#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
(গল্পের শেষে নোট পড়াার অনুরোধ রইলো)
হসপিটালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করতেই খানিকক্ষণের জন্য চমকে গেলাম। পুরো ঘটনাটা মাথায় আসতেই প্রথমেই হাত চলে গেলো মুখে। আমি আবছা চোখে কি সত্যিই রক্ত দেখেছিলাম? সামনে তাকাতেই দেখলাম হেনা আপা আর মিতাকে। আমি পিটপিট করে তাদের দিকে তাকালামম। দুজনে কাছে এসে নরম গলায় বলে,
‘কি রে! এখন কেমন লাগছে?’
‘হু ভালো। আমাকে কি তোমরা এনেছো?’
হেনা আপা মাথা নাড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবছিলাম আজকের ঘটনাগুলো। এরমধ্যেই মাথায় আসে মাহিদের কথা মাথায় আসতেই ব্যস্ত গলায় বললাম,
‘তোমরা কি মাহিদকে বা আমার বাড়ির কাউকে কিছু জানিয়েছো?’
মিতা বললো, ‘নাহ। তোমাকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম তাই ওদের কথা মাথায় আসেনি তারওপর ওরা তোমাকে নিয়ে টেনশন করবে। তাই ভাবলাম তোমার সেন্স আসার পরই ওদের জানাবো।’
‘নাহ নাহ। ওদের জানানোর দরকার নাই। অযথা টেনশন করবে।’
হেনা আপা মিতা কিছু বললেন না। একটু পর একজন নার্স আসলেন। আমার রক্ত নিয়ে চলে গেলেন। আমি প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালাম হেনা আপা আর মিতার দিকে। হেনা আপাা বললেন,
‘তোর অবস্থার কথা বলেছিলাম তাই টেস্টের জন্য রক্ত নিয়ে গেছে। আল্ট্রাও বোধহয় দেবে।’
আমি কিছু বললাম না। হেনা আপা আর মিতা অনেকক্ষণ থেকে চলে গেলেন৷ ওদেরও তো কাজ আছে তাছাড়া আমি এখন আগের থেকে ভালো আছি। টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে চলে যাবো বাড়িতে।
প্রায় ২ ঘন্টা পর নার্স আসলেন আমার কাছে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বললেন,
‘আপনার বাড়ির লোক কোথায়?’
অদধদদদঠড্ে
‘তারা তো নেই। কেনো আপা?’
‘আপনার রিপোর্ট আমি ডক্টরকে দিয়ে এসেছি। আপনি যান।’
আমাকে ডক্টরের নাম বলে তার কেবিনে যেতে বললেন। আমি মাথা নাড়লামম। রিপোর্ট নিয়েই বাড়ি চলে যেতে পারবো। ডক্টরের কেবিনে ঢুকতেই খেয়াাল করলাম তার মুখটা মলিন হয়ে আছে। আমাকে দেখে বসতে বললেন। আমি বসার পর বললেন,
‘আপনিই মায়া?’
‘জ্বি।’
‘আপনার বাড়ির লোক কোথায়?’
‘আসলে আমার সাথে যারা ছিলো ওরা তো চলে গেছে আর আমার বাড়ির কেউ জানে না যে আমি হাসপাতালে।’
তিনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু এই রকম কেইসে তো আমরা ফ্যামিলি মেম্বারের সাথেই কথা বলি। এসব ক্ষেত্রে পেশেন্টরা তাদের রিপোর্ট টা ইজিলি নিতে পারে না। অবশ্য নেওয়াটাই কঠিন।’
তার কথায় আমার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়লো। কি এমন হয়েছে আমার? আমি ইজিলি কেনো নিতে পারবো না? কি এমন রিপোর্ট আমার? খুব খারাপ কিছু কি! শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
‘আপনি আমাকে বলুন। সমস্যা নেই ম্যাম। খারাপ রিপোর্ট হলে আমি মেনে নিতে পারবো তবে আমার ফ্যামিলির পক্ষে তা কঠিন হবে। তাই আমাকেই বলুন।’
ডক্টর দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘বি স্ট্রং মায়া। আপনি ব্ল্যাড ক্যান্সারের লাস্ট পর্যায়ে আছেন।’
মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। ডক্টর ম্যামের ধরে রাখা হাত আলগা হয়ে গেলো। পিটপিট করে চেয়ে রইলাম ম্যামের দিকে। ভুল শুনেছি আমি! আমার কিভাবে ব্ল্যাড ক্যান্সার হবে! নাহ নাহ। নিশ্চয় রিপোর্ট ভুল আসছে। নিজেকে সামলে কোনো রকমে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ম্যাম আপনি মনে হয় কিছু গুলিয়ে ফেলেছেন! তাই না? আ-আমার কিভাবে ব্ল্যাড ক্যান্সার! নাহ নাহ হতে পারে নাহ এটা। আপনাদের মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে ম্যাম।’
‘নাহ মিস মায়া। আমাদের ভুল হচ্ছে না। প্রথমে রিপোর্ট টা দেখার পর আমরা আরো কয়েকবার টেস্ট করেছি। বাট!’
পৃথিবী থমকে গেলো মুহুর্তেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার ব্ল্যাড ক্যান্সার! ডক্টর ম্যাম শক্ত করে হাত ধরলেন। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মাহিদ, মাহমুদা, মাইশা আর ছোট্ট সিহাবের মুখটা। আমার কিছু হয়ে গেলে ওদের কি হবে! মাথা ঘুরাতে লাগলো মুহুর্তেই। নিজেকে সামলে ডক্টরের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন,
‘ভেঙে পড়বেন না। আমি বুঝতে পারছি এটা আপনার কাছে কত বড় ধাক্কা কিন্তু যা হয়েছে তা তো মেনে নিতে হবে।’
আমি মাথা নাড়লাম। কাঁপা কাঁপা গলায় পানির গ্লাস দেখিয়ে বললাাম, ‘আমি খেতে পারি?’
‘জ্বি অবশ্যই।’
কাঁপা কাঁপা হাতে কোনো রকমে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলাম। শরীর কাঁপতেছে। ডক্টর ম্যাম উঠে এসে আমাকে শক্ত করে দুহাতে চেপে ধরে বললেন,
‘মিস মায়া কি হয়েছে? ঠিক আছেন আপনি? এভাবে কাঁপছেন কেনো?’
এতো বড় একটা ধাক্কা সামলাতে পারলাম না। কাঁপতে কাঁপতে সেন্সলেস হয়ে গেলাম। বার বার চোখের সামনে প্রিয় মানুষগুলোর মুখ ভেসে আসছিলো। আমার সাথে কেনো এমনটা হলো?
সেন্স ফিরতে টের পেলাম আমি এখনো ডক্টর ম্যামের কেবিনেই আছি। তিনি ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘ঠিক আছেন আপনি? এভাবে ভেঙে পড়লে আপনি কিন্তু দ্রুত ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাবেন। নিজেকে সামলান প্লিজ।’
আমি মাথা নাড়ালাম। শক্ত হয়ে বসলাম চেয়ারে। তিনি আমাকে কিছুক্ষণ শান্ত হতে দিয়ে বললেন, ‘আপনি কখনো টেস্ট করাননি?’
আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম। উনি হতাশ হয়ে বললেন, ‘আপনি কোনো সিম্পটমস ই টের পাননি!’
‘আমি মূলত জানিই না কি কি সিম্পটম হয়!’
উনি আরো হতাশ হলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আপনার শরীরে অনেক জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। আপনাকে কি কেউ খুব খারাপ ভাবে মা’র’ধো’র করতো বা করে?’
আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। তিনি আশ্বাস দিলেন সবটা বলার জন্য৷ আমি ধীরে ধীরে পুরো ৪ বছরের সবটাই বললাম। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘মানুষ এতে নীচও হয়!’
আমি তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলাম। উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিপোর্ট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ফের বললেন, ‘আপনার শরীরের রক্ত একপ্রকার একদম ড্যামেজ হয়ে গেছে। নতুন রক্ত উৎপন্ন করতে পারছে না রক্তকণিকারা। আর যখন রক্তকণিকারা রক্ত উৎপন্ন বন্ধ করে দেয় তখন বেঁচে থাকা খুবই টাফ। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড!’
আমি মাথা নাড়লাম। রিপোর্ট নিয়ে বের হয়ে আসার সময় ম্যাম পেছন থেকে ডাকলেন। আমি পেছনে তাকাতেই তিনি বললেন,
‘ব্লাড জোগাড় করে হসপিটালে এডমিট হয়ে যাবেন। নতুন রক্ত শরীরে যাওয়ার পর দেখি কি হয়! ভাগ্য থাকলে হয়তো অনেকগুলো দিন বাঁচতে পারেন।’
আমি মলিন হেঁসে বললাম, ‘বাঁচার চান্স কতটুকু ম্যাম?’
উনি কোনো কথা বললেন না। আমি বুঝে গেলাম। দুপা এগোতে এগোতে বললাম, ‘আমরা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে ম্যাম আমাদের গোটা একটা মাসই যেখানে কষ্টের ওপর যায় সেখানে এভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়াটা বিলাসিতা বয় কি আর কিছু না।’
বের হয়ে আসলাম। ভাবতে থাকলাম নিজের ভেতর থাকা এতো বড় অসুখটার কথা। শরীরে এতো বড় একটা অসুখ বাসা বেঁধে গেছে অথচ টেরই পাইনি। প্রায়ই আমার শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যাথা করতো যা আমি ক্যালশিয়ামের অভাব বলে উপেক্ষা করে গেছি৷ এর আগে ২/৩ বার রক্ত বমি হয়েছে তাও আমি উপেক্ষা করেছি। মাসের বিশেষ দিনগুলিতে বেশি ব্লিডিং হতো, কখনো কখনো ১০ দিনের বেশি ব্লিডিং হতো তাও আমি উপেক্ষা করেছি। নিজেই নিজেকে এতোবড় অসুখে ঠেলে দিলাম। এই রিপোর্টটার কথা কিভাবে বলবো ভাইকে? আর আরাফ! সে তো আমার মুখে ম’রার কথা শুনেই অভিমান করে আছে। যদি জানে আমি সত্যি হারিয়ে যাবো তাহলে সে কি করবে! সামলাবে কিভাবে নিজেকে? ওর তো পুরো পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে ছেলেটা আমাকে ছেড়ে বাঁচবে কিভাবে? আচ্ছা সুখটা কার কপালে নেই? আমার নাকি আরাফের! যখন দুজনই একটু সুখের মুখ দেখলাম তখনই জীবনে এতো বড় ধাক্কা! আমি কখনো কোনো কিছু নিয়ে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করিনি। নিজের জীবনে এতো কষ্ট আল্লাহর পরীক্ষা ভেবে মেনে নিয়েছি তাহলে এটা কেনো? আজ আমার ভীষণ অভিযোগ করতে ইচ্ছে করলো। কেনো আমার সাথেই এমন হলো? আমি কি বলবো মাহিদকে? কি বলবো মাহমুদা আর মাইশাকে! যে ছেলেটার কেউ নেই বলে নিজের বাড়িতে নিজের ভরসায় রাখলাম তাকে কি বলবো? আরাফকে কিভাবে বলবো আমি আর তার হবো না! আশে পাশের পুরো শহর যেনো মাথার ওপর ঘুরতে শুরু করেছে। রিপোর্টটা ব্যাগের ভেতর রেখে হেঁটে চললাম। ফোনের শব্দে তা হাতে নিয়ে চোখে পড়লো গোটা গোটা অক্ষরে হেনা আপার নাম। অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকিয়ে থাকলাম ফোনটার দিকে। ফোনটা ব্যাগে রেখে হাঁটা লাগালাম। আকাশে মেঘ ডাকছে গুরুম গুরুম। আজ বুঝি আমার মতো তারও মন খারাপ! উপরে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। একটা লেকেড় পাশে চুপচাপ বসে থাকলাম। সবার সামনে কিভাবে নিজেকে শক্ত রাখবো? পারবো কি আদৌও? সামনে তাকিয়ে দেখলাম একজোড়া কপোত-কপোতী। কি সুন্দর হাতে হাত রেখে হাঁটছে। সেদিন আমরাও এভাবে হেঁটেছি। সময় গুলো কত সুন্দর ছিলো। বার বার মনে হচ্ছিলো এটা আমাার স্বপ্ন। একটু পরই ভেঙে যাবে ঘুম। আমার ভাবনার মধ্যেই হুট করে বৃষ্টির ফোঁটারা পড়তে শুরু করলো। ইচ্ছে করলো না আর উঠতে। ওভাবেই বসে থাকলাম। চোখ বেয়ে পড়তে থাকলো অজস্র অশ্রু। অনুভব করলাম ঘাড়ে কারো হাতের ছোঁয়া। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চোখে পড়ে বিষাদে ভরা আরাফের মুখ। তার চোখে চোখ রাখতেই আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়লো। আরাফ আমার দুগাল দুহাতের আজলে নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
‘আপনি এটা কিভাবে পারলেন মায়া? আপনি কিভাবে পারেন আমাকে ছেড়ে যেতে! আপনি জানেন না আপনি আমার কি?’
আরাফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। শব্দ করে কাঁদতে থাকলাম তাকে আঁকড়ে ধরে। তার প্রশস্ত বুকে আমার চোখের পানির ফোয়ারা বইতে লাগলো। বৃষ্টির সাথে সাথে মিশে গেলো আমার চোখের অশ্রুকণা। আরাফ টেনে সরিয়ে দেয় আমাকে। অভিমানে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
‘নিজের প্রতি এতো অবহেলা কেনো করেছেন? কেনো নিজের যত্ন না নিয়ে ভেতরে এতোবড় অসুখ বাঁধালেন! আপনি খুব খারাপ মায়া। আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।’
পাগলের মতো আঁকড়ে ধরলাম আরাফকে। হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বললাম, ‘আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি আরাফ। আমার থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। আপনি আমার সাথে এমন করবেন না।’
আরাফ শুনলেন না৷ ছাড়িয়ে নিলেন নিজেকে। কান্না চোখে অভিমানী মুখ নিয়ে উঠে চলে গেলেন। বার বার কান্না করতে করতে চিৎকার করে বললাম, ‘আরাফ যাবেন না আমাকে ছেড়ে। আমি ভীষণ ভালোবাসি আমাকে।’
আমার কথা গুলো আরাফের কান অব্দি পৌছালো না। চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম মাটিতে পড়ে। বৃষ্টির সাথে সাথে আমার কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজার দরুণ আর এতোবড় ধাক্কায় নিজেকে সামলাাতে পারলাম না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলাম সেখানেই।
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আগের পর্ব পড়ে বলছিলেন আমি নাকি গল্পটাকে সিরিয়াল বানিয়ে ফেলেছি! সিরিয়াসলি? আমি এমন একজন কে দেখেছি যিনি সারাজীবন কষ্টের পর একটু সুখের মুখ দেখতেই ব্ল্যাড ক্যান্সের আক্রান্ত হন। তার জীবনে কিন্তু এই আরাফ নামক মানুষটার মতো এতো ভালোবাসার কেউ ছিলো না। বাস্তব জীবনে কখনোই আরাফের মতো কাউকে পাওয়া যায় না। আমি শুধুমাত্র গল্পের স্বার্থে আরাফকে এনেছিলাম। গল্প শুরু করার আগেই থিম ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু আপনারা যেভাবে কথা শুনাচ্ছেন!🙂 কেউ কেউ বলতেছেন গল্পই পড়বেন না। আপনারা গল্প না পড়লে তো আমি জোড় করে পড়াতে পারবো না। কিন্তু থিম চেঞ্জ করে গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারি না। দুঃখিত। এই পর্বের পর আমার পাঠক পাঠিকা কমে যাবে কিন্তু তাতে আমি কি-ই বা করতে পারি! এই অসুখের মাধ্যমে কিন্তু আরেকটা বাস্তবতা দেখা যায়। যাক, অনেক কথা বললাম কারো খারাপ লাগলে দুঃখিত। আর গল্পটা সিরিয়ালের মতো মনে হলে আমার কিছু করার নাই।)
#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
নিজেকে সম্পূর্ণ অন্য একটা জায়গায় আবিষ্কার করে যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছলাম। পিটপিট করে চেয়ে রইলাম পুরো রুমের দিকে। পুরো ঘটনাটা মনে পড়তেই চমকে উঠলাম। আমি না বৃষ্টির মধ্যে ছিলাম! আরাফ আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেছিলো? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শাড়ি বদলানো। আমি দ্রুত পায়ে উঠে দরজার কাছে যেতেই আরাফ দরজা খুলে ঢোকে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। আরাফ এগিয়ে আসে আমার কাছে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
‘উঠেছেন কেনো? শরীর খারাপ আপনার।’
আমি জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। আরাফ আমাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। খাবারের ট্রে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আগে কিছু খেয়ে নেন। বৃষ্টিতে কেউ এভাবে ভিজে? আমি না থাকলে কি হতো!’
‘আপনি আমাকে ছেড়ে যাননি!’
আরাফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘জ্বরের ঘোরে কি ভুল বকছেন? আমি আপনাকে ছেড়ে কেনো যাবো?’
আমি ঢোক গিললাম। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা কিছুই মাথায় আসছিলো না। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘আপনি বৃষ্টির মধ্যে আসেননি আমাার কাছে? অভিমানে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন যে! পরেই তো আমি!’
আরাফ স্যুপে ফুঁ দিতে দিতে বলে, ‘আপনি বোধহয় হ্যালুসিনেশনের শিকার। কারণ আমি অফিস থেকে ফেরার সময় আপনাকে ওখানে পড়ে থাকতে দেখেছি।’
আমি কি বলবো বুঝলাম না। মনে হলো যা ঘটেছে তা চোখের সামনেই ঘটেছে। কিন্তু! আমি আর কিছু বললাম না। আরাফের গম্ভীর মুখ দেখে চোখ পিটপিট করলাম। আস্তে করে বললাম,
‘আপনি কি রেগে আছেন?’
‘নাহ।’
আমি ভড়কালাম৷ দৃষ্টি এদিক ওদিক করলাম। আরাফ আমার মুখের সামনে এক চামচ স্যুপ তুলে ধরে। খেতে ইচ্ছে না করলেও আরাফের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পেলাম না। চুপচাপ খেয়ে নিলাম। আরাফ খাওয়া শেষে একটা ওষুধ এগিয়ে দিলো সামনে। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। সে আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো,
‘জ্বরের ওষুধ। বৃষ্টিতে ভিজে একদম জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছেন। মাহিদকে বলেছি ‘ও’ আসবে নিতে।’
তারপর আমার হাতে ওষুধ দিয়ে ট্রে হাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমার মাথা যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার ব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগটা দেখেই কোনোরকমে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। ব্যাগ হাতরে দেখলাম ভেতরে রাখা সব ভিজে চুপচুপা হয়ে গেছে। রিপোর্টটাও ভিজে গেছে। যেমন ভাবে ছিলো সব তেমন ভাবেই সব আছে। রিপোর্টটা হাতে নিয়েই চোখ মুখে বিষন্নতা ভর করলো। আমি সত্যিই আর এই সুন্দর, নি’ষ্ঠুর পৃথিবীতে থাকবো না বেশিদিন। আচ্ছা আরাফ যখন সত্যিটা জানবে তখন কি সে সত্যিই অভিমানে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে! তিক্ত এক অনুভূতিতে ভেতরটা ছেয়ে গেলো। কারো আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত রিপোর্ট গুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে বিছানায় বসলাম। মিনিট খানেক বাদেই হাজির আরাফ। আমি দৃষ্টি এদিক ওদিক করলাম। আরাফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকে। পকেটে হাত গুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘ওখানে কি করছিলেন?’
কি উত্তর দিবো ভেবে পেলাম না। তাকালামও না আরাফের দিকে। আরাফ কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় তাকিয়ে হতাশ শ্বাস নিয়ে বলে, ‘আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি!’
আমি উত্তর না দিয়ে থম মে’রে বসে রইলাম। চোখ গেলো আমার পড়নের শাড়ির দিকে। আরাফ কিছু বলতে নিলেই আমি ব্যস্ত গলায় বললাম,
‘আপনি আমার শাড়ি পাল্টেছেন কেনো? আপনি এটা কেমনে করলেন?’
আরাফ হতভম্বের মতো চেয়ে রইলেন। আমি ব্যস্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরাফ অবাক কন্ঠেই বলে, ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি কেনো আপনার কাপড় চেঞ্জ করবো?’
‘তাহলে আমার শাড়ি পাল্টে গেলো কেমনে?’
আরাফ মাথা চেপে ধরে হাতে। আমার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘অসম্ভব।’
বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আচ্ছা কি এমন বললাম উনাকে! মনে মনে নিজের কথাগুলো কয়েকবার ভাবার পরও যখন কিছু খুঁজে পেলাম না তখন বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আরাফ ছাড়া তো এই বাড়িতে কেউ থাকে না তাহলে আমার শাড়ি পাল্টালো কে? এতো ভাবতে না পেরে চুপচাপ একটা কাথা মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলাম। এতো এতো ঘটনার কথা মাথাতে
আসতেই আমার মাথা খারাাপ হওয়ার জোগাড়। ধপ করে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। এর মধ্যেই আবার মনে হলো কেউ আসছে। তার কয়েক মিনিট পরই ব্যস্ত পায়ে মাহিদ, মাহমুদা, আরাফ রুমে ঢোকে। মাহমুদা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি থতমত খেলাম। মাহমুদা ব্যস্ত গলায় বলে,
‘ঠিক আছো বুবু? তোমার কিছু হয়নি তো?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই মাহিদ আমাকে তার৷ নিজের দিকে করে শক্ত করে ধরে৷ ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘তুমি বৃষ্টিতে কেনো ভিজেছো বুবু? কতটা জ্বর আসছে তোমার! শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?’
প্রশান্তিতে মুখে হাসি ফুটে উঠে। এতো ভালোবাসে আমার ভাই বোন গুলো! এই ভালোবাসায় ভেতরের সব তিক্ততা কাটিয়ে দেয়। আমি আরাফের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
‘কিছু হয়নি পাগল। ঠিক আছি আমি। তোরা শুধু শুধু টেনশন করছিস!’
মাহিদ আমাকে ছেড়ে কপালে হাত বুলায়। জ্বর কতটা তা দেখার জন্য! মাহমুদা আমাকে আগলে বসে। আরাফের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, ‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
আরাফ সৌজন্যমূলক হাসে। মাহিদ আর মাহমুদা আরাফের সাথে কথা বললো৷ আমি চুপচাপ গালে হাত দিয়ে ৩ জনের গল্প দেখলাম। একটা সময় মাহিদ আর মাহমুদা আমাকে নিয়ে বের হওয়ার কথা বললো৷ মাহিদ নিচে নেমে গেলো সিএনজি ডাকতে। মাহমুদা আমার জন্য পানি আনতে রান্নাঘরে গেলে এগিয়ে আসে আরাফ। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,
‘চিন্তায় আর চুল পাকানোর দরকার নাই। আপনার ড্রেস পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি চেঞ্জ করেছে।’
আমি দাত দিয়ে জিভ কেটে তার দিকে তাকাতেই সে গম্ভীর মুখ করে চলে গেলো। আজ এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেনো? অভিমান করে আছে এখনো?
______
আরাফের বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আসার সময়ও লোকটা আমার সাথে ভালো করে কথা বললো না। এমনকি একটু হাসলোও না৷ সকালের অভিমান এখনো আছে? উনি তো আমার অসুখের কথা জানে না তাহলে কি সকালের জন্য এখনো অভিমান করে আছে! কি জানি বাবা! এদিকে আমার জ্বরের জন্য কিছু ভালো লাাগছেও না। রাত হয়ে গেছে। মাহিদ আর মাহমুদা আমাকে বসিয়ে আগে খাাবাার নিয়ে হাজির হলো। সিহাব আর মাইশা তাদের কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। আমি মাহমুদার হাতে খাবার দেখে বললাম,
‘আরেহ আমি খাবো না। আরাফ আমাকে খাইয়েছে তো।’
মাহমুদা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ভাইয়া কি খাইয়েছে তোমাকে?’
‘স্যুপ।’
‘ওটা খেয়ে পেট ভরেছে!’
আমি উপর নীচ মাথা নাড়ালাম। মাহমুদা কপাল চাপড়ায়। আমি সিহাব আর মাইশার মাঝে বসে ওদের গল্প শুনতে থাকলাম। যে কটা দিন থাকবো ততদিন আমি ওদের সাথে নিজেকে নিয়ে খুশিতে বাচবো। রাতে মাহমুদা আর আমি একসাথে শুয়ে রইলাম। দুজনের কেউই ঘুমাইনি। মাইশা ঘুমে কুপোকাত। কথায় কথায় মাহমুদাা জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি ওখানে গেলে কেমন করে আপু? ওটা তো গার্মেন্টস থেকে বেশ অনেকটা দুর।’
ওর প্রশ্নের কি উত্তর দিবো বুঝে উঠলাম না। সত্যিটা বলতে পারবো না। তাই হাঁসার চেষ্টা করে বললাম, ‘ভালো লাগছিলো না বলে ওদিকে গেছিলাম কিন্তু বৃষ্টিতে পড়ে গেছিলাম।’
মাহমুদা বিশ্বাস করলো কি না বুঝলাম না। কিন্তু চুপ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলো। আমি জ্বরের ঘোরে আর মাথাায় এক কথা বার বার ঘুড়তে থাকায় মাহমুদাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আচ্ছা মাহমুদা আরাফ আমাকে কতটা ভালোবাসে?’
মাহমুদা হেঁসে বলে, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেনো বুবু! তুমি বুঝি জানো না ভাইয়া তোমাকে কতটা ভালোবাসে! ‘
আনমনে বললাম, ‘আমি হারিয়ে গেলে কি আরাফ অনেক কষ্ট পাবে?’
মাহমুদা চমকে ওঠে। আমার কাছ ঘেঁষে শুয়ে বলে, ‘কি বলো বুবু? তুমি কই হারাবে!’
‘যদি ম’রে যাই তাহলে কি আরাফ অনেক কষ্ট পাবে!’
বলেই তাকালাম মাহমুদার দিকে। মাহমুদা আতঙ্কে জাপ্টে ধরে আমায়। ভাঙা গলায় বলে, ‘উল্টা পাল্টা কথা বলবেনা বুবু। তোমার কিছুই হবে না। আল্লাহ তোমাকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক।’
ওর কথা শুনে আমি হাসলাম। একহাতে আগলে নিলাম। মাহমুদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বলে, ‘আর যদি বলো আরাফ ভাইয়ের কথা! তাহলে আমি যতদুর তাকে চিনেছি তোমাকে সে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। তোমার কিছু হয়ে গেলে মানুষটা একদম খাপছাড়া হয়ে যাবে। আমি দেখেছি তোমাকে নিয়ে তার চোখের বিষন্নতা। তার গভীর ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তোমার দিকে তাকানো। যে মানুষটা তোমাকে না দেখতে পেয়ে জ্বর নিয়েও ছুটে আসে একপলক দেখতে সে মানুষটা তোমাকে না দেখে থাকতে পারবে কেমনে! আমার তো ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তুমি ভুল করেও আর উল্টা পাল্টা কথা বলবে না। আরাফ ভাই তো একা না বুবু তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা সসবাই ভেঙে যাাবো। তোমার কখনো কিছু হবে না বুবু।’
বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে৷ অনুভূতি শূণ্যের মতো চেয়ে রইলাম। অনেক কষ্টে ফাঁকা ঢোক গিলে মনে মনে আওড়ালাম,
‘আমি আপনার ফের বিষন্নতার কারণ হবো আরাফ। আপনার বিরহের কারণ হবো। আমি তো আপনার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম তবুও আমার সাথে কেনো এমন হলো! কেনো শেষ প্রান্তের মায়া একটুকু সুখও পায় না? কেনো মায়া আরাফের হবে না! কেনো মায়াই হবে আরাফের বিরহের কারণ! আচ্ছা আরাফ আমাকে ভালোবেসে আপনি এজীবনে বাঁচতে পারবেন তো! আমাকে দেখার তৃষ্ণা জাগলে মেটাবেন কিভাবে? কিভাবে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন!’
চোখের কোণ বেয়ে টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়ালো। এ কান্না আরাফের জন্য। নিজেকে তো কবেই হারিয়েছি, শেষ হয়েছি তাহলে আরাফ কেনো আসলো জীবনে! যদি আরাফেরই আসতে হতো তবে কেনো ব্লাড ক্যান্সার হলো! কেনো আমি হলাম আরাফের বিরহের কারণ! কান্না পেয়ে গেলো ভীষণ। ইচ্ছে করলো চিৎকার করে কান্না করি। কিন্তু তা হলো না। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বেড়িয়ে আসে,
‘আমি আপনার বিরহ হতে চাই নাা আরাফ। আমি আপনাতে আষ্টেপৃষ্টে থাকতে চাই। আমি আপনার হাতে হাত রেখে কাটাতে চাই হাজার বছর। আপনাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসতে চাই আরাফ। ভালোবাসি আপনাকে।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)