#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________
সময় কত দ্রুত চলে যায় তা কেউই টের পায় না। দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় ৪ মাস। মাহিদের এক্সাম শুরু হবে কাল থেকে। তাই ওকে আজই বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। সিহাবকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। প্রথমে তো সে ভর্তিই হবে না পরে কত কি করে ভর্তি করালাম। ওর ভাষাটাও শুদ্ধ করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আগের ভাষায় কথা বলে ফেলে। আমি প্রতিদিন কাজ শেষ করে আসার সময় ওকে নিয়ে আসি৷ কোনো কোনো দিন মাহিদও নিয়ে আসে। দুই ভাইয়ের মধ্যে মিল দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। কেউ এদের দেখলে বলতে পারবে না যে এরা নিজের ভাই না। সকালে যখন দুজনকে ডাকতে যাই তখন এদের অবস্থা দেখলে হাসিও পায় আবার আনন্দও হয়৷ আমি ভাবছিলাম হয়তো মাহিদ সিহাবকে তেমন ভাবে মানতে পারবে না কিন্তু ওদের দুজনের বন্ডিং দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি। প্রতিদিন সকালে ডাকতে গিয়ে দেখি একজন অন্যজনের কোলের মধ্যে বিড়ালের বাচ্চার মতো জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। এমন না যে জায়গা কম! আসলে ওরা দুজন ঘুমায়ই এমনভাবে। ওহ হ্যাঁ তিন্নি প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার যে টেস্ট দিয়েছিলো ওগুলো করানোর পর জানতে পারে তিন্নি প্রেগন্যান্ট। সোহান ভাই আর তিন্নি তো প্রচুর খুশি। সোহান ভাই অনেক খেয়াল রাখে তিন্নির। কাজ থেকে অবসর পেলেই ছুটে আসে বাড়িতে। তিন্নি কি করছে, কি খাচ্ছে, নিজের যত্ন নিচ্ছে কি না সবটার খেয়াল রাখে সে। সোহান ভাইয়ের পাগলামো দেখে তিন্নি শুধু হাসে। আপাতত তিন্নি ৬ মাসের প্রেগন্যান্ট। পেট টা কি সুন্দর ফোলা ফোলা।আগের থেকে মুখে উজ্জ্বলতার ছাপটাও বেশি। আমার ভাবনার মাঝেই তিন্নির ডাক। পেটে হাত দিয়ে আমার বাড়িতে ঢোকে। আমি ভাইয়ের ব্যাগ রেখে এগিয়ে যায় তার দিকে। তিন্নি হেঁসে একটা ব্যাগ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এটা মাহিদকে দাও। আমার আর উনার পক্ষ থেকে একটা ছোট্ট গিফ্ট। ওর পরীক্ষা উপলক্ষে।’
আমি নিজেও হেঁসে দিলাম। বললাম, ‘পরীক্ষা উপলক্ষে গিফ্ট! বাহ।’
তিন্নিকে বিছানায় বসিয়ে আমি ব্যাগটা গোছানোর ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলাম। সিহাব ছুটে এসে বলে,
‘বুবু ভাইজান আবার কবে আইবো?’
‘তুই ভালো করে কথা বল আগে। তোকে বলেছি না এভাবে কথা বলবি না নয়তো অভ্যাস থেকে যাবে। স্কুলেও এভাবে কথা বলিস?’
সিহাব দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। কয়েক মিনিট নিজে নিজেই কিছু আওড়ে আবার বলে,
‘বুবু ভাইয়া কবে আসবে আবার?’
‘তোর ভাইয়ার পরীক্ষা শেষ হলেই চলে আসবে। তা তোর ভাইয়া কই?’
‘ভাইয়া তো মন খারাপ করে কোথায় যেনো গেলো।’
এই ছেলেটা যাচ্ছে মাত্র কয়েকদিনের জন্য অথচ ভাবসাব এমন যেনো আমাকে ছেড়ে একদম চলে যাচ্ছে। মানলাম ‘ও’ আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে তার মানে তো এই না যে পড়ালেখা ছেড়ে বসে থাকবে! আমি সিহাবকে বললাম মাহিদকে ডেকে আনতে। তিন্নি আর আমি গল্প জুড়ে দিলাম। কথায় কথায় তিন্নি মজা করে বলে,
‘মায়া বিয়ে করবে নাকি? আমার কাছে ভালো একটা ছেলে আছে।’
আমি তাকালাম তিন্নির দিকে। মেয়েটার মুখে হাসি লেগেই আছে। আমি নিজের কাজে মন দিয়ে বললাম,
‘তোমার পুচকু আগে আসুক তারপর তার পছন্দে বিয়ে করে নিবো নয়তো পুচকু রাগ করবে। ঠিক বলেছি না পুচকু!’
তিন্নি খিলখিলিয়ে হাসে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম ওর মন মাতানো হাসিটা। দুজনের কথার মধ্যেই মাহিদ আর সিহাব হাজির। মাহিদকে দেখে ব্যস্ত গলায় বললাম,
‘মাহিদ বই গুলো নিবি নাকি ওখানকার গুলো আছে? তুই বাাড়িতেই তো থাকবি তাই না!’
মাহিদ ধীর কন্ঠে বলে, ‘নাহ। বাড়িতে যাবো না। কিন্তু এতগুলো বই তো নেওয়াও যাবে না। তুমি দিও না বইগুলো আমি ওখানে গিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিবো।’
আমি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম ভাইয়ের দিকে। মন খারাপ করে আছে। কন্ঠেও কেমন যেনো মলিনতা। আমি মাহিদের হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
‘তুই এমন করছিস কেন ভাই? মাত্র কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার। এমন একটা ভাব করছিস যেনো আমাকে শ্বশুরবাড়ি নয়তো কবরে রেখে যাচ্ছিস।’
মাহিদ চমকে তাকায় আমার দিকে। আমি হাসিমুখেই তাকিয়ে ছিলাম। তিন্নি একটা ধমক দিয়ে বলে, ‘তোমার কি যা তা বলার স্বভাব কোনোদিন যাবে না? কি উল্টা পাল্টা বলতেছো এসব?’
মাহিদ রাগ দেখিয়ে কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সিহাবও ছোট ছোট চোখ করে কয়েকটা কথা বলেই চলে যায়। তিন্নি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে রাগী দৃষ্টিতে। আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘কথার কথা বলেছি বলে ৩ জনই এমন রেগে যাবে নাকি!’
‘তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কি! হয়তো তোমার সাথে পরিচয় অল্প কিন্তু তোমার সাথে সম্পর্কটা এমন যেনো মনে হয় কত আপন তুমি।’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তিন্নির মুখের দিকে। আনমনে বলে বসলাম, ‘যেখানে নিজের বাবা-মা মুখে বলেছিলো আমাকে ম’রে যাওয়ার কথা সেখানে অপরিচিত তোমরা আমার ম’রার কথা শুনে আমার ওপর রেগে যাচ্ছো! এটাই কি জীবন!’
তিন্নি কিছু বললো না। এই একটা কথার পিঠে আর কোনো কথা কারোরই আসে না। জীবন এগিয়ে গেছে ঠিকই তবে এখনো কিছু কথা মনে দাগ কেটে আছে। আপনজনদের সেই নি’ষ্ঠুর রুপ গুলো আজও ভেতরে ভেতরে আমাকে পু’ড়ায়৷ অন্যের কথা তাও মুখ বুজে সহ্য করা যায় কিন্তু নিজের মানুষগুলোর কথা একদম তীরের মতো বুকে এসে বিঁধে।
খানিক পরই মাহিদ, সিহাব একসাথে বেড়িয়ে আসে। মাহিদ রেডি হয়ে গেছে। সোহান ভাই নিজেই যাবে মাহিদকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। মাহিদ অভিমানে আমার দিকে তাকালোই না। আমি নিজেও ওর সাথে কথা বললাম না। কারণ কথা বললেই এখন আর যেতে চাইবে না। কিন্তু ওর যাওয়াটা দরকার। কোনো কিছুর জন্য না হলেও নিজের পড়ালেখার জন্য তো যেতেই হবে। পড়ালেখা ছাড়া এখন আর জীবনে কিছু নাই। যদিও আজকাল মেধার চেয়েও ঘু’ষের দাম বেশি তবুও পড়ালেখা শেষ করাটা অন্যরকম শান্তি। সৎ পথে থেকে চললে আল্লাহ তায়ালা কোনো না কোনো ব্যবস্থা ঠিক করে দিবে। মাহিদ যখন বাড়ি থেকে বের হয় তখন পিছন ফিরে আরো একবার তাকায়। আমি হেঁসে শুধু ভাইয়ের চুল গুলো এলোমেলো করে দিলাম। ভাই হেঁসে জড়িয়ে ধরে।
___________
ভাই গেছে আজ কয়েকদিন হলো। ওর পরীক্ষা গুলো আল্লাহর রহমতে ভালোই হচ্ছে। ওর টাকা দিয়ে ওকে ফোন কিনে দিয়েছিলাম আর আমি ছোট্ট একটা বাটন ফোন কিনে নিয়েছিলাম শুধু মাত্র কথা বলার জন্য। সিহাবেরও স্কুল ভালো যাচ্ছে। শুধু তিন্নির শরীরটা ইদানীং খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। গার্মেন্টস থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগালাম সিহাবের স্কুলের দিকে। তার মধ্যেই সামনে এসে দাঁড়ালো সেই ছেলেটি। এতগুলো দিনেও আমি তার নাম শুনিনি, জানিও না। ইচ্ছেও প্রকাশ করিনি জানার মতো। প্রায়ই এখানে তাকে দেখা যায়। আমরা মেয়েরা বরাবরই কারো চোখ, মুখ দেখলে বুঝতে পারি সে কোন দৃষ্টিতে তাকায়। তাই আমারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি আর এজন্যই আরো বেশি করে এড়িয়ে যাই। ছেলেটা আমার সামনে এসে বলে,
‘আপনার সাথে আমার কথা আছে।’
‘আপনি আমাকে চিনেন? অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে কি কথা আপনার?’
‘আমি আপনাকে চিনি না। তাতে কি! কথাও বলা যাবে না?’
আমি নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। শান্ত গলায় বললাম, ‘সিহাবের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে আমার ওকে আনতে হবে। আপনার সাথে কথা বলতে গেলে ওকে আনতে দেড়ি হয়ে যাবে। রাস্তা ছাড়েন।’
‘সিহাবের স্কুলে তো প্রতিদিনই হেঁটে যান। চলুন হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলবো।’
ছেলেটাকে কি দিয়ে কি বুঝাবো জানি না। এভাবে কথা না বললে যে পিছুও ছাড়বে না তাও হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তাই কিছু না বলে নিজের মতো হাঁটা লাগালাম। সাথে সাথে ছেলেটাও হাঁটতে লাগলো। নিজে থেকেই বললো,
‘আমি আরাফ। আপনার নাম মায়া তাই না?’
‘জানেন যখন তখন জিজ্ঞেস কেনো করছেন? কি বলবেন সেইটা বলুন।’
ছেলেটা নিজের স্বর পরিষ্কার করে নিলো। আমতা আমতা করে মিনমিনিয়ে বলে, ‘এতো কড়া না হয়ে একটু ভালো ভাবে কথা বলা যায় না? ফ্রেন্ড মনে করেই না হয় বলুন!’
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আরাফের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললাম, ‘আমার নাম বাদ আর কিছু জানেন আমার বিষয়ে?’
আরাফ দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ায়। বলে, ‘হ্যাঁ। আপনি মায়া। আপনি ডিভোর্সী এবং ওই গার্মেন্টসে কাজ করেন।’
‘এগুলো তো আমার থেকেই শুনেছেন! এর বেশি কিছু জানেন?’
‘এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র বন্ধু হতেই তো বলছি। একটু বন্ধুর মতো কথা বললে কি এমন হবে?’
‘ডিভোর্সীদের বন্ধু-বান্ধব বলতে কিছু হয় না। সুযোগ বুঝে তারাও পিঠ পিছে ছু’ড়ি বসিয়ে দেয়।’
আরাফের হাঁটা থেমে গিয়েছে। থমথমে গলায় পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে, ‘সবাই এক না মায়া। সবাই পিঠ পিছে ছু’ড়ি না বসিয়ে খোঁপায় বেলীফুলের মালাও গুজে দেয়।’
আমি হাঁটা থামালেও পিছু ফিরে তাকালাম না। ছেলেটার বয়স আনুমানিক ২৪/২৫। আমার বড়ই হবে তারপরও এমন ইমম্যাচুউরদের মতো কথা বলতে পারে কিভাবে! ওর ব্যবহার, কথার ধরণ দেখলেই বুঝা যায় সে আমাকে পছন্দ করে। একজন ডিভোর্সীকে পছন্দ করার মানে বুঝে উনি? নিজের লাইফটা নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আরাফ আর আসে না। তবে আমি এগিয়ে যাই৷ সিহাবকে নিয়ে চুপচাপ বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে সিহাবের ড্রেস খুলে ওকে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বললাম। আমি হাত মুখ ধুয়ে আগে তিন্নির কাছে গেলাম। মেয়েটা এই অবেলাতেই শুয়ে আছে। বোধহয় শরীরটা অনেক বেশি খারাপ। তিন্নি ঘুমাচ্ছে বলে আমি আর কিছু না বলে নিজের বাড়ি এসে হাত মুখ ধুয়ে দ্রুত রান্না বসালাম। সিহাব বস্তির ছোট ছোট ছেলেপুলেদের সাথে খেলতে গেছে। ভাত রান্না হয়ে গেছে কেবল তরকারি তুলে দেবো এমন সময় হুট করেই তিন্নিদের ঘর থেকে তিন্নির জোড়ে জোড়ে কান্নার আওয়াজ পেলাম। আমি কোনো কিছু না ভেবে চুলায় পানি ঢেলে এক দৌড়ে গেলাম তিন্নির কাছে। তিন্নি মেঝেতে বসে পেট চেপে কান্না করতেছে। সোহান ভাইও দেখলাম আসেনি। তিন্নির কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে আরো জোড়ালো হলো। চিন্তায় আমার ঘাম দিচ্ছে। তিন্নিকে আগলে নিয়ে কোনো রকমে বসলাম। ৬ মাসের প্রেগন্যান্সিতে হঠাৎ এমন ব্যাথার কারণ বুঝলাম না। তিন্নি কোনো কথা না বলে কান্না করেই যাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি না জানি বাচ্চাটার কিছু হয়। যা বুঝতেছি তাতে ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটাল নিতে হবে। আশে পাশে তাকিয়ে তিন্নির ফোন নিয়ে দ্রুত কল দিলাম সোহান ভাইকে। ২ বার রিং হওয়ার পরই তিনি কল রিসিভ করলেন। আমি ব্যস্ত গলায় বললাম,
‘সোহান ভাই দ্রুত বাড়ি আসেন। তিন্নি কেমন যেনো করতেছে ওকে এখনই হাসপাতাল না নিলেই নয়।’
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না৷ আমি তিন্নিকে রেখে বাহিরে এসে পাশের বাড়ির কাকিকে ডাকলাম। আর ওই বাড়িরই ছোট একটাা ছেলেকে বললাম সিহাবকে ডাকতে। কি রেখে কি করবো আমার মাথায় কিচ্ছু আসতেছে না। টেনশনে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কোনো রকমে নিজেকে শান্ত করলাম। যা করার তা মাথা ঠান্ডা করে করতে হবে। নয়তো বিপদ বাড়বে বয় কমবে না। আমি আর পাশের বাড়ির কাকি মিলে দ্রুত তিন্নিকে তুললাম। কাকা গেছে মোড় থেকে গাড়ি আনতে। এর মধ্যেই ছুটে আসে সোহান ভাই। সিহাবও চলে এসেছে। সোহান ভাই কোনোদিকে না তাকিয়ে তিন্নিকে আগে পাজা কোলে তুলে নিলেন। তিন্নি ব্যাথায় ছটফট করছে আর কান্না করছে। আমি একটা জিনিস ভেবেই খুব অবাক হলাম। ৬ মাসে হঠাৎ এমন কেনো হলো! একটু এগোতেই কাকা একটা সিএনজি নিয়ে হাজির হলো। সিহাবকে আমার ফোন আনতে বলে আমি পেছন পেছন ছুট লাগালাম। সিএনজির মধ্যে আমি প্রথমে বসে আমার পাশে তিন্নিকে বসিয়ে নিলাম। সিহাবও ছুটে আসে। সোহান ভাই আর সিহাব সিএনজির সামনে বসে। ঢাকা শহর মানেই জ্যাম। কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই থাকবে৷ তবে ভাাগ্য ভালো থাকায় তেমন একটা জ্যাম পেলাম না। যত দ্রুত সম্ভব তিন্নিকে একটা হসপিটালে নিয়ে আসলাম। ইমার্জেন্সিতে ডক্টর দেখলো। ব্যাথা কমার জন্য ইনজেকশন আর স্যালাইন দিলো। ব্যাথায় চোখ মুখের হাল খারাপ তিন্নির। ডক্টর ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘উনার রিপোর্ট গুলো আছে?’
আমি রিপোর্ট গুলো সিহাবের থেকে নিয়ে ম্যামকে দিলাম। ভাগ্যিস তখন রিপোর্ট গুলো কাজে লাগবে ভেবে নিয়ে নিয়েছিলাম নয়তো আরো ঝামেলা বাড়তো। সোহান ভাই চুপ করে বসে রইলেন একটা বেঞ্চে। ম্যাম রিপোর্ট গুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি সিহাবকে নিয়ে বসলাম সোহান ভাইয়ের কাছে। সোহান ভাইয়ের মনের অবস্থা ভেবেই আরো বেশি খারাপ লাগছিলো। এমন সময় ফোন আসে মাহিদের। আমি নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে ফোন রিসিভ করলাম। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে মাহিদ ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘বুবু আব্বা-মা মাহমুদার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তন্ময় ভাইয়ের মতোই এবারের ছেলেটাও বড়লোক। ২/৩ দিনের মধ্যেই বোধহয় বিয়ে হয়ে যাবে৷ কি করবে বুবু!’
মাথায় যেনো আকাশ ভে’ঙে পড়লো। আমার মতো আমার বোনটার অবস্থা হবে না তো! আমি যেমন কষ্ট পেয়েছি আমার বোনটাও পাবে না তো! কিন্তু এই মুহুর্তে আমি যাবো কি করে! একদিকে তিন্নির এই অবস্থা ওদিকে আমার বোনটা। আমি না গেলে আব্বা-মা সত্যি সত্যি ওর বিয়ে দিয়ে দেবে। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিত বুঝে উঠলাম না। অনুভূতিশূণ্যের মতো চেয়ে রইলাম তিন্নির বেডের দিকে….
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলাম বেঞ্চে। তিন্নির ব্যাথা কমলেও ঘুমিয়ে পড়েছে। সোহান ভাই টেনশন করতে করতেই কেমন যেনো একটা হয়ে গেছে। এই অবস্থায় এদেরকে রেখে আমি যাবোই বা কিভাবে! ওদিকে মাহিদের পরীক্ষা চলতেছে কোনোভাবেই ছেলেটাকে টেনশনে রাখা যাবে না৷ আমি এতদুর থেকে কিছু করতেও পারবো না৷ কাল সকাল পর্যন্ত তিন্নির অবস্থা না দেখে, আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট না দেখে ডক্টর ম্যামও তেমন কিছু বলতে পারবেন না। শুধু এটুকু বলে আশ্বাস দিয়েছে, ‘এমন অবস্থায় এরকম হয়ে থাকে আপনারা চিন্তা করবেন না। কাল নতুন টেস্টের রিপোর্টগুলো দেখলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
আমি মেনে নিলেও সোহান ভাই যে মানতে পারতেছে না তা বুঝেছি। আমারই টেনশনে মাথা কাজ করছে না। কয়েক বার মাথা ঘুরে উঠেছে৷ সারাদিন তেমন কিছু না খাওয়ারই ফল এটা। মনে হচ্ছে শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যাথা করতেছে। নিজেকে সামলাতে চাইলেও বার বার মাথায় সব ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার বোনটার যে কি হবে ভেবে পাচ্ছি না৷ মাথা চেপে বসেছিলাম। সিহাব কিছু বুঝেছে কি না জানি না। কিন্তু তার ছোট ছোট হাতে আমার মুখ ছুঁইয়ে দেয়। আমি মাথা তুলে তাকাই তার দিকে। সিহাব বলে,
‘তোমার কি মাথা ব্যাথা করতেছে বুবু? এভাবে বসে আছো কেন? কিছু নিয়ে চিন্তা করতেছো?’
আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম এই ছোট্ট ছেলেটার দিকে। ওর চোখ মুখ ছুঁয়ে দিয়ে পাশে বসালাম। হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘তুই দুপুরে খেয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ। তুমিই তো টিফিন দিয়ে দিয়েছিলে আমাকে।’
‘তোর কি ক্ষুধা পেয়েছে? আর কিছু খাবি?’
সিহাব দুদিকে মাথা নাড়ায়৷ ভালো মতো বসে বলে, ‘তুমি যদি কিছু নিয়ে চিন্তা করো তাহলে বড় করে নিঃশ্বাস নাও আর মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করো।’
পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম সিহাবের দিকে। এতটুকু একটা ছেলে অথচ কত বুঝদার। আমি ওর কথা মতোই বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম সহস্রবার। মাথা ঠান্ডা করে ভেবে নিলাম কি করা যায়! দ্রুত ফোন নিয়ে কল লাগালাম মাহিদের নাম্বারে। ২ বার রিং হতেই ভাই ফোন তুলে। আমি ব্যস্ত কন্ঠে বললাম,
‘কাল তোর পরীক্ষা আছে?’
ভাই মলিন কন্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ। বুবু আমি কালকের পরীক্ষাটা দিবো না।’
‘এসব বলবি না। তুই সবগুলো পরীক্ষা দিবি।’
‘কিন্তু বুবু আমি পরীক্ষা দিতে গেলে যে আমার আরও একটা বোনের জীবন ন’ষ্ট হয়ে যাবে। যদি কখনো ওরও ডিভোর্সী ট্যাগ নিতে হয়! বুবু তুমি আর আমি জানি এই সমাজের সাথে লড়াই করে কিভাবে টিকে আছি।’
‘জানি ভাই কিন্তু তুই তোর পরীক্ষা টা ছাড়িস না৷ মাহমুদাকে কোনো রকম ভাবে বল যেনো বিয়েটা আটকে রাখে আমি না আসা পর্যন্ত। আমি কালই চলে আসবো।’
‘আজ আসবে না বুবু?’
‘নাহ রে। আসতে পারবো না। আমি তোকে সবটা কাল গিয়ে বলবো। তুই কোনোভাবে মাহমুদাকে বল যেনো বিয়েটা আটকায়৷ আমি যতটুকু সম্ভব দ্রুত চলে আসবো।’
‘ঠিক আছে। সাবধানে থেকো।’
আমি সম্মতি জানিয়ে কল কেটে দিলাম। বিপদ যখন আসে তখন সব দিকে থেকেই আসে। ওদিকে মাহিদেরও পরীক্ষা চলতেছে। পরীক্ষায় ফেইল আসলে আরো এক বছর একই ক্লাসে থাকতে হবে। কোনো কিছুতেই আমার আর মাথা কাজ করতেছে না। কোনো রকমে নিজেকে সামলে সোহান ভাইয়ের কাছে আসলাম। উনি আমাকে দেখেই মলিন কন্ঠে বললেন,
‘আপনি বাড়ি চলে যান আপু। সারাদিন এমনিতেই কত কাজ করেন। ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমি একা থাকতে পারবো।’
‘সমস্যা নেই ভাইয়া। আপনিও তো সারাদিন কত কাজ করেন। আমি রাতে থাকি। তিন্নির কোনো সমস্যা হলে অন্তত সাহায্য করতে পারবো। আর আপনি এতো চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সোহান ভাই কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি হাসার চেষ্টা করে সরে আসলাম। রাতে সিহাবকে বাহির থেকে খাইয়ে এনেছি। এই পরিস্থিতিতে আমার বা সোহান ভাইয়ের গলা দিয়ে খাওয়ার নামবে না।
_________
সকাল বেলা প্রথমেই তিন্নিকে দেখে ডক্টর টেস্ট দিলেন। টেস্ট করিয়ে এনে তিন্নিকে একদম হালকা কিছু খেয়ে শুইয়ে দিলাম। মেয়েটার পেটের ব্যাথা এখনো আছে। একদিনের ব্যাথাতেই চোখ মুখ কেমন মলিন হয়ে গেছে। সোহান ভাই সেই যে সারারাত হাত ধরে বসে ছিলো এখনো হাত ধরেই আছে। কিছু তেই সে বউয়ের হাত ছাড়বে না। আমিও সকালে মাহিদকে কল দিয়ে আগে সেখানের খবরটা জেনেছি। আজ আমাকে যে করেই হোক বাড়ি যেতেই হবে। বেশি ভিড় না থাকায় রিপোর্ট পেতে খুব বেশি দেড়ি হলো না। রিপোর্ট পাওয়ার পর তা নিয়ে ডক্টরের কাছে গেলাম। সোহান ভাই আসেনি৷ আমি নিজেই গেলাম। ডক্টর রিপোর্ট গুলো দেখে বললেন,
‘দেখুন উনার বেবির পজিশন টা ভালো না। এছাড়া তেমন কোনো মেজর প্রবলেম নেই৷ আমি প্রেসক্রিপ করে দিচ্ছি সময় মতো ঠিক ঠাক ভাবে উনাকে খাওয়াবেন এবং খেয়াল রাখবেন যেনো ভারী কোনো কাজ একদমই না করে। আর কোনো অনিয়ম যেনো না হয়।’
আমি স্বস্তির শ্বাস নিলাম। তেমন কোনো সমস্যা নেই এটা শুনেই শান্তি পেলাম। ম্যামের থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেডে আসলাম৷ সোহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললাম,
‘আর চিন্তা করে পাগল হইয়েন না। ডাক্তার বলছে সব ঠিকঠাক আছে। আর ওষুধ দিয়েছে এগুলো সময়মতো ঠিকঠাক ভাবে খেলেই হবে। আর তিন্নি তুমি কিন্তু ভারী কোনো কাজ করবে না।’
সোহান ভাই স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। তিন্নি মৃদু হেঁসে বলে, ‘বেবি ঠিক আছে তো মায়া!’
‘হ্যাঁ ঠিক আছে। চিন্তা করো না একদম।’
সিহাবও খুশি হলো। আমি নিজেকে শান্ত করে বললাম, ‘একটা কথা বলবো?’
দুজনেই আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘আমি আজ তোমার সাথে থাকতে পারবো না তিন্নি। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ। আমার বোন ওখানে বিপদে আছে। আমি না গেলে ওর জীবনটা একদম ন’ষ্ট হয়ে যাবে।’
তিন্নি আর সোহান ভাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকায়। সোহান ভাই বলে, ‘কি হয়ছে আপু?’
আমি সবটা ক্লিয়ার করে বললাম। সোহান ভাই বললেন, ‘এগুলো আগে বলেননি কেনো? আপনার তো এখন ওখানে যাওয়া বেশি জরুরি। জলদি যান। আর আমাদের বিপদে এভাবে পাশে থাকার জন্য আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে।’
তিন্নিও বললো চলে যেতে। আমি ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সিহাবের হাত ধরে ছুটলাম। কোনো রকম সিএনজি নিয়ে আগে বাড়ি আসলাম। হেনা আপাকে কল করে বলে দিলাম যেনো ম্যানেজারকে একটু সামলে নেয়। হেনা আপা আমাকে আস্বস্ত করলেন। সিহাবকে রেডি করে আমি নিজেও রেডি হয়ে নিলাম৷ সিহাব কোনো কথা ছাড়াই রেডি হয়ে গেলো। একটা প্রশ্নও করলো না। ব্যাগ নিয়ে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। টিকিট কেটে বাসের অপেক্ষায় বসলাম। বেশিক্ষণ সময় নিলো না বাস আসতে।
______
আর কখনো এ গ্রামে পা রাখবো না বলেও আজ আবার আসতেই হলো। মাহমুদার বিয়ে কাল। তবে মাহমুদা কান্নাকাটি করে আরো অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। মাহিদ পরীক্ষা শেষ করেই ছুটে গেছে বাড়িতে। আমাদের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সিহাবের হাত ধরেই বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। মাহিদ, মাইশা আর মাহমুদা একসাথে বসে আছে। আব্বা-মা এখনো চিল্লাচ্ছে। আশে পাশের লোকজন মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখে যাচ্ছে। সম্ভবত মাহিদের রাগের জন্যই লোকজন এসে বাড়িতে দাঁড়াতে পারতেছে না। কোনো রকমে বাড়িতে পা রাখতেই মাহমুদা বুবু বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে উঠে। আমি আগলে নিলাম মাহমুদাকে। মাহিদ এগিয়ে এসে সিহাবের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। আব্বা-মা আমাকে দেখেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আমি মাহমুদাকে শান্ত করতে করতে বললাম,
‘কাঁদিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলে আসছি না!’
মাহমুদা তবুও কান্না থামালো না। মেয়েটা সারাদিন কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আমার বলা কথা শুনেই মা তেতে উঠে বললেন,
‘তুই কেন আইছোস? এখন কি এই পো’ড়ামুখ নিয়া আমার মাইয়ার বিয়ে ভাঙবি!’
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। মায়ের কথা শুনে মাহমুদা কান্না থামিয়ে চোখ তুলে তাকায় আমার দিকে। আমি মাহমুদাকে সরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললাম,
‘হ্যাঁ। আমি আসছি ওর বিয়ে ভাঙতে। কি করবেন আপনারা? আমার জীবনটা যেভাবে নিজ হাতে ন’ষ্ট করে দিয়েছেন সেভাবেই ওর জীবনটাও ন’ষ্ট করবেন! নিজেরটা মেনে নিয়েছি বলে ওদেরটা মানবো এটা ভুল করেও ভাববেন না।’
আব্বা হাত তুললেন থা’প্প’ড় মা’রতে। মাহিদ হুংকার দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আব্বা খবরদার বুবুর গায়ে হাত তুলবেন না। আপনারা আমাদের জন্ম দিয়েছেন বলেই এখনো সম্মান করতেছি। বুবু ভুলটা কি বলছে? আপনারা এই বড়লোক ছেলের কাছে যৌ’তুক না দিয়ে বুবুর বিয়ে দিয়েছিলেন বলেই কিন্তু আজ আমার বুবুর এই অবস্থা। সে দোষ আপনারা মানেন নি আমরাও কিছু বলিনি কিন্তু মাহমুদার জীবন আমরা এভাবে ন’ষ্ট করতে দিবো না৷’
মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোর জন্য আইজ আমার পোলাডাও পর হইয়া গেছে। আর কত খাবি আমাগো জীবন! না ম’ইরা বাঁইচা আছোস কিন্তু আমাগো মা’রার জন্য উইঠা পইড়া লাগছোস।’
মায়ের কথায় তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। প্রায় ৫ মাস আমি তাদের সাথে থাকি না। অবশ্য গত সাড়ে ৪ বছরই ছিলাম না। তাদের ওপর তো বোঝা হয়ে নেই তবুও আমার প্রতি ক্ষোভ তাদের এখনো আছে। এমন পরিবারও বুঝি হয়! চোখ ফেটে কান্নারা আসতে চাইলে নিজেকে সামলে নিলাম। কয়েকবার ঢোক গিলে কন্ঠ তীক্ষ্ণ করে বললাম,
‘মাহমুদা এখন বিয়ে করতে চায় না। আপনারা ওকে জোড় করে বিয়ে দিবেন কিভাবে?’
‘আমাগো মাইয়া আমরা কি করমু বুইঝা নিমু। তুই বিদায় হ।’
‘আমি থাকতে আসিনি। মাহমুদার বয়স ১৮ হয়নি। আইন অনুযায়ী ওর এখন বিয়ে হলে সেইটা বাল্যবিবাহ হবে। আর মাহমুদা যদি সবার সামনে বিয়ে করতে অস্বীকার করে তখন কিন্তু আপনাদেরকে জে’লে যেতেই হবে।’
আব্বা মায়া ভরা কন্ঠে বললেন, ‘মাহমুদা মা তুই কি আমাগো সাথে এইডা করতে পারবি মা? আমরা কি তোর খারাপ চাই মা? মায়ার শ্বশুরবাড়ি ওইরকম হয়ছে বইলা যে তোরও হইবো তার তো কোনো মানে নাই।’
আমি তাকালাম মাহমুদার দিকে। আব্বার এমন মায়া ভরা কন্ঠের জন্যই একদিন আমি কিছু করতে পারিনি আর আজ যদি এই মিথ্যা মায়ায় পড়ে আমার বোনটাও ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ওরও একই দশা হবে। যৌ’তুক এখন এই সমাজের জন্য কত বড় ঘটনা তা আমি বুঝে গেছি হাড়ে হাড়ে। বিশেষ করে এটা বুঝে গেছি দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বড়লোক বাড়ির বউ হতে নেই। তাছাড়া আমি চাই আমার বোন পড়ালেখা করুক। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। মাহমুদা অসহায়ের মতো তাকায় আমার দিকে। বুকের মধ্যে কেমন ছ্যাত করে ওঠে। মাথা নাড়িয়ে বার বার ‘না’ করতে থাকলাম। মাহমুদা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। নিজেকে সামলে বলে,
‘বুবুর মতো যে হবে না তার কি গ্যারান্টি আব্বা? আমারও যে বুবুর মতো দিনের পর দিন অ’ত্যা’চার সহ্য করতে হবে না তার গ্যারান্টি কি! আমারও যে এমন ডিভোর্সী ট্যাগ নিয়ে বাঁচতে হবে না তার গ্যারান্টি কি! আমি চাই না আমার বুবুর মতো কষ্ট পেতে। আমি চাই না এই সমাজের সাথে লড়াই করে বাঁচতে। আমি তো বুবুর মতো এতো শক্ত মনের মানুষ নই। আমি চাই পড়ালেখা করে নিজে কিছু করতে। বুবু আমাকে তুমি বাঁচাও বুবু। আমি চাই না তোমার মতো প্রতি মুহুর্তে ম’রে ম’রে বাঁচতে। তুমি আমাকে বাঁচাও বুবু।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#শেষ_প্রান্তের_মায়া
#বোনাস_পার্ট
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে৷ মাহমুদার কথায় সবাই চুপ করে গেছে। মাহমুদা আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সিহাব এতো চেঁচামেচিতে একদম মাহিদের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। মাইশা চুপচাপ বারান্দার খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা গম্ভীর গলায় বললেন,
‘তুই এই বিয়া করবি না?’
মাহমুদা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘নাহ আব্বা। আমি পড়তে চাই। বিয়ে করতে চাই না।’
আব্বা হুং’কার ছেড়ে বললেন, ‘তোরে ঘাড়ের ওপর বসাইয়াা খাওয়াইবে কেডা? আবার পড়া! পড়াশোনা না করলে কি হইবো? মায়া নিজের কপালের দোষে নিজের এই দশা করছে। তোর বিয়া কালই হইবো আর ওইখানেই হইবো। আমরা যহন কথাা দিছি তহন কথা রাখমুই। গরীব বইলা কি মানসম্মান নাই নাকি! আমাগো জবানের দাম আছে।’
সবাই চুপচাপ আব্বার মুখের দিকে তাকালাম। মাহিদ রাগী গলায় বললো, ‘আপনার মানসম্মান ধুয়ে আপনি পানি খান। আমার বোনের জীবন আমি ন’ষ্ট হইতে দিবো না মানে না৷ আপনিও কেমনে বিয়ে দেন আমি দেইখা নিমু।’
মা ধমক দিলেন মাহিদকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘বড়টার লগে থাইকা থাইকা আব্বার মুখে মুখে তর্ক করা শিখছোস তাই না! এই মাইয়া তুই আসলেই একটা অ’পয়া। তোর মতো মাইয়া পেটে ধইরাই আজ আমাগো এতো সর্ব’নাশ।’
আমি জবাব দিলাম না। শুধু চেয়ে রইলাম আব্বা-মায়ের দিকে। তাদের কথার বিপরীতে আমি কথা খুঁজে পাই না। এই দুইটা মানুষকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি তা বোধহয় কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো যাবে না। মুখে যতই বলি উনাদের প্রতি ঘৃ’ণা থাকবে তবুও তাদেরকে ঘৃ’ণা করতে আমার কষ্ট হয়। হাজার হলেও তারা জন্ম দিয়েছে। এখন বাজে কথা বললেও একসময় আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে। নিজেকে সামলে নিলাম। মাহমুদা মা-কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তুমি বুবুরে কেন এসব বলতেছো মা! বুবু তো কিছু করেনি। তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য ভাইকে হারাইছো। আর তোমরা তোমাদের সন্তানের কথা না ভেবে আগে নিজেদের সম্মানের কথা ভাবতেছো! আচ্ছা তোমরা কি আসলেই বাবা-মা নাকি পাথর! আর বুবুর কথায় না আমি এমনিই করবো না এই বিয়ে। আব্বার যদি মানসম্মান নিয়ে এতো চিন্তা থাকে তাহলে আমার নিজেরও নিজেকে নিয়ে চিন্তা আছে৷ তোমাদের মতো নি’ষ্ঠুর মানুষ আমি এজীবনে দেখিনি!’
মাহমুদা কথা শেষ করার সাথে সাথে মা এসে সটান করে একটা থা’প্প’ড় বসিয়েছে তার গালে। মাহমুদা শব্দ করে কাঁদতে থাকে। মাহিদ রাগে ফেটে পড়েছে। সিহাবের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। আমি মাহমুদাকে নিজের দিকে টেনে আনলাম৷ কাঠকাঠ গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘আপনি ওকে থা’প্পড় মা’রলেন কেন?’
মা খ্যাক করে উঠলেন। রাগী গলায় বললেন, ‘আমার মাইয়ারে আমি থা’প্প’ড় মা’রমু নাকি কি করমু তা আমার ব্যাপার। তুই কওনের কেডা? খুব তো কইয়া গেছিলি আর কখনো আমাগো মুখ দেখাবি না এহন আয়ছোস কেন?’
আমি তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বললাম, ‘এই কথাগুলো যেনো কখনো মাহমুদার শুনতে না হয় তাই এসেছি৷’
মাহমুদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুই বিয়ে করতে চাস নাকি আমার সাথে যেতে চাস?’
মাহমুদা কিছু বলার আগেই আব্বা হুং’কার ছেড়ে বললেন, ‘আমার মাইয়া কোথাও যাইবো না৷ তুই বাইর হ বাড়ি থেইকা। আমার পোলাডা রে তো ছিন্না নিয়া গেছোস এহন আমার মাইয়ার দিকেও তোর নজর পড়ছে!’
মাহিদ কড়া গলায় বলে, ‘বুবু কেড়ে নেয়নি আপনারা নিজেদের দোষে আমাকে হারিয়েছেন আর আজ মাহমুদাকেও হারাবেন!’
আব্বা- মা রেগে আমাকে কথা শোনাতে থাকলেন৷ মাহমুদা চেঁচিয়ে বললো, ‘আপনারা একটু চুপ করবেন? আপনারা বাবা-মা নাকি পাথর! নিজের সন্তানকে কেউ এভাবে বলতে পারে! আজ বুবুর এই অবস্থা শুধুমাত্র আপনাদের জন্য। আপনারা মানুষ না। আমি স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি এই বিয়ে আমি করবো না মানে করবো না। যারা নিজের মানসম্মানের কথা ভেবে সন্তানকে ছোট করে, আ’ঘাত দেয় অন্তত সেই বাবা-মায়ের মানসম্মানের চিন্তা আমি করবো না। বুবু আপনাদের কথা মাথায় রেখে যে বোকামি করেছে! যার জন্য আজ তার এই অবস্থা ঠিক সেই একই বোকামি আমি কখনই করবো না৷ আমি বুবুর মতো কষ্ট পাবো না। আর বুবুও আমাকে কষ্ট পেতে দেবে না। বুবু আমাকে তুমি নিয়ে যাবে না?’
আমি রোবটের মতো মাথা নাড়ালাম। আব্বা-মা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন৷ আমি মাহমুদার হাত ধরতেই মাইশা ছুটে আসে। আমাকে জাপ্টে ধরে বলে, ‘আমাকেও নিয়ে যাও বুবু।’
আমি কি বলবো বুঝলাম না। মাইশা কেবল ৬ এ পড়ে। মাহমুদা এ বছর এসএসসি দিয়েছে। আমি মাইশার সামনে হাটু মুড়িয়ে বসলাম। ওকে আগলে নিয়ে বললাম,
‘তোমাকেও নিয়ে যাবো সোনা তবে এখন না।’
মাইশা জিদ করতে থাকে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য। কি করবো ভেবে পেলাম না। মাইশা যাবে মানে যাবেই। মাহিদ আস্তে করে বলে,
‘ওকেও নিয়ে যাবে বুবু!’
মা মুখে আঁচল চেপে কান্না শুরু করে দিলেন। কয়েকটা অ’কথ্য ভাষায় গা’লি দিয়ে বললেন,
‘আমার সব গুলা পোলা মাইয়ারে কাইড়া নিলি! আমাগো একলা ফালাইয়া মা’রবি তুই।’
আমি কাঠকাঠ গলায় বললাম, ‘আপনারা নিজেরা দায়ী নিজেদের এই একাকীত্বের জন্য। আমি তো মাহমুদা বা মাইশাকে কেড়ে নিতে আসিনি। আপনারা নিজেদের দোষে ওদের হারিয়ে ফেললেন।’
মাহমুদা বলে, ‘একবার নিজেদের ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর চিন্তা না করে যদি ভাবতেন আমাদের কথা! তাহলে বোধহয় আজ আর একা হতেন না। আর বুবু! এমন পা’ষাণ আব্বা-মায়ের কাছে মাইশারে রাখার চেয়ে নিয়ে যাওয়াটাই ভালো৷ কে বলতে পারে নিজেদের ওপর থেকে বোঝা কমানোর জন্য যদি এতটুকু বয়সে ওকেও বিয়ে দিয়ে দেয়!’
আব্বা-মা কেমন যেনো দৃষ্টিতে তাকালেন। আমাার কষ্ট হলো ভীষণ কিন্তু তা প্রকাশ করলাম না। কি করবো আর না করবো তা ভাবতে গিয়ে দোটানায় পড়ে গেলাম। মাইশাকে নিয়ে যাওয়া উচিত কি না ভেবে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যেই আব্বা করে বসে এক ভ’য়ং’কর কাজ। রাগের চোটে নিচে পড়ে থাকা ইটের টুকরো নিয়ে ছুড়ে মা’রে আমার দিকে। ঘটনাটা এতো দ্রুত হয়ে গেছে যে কেউ কিছু বুঝে উঠতেই পারেনি। অদ্ভুত ভাবে ইটের টুকরোটা এসে মাথায় লেগে সাথে সাথে রক্তের ফোয়ারা বয়ে গেলো। মাহমুদা, মাইশা, মাহিদ, সিহাব সবাই ছুটে এসে ধরে। ব্যাথায় ততক্ষণে আমার চোখ মুখ নীল হয়ে গেছে। মাহিদ পাগলের মতো আমার মাথার রক্ত চেপে ধরে হাউমাউ করে কাদতে শুরু করে। মুহুর্তেই কি মনে করে ছুটে যায় আব্বার কাছে। আঙুল উচিয়ে বলে,
‘আপনি যদি খালি আমাদের জন্মদাতা না হইতেন তাইলে এখনই পু’তে ফেলতাম আপনারে। আমার বুবুর যদি কিছু হয় তাইলে আমি আপনারে জে’লের ভাত খাওয়ামুই। মাথায় রাইখেন!’
আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। মাথায় কি প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। অথচ এই ব্যাথার থেকেও বেশি ব্যাথা পেয়েছি একদম হৃদয়ে। কতটা ক্ষ’ত হয়েছে তা যদি দেখানো যেতো তবে বুঝি শান্তি পেতাম। এক দৃষ্টিতে তাকালাম আব্বা-মায়ের দিকে। তারা একটু এগিয়েও আসে না। মাহিদ ছুটে গেলো কোথায় যেনো! মাহমুদা ওড়না দিয়ে মাথার রক্ত আটকানোর চেষ্টা করছে অনবরত। মাইশা আর সিহাব হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি শুধু সিহাবের দিকে তাকালাম। ছেলেটা আমার রক্তের কেউ না অথচ আমার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে অথচ যারা আমাকে জন্ম দিয়েছে তারা এক পাও এগিয়ে আসলো না৷ আচ্ছা সত্যি কি এরা আমাকে জন্ম দিয়েছে! ব্যাথায় ক্রমশ নিজের ভারসাম্য হারাতে থাকলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো কেউ শুষে নিচ্ছে। চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। হাত বাড়িয়ে সিহাবকে আঁকড়ে ধরলাম। সিহাব আরো জোড়ে জোড়ে কান্না শুরু করলো। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকলো। ক্রমশ বাড়তে থাকলো কষ্ট। আজ আমি আবারও র’ক্তাক্ত হলাম তবে তা নিজের প্রিয় বাবার থেকে। সেই প্রিয় বাবাকে তো কবেই হারিয়ে ফেলেছি তবে আজ ২য় বারের মতো আবার হারালাম। গলা ফাটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে ভেসে আসলো ছোট বেলার স্মৃতি। বাবার হাত ধরে পুরো গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। ছোট ছোট পায়ে তার সাথে দৌড়ানোর স্মৃতি। বাবার কাঁধে উঠে বেড়ানোর স্মৃতি। খাবো না বলে জিদ করে যখন ছুটতাম তখন ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ানোর স্মৃতি। রাতের পর রাত বাবার কোলে ঘামটি মে’রে গান শুনে ঘুমানোর স্মৃতি। সাথে ভেসে আসলো আরো তিক্ত স্মৃতি। গত ৪ বছরের একেকবিন্দু রক্তের স্মৃতি। বাবা-মা পাশে না থাকার স্মৃতি। আমি নিজেকে আজ আরো একবার হারালাম। আরো একবার হেরে গেলো মায়া। শেষ প্রান্তের মায়া বুঝি মুক্তি পাবে এবার! এই হারজিত লড়াইয়ের থেকে বুঝি একেবারে হেরে যাওয়া হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে নেওয়ার সাথে সাথেই গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা অশ্রু।
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)