#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
মৃ’ত্যুর মুখ থেকেও বেঁচে ফিরে নিজেকে যেনো মেনে নিতে পারলাম না। এত কষ্টের থেকে তো ম’রে যাওয়াটাই ভালো ছিলো। নিজেকে কেমন যেনো অনুভূতিশূণ্য মনে হলো। চারিপাশে তাকিয়ে দেখলাম। শুভ্রতার ভিড় যেনো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। হাতে স্যালাইন চলছে। মাথা ঘুড়িয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি মাহমুদা, মাইশা আমার ডানহাত আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। আরেকপাশে সিহাব আর মাহিদ বসে আছে। তবে সিহাব আমার বেডি মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর মাহিদ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। এতো ভালোবাসার ৪ টা ভাই বোন থাকলে আর কি চাওয়ার আছে! তবুও বাবা-মায়ের জন্য আক্ষেপ আমার সবসময় থাকবে। নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে মিলাতেই খেয়াল করলাম সূর্যের আলো এসে সরাসরি রুমে এসে পড়ছে। হাসপাতালটা গ্রাম থেকে প্রায় অনেকটাই দুরে। অন্য শহর। রোদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। হঠাৎ করেই মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম। সিহাব তার ছোট ছোট হাতে আমার মাথায় একদম আস্তে হাত নাড়তেছিলো যাতে করে ব্যাথা না পাই। আমি হাসলাম। সিহাব আমার চোখ খুলতে দেখে হুট করেই জাপ্টে ধরলো এক পাশ দিয়ে। আমি কিছু বললাম না। সিহাব ধীর কন্ঠে বলে,
‘বুবু তুমি ঠিক হয়ে গেছো! তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বুবু?’
আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘নাহ। তুই ঠিক আছিস!’
সিহাব উপর নীচ মাথা নাড়ায়। এর মধ্যে ঘুম ভেঙে যায় মাহিদের। ছেলেটার ঘুম একদম হালকা। একটু টু শব্দ করলেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আমার কাছে এসে ব্যস্ত গলায় বলে,
‘বুবু তোমার ঘুম ভেঙে গেছে! কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার ডাকবো? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? মাথায় ব্যাথা করতেছে?’
‘আস্তে বল মাহিদ। ওদের ঘুম ভেঙে যাবে তো। আর আমার কষ্ট হচ্ছে না কোথাও৷’
আমার কথার মধ্যেই ধড়ফড় করে ওঠে মাহমুদা। চোখে মুখে হাত দিয়ে, কপালে হাত দেয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, ‘জ্বর নেই৷ কেমন লাগতেছে এখন বুবু!’
‘ভালো বোন। তোরা সবাই ঠিক আছিস?’
মাহমুদা মাথা নাড়ে। মাইশা তখনো ঘুমে আছে। মাহমুদা মাথা নিচু করে অপরাধি ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা হলো বুবু। আমি ভাবিনি কখনো এমন হবে। তুমি আমাকে মাফ করে দিও।’
‘ধুর পা’গলী। কি বলিস এসব! বুবুর কাছে কেউ মাফ চায়? আর তোর দোষ নেই রে। সব দোষ আমার ভাগ্যের। ছাড় এসব। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’
মাহিদ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তাই বলে কি সব ভালো তোমার সাথেই হতে হবে বুবু? তোমাকেই সবার গুণে গুণে আ’ঘাত করতে হবে? তুমি কি সুখ পাওয়ার যোগ্যতা রাাখো না? অথচ তুমি কত ধৈর্য রেখে বসে থাকো। তাহলে সব সময় আল্লাহ কেনো তোমার সাথেই এমন করে!’
ওর কথা শুনে ব্যস্ত গলায়য় বললাম, ‘ছিঃ ভাই এসব বলতে হয় না। আল্লাহ নারাজ হবেন ভাই। তুই কখনো এসব বলবি না। আল্লাহ যা করেন তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। তিনি আমার ধৈর্যের যত পরীক্ষা চান আমি দেবো। তবুও তার ওপর থেকে ভরসা হারাবো না। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আল্লাহর ওপর অভিযোগ রাখবি না। সব সময় আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করবি। খুশি হবি। যায় হোক না কেনো আলহামদুলিল্লাহ।’
মাহিদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সিহাব হেঁসে বলে, ‘বুবু তুমি কত্তো কিছু জানো আর কি সুন্দর করে সব বুঝাও।’
আমি হাসলাম৷ মাহমুদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তোরা কিছু খেয়েছিস?’
‘তোমার এই অবস্থাতে কি আমাদের খাওয়া হবে বুবু?’
‘তোরা এতো বোকা কেন হু? নিজেরা তো খাসই নি আবার এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে না খাইয়ে রাখছিস! মাইশা আর সিহাবকে আগে কিছু খাওয়া। যা!’
মাহমুদা আর কিছু বললো না। মাইশাকে তুলে হাত মুখ ধুইয়ে নিলো। মাহিদকে সাথে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। আমাকে একা রেখে যেতে না চাইলেও আমি জোড় করে পাঠিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিলাম।
_________
হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয় ২ দিন পর। মোটামুটি ঠিক থাকলেও এই অবস্থায় জার্নি করা সম্ভব না। আবার মাহিদ বা মাহমুদা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতেও নারাজ। এমনিও আমি যেতাম না। মাহিদের এক্সামও শেষ। দুজনকে অনেক বুঝালাম এই অবস্থায় আমি জার্নি করতে পারবো তবুও কেউ মানলো না। হাসপাতাল থেকে বের হতেই ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে যায় রুপা আর রাফিন ভাইয়ের সাথে। রুপা আমাকে দেখেই হেঁসে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু মাথায় তখনো ব্যান্ডেজ লাগানো দেখে ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কন্ঠে বলে,
‘তোর মাথায় ব্যাথা পেলি কিভাবে?’
আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম। বাদ দে! তুই হঠাৎ হাসপাতালে?’
‘ডাক্তার দেখানোর জন্য আসছিলাম। ভালোই হলো দেখা হয়ে। এখন কি ঢাকা চলে যাবি?’
আমি কিছু বলার আগেই চট করে মাহিদ বলে, ‘আপা তোমার বাড়িতে একটু বুবুরে রাখবা! কালকেই নিয়ে চলে আসবো।’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। এবারও কিছু বলার আগে রুপা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো, ‘এটা আবার জিজ্ঞেস করার মতোন কথা নাকি! আমি তো ২ পায়ে দাঁড়িয়ে আছি ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কতদিন দুই সই মিলে আড্ডা দেওয়া হয় না।’
আমি ব্যস্ত গলায় বললাম, ‘নাহ নাহ রুপা। ‘ও’ তো এমনি…
‘তুই চুপ থাক। তুই যাবি মানে যাবি। আর কিছু জানি না আমি।’
রাফিন ভাইও হেঁসে বলে, ‘তুমি গেলে রুপারও ভালো লাগবে। কতদিন তোমার জন্য আক্ষেপ করে। কতদিন তোমার সাথে তার আড্ডা দেওয়া হয় না, কথা হয় না! আর মাহিদ তোরাও চল। এমনিতেই আমাদের বাড়িতে তেমন আত্মীয়-স্বজনের আসা যাওয়া নেই। তোরা গেলে আব্বা-আম্মার ভীষণ ভালো লাগবে।’
রুপা খুশি হয়ে বলে, ‘ঠিক ঠিক। এই তোরা সবাই চল। কিরে মায়া এই পুচকু কে?’
সিহাবকে উদ্দেশ্য করে বলে। আমি হেঁসে বললাম, ‘আমার আরেকটা ভাই।’
রুপা আর রাফিন ভাই মিলে সবাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার বায়না শুরু করলেন। মাহিদ, মাহমুদা রাজি না হলেও ওরাও ছাড়বে না। শেষে গিয়ে ওদের জিদের কাছে হার মেনে সবাই ওদের সাথে যাওয়ার জন্য রাজি হলাম। রাফিন ভাই সিএনজি আনে। সবাই মিলে রওনা হলাম রাফিন ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাফিন ভাইয়ের বাড়িতে ঢুকার আগেই আমার ভয় ভয় করলো। গত দিনগুলোতে এতো এতো অপমানিত হয়েছি যে আর অপমানিত হতে ইচ্ছে করে না। ভয় হয় নিজের সম্মান নিয়ে। যদি রুপার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের আসাটাকে ভালো চোখে না নেয়! এটা সেইটা ভাবতে ভাবতেই তাদের বাড়িতে ঢুকলাম। চারপাশে ইটের দালান তবে উপরে ছাঁদের জায়গায় টিনশেড করা। রাফিন ভাই আর রুপা আমাদের সবাইকে বসতে দেয়। রুপা তার শ্বাশুড়িকে ডাকে। রুপার শ্বাশুড়ি বাহিরে এসে কাউকে কিিছু না বলেই আগে রুপাকে বললেন,
‘ডাক্তার কি কইলো মা? তোর সব ঠিক আছে তো! আর বাচ্চা ঠিক আছে তো!’
রুপা হেসে গলা জড়িয়ে ধরে তার শ্বাশুড়ির। বলে, ‘সব ঠিক আছে মা৷ তুমি এসব ছাড়ো আর দেখো কাদের ধরে এনেছি।’
এতক্ষণে নজর দিলেন রুপার শ্বাশুড়ি। আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার রুপাকে বলে, ‘এরা কারা? কোথা থেকে আনলি?’
‘মা তোমাকে বলেছিলাম না আমার সইয়ের কথা! মায়া। ওইটাই মায়া৷ আর সবগুলো ওর ভাই বোন। জানো আজ না ‘ও’ হাসপাতালে ছিলো। চলে যাচ্ছিলো তাই ভাবলাম আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আসি। তাছাড়াও মায়ার মন আর শরীর কোনোটাই ভালো না। ওনে নিয়ে এসে ঠিক করেছি না?’
রুপার শ্বাশুড়ি হাসলেন। রাফিন ভাই বললেন, ‘দুজনে আপ্যায়ন করো আমি গেলাম।’
বলেই সে ছুট লাগায়। রুপা আর তার শ্বাশুড়ি হেঁসে দেয়। রুপার শ্বাশুড়ি এসে আমার পাশে বসে বলে,
‘বাহ মাশাল্লাহ। মেয়েটার নামের সাথে কিন্তু মুখের দারুণ মিল। তাই না রুপা?’
‘তা আর বলতে! এই নারী আমাদের পুরো গ্রাম কাঁপিয়ে দিতো তার সৌন্দর্যে আর মায়ায়।’
আমি মলিন হাসি হাসলাম। সবার চোখে বুঝি আমার মাঝের মায়া পড়ে! তাহলে আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, নিজের বাবা-মায়ের চোখে কেনো পড়লো না! নাকি আমার মায়াাটা দেখা তাদের জন্য নিষিদ্ধ! আমার ভাবনার মাঝেই রুপার শ্বাশুড়ি বললো,
‘রুপা তুই ওদের ঘরে নিয়ে যা। আমি কিছু আনি ওদের জন্য।’
ব্যস্ত গলায় বললাম, ‘নাহ নাহ খালাম্মা কিছু লাগবে না।’
রুপার শ্বাশুড়ি বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বললেন, ‘আমাকে দেখতে মোটেও অতোটা বুড়ি লাগে না যে তুমি খালাম্মা বলতেছো!’
রুপা হেঁসে দেয়। আমি থতমত খেলাম। রুপার শ্বাশুড়ি হেসে চলে যায়। রুপা সবাইকে নিয়ে দুইটা রুমে আসে। একটা রুম ওর ননদের আরেকটা এমনি খালি পড়ে থাকে। মেহমান আসলে তারা থাকে। আর ওর ননদের বিয়ে হয়ে গেছে বলে এখানে তো থাকে না। আমাদেরকে ওর ননদের ঘরে আর মাহিদ, সিহাবকে মেহমানের রুমে দিয়ে আসে। মাহমুদা আর মাইশা বিছানার ওপর বসে থাকে। আমাকে নিয়ে রুপা গল্প জুড়ে দেয়। তার শ্বশুরবাড়ি আর তার। তার শ্বাশুড়ি আর শ্বশুরের ভালো ব্যবহার, বন্ধুর মতো আচরণ আর মেয়ের মতো ভালোবাসার গল্প। আমি শুধু ওর চকচকে মুখের দিকে তাকালাম। শুনেছি বেশি সুখ নাকি মানুষের সয় না! কিন্তু এই মেয়েটার সুখ যেনো আল্লাহ সব সময় এভাবেই রাখে। মেয়েটা যেনো আজীবন এমনই হাসিখুশি থাকে। এমনই যেনো তার সংসার সবসময় খুশি দিয়ে ভরে থাকে। রুপার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙে। রুপা আমাার মাথায় গাট্টা মে’রে বলে,
‘তোর এই ভাবুক স্বভাব বোধহয় জীবনেও যাবে না।’
আমি হাসলাম। রুপার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, ‘যার জীবনটাই ভাবনায় ভরপুর তার কি না ভাবলে চলবে!’
রুপা দীর্ঘশ্বাস নেয়। আমি নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তোকে খুব ভালোবাসে তাই না রে!’
‘তা আর বলতে! শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি না আমার উনি, ননদ, তার ছেলে মেয়ে সবাই অনেক ভালোবাসে। মানুষ অনেক ভাগ্য করে এমন শ্বশুরবাড়ি পায়। আল্লাহ আমাকে এতো ভালো শ্বশুরবাড়ি দিবে আমি কখনো কল্পনাও করিনি। তাারা আমাকে একদম নিজের মেয়ে, নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। একটু আ’ঘাত পেলেও তারা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহর কাছে হাজাার হাজার শুকরিয়া তিনি আমাকে এমন পরিবার দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।’
রুপার কথা শুনে মুগ্ধতা নিয়ে তাকালাম তার দিকে। মেয়েটা কত সুখী! আল্লাহ বোধহয় সব সুখ মেয়েটাকেই দিয়েছে। যাক তবুও ভালো থাকুক মেয়েটা। বাবার বাড়িতে সৎ মায়ের সংসারে খুব কষ্ট করেছে। এখন সুখ পাচ্ছে এটাই অনেক। ইসসস ওর মতো যদি শ্বশুরবাড়ি হতো! তাও যদি না হয়ে শুধু এমন একটাা স্বামীই হতো! যদি সেও এমন ভাবে আগলে রাখতো! তাহলে কি খুব ক্ষ’তি হতো! হয়তো হতো। পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ রয়েছে। একই শহরের একেকটা সংসারে একেকটা গল্প। একেকজন একেক রকম। সব শ্বশুরবাড়ি খারাপ হয় না আবার সব ছেলের বউও ভালো হয় না। তবুও আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুক। সবাই নিজেকে শুধরে নিক। সবার জীবনে যেনো সুখ আসে শুধু এই মায়ার মতো কষ্ট যেনো কেউ না পায়।
আমাার ভাবনার মাঝেই রুপা অদ্ভুত গলায় ডাকে। আস্তে করে বলে, ‘আমি জানি বিয়ের আগে উনি তোকে ভালোবাসতো। আচ্ছা সই স্বামীর প্রথম ভালোবাসাকে কি কোনো মেয়ে সহ্য করতে পারে?’
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)
#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________
রুপার কথায় থমকে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। মেয়েটা জানে! ভয় পেলাম। এবার বুঝি সাধের সইকেও হারাবো! চোখ দুটো পিটপিট করতে থাকে। রুপা কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। ওর এই দৃষ্টিতেই আমার বুক ছ্যাত করে ওঠে৷ কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে নিলাম। রুপা শক্ত করে আমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়৷ আমি চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে। রুপা মুচকি হেঁসে বলে,
‘ভয় পাচ্ছিস কেনো সই? তোর সই কখনোই তোকে ভুল বুঝবে না। আমি যেমন জানি উনি তোকে ভালোবাসতো তেমনই এটাও জানি যে তুই উনাকে ভালোবাসতি না৷ আর এজন্যই তো আমি উনাকে পেলাম। তোর কাছে তো আমার ঋণ। তুই যদি উনাকে ফিরিয়ে না দিতি তাহলে তো আমি উনাকে পেতাম না।’
আমি উত্তর দিলাম না। রুপা কি বুঝলো জানি না। আলগোছে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার তোর ওপর রাগ নেই৷ সবারই একটা অতীত থাকে এটাই স্বাভাবিক। আর আমি যেমন উনাকে ভালোবাসি, উনাকে সম্মান করি ঠিক তেমনই উনার সকল অনুভূতিকে সম্মান করি। আর উনি তো এখন তোকে ভালোবাসে না। সে তো এখন আমার অনাগত সন্তানের বাবা।’
আমি উত্তর না দিলেও হাত দিয়ে আগলে নিলাম রুপাকে। রুপার শ্বাশুড়ি তখন আসে। হাতে তার ট্রে। তার মধ্যে চা, বিস্কুট, চানাচুর, ফল। আমাদের দুজনকে এমন ভাবে দেখে বলে,
‘দুই সই দেখি এক্কেবারে গলায় গলায় হু! আমারও একটা সই থাকলে এমন করতাম। একটা সই নাই বলে!’
আমি আর রুপা হেঁসে দিলাম। রুপা উচু হওয়া পেটে হাত রেখে ধীরে উঠে পড়ে। শ্বাশুড়ির গলা জড়িয়ে বলে, ‘আমি আছি না!’
রুপার শ্বাশুড়ি হাসে। মাহিদ, সিহাব, রাফিন ভাই একসাথে রুমে আসে। সবাই টুকটাক খেতে খেতে গল্প করে। আমি রুপার সংসার দেখলাম। দুচোখ ভরে ওর সুখ দেখলাম। হিংসে হলো না একটুও। শান্তি পেলাম। কেউ তো সুখে আছে! চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নিলাম।
রাতে খাওয়ার সময় মাহমুদা আমাকে খাইয়ে দিলো। রুপার শ্বাশুড়ি ওকে সুন্দর করে খাইয়ে দিলো। আমি দেখলাম শুধু। রাতে ৩ বোন একসাথে ঘুমালাম। পরেরদিন সকালে খেয়ে ৫ জন একসাথে বেড়োলাম। রুপা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘নিজের খেয়াল রাখিস। কোনো কিছুতে ভেঙে পড়বি না। সবসময় শক্ত হয়ে থাকবি।’
আমি নীরবে মাথা নাড়ালাম। সবাই একসাথে বের হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। তিন্নি আর সোহান ভাই এই ক’দিনে খোঁজ নিয়েছে। তিন্নি অসুস্থ বলে আর ওকে সবটা বলিনি। এমনিতেই যেতে দেড়ি হবে বলেছি।
________________
বাড়ি এসেও গার্মেন্টসে যাইনি৷ মূলত আমার ভাই বোন গুলো যেতে দেয়নি। এখন কিছুটা সুস্থ। রান্না থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই মাহমুদা করে। আমার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে তিন্নি আর সোহান ভাইয়ের প্রশ্নের শেষ ছিলো না। তাদের সবটা বলার পর শান্ত হয়েছিলো। দুজনই ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো। আমি কিছু বলিনি৷ মাহিদ প্রতিদিন আবার কাজ শুরু করেছে। সোহান ভাইয়ের সাথেই আসা-যাওয়া করতেছে। তিন্নিরও ভালো হয়েছে। সবসময় মাহমুদা, মাইশা নয়তো আমি থাকি। আজ ৮ দিন পর গার্মেন্টসে যাচ্ছি। ম্যানেজার যে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছি না। সিউর আজ আমার কপালে দুঃখ আছে। নিজেকে সামলে গার্মেন্টসে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই হেনা ধীর কন্ঠে বলে,
‘কিরে দুদিনের কথা বলে ৮ দিন হাওয়া হয়ে গেছিলি কেন! ম্যানেজার কিন্তু তোর ওপর ক্ষে’পে আছে। জলদি যা।’
আমি ঢোক গিললাম। মাথায় বার বার একটাই কথা আসছিলো, ‘আমাকে যদি বের করে দেয় কাজ থেকে!’
নিজেকে নিজে বুঝালাম। তেমন কিছুই হবে না। আস্তে করে ম্যানেজারের কাছে যেতেই তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘আরেহ বাহ মহারানী! আপনি আসছেন। আমি তো ভাবছিলাম এবছর বুঝি আর আপনার মুখও দর্শন হবে না। তো যে গেইট দিয়ে আসছেন ওইটা দিয়ে আবার বের হয়ে যান।’
আমি আঁতকে উঠলাম। ব্যস্ত কন্ঠে বললাম, ‘এমন কথা বলবেন না স্যার৷ আমাকে কাজ থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় যাবো! কি করবো! আমার আর কখনো এমন হবে না। দয়া করে আমাকে বের করে দিবেন না।’
‘বের করে দিবো না! তুমি কি এমন রাজকার্য করতে গেছিলে যে তোমার আসতে ৮ দিন লেগে গেলো! ৮ দিনে কত কাজ ছিলো তোমার মাথায় নাই?’
কি বলবো ভেবে পেলাম না। সত্যিটা বললে নিজের বাবা-মা কে ছোট করা হবে। আমার ঘরের কথা ঘরেই থাকুক। কয়েকবার ঢোক গিলে আস্তে করে বললাম, ‘আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছিলো স্যার। আমাদের গ্রামে যাওয়ার সময় টই ঘটনা হওয়ায় কেউ জানতো না। আমি কি কখনো এরকম ভাবে মিস করছি!’
ম্যানেজার সাহেব আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। মাথায় লাগানো ওয়ান টাাইম ব্যান্ডেড চোখে পড়তেই নিজের কাজে মন দিতে দিতে বলে,
‘ঠিক আছে। আর যেনো কখনো এমন না হয়। আর কাল থেকে তুমি ওভার টাইম করবে। শুধু তুমি না অনেকেই করতেছে তাই তুমিও করবে।’
‘জ্বী স্যার।’
হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিজের কাজে আসলাম। হেনা আপু কাজ করতে করতে আমাকে বললো,
‘কি বললো?’
‘কাল থেকে ওভার টাইম করতে বললো। তুমিও করবে?’
‘হ্যাঁ রে। আমারও আছে। ভালোই হলো একসাথে করা হবে।’
আমি মাথা নাড়ালাম। নিজের কাজ করতে করতে আশে পাশে তাকালাম। নতুন কয়েকজন কর্মচারী চোখে পড়লো। আমার পাশেই একজন নতুন মেয়ে কাজ করছিলো। আমি তার দিকে তাকালাম। বয়সটা ঠিক আমার বয়সের কাছাকাছি। নয়তো আমার বড়। মেয়েটা আমাকে তাকাতে দেখে হেঁসে বললো,
‘কিছু বলবে?’
আমি দুদিকে মাথা নাড়ালাম। মেয়েটা কি মিষ্টি করে হাসে। নিজের কাজ করতে করতে বলে, ‘তোমার নাম কি?’
‘মায়া। তোমার?’
‘মিতা।’
‘মাশাল্লাহ।’
মিতা খানিকটা হাসে। বলে, ‘তোমার কথা হেনা আপুর কাছপ শুনেছিলাম। তোমার আর আমার দেখি একই দশা।’
আমি চমকে তাকালাম। মিতা হাসলো। অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আমিও ডিভোর্সী।’
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। পৃথিবীতে কি ডিভোর্সের পরিমাণ বেড়েছে! চারপাশে এতো এতো বিচ্ছেদ দেখলেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সম্পর্ক তো পবিত্র তাহলে মানুষের উদ্দেশ্য গুলোও কেনো পবিত্র হয় না? কেনো মানুষ গুলো এক নারীতে/ এক পুরুষে আসক্ত থাকতে পারে না! কেনো আল্লাহর কালাম পড়েও মানুষ সম্পর্ক বিচ্ছেদের পথ অনুসরণ করে! সবারই কি আমার মতো এতো কষ্ট পাওয়া? মিতা আমার ভাবনার মাঝেই বলে,
‘কি ভাবছো!’
আমি দুদিকে মাথা নাড়ালাম। মানে কিছু না। দুজন কাজ করতে করতেই গল্প জমালাম। একে অপরের সাথে ফ্রি হয়ে গেলাম। মিতা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধালো, ‘তোমার ডিভোর্সের কারণ কি?’
আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম, ‘ধরে নাও যৌ’তুক, অ’ত্যা’চা’র, স্বামীর প’রকীয়া।’
‘সমাজটা একদম নিচু হয়ে গেছে গো। প’র’কী’য়া দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। জানো আমার না প্রেমের বিয়ে। ২ বছর প্রেমের পর বিয়ে করেছিলাম। ফের ২ বছর সংসার করেই ছুড়ে ফেললো। আমার পরিবার মধ্যবিত্ত, তাদের কিছু দেয় নি। আর সব থেকে বড় কথা কি জানো! আমি নাকি তার মোহ ছিলাম! সে নাকি তার সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েছে।’
হাসে মিতা। এই হাসির মধ্যে কত য’ন্ত্রণা লুকানো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়েই বললাম, ‘তোমার পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছো নাকি তারাও ডিভোর্সী বলে দুরে সরিয়ে দিয়েছে!’
‘আমি ভেবেছিলাম সমাজের মতোই আব্বু-আম্মুও বোধহয় দোষ গুলো আমাকেই দেবে। কিন্তু তারা আমাকে অবাক করে দিয়ে আগলে নিলেন। সমাজের থেকে লুকিয়ে রাখলেন আঁচলের নিচে। বড় ভাইয়া আর ভাবি আমাকে মানতে পারলো না৷ তাই আব্বু-আম্মু সহ বের করে দিলেন। আব্বুর বয়স হয়েছে কিছু করতে পারে না৷ যার কাছে চাকরির জন্য যেতাম সেই কু’প্রস্তাব দিতো। মেনে নিতে পারতাম না। চুপচাপ ওসব থেকে সরে এসে গার্মেন্টসে যোগ দিলাম। আমাদের ছোট সংসারটা চললেই হবে।’
আহারে জীবন। আমার বাবা-মা আমাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে আমি ডিভোর্সী বলে আর মিতার বাবা-মা ওকে কাছে টেনে নিয়েছে পুরো সমাজের থেকে আগলে রেখেছে। আবার আমার ভাইটা আমাকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছে যাতে কেউ কিছু না বলতে পারে। আমার জন্য বাবা-মা সব ছেড়ে এসেছে আর মিতার ভাই তাকেসহ তার বাবা-মা’কে বের করে দিয়েছে। মানুষের কত বিচিত্র রুপ। সবাই যে এক না তার আরো একবার প্রমাণ পেলাম। আসলেই একেকটা সংসারের একেকটা গল্প।
_________
গার্মেন্টস থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরলাম। সিহাবকে নিয়ে বাড়ি যাবো। শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো লোপ পেয়েছে৷ কোনো রকমে পা ছুটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে কেউ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে ধরে। আমি ভয় পেয়ে যাই। আরাফ! হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যস্ত গলায় বলে,
‘কোথায় ছিলেন আপনি? গত ৮ দিন আসেননি কেনো? কি হয়েছে আপনার?’
আমি থতমত খেয়ে দুপা সরে গেলাম। আরাফের কন্ঠের ব্যস্ততা দেখে খানিকটা ইতস্তত বোধ হলো। নিজেকে সামলে বললাম,
‘যেখানেই থাকি, যা হয়ে থাক আপনাকে কেনো বলবো!’
আরাফের চোখে মুখে হুট করেই রাগের ছাপ পড়ে গেলো। চোখ আর নাক লাল টকটকে হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে পাশ কেটে চলে আসতে নিলে হাত চেপে ধরে আরাফ। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘ত্যাড়ামো করবেন না একদম আমার সাথে৷ আমি চুপচাপ আপনার ত্যাড়ামো সহ্য করি বলে সবসময় করবো না। আপনাকে আমি প্রশ্ন করেছি চুপচাপ উত্তর দিন। আর আপনার মাথায় ব্যান্ডেড কিসের? কি হয়েছে?’
‘আপনি হাত ছাড়ুন। কোন সাহসে আমার হাত ধরেছেন?’
‘বেশি কথা বললে থা’প’ড়িয়ে গাল ফুলিয়ে দিবো। চলেন আমার সাথে!’
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)