ্যান্ত একটা মানুষ তোমাদের সামনে দিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই দেখেছো। তোমার উচিত ছিল না একবার আসা। আমি রুমে এলাম৷ ফাঁকা, কেউ নেই। ভাবলাম ফ্রেশ হয়ে নেই আসবে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়েও রুম ফাঁকা। তারপরও মনকে শান্তনা দিলাম আসবে। হ্যা এসেছে প্রায় এক ঘন্টা পরে। এসেই বইপত্র নিয়ে পড়তে বসে গেলে। একবার আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলে না। সারাদিন অফিসে খাটাখাটুনি করছি। অজ্ঞাত ব্যক্তিকে নিয়ে টেনশন করছি। সর্বোপরি বিরক্ত হয়ে পড়ছি। আমি কি আশা করতে পারি না বাড়িতে ফিরে বউয়ের হাসিমুখ দেখে ক্লান্তি দূর করব, বউ একটু হেসে হেসে আদুরে কন্ঠে দু’চার কথা জিজ্ঞেস করবে। না-কি এতটুকুও আশা করতে পারি না? সারাদিন তো বাড়িতে থাকি না এতটুকু সময় কি আমাকে দেওয়া যায় না? এতটুকু সময়ের তো সবটুকু চাই নি। সামান্য একটু। বাকি সময় যা খুশি করো। কিন্তু আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাকে আমার ঘরে চাই।”
মেহের মনে মনে অনুতপ্ত হচ্ছে। আসলেই আজকাল ফায়াজের খোঁজ খবর রাখছে না, খেয়াল রাখছে না। পাগলামিও করছে না। ফায়াজের অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত। এতে কোন অপরাধ নেই।
মেহের অনুতাপের সুরে বলল,
“তোমার অভিযোগ পুরোপুরি সত্যি। আমি আসলেই আজকাল আমার দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। তোমার দুঃখে শরিক না হয়ে নিজেকে নিয়ে আছি। তোমার প্রতি যত্নশীলও নই। পরবর্তী থেকে এমন হবে না।”
“মেহের, তোমার খারাপ লাগলে সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। কিন্তু তুমি জানো আমি যা অনুভব করি তাই বলি। আমি তোমার অভাববোধ করছি। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি তোমার তীব্র অভাব অনুভব করি।”
মেহের ফায়াজের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার খারাপ লাগে নি। কষ্টও পাই নি। সব নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে যাকে ঘিরে আমার সব তার খবর রাখছি না। এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।”
ফায়াজ বাঁকা হেসে বলল,
“অন্যায়ের শাস্তি হওয়া দরকার।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। কিন্তু ফায়াজ ছাড়ার পাত্র নয়৷ মেহেরকে কোলে তুলে নিল। চোখে-মুখে চুমু খেতে খেতে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
।
পরের দিন মেহের খেয়াল করল ওর শাশুড়ী মা আর আগের মতো কথা বলে না, ডাকে না। আগের মতো হাসিখুশীও না। কেমন মন মরা হয়ে থাকে।
ফায়াজ নিচে নামার সময় দেখে ওর মা সিড়ির একটা রেলিঙ প্রাণপণে ধরে আছে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারছে না। চোখ জড়িয়ে আসছে। ফায়াজ মা বলে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে ধরে। ওর মার চোখ বুজে আসছে। শরীরের ভার রাখতে পারছে না। ফায়াজ চিৎকার করে মেহের আর ফাইজাকে ডাকল।
চলবে..
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৫৭|
“প্রেশার একদম লো। এই অবস্থা কি করে হলো? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না না-কি?এভাবে চললে কি মানুষ বাঁচে? এমন অনিয়ম কেউ লক্ষ্য করে নি? উনাকে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই বয়সে শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে বুঝেন ই তো। আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। খাওয়াদাওয়ার প্রতি যত্ন নিবেন। শরীরের যে কন্ডিশন তাতে অতিরিক্ত চিন্তা করা যাবে না। খেয়াল রাখবেন।”
ডাক্তার ফায়াজের বাবাকে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলল।
ফায়াজের বাবা স্ত্রীর মুখের দিকে একবার চেয়ে ডাক্তারকে বলল,
“জি খেয়াল রাখব।”
ডাক্তার আরো নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফায়াজ সবার অগোচরে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। কেউ খেয়াল না করলেও মেহের ঠিকি খেয়াল করেছে।
মেহের দূর থেকে দেখল ফায়াজ বাগানে ঘাসের উপর পা দিয়ে কি জানি করছে। মনে হচ্ছে জুতো দিয়ে আকিঝুকি করছে।
ফায়াজ জানে ওর মা’য়ের অসুস্থতার কারণ ও নিজে। পরোক্ষভাবে কম অপমান, অবহেলা তো করে নি। হয়তো এজন্য অভিমান করে খাওয়াদাওয়া ছেড়েছে। নিজের যত্ন নেন না।
মেহের পেছনে থেকে নিঃশব্দে ফায়াজের কাঁধে হাত রাখল। ফায়াজ চমকালো না, আশ্চর্যও হলো না। এমনকি পেছনেও ঘুরল না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
মেহের ফায়াজের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“একটা কথা বলব? সেদিন তোমাকে বলেছিলাম আমি আর কখনো এ নিয়ে কথা বলব না। কিন্ত না বলে থাকতে পারছি না। খুব বলতে ইচ্ছে করছে। বলব?”
মেহের ফায়াজের পারমিশনের জন্য অপেক্ষা করছে। ফায়াজ বুঝতে পারল মেহেরকে পারমিশন না দিলে বলবে না।
ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,”হ্যাঁ বলো।”
ফায়াজের পারমিশন পেয়ে মেহের দ্রুত বলল,
“তুমি যেদিন নাস্তা না করে চলে গেলে তার পরের দিন থেকে মা বদলে যেতে শুরু করল। আমার সাথে আগের মতো কথা বলতো না, নিজে খেতে ডাকত না। কোনকিছু নিজ থেকে বলতো না। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা ছোট করে উত্তর দিতো। বাড়তি কথা বলতো না। আগের মতো আমাকে আদর করে খাওয়াতো না। তার কাজেও অনেক গাফিলতি দেখেছি। মা যথেষ্ট পরিপাটি টাইপের। তিনি রুটিন অনুযায়ী সব করতেন। সময়ের হের ফের হতো না। কিন্তু ইদানীং তিনি কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে। সময় মতো কিছুই করত না। না খেতো না ঘুমাতো।”
ফায়াজ ছোট করে বলল,”ওহ! আচ্ছা।”
মেহের ফায়াজের উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না। একটা চাপা অসন্তোষ কাজ করল। মেহের ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
তারপর মোলায়েম গলায় বলল,
“তুমি আমার কাছে খোলা বইয়ের মতো। তোমার এই ছোট উত্তরের মাঝে যে বড়সড় আর্তনাদ আঁটকে আছে সেটা আমি জানি। তাই বৃথা নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করো না। আমি তোমার অর্ধাঙ্গিনী।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের ফায়াজকে পরম ভালোবাসায় আগলে নিল।
“মেহের, এ-সব কার জন্য হয়েছে আমি জানি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। যাদের আঙুল ধরে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে শিখেছি, যাদের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি, যাদের অজস্র রাতের ঘুম নষ্ট করেছি, যারা হাসতে শিখিয়েছে তাদের কি করে এত কষ্ট দিলাম?”
মেহের ফায়াজকে সোজা করে গালে হাত রেখে বলল,
“এখনো সময় আছে।”
“কোন মুখে আমি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব?”
মেহের স্মিত হেসে বলল,
“বাবা-মা কখনো তার ছেলে-মেয়েকে ফেলে দিতে পারে না। সন্তান যত ভুল করুক না কেন বাবা-মা বুকে জড়িয়ে নেয়। বাবা মা’কে খুব ভালোবাসে আর মা’য়ের এ অবস্থার কারণ তার অজানা নয়। তবুও তোমার দিকে আঙুল তুলে নি। একটা প্রতিবাদ বাক্য করে নি। কারণ কি জানো এই পৃথিবীর প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে সন্তান অমূল্য সম্পদ। সন্তানকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন৷ তাদের অবস্থান সবার উর্ধ্বে। যেখানে নিজেদের বড় বড় আঘাত কিছুই না সেখানে সন্তানের সামান্য কষ্টে বাবা-মায়ের কলিজা পুড়ে যায়। এখন বুঝতে পারছ না তো! একদিন বুঝবে যেদিন তুমি নিজে বাবা হবে।”
ফায়াজ চমকে মেহেরের দিকে তাকাল। ও কোনদিন বাবা হবে? হ্যা হবেই তো। ওর ও তো একদিন ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। আদর ভালোবাসায় বড় হবে। সেদিন কি পারবে সন্তানের দেওয়া কষ্ট মেনে নিতে? ফায়াজ আর কষ্ট দেবে না ওর বাবা-মাকে। আজ থেকে বাবা-মাকে আগলে রাখবে।
।
ফায়াজ মায়ের ঘরের দরজা খুলল। ভেতরে হালকা আলো জ্বলছে। ফায়াজ ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল। ওর মা বিছানার সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে। গায়ে ধূসর রঙের একটা চাঁদর। ফায়াজ বিছানার পাশে গিয়ে বসল। দু-হাত বিছানার উপরে রেখে মাথা নিচু করে বসে রইল। নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
“ফায়াজ!” শীতল কন্ঠস্বর শুনে ফায়াজ মাথা উচু করল।
দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল,
“হ্যাঁ মা।”
হ্যাঁ মা বলে ফায়াজ নিজেই চমকে গেল। ফায়াজের মা ফায়াজের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এতদিন পরে ছেলের মুখে মা ডাক শুনে কলিজা জুড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর যে হাহাকার ছিল তা যেন নিমিষেই পানি হয়ে গেল৷ খুশির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে হৃদয় জুড়ে। ঠোঁট কাঁপছে। চোখে পানি জড়ো হয়েছে।
ফায়াজ অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে।
ফায়াজের মুখে মা ডাক শুনে ওনার শরীর খারাপ যেন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেল। শান্তি লাগছে খুব। তিনি উঠে বসলেন। ফায়াজ বাঁধা দিতে চেয়েও পারল না।
ধীরে ধীরে ফায়াজের হাতের উপর হাত রাখল। ফায়াজের শরীরে কম্পন বয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ আচমকা মায়ের হাত ধরে কাঁদতে লাগল।
ফায়াজের মা বিচলিত হয়ে বলল,
“ফায়াজ, বাবা কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? কেউ কিছু বলেছে? তোমার বাবা বকেছে?”
যেন ছোট বাচ্চা বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে নালিশ দিচ্ছে এমন ভাব। মায়ের কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না। সেটা মায়ের উদ্ভব কথায় প্রকাশ পেল।
ফায়াজ হাতের উপর মাথা রেখে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো মা। রাগের বশে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করো। আমি অনেক খারাপ মা। তোমার খারাপ ছেলে।”
ফায়াজের মা ওর মুখ তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কে বলেছে তোমাকে তুমি খারাপ? তুমি আমার কলিজার টুকরো। আমার ছেলে।”
“আমাকে একটু আদর করবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? আমি না এগুলো খুব মিস করি। ঠিক করে মনে করতে পারি না। কবে আমি শেষ এই আদর পেয়েছি তোমার কাছ থেকে।”
“হ্যা করব আদর। আজ আমি আমার ছেলেকে প্রাণভরে আদর করব।” চোখের পানি মুছে ফায়াজের মাথা কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর এটা সেটা বলছে।
কিছুক্ষণ পরে ফাইজা আর মেহের দরজায় উঁকি দিচ্ছে আর ফিসফিস করছে।
“এই বিচ্ছুরা চোরের মতো দরজার সামনে উঁকিঝুঁকি না করে ভেতরে আয়।”
মেহের আর ফাইজা দাঁত কেলিয়ে ভেতরে ঢুকল। ফাইজা ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যে একটা মেয়ে আছি সেটা তো ভুলেই গেছে বুড়ো খোকাকে পেয়ে।”
মেহের চোখ উল্টিয়ে চেয়ে বলল,
“আর আমি তো পরের মেয়ে।”
ফায়াজের মা ভ্রু কুচকে তাকাল। তারপর বলল,
“হয়েছে হিংসুকের দল। আয় তোরাও আয়।”
ফাইজা আর মেহেরও গিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহের সুযোগ বুঝে ফায়াজকে চিমটি কাটল। ফায়াজের মা দোয়া করল,
“হে আল্লাহ! আমার তিনটা সন্তানকে এভাবেই হাসিখুশি রেখো।”
মেহের ঘরে এসে উচ্ছ্বাসের সাথে ফায়াজকে বলল,
“আজকে যে আমি কি পরিমাণ খুশি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। খুশিতে আমার নাঁচতে ইচ্ছে করছে।”
ফায়াজ ব্যঙ্গ করে বলল,
“নাচো৷ অনেক দিন তোমার নাচ দেখি না। আজ দেখিয়ে মন শান্তি করো।”
মেহের ভেংচি কেটে বলল,
“শখের দেখছি কমতি নেই।”
ফায়াজ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“মজা করছি না। আ’ম সিরিয়াস।”
“আমার কাজ আছে। এসবের টাইম নেই।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“দু’জন একসাথে।”
মেহের ভ্রু কুঁচকে ফায়াজের দিকে চেয়ে ভাব দেখিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। আজ এত ভালো একটা কাজ করেছো। ওকে।”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর অল্প সাউন্ড দিয়ে গান ছেড়ে মেহেরের সাথে তালে তাল মিলাচ্ছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে আজ ও পরিপূর্ণ। সব আছে ওর।
“তুমি আমার জীবনের লাকি চার্ম মেহের। তুমি আসার পর থেকে আমার এলোমেলো জীবনটা পূর্ণতা পাচ্ছে। এক এক করে সব ফিরে পাচ্ছি। সবার প্রথমে নিজেকে পেয়েছি। নিজের ভেতরটা চিনেছি। তোমাকে আমি সারাজীবন আগলে রাখব। সীমাহীন ভালোবাসা দেব।”
।
কিছুদিন পরে মেহেরের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা ঘনিয়ে এল। ফায়াজ মেহেরকে একদিনের জন্য একা ছাড়ে নি। রোজ পরীক্ষার হলে আনা নেওয়া করত। ওর ফ্রেন্ডদের ওর সাথে থাকার জন্য বলত। সামিরা মেহেরকে এক মিনিটের জন্য একা ছাড়ে নি। ফায়াজের কড়া নির্দেশ। ঠিক নির্দেশ নয় অনুরোধ। ফায়াজ সেদিন অনেক অনুনয় করেছে। বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবে না? মেহেরর সাথে এতদিন হোস্টেলে এক সাথে থেকেছে, ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠেছে।
এভাবে পরীক্ষা শেষ করে মেহের স্বস্থির নিশ্বাস নিয়েছে।
.
আজ মেহেরের ২২তম জন্মদিন। মেহের বাচ্চাদের মতো জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চায় নি কিন্তু ফায়াজ নাছোড়বান্দা। তাই মেহের মত দিয়েছে। তবে শর্ত দিয়েছে পার্টিতে শুধু দুই ফ্যামিলি আর ওদের কিছুসংখ্যক বন্ধু থাকবে। ফায়াজ তাতেই রাজী হয়েছে।
মেহের আজ শাড়ি পড়েছে৷ সোনালী পাড়ের নেভি ব্লু শাড়ি। ফায়াজ ব্লু স্যুট। হুট করে সব আলো নিভে গেল। মেহের ভয়ে ফায়াজের হাত চেপে ধরে বলল,
“লাইটের কি হলো?”
ফায়াজ হাত ছাড়িয়ে বলল,
“বাইশ বছর হয়ে গেছে তবুও বাচ্চাদের মতো ভয় পাও?”
মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই মৃদু আলো জ্বলে উঠে। বড় একটা স্কিন ভেসে আসছে। আর সেখানে মেহেরের ছোট বেলার একটা ছবি। দুই ঝুটি করা। ফ্রক পরা, ফোকলা দাঁতের হাসি। মনে হয় সবে দাঁত পড়েছে।
তারপর একে একে ফায়াজের সাথে ওর যত ছবি। ওদের ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সব কিছু ক্যামেরা বন্ধি করেছে। শেষে লিখা #মেহেরাজ
মেহের মৃদু হেসে বলল,
“#মেহেরাজ।”
মেহের খুশিতে কেঁদে দিবে অবস্থা। তারপর দু’জন মিলে কেক কাটল। নাচ গান, আড্ডার মাধ্যমে জন্মদিনের পার্টি শেষ হলো।
মেহের ফায়াজের নাম লিখা একটা বক্স পেল। কৌতূহল বশত হাতে নিল। ফায়াজ সকাল সকাল অনেক গিফট দিয়েছে এখন আবার এই বক্স কিসের জন্য বুঝতে পারছে না। এত গিফট দিয়ে কি করবে।
মেহের কৌতূহল নিয়ে বক্সটা খুলল। বক্স খুলতেই চিৎকার করে বক্স ফেলে দেয়। মেহের বুকে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে। ভয় পেয়ে গেছে খুব।
ফায়াজ চিৎকার শুনে দৌড়ে এল।
মেহের ফায়াজকে দেখে রেগে গিয়ে বলল,
“এসব কি? এগুলো কি ধরনের মজা?”
ফায়াজ মেঝেতে চেয়ে দেখে একটা পুতুল পড়ে আছে। হাত দিয়ে তুলে নিজেই চমকে গেল। কি ভয়ানক পুতুল।
মেহের বলল,”এটা কি ধরনের গিফট? এটা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য দিয়েছো?”
ফায়াজ বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমি? আমি তো এটা আনি নি।”
চলবে…