শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-০৬ এবং বোনাস পর্ব

0
243

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৬

স্মরণের কথার হেরফের করতে বেশ তর্ক বিতর্ক শুরু হলো বাড়ির মাঝে। বাবা এক পর্যায়ে বলে বসলেন

— গেলে তুমি যাও স্মরণ। আমি বউমা আানার আগে মেয়ে এনেছি। তাই আমার মেয়ে আমার বাড়িতেই থাকবে। আর হ্যা, আমার নাতনি কেও রেখে যেও।

ব্যাস, এই কথাতেই সব তেজ থমকে দিতে বাধ্য হলো স্মরণ। অবশেষে সে রাগ ক্ষোভ নিয়ে দেখলাম বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে সে আমার সাথে একবার ভয়াবহ সাক্ষাৎ করে গেলো। আচমকা আমার হাত টেনে উল্কার বেগে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে বলল

— বাবার জন্য কিচ্ছু হচ্ছে না। আপনি একটা বোঝা আমার কাছে। একটা কথা ভালো করে শুনে নিন। নেক্সট টাইম আমাকে কখনো ফলো করার চেষ্টা করবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।

আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার কথাগুলো হজম করলাম। মনে মনে খুব করে জানতে চাইলাম

” আমাকে নিয়ে আপনার কি এতো সমস্যা? আমি কি আপনার কাছে ভালোবাসা চাইতে গেছি? আপনার ধার ধারে পরে থেকেছি? স্ত্রীর অধিকার চেয়েছি? তবুও?”

— আমার অথৈ এর জায়গা নেওয়ার সহসটা কখনো করবেন না।

দু কদম এগিয়ে গিয়েও আবার হঠাৎ পিছু ফিরে সে একথা বলল খুব গভীর করে। তারপর আবারও তেজ নিয়ে গটগট করে হেটে গেলো। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। সে কি তবে আমাকে একটু হলেও মেনে নিলো? ভাবতেই বুকের মাঝে ঢিপঢিপ ছন্দ উঠলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো তার এই কথা। আমি চোখদ্বয় চরক গাছ করে দাড়িয়ে রইলাম। একদল একপাক্ষিক ভালোবাসায় ডুবন্ত মানুষদের মতো করে বলে উঠলাম

” তুমি প্রিয় নাই বা আমাকে ভালোবেসো। শুধু আমাকে দূরে ঠেলে নাহি দিও।”

স্মরণ প্রস্থান পথ ধরায় আমার কথা শুনতে পেলো না। তবে আমি ঠিকই শুনতে পেলাম আমার মনের কথা। কেউ যেন বলে যাচ্ছে

” না প্রথম দেখাতে ভালোবাসিনি আমি তবে ধীরে ধীরে জাগলো এ অনুভূতি। আমি সারাদিন ভেবে, এই ভেবে যায় আমার রাত পেরিয়ে। ”

.
শেষ বিকেলের আলোটা নিভে চারিদিকে অন্ধকার নামলো। ছোয়াকে আজ পড়াতে বসালাম আমি৷ বাবার রুমে এরমাঝে একবার উঁকি দিয়ে এসেছি। দেখে বুঝলাম তার মন মেজাজ ততটা ভালো নেই। বিধায় আমি ওষুধ খাওয়ার বিষয়টা ছাড়া বাকি কোনো প্রসঙ্গ টেনে কথা বলিনি। ছোঁয়ার পড়া শেষ হতেই ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিলাম। কিছু সময় টিভির পর্দায় চোখ রাখলো মেয়েটা। অতঃপর টিভি দেখা কালেই ঘুমিয়ে পরলো আমার কোলে। ওকে একহাতে শক্ত করে ধরে নিয়ে আমি সোফায় ঠেস দিয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলাম। এক সময় যেনো আমার চোখও নিভু নিভু হয়ে এলো। কখন যে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলাম তা আমার অজানা।

ঘুম ভাভলো আমার কোলটা কেউ ফাঁকা করার তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এমন অনুভব করে। ঈষৎ চমকে চোখ জোরা ঘুম ছাড়িয়ে টেনে তোলার চেষ্টায় মরিয়া হলাম। একটু চোখ খুলতেই অক্ষিপটে ভেসে উঠলো কারো অতি সুদর্শন মুখ। কাপালে কিঞ্চিৎ বিরক্তির ভাজ। চোখ জোরা তীক্ষ্ণ করে রাখা। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ঘুমের মাঝে নিঃশ্বাসটা নিলেও এখন নেওয়া যেন একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের পলক ফেলতেও অস্বস্তিতে জমে যাচ্ছি। স্মরণ ছোঁয়াকে আলগোছে আমার কোল থেকে তুলে নেওয়ার জন্য বেশ যুদ্ধে নেমে গেছে। কিন্তু ঠিক জয়ী হতে পারছে না ছোঁয়া আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখায়। আমি শুধু এভাবেই নড়চড় হীন দেখে গেলাম প্রায় মিনিট দশেক। অতঃপর আস্তে করে বুকের ধুকপুক লুকিয়ে রেখে তাকে বললাম

— আজকে থাক আমার কাছে।

আমার কন্ঠ পেয়ে স্মরণ তড়িৎ গতিতে উঠে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলো। বেশ খানিকটা বিব্রত ভাব তার চেহারায় জমে গেলেও তা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো

— না। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

— ঘুমানোর আগে বলেছিল ‘আন্টি আমি তোমার সাথে থাকবো’।

মনে অসীম সাহস নিয়ে একথা তাকে শুনিয়ে দিতেই সে ক্ষুদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো আমার দিকে। আমিও নিষ্পাপ দৃষ্টি তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বসে আছি। সে ক্ষণকাল আমিসহ ছোঁয়াকে পরখ করলো। অতঃপর আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো আমার সম্মুখ হতে। আমি তার রাগের মাত্রা পরিমাপ করে ছোঁয়াকে কোলে নিয়ে আমার ঘরের দিকে রওনা হলাম। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাথা চাপিয়ে আমিও শুয়ে পরলাম ওর পাশে।

.
খুব মিষ্টি একটা সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে ছোঁয়ার মায়া ভরা মিষ্টি মুখ দেখে মনটা যেন আরো ভালো হয়ে গেলো। মাত্রই যখন সাংসারিক ব্যস্ততার কথা মাথায় এলো তখন ক্যালেন্ডার বলে দিলো আজ শুক্রবার। মনে অন্যরকম অজানা আনন্দ ধরা দিলো। ঘরে প্রকৃতির আলোকচ্ছটা চিরচেনা দিনের সুর তুলল। বুকের মাঝে আনচান ভাব। এমন দিনে আগে প্রায়ই নানিমার কাছে ছুটে যেতাম। চাচি আম্মার বকাবকির কোনো সীমান্ত ছিলো না। সুযোগ ভীষণ কমই ছিলো। কিন্তু এই সুযোগ প্রসারিত করে দিতো ওয়ারেসিয়া। আমার চাচাতো বোন৷ টুকিটাকি কেনা কেটা বা তার বস্তাভর্তি শপিংয়ের অজুহাতে আমাকে নিয়ে যেতো নানি মার কাছে। আর সে বন্ধুদের সাথে শপিং করতো। যদিও কষ্টে পার করেছি জীবন। তেরো বছর বয়স থেকে প্রথমে মামার বাড়ি তারপর চাচার বাড়িতে বেড়ে ওঠা। আজ ভীষণ মনে পরছে তাদের। একটাবারও কেউ খোঁজ নিচ্ছে না আমার? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তাদের। কিন্তু কিভাবে যাই? মনে বিষন্নতা ভর করলো। ধীরে গতিতে বিছানার থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। জয়নব খালা হয়তো এসে গেছে এতক্ষণে।

.
রান্না অর্ধেকের বেশি খালাই করে নিয়েছিল। আমি শুধু পরিবেশনের কাজটা সম্পন্ন করলাম। খারাপ টেবিলে একে একে সব রাখতেই স্মরণের আগমন ঘটলো। সে ভীষণ ব্যাস্ততা নিয়ে পরিপাটি ড্রেসে চেয়ারে বসেই হুকুম দিলো

— খালা আমার নাস্তাটা তাড়াতাড়ি দিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দূর্ভাগ্যবশত খালা তখন রান্নঘরেও ছিল না। সে গেছে বাড়ির দারোয়ানের কাছে ছোট খাটো একটা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিতে।

— খালা নেই। নিচে গেছে।

মিনমিন করে তাকে বললাম। সে আমার কথায় একপলক আমাকে দেখে নিলো। তারপর ছোঁয়ার কথা জানতে চেয়ে বলল

— ছোঁয়া ঘুম থেকে ওঠেনি?

— না।

সে যেন চমকে উঠলো। হঠাৎই তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল

— নয়টা বাজবে এখন। ওর আবার জ্বর হয়নি তো?

হঠাৎ এমন দুশ্চিন্তা ভাবমূর্তি স্মরণের মাঝে দেখে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। অবুঝের মতো বললাম

— ঘুম থেকে দেরিতে উঠলে জ্বর আসে?

সে আমার প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব না দিয়ে শুধু একটা রাগপূর্ণ দৃষ্টি উপহার দিয়ে ছুটলো আমার ঘরের দিকে। আমিও তার পিছু নিলাম। উল্কার বেগে ছুটে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত রেখেই গভীর মনোযোগ দিয়ে অনুভব করতে লাগলো শরীরের তাপমাত্রা। এরই মাঝে ছোঁয়া চোখের পাতা অল্প একটু উন্মুক্ত করে ডেকে উঠলো

— বাবা?

— হ্যা মা। তোমার কি খারাপ লাগছে?

— হু।

স্মরণ কোলে তুলে নিলো ছোঁয়াকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল

— এভাবে বুঝি একজন মা হয়ে উঠতে চান আপনি? সারা রাত পাশে থেকেও বোঝেননি মেয়েটার জ্বর এসেছে। এতোটাই যখন অনীহা তখন কাল কেন নিজের কাছে নিয়ে এলেন? আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাইনি?

— আমি তো আসলে….

— আসলে বোঝাই লাগবে আপনার কাছে। এমনই হওয়ার কথা। কোন মেয়ে চাইবে একটা বাচ্চাওয়ালা সংসারে আসতে? এখনো সময় আছে চলে যেতে পারেন। আমি আটকে রাখিনি। আমি তো চাই-ই না আপনাকে।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলো স্মরণ। আমি এবার মৌনতা কে ঠাঁই দিয়ে নিঃশব্দে দারিয়ে রইলাম। সে কিছুটা সময় নিয়ে আমকে পরখ করেই চলে গেলো ঘর থেকে। তার কথাগুলো আমাকে আহত করে দিলো। আমি সত্যিই ভাবিনি ছোঁয়া অসুস্থ হতে পারে। পুরোটা রাত আমাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে ছিলো। কিন্তু ওর শরীরের তাপমাত্রা সহনীয় ছিল। অস্বাভাবিক কিছু আমি বুঝিনি। ভাবনার মাঝে রুম থেকে বেরিয়ে স্মরণের রুমের দিকে রওনা হলাম।

চলবে…

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#বোনাস_পার্ট
#আলিশা

স্মরণের রুমের দরজার এপাশে দাড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবার হৃদয়ে মেয়ের জন্য উপচে পড়া ভালোবাসা। চিন্তিত মুখের অভিপ্রায়। ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা পরম মমতা নিয়ে। ছোঁয়া আধবোজা চোখ নিয়ে বিছানার মধ্যে পরে আছে। নিমিষেই স্মরণ একটা কাচের বাটিতে পানি সহ রুমাল নিয়ে হাজির। দেখতে দেখতে সে রুমাল ভিজিয়ে কপালের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে থার্মোমিটার খুঁজে আনলো। টেবিলের ড্রয়ার হতে বের করলো বিস্কুট, চিপ্স, ব্রেড। ছোঁয়ার মুখের নিকট একেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে আর সেধে যাচ্ছে। কিন্তু ছোঁয়া এসবের কিছু খেতে বড্ড নারাজ। হঠাৎ যেন আমি তার চোখে পরলাম। সে অদূর হতেই ডেকে বলল

— আন্টি, আমি বিরিয়ানি খাবো।

মায়ার একটা আস্ত স্তুপ যেন ছোট মেয়েটার কথার দরূণ আমার বুকে চেপে বসলো। স্মরণ ঝট করে পেছন ফিরে আমাকে দেখতেই বলল

— আমি অর্ডার করছি।

আমি ধীর পায়ে হেটে গিয়ে ছোঁয়ার কপালে আলতো করে হাত রেখে বললাম

— আপনি এমন কেন? দেখছেন তো মেয়ে অসুস্থ। তারপরও এমন খিটখিট করেন কেন? আপনিও বুঝি এভাবেই বেস্ট বাবা হয়ে উঠতে চান? যে বাবা মেয়ের ভালো বোঝে না। যে বাবা মেয়ের মাতুল্য কোল চেনে না। এটা রুমাল ভেজানো হয়েছে? চুল ভিজে মাথায় পানি গিয়ে ঠান্ডা লাগবে আরো।

স্মরণ যেন বিস্মিত হলো আমার কথায়। এই বিষ্ময় ভাব কেটে উঠতে তার সময় লাগলো আনুমানিক তিনটে মিনিট। অতঃপর কড়া গলায় বলে উঠলো

— হোয়াট রাবিশ! আপনি আমাকে আমার মেয়ের ভালো মন্দ শেখাচ্ছেন?

— হয়তোবা। শিখে রাখুন। আপনি তো কথায় কথায় আমাকে হুমকি দেন এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার। জোর করে তো কারো ঘাড়ে চেপে বসা যায় না।

স্মরণ প্রত্যুত্তর করলো না। আমি ছোঁয়াকে ছেড়ে স্মরণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে চাইলাম তার অভিপ্রায়। সে যেন শূন্য, ঘোলাটে, পুরোটাই ধোঁয়াসায় মুড়িয়ে রেখেছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে এক পা ফেলতেই হঠাৎ টান পরলো আমার হাতে। শুনতে পেলাম ছোঁয়ার কন্ঠ

— আন্টি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

বুকের মাঝে কষ্ট হলো এমন মিষ্টি ডাক শুনে।

— না তো মা। মেয়েকে ছেড়ে মা কি দূরে যেতে পারে কখনো?

— তুমি এখন এত্তগুলা ভালো হয়ে গেছো। আমি এখন তোমাকে মা বলেই ডাকবো। অথৈ মা আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। তুমি আমাকে ফাঁকি দেবে না তো?

পাকা পাকা কথাগুলো আমার চোখে জল আনতে বাধ্য করলো। আমি জড়িয়ে যাওয়া গলা নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। ওর যে মা নেই। ওর থেকে বহু দূরে চলে গেছে তা এতো ছোট মস্তিষ্কে না ঢুকলেও পারতো। ছোট কলিজা নিশ্চয়ই ছটফট করে।

— বাবা আম্মুর কথা মনে পরছে৷

হঠাৎই ছোঁয়া একথা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। স্মরণ দিশেহারা হয়ে কোলে তুলে নিলো। সেও যেন অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। মেয়েকে দু’টো কথায় বুঝ দিতে গিয়ে হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। খেয়াল করে দেখলাম তার চোখ বন্ধ। কান্নারত ছোঁয়াকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। চোখের কর্ণিশ বেয়ে উঁকি দিচ্ছে একটু আধটু জল। মুহূর্তেই ঘর ছেড়ে গেলো বিষাদে। স্মরণ হঠাৎ ছোঁয়া কে ছাড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আগলে নিলাম ছোট মেয়েটাকে। স্মরণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম নির্নিমেষ। মনে পরে গেলো অনেক আগের কথাগুলো। এই মানুষটাই ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা! অবাক হবার বিষয় না? আমি বড্ড অবাক হয়েছি দু’দিন আগে। যেদিন সে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে বিদেশে ছুটলো। সেদিন রাতে। ঐ তো ছোঁয়ার সাথে আমার ভারি ভাব হলো। তাকে নিয়ে এই রুমের বেলকনিতে বসে ছিলাম। একটু আধটু কৌতুহল ছিলো এই মানুষটাকে নিয়ে। সেই থেকে সকলের অগোচরে সেদিন খুঁজে ছিলাম কিছু। যদি কিছু নোটবুক মেলে? মনে দুই আনার আশা নিয়ে খামোখা এই ঘরটা দেখতে গিয়ে হাতে পেয়েছিলাম একটা অ্যালবাম। যে এলবামে দেখেছি তেরো বছর বয়সে দেখে আসা মুখটা। এলোমেলো এক গুচ্ছ সিল্ক চুলের অধিকারী ছেলেটাকে। যার কিনা একটা অবাধ্য, জোর করে বসে যাওয়া সৌন্দর্য আছে। একটা গেজ দাঁত। এই দাঁতের হাসিটা দেখার জন্য আমি প্রত্যহ বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের খেলার মাঠে গিয়ে বসে থাকতাম। ছোট থেকেই ভীষণ শান্ত প্রকৃতির আমি একদিন এলাহি কান্ড বাধিয়ে ঝগড়াও করেছিলাম একটা মেয়ের সাথে। কেন সে আমার ভালো লাগার মানুষটার দিকে তাকাবে এই নিয়ে। হাজারো স্বপ্ন বুনে বুনে মনের মাঝে রেখে দিতাম। এই মানুষটার নামে খোলা আকাশে চিঠি পাঠাতাম। কিন্তু সে আমাকে কখনো চেনেনি। কখনো জানেনি তার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো আমার কিশোরী মন। তবে আমার সব অনুভূতি মরমর হলো একদিন। যেদিন দেখেছিলাম আমার স্বপ্নে, শয়নে, জল্পনা-কল্পনায় অবিরাম বসবাস করা মানুষটা অন্য মেয়ের রাজা। রাজা রাণীর গভীর ভালোবাসা। একে অপরের প্রতি পুকুর ঘাট আর দুবলা ঘাসের মতো আসক্ত। দিনের শুরু হয় ঝগড়ায় আর দিনশেষে শেষ বিকেলে তাদের দেখা যায় হাতে হাত রেখে নদীর তীরে বালুচরে হাঁটতে। আমার কিশোরী মন ভেঙে গুড়িয়ে যেতো তাদের এই মিষ্টি দৃশ্য দেখে। প্রথমে সৌভাগ্য ভেবে বসেছিলাম। অতঃপর দেখি আমার দূর্ভাগ্য যে আমি তাদের সাথে একই কলেজে পড়ি। প্রতিষ্ঠানটা ছিলো স্কুল এন্ড কলেজ। তারা দু’জনে কলেজে আর আমি স্কুল হলগুলোর একটাতে। একদিন আমার সাথে খুব হৃদয়বিদারক এক ঘটনা ঘটলো। স্মরণ রাজার রাণী আমাকে হুট করে একদিন রাস্তার মাঝে ডেকে বলল

” তুমি ভারি মিষ্টি। তোমার নাম কি মেয়ে? ”

আমি গোমড়া মুখে বলেছিলাম

” খেয়া জান্নাত। ”

” ওয়াও! নাইস নেম।”

” তুমি কিসে পড়?”

” ক্লাস নাইন।”

” আমি ইন্টার ফ্রাস্ট ইয়ার। তোমার বড় আপু।”

আমি মনে মনে ভেংচি কেটে বলেছিলাম

” বড় আপু না। আমার সতিন তুমি। আমার মনের মানুষ তুমি নিয়ে নিয়েছো।”

” ঐ যে দেখছো, কালো শার্ট পরা সুন্দর ছেলেটা ওকে একটু ডেকে দেবে?”

আমি আপত্তি করতে চেয়েও পারিনি। সেদিন ডেকে দেই স্মরণকে। আর বারবার মেয়েটাকে মনে মনে বলেই যাই,
” তুমি আমার সতিন। তোমাকে এত্তগুলো ঘৃণা।!”

বুঝিনি ওটুকু বয়সে দিয়ে আসা গালিটা এভাবে সত্যি হবে। এভাবে আদোতেই তার সতিন হয়ে যাবো। আমার কিশোরী বয়সের ভালোবাসার মানুষটা এভাবে আমার খুব কাছের হয়ে যাবে। কিন্তু আফসোস, দুঃখ, আমার ভাগ্য তাকে পেয়েও হারানোর পথে। সে তো চায় না আমায়। সে তো বারেবারে বোঝাতে চায় সে আমার কখনো ছিলো না, আর কখনো হবে না। তবে আমি তাকে বলে দিতে চাই

” না বাসলেন ভালো। নাই বা আপনার কাধে আমার মাথা রাখার সাহসটা দিলেন। আমি আপনার রাজ্যের রাণী না হয় নাই হলাম। পরম ভালোবাসা দিয়ে আমার খোঁপায় রোজ একটা বেলি ফুলের মালাও পরিয়ে দিতে হবে না৷ শুধু আমি যেটুকু ভালোবাসা দেই এটুকু একটু গ্রহণ করুন। আমি সব হারিয়ে অবশেষে আপনার দ্বারে। দূরে ঠেলে না দিলে কি হয় না? শুধুমাত্র জীবনের শেষ বিকেলে আমি আর আপনি কি একসাথে ঘোর কুয়াশার মাঝে হেঁটে হেঁটে বহুদূর যেতে পারি না?

চলবে…..