শেহজাদী পর্ব-৩৬ + বোনাস পর্ব

0
823

#শেহজাদী
Part–36
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

মিরার যখন জ্ঞান ফেরে, সে তখন সম্ভবত হাসপাতালে শুয়ে ছিল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে আধার নেমেছে। সে যেন এক অপার ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। মাথার পেছনের দিকটা ব্যথায় একাকার। সে আস্তে করে চোখ বুজে ফেললো। চোখের পলক ফেলার শক্তিটাও তার মধ্যে নেই। তার পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। হাতের উপরিভাগে চিনচিন ব্যথার অনুভূতি জাগছে।এমনকি তার প্রচুর শীত লাগছে। মনে হচ্ছে, দুটো লেপ মুড়িয়ে শুলেও শীত ভাব কমবে না। আচ্ছা সে কোথায় এখন? এ রুমে কি সে একা? কেউ নেই কোথাও? তার মনে ভয়েরা দল বেঁধে ডানা ঝাপ্টাতে লাগে। কালকে পর পর বেশ ক’টা দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে। মজার ব্যাপার হলো সে স্বপ্নের মধ্যেই বুঝে যাচ্ছিল, সে স্বপ্ন দেখছে! কি অদ্ভুত ব্যাপার! আচ্ছা এটা কি পৃথিবী নাকি অন্য কোন ভূবন ?

তার চিৎকার করে মা বলে ডাকতে মন চাচ্ছে! মা কোথায়?বাবা কোথায়? ইরা কি আশেপাশে নেই? আচ্ছা ইমান কি রাতে বাসায় ফেরেনি?সারারাত কোথায় ছিল সে? আধো অচেতন অবস্থাতেও মিরা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠে ইমানের জন্য। এক ঝলক দেখার জন্য কাতরাতে লাগে।

তখনই রুমে কারো উপস্থিতি টের পেল সে। কেউ যেন কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে।

সে মিরা কাহিল গলায় বলে, ইমান?

— না। আমি তোমার বড় আব্বু।

মিরা যেন একথায় কিছুটা লজ্জা পেল। চোখ হালকা চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে।

বড় আব্বু কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে, ব্যাপার কি মিরা মামনি? তুমি হুট করে এতো সিক হলে কিভাবে? কালকেই তো সুস্থ ছিলে, ঘুরে আসলে, আর আজকে সোজা হাসপাতালে!

— কি হয়েছিল?

— সকালে নাস্তা খাওয়ার জন্য তোমাকে ডাকতে গিয়ে ইরা দেখলো তুমি অচেতন হয়ে আছো। তখন বাসায় আমি বা তোমার বাবা কেউ ছিলাম না। গোডাউনে ছিলাম। ইমানের ছোট ভাই তোমাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করালো।তোমার আম্মু ভীষণ আপসেট হয়ে আছে।যদিও বা ডাক্তার বলেছেন নাথিং সিরিয়াস।

মিরা চুপ করে বড় আম্মুর কথা শুনলো। এরপর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, এখন ক’টা বাজে?

— দুপুর এখন। তুমি কি কিছু খাবে? হালকা স্ন্যাকস জাতীয় কিছু?

— না৷ কিছু খাব না। আচ্ছা বড় আব্বু ইমান কি কাল বাসায় আসেনি?

বড় আব্বু কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলে উঠে, না আসেনি। ওর কথা কেন বারবার বলছো? তোমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে?

মিরা ধপ করে আরো মিইয়ে পড়লো। বড় ক্লান্ত লাগছে তার। হুট করে সবকিছুই অসহ্য লাগা শুরু করলো।

বড় আব্বু বললেন, তোমার সম্ভবত বদহজম হয়েছিল৷ বমি-টমি করে বিশ্রী অবস্থা! সেই সাথে ভীষণ জ্বর। এমনি কি মানা করি বাইরের খাবার খেতে? যাগ গে! জ্বর সেরেছে। এখন কেমন লাগছে?

— ভালো না।

— এই ভালো না কি মনের নাকি শারিরীক?

— তাতো জানি না।

— আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার এই ভালো না লাগাটা সম্পূর্ণ মনের। শরীরের না। ঠিক কিনা?

মিরা না ভেবেই বলে, ঠিক বলেছেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

বড় আব্বু মিরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, সুখ-দুঃখ দুটোই সাময়িক। ক্ষণস্থায়ী।

— তাহলে চিরস্থায়ী কি?

— ভালোবাসা! ভালোবাসা চিরস্থায়ী।

মিরা বেশ খানিকটা অবাক হলো। বড় আব্বুর মুখে ভালোবাসা শব্দটা বেমানান! তার মুখে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু কোনদিন শোনেনি মিরা। আজ প্রথম সেই ব্যক্তির মুখে ভালোবাসা নিয়ে উক্তি শুনে হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

বড় আব্বু এবারে মলিন স্বরে বলে, তোরা মনে করিস, আমি বুঝি খুব নির্দয়। তোদের ভালো-মন্দের খবর রাখি না। কিন্তু এ ধারণা ভুল। তোদেরকে বোধহয় আমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসে না। তোকে, ইমানকে, ইরাকে আমি নিজের সন্তান হিসেবেই দেখি। সায়েমা,সোনালী যেমন তোরাও তেমনই! তবে ইমান আমার একটু বেশিই প্রিয়! কেন তা জানি না! হয়তোবা মৃত বোনের ছেলে জন্য! ইমান কষ্ট পেলে সেই আঘাতটা সরাসরি আমার গায়ে এসে লাগে।

মিরা এবারে বড় আব্বুর চোখের দিকে তাকালো। তার চোখ ছলছল করছে। তিনি মাথাটা সোজা রেখে বলে উঠে, আম্মা যখন তোদের বিয়ে নিয়ে মত সবার সামনে রাখলো, আমি সেদিন অনেকটা সময় নিয়ে ভাবলাম। ভাবার পর একটা ব্যাপার উপলব্ধি করি তাহলো, তোর জন্য ইমান পারফেক্ট একটা ছেলে। তোকে সামলে রাখার ক্ষমতা আছে ওর। এজন্য প্রস্তাবে রাজী হই। কিন্তু এটাই বুঝি ভুল ছিল। তোদের বিয়ে ভেঙে গেল। তুই দূরে চলে গেলি। এদিকে ছেলেটা তীব্র কষ্ট পেল!

— পুরনো কথা হঠাৎ বলছেন কেন?

বড় আব্বু অকপটে জবাব দেন, কালকে ইমান শুধুমাত্র আমার ফোন রিসিভ করেছিল।

সে ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, কোথায় আছে ও? ওকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলুন প্লিজ!

— তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে জানি না কিন্তু ইমান অনেক বেশি আপসেট, হতাশ! ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝে গেছি আমি।

মিরা এতো অসুস্থতার মাঝেও উঠে বসে আচমকা হুহু করে কেঁদে দিয়ে বলে, বড় আব্বু প্লিজ ওকে আসতে বলেন। আমি আর কোনদিন ওকে ভুল বুঝব না।

আজমল সাহেব ভড়কে গেলেন তাকে কাঁদতে দেখে। অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটা এতো হাইপার কেন হচ্ছে ইমানের জন্য? তিনি বললেন,

— তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে জানি না কিন্তু শুধু এতোটুকুই চাই যে তোমরা সবাই মিলেমিশে থাকো। আমাদের বংশে কোন ছেলে নেই। এই বংশ টিকিয়ে কে রাখবে? বল? তোমরা এভাবে আলাদা হয়ে পড়লে, আমি মারা গেলেই আমাদের এতো কষ্টের যক্ষের ধনের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে।

— ওকে শুধু একবার আমার কাছে আসতে বলেন। আমি সব ঠিক করে দিব।

— দেখি। তুমি রেস্ট নাও।

বলে উনি উঠে দাঁড়ালো এবং বাইরে চলে গেলেন। এদিকে মিরা বিছানায় ছটফট করতে লাগলো। হাতে স্যালাইন দেওয়া জন্য উঠে চলে যেতেও পারছে না। দুশ্চিন্তায় সে ঘেমে যাচ্ছে। এতো অস্থিরতা মনে পুষেও সে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো। আস্তে আস্তে প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হতে লাগলো তার ঘুম।

বড় আব্বু মিরার কেবিন থেকে বের হলো। বাইরে কেউ নেই৷ কিছুক্ষণ আগেই ইরা আর মিরার বাবা-মা রেস্ট নেওয়ার জন্য বাসায় ফিরে গেছে। বাসা থেকে হাসপাতাল বেশি দূর না। তিনি একাই মিরার সঙ্গে ছিলেন এবং আছেন। বাসায় সোনালী একা জন্য সুপ্তি বেগম বেশি ঝামেলা করেননি। এছাড়া ডাক্তার বলে দিয়েছে, মেজর কিছু না। জ্বরের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।

তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে ইমানকে কল লাগায়। চার বারের বার সে রিসিভ করতেই আজমল সাহেব থমথমে গলায় বলে, ফোন ধরছিলে না কেন?

ইমান বিনীত গলায় সালাম দিয়ে বলে, মামা আমি একটু বাইরে আছি এজন্য ফোন ধরতে দেরি হলো!

— তুমি এই মূহুর্তে কোথায়?

— বসুন্ধরাতে।

— এক্ষুনি রওনা দাও৷

— কেন? মামা? কোন সমস্যা হয়েছে?

— মিরা অসুস্থ। হুট করে কালকে রাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মাত্র জ্ঞান ফিরলো। তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। তুমি কি আসবে না?

ইমান যখন খবর পায় যে মিরা অসুস্থ তখন সে যমুনা ফিউচার পার্কে ছিল। মামার কথা শোনার পর তার পা থেকে মাটি সরে গেল। কালকেই সুস্থ ছিল আর আজকে একদিনের ব্যবধানে হাসপাতালে মিরা এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে তার।ভীষণ কষ্ট!

সে দিশেহারা অবস্থাতে বের হয়ে ড্রাইভারকে ফোন দিলো। ভাগ্য ভালো আজ সে ড্রাইভার সঙ্গে এনেছে।নাহলে আজকে একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলতে পারত!

সে গাড়িতে উঠে তড়িঘড়ি করে বলে, দ্রুত সূত্রাপুর চলুন।

— স্যার! এখন ওদিকে যেতে সময় লাগবে। চারটা থেকে প্রচুর জ্যাম হয় তো!

— হোক।তবুও যেতে হবে। এক কাজ করুন, হাতিরঝিল হয়ে যান। আর এসিটা বাড়িয়ে দেন। প্রচুর গরম লাগছে।

— আচ্ছা স্যার।

ড্রাইভার গাড়ি নিজ গতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে ইমান হাঁসফাঁস করছে। বারবার সময় দেখছে সে। আর সহ্য হচ্ছে না। রাস্তায় মরা জ্যাম লেগে গেছে। তার মন চাচ্ছে, হেলিকপ্টার ডেকে আকাশপথে উড়াল দিতে!

ইমানের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যাচ্ছে। সূর্য ঢলে পড়ছে। ইমানের মনে মনে ঢাকা শহর আর ঢাকা শহরের জ্যামের গুষ্টি উদ্ধার করা শেষ।

কেবিনের দিকে যেতেই ইরা আর সাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ।

ইরা তাকে দেখে স্মিত হেসে বলে, আপু ঘুমাচ্ছে।

— মামী কই?

— বাসায়। সোনালী আপুর প্রেসার একটু বেড়ে গেছে জন্য আম্মু বাসায় আছে। বড় আব্বু মাত্র বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো।

ইমান শুকনো ঢোক গিলে বলে, আর ছোট মামা উনি কোথায়?

— আব্বু তো আসরের ওয়াক্ত থেকেই হাসপাতালের মসজিদে বসে আছে৷

এবারে সাদ বলে উঠে, তোমরা টেনশন নিও না! সব ঠিকই আছে। জাস্ট রিল্যাক্স।

সাদের কথার পিঠে কেউ জবাব দিলো না৷ ইমান কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেল।

ঢুকতেই মিরার ঘুমন্ত মুখ চোখে পড়লো। তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। মিরা ঘুমাচ্ছে কিন্তু মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট! সে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে এনে মিরার মাথার কাছে বসে, তার চুলে হাত রাখলো এবং সে মিরার কপালে খুবই প্রগাঢ় করে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো। ঘুমন্ত মিরা টের পেল না।

সে নিস্তেজ হয়ে ঘুমাচ্ছে। ইমান আপনমনে তার চুলে বিলি কাটছে আর এক দৃষ্টিতে তারই পানে তাকিয়ে আছে। থেকে থেকে কপালে গভীর করে ভালোবাসার পরশ একে দিচ্ছে।

আচমকা মিরা নড়েচড়ে উঠে। হয়তোবা ঘুম ভেঙে গেছে তার ইমানের অযাচিত স্পর্শ পেয়ে। ইমান দেখলো, সে পিটপিট করে চোখ খুলে তার দিকে তাকালো এবং বেশ বিষ্মিত হলো৷ মনে হচ্ছে ইমানের আসার ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

ইমান তার চোখে চোখ রেখে খুবই সাবলীল ভাবে বলে, কেমন আছো?

— ভালো৷

— ভালো আছো?

— হু৷

— তাহলে হাসপাতালে কি করছো?

— ফটোশুট করতে এসেছি। আপনি করবেন?

ইমান শব্দ করে হেসে দিল না চাইতেও। মিরা ঠোঁট বাকিয়ে, অপর পাশে মুখ ঘুরে, ইমানের দিকে পিঠ দিয়ে শুলো।

ইমান বলে, কালকেই না দিব্যি সুস্থ ছিলে। তিড়িংতিড়িং করে নাচা-নাচি করলে, আর আজকেই এই দশা কেন?

— অসুস্থতা বুঝি এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসে?

— তুমি আসলে কার উপর রাগ দেখাচ্ছো?

— কারো উপরই না।

— আমার মনে হচ্ছে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছো।

— উহু। একদমই না।আপনি কে? যে আপনার উপর রাগ দেখাব?

ইমান ঠোঁট দুটো গোল করে বলে, ও।

মিরা এবারে উঠে বসলো। তার আসলেই রাগ লাগছে। এই ছেলেটাকে দেখার জন্য সে কাল রাত থেকে অস্থির করছে, জ্বর শরীরেও ওকে দেখার জন্য মন কাতরাচ্ছিল কিন্তু দেখামাত্র সব, সব দুঃখ-কষ্ট এক নিমিষেই ফুরিয়ে গেলো।

সে টেনে টেনে শ্বাস নিতে নিতে ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনি খুব পঁচা৷

— জানি।

— জানেন?

— হুম।

— আপনাকে আমি একফোঁটা ও ভালোবাসি না।

ইমান বাঁকা হেসে বলে, এই ব্যাপারটা তুমি যেদিন আমাকে ভালোবাস-বাসির কথা বলেছিলে সেদিনই বুঝি গেছি।

মিরার কি যেন হলো একথা শুনে। ভীষণ রাগ উঠে গেল তার। সমস্ত ক্লান্তি, গ্লানি ছাপিয়ে তার মনটা অজগর সাপের ন্যায় ফুসতে লাগে। সে ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় হামলে পড়ে ইমানের দিকে।

ইমান ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মিরা তার চুল খামচে ধরেছে। আচ্ছা বজ্জাত তো মেয়েটা! যতোই হোক ইমান তার এককালীন টিচার, সম্মান তো করেই না! সুযোগ পেলেই তার চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়।

ইমান থমথমে গলায় বলে, কি?

— দেখ ইমান! বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর ভালো হবে না বলে দিলাম!

মিরার কথা কর্ণকুহর হতেই ইমানের চোখ কপালে। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে! অসুস্থ জন্য দেখতে এলো, অথচ মেয়ে তার সঙ্গে তুই-তুরাকি শুরু করেছে। এটা মানা যায় না!

মিরা সত্যি সত্যি ইমানের চার-পাঁচটা চুল টেনে, শান্ত মেয়ের মতো তার বুকে নেতিয়ে পড়ে, কান্না করে দিয়ে বলে, আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি। এক সমুদ্রে যতোগুলো ঢেউ সৃষ্টি হয়, ঠিক সেই পরিমাণ ভালোবাসি!

আজকে ইমানের কি যে হলো! সে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারলো না। কঠোর হতে পারলো না। মিথ্যা জিহবা দিয়ে বের হলো না।

সে মিরাকে নিজের বুকের সঙ্গে প্রায় পিষে ফেলে, কোমল গলায় বলে, ভালোবাসি তো!

এই দুটো শব্দই যেন মিরার শরীরে ঔষধের ন্যায় কাজ করলো। সমস্ত রোগ-বালাই গায়েব হয়ে গেল দেহ থেকে, এবং দেহে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল৷

ইমান তাকে বুক থেকে সরিয়ে, সোজা করে বসিয়ে দিলো এবং তার নাকে নাক ঘষে বলে, লাভ ইউ মাই শেহজাদী!

চলবে।

#শেহজাদী
বোনাস পার্ট
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

একে অপরের অনেকটা নিকটে এসে গেছে ইমান-মিরা। দুইজনেই মগ্ন দুজনাতে। চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর এক জগতেন।যে জগতের প্রাণ কেবল প্রেম। প্রেমের জগতের সবকিছুই প্রেমময়!

দুজনেই দুজনার নিশ্বাস, হৃদপিণ্ডর ধুকপুক আওয়াজ শুনতে পারছে। ইমানের এক হাত মিরার চিকন কোমড়ে গিয়ে থেমে আছে। চোখে চোখ রেখে অপলক নয়নে চেয়ে আছে তারা। এ যেন নিরবে দৃষ্টিবিলাস চলছে দুজনার! কখনো কথা না বলেও অনেক কথা বলা হয়ে যায়। আজ তারা নিরব থেকেও চোখের ভাষায় একে অপরকে অনেককিছুই জানিয়ে দিচ্ছে। মান-অভিমান ভাঙ্গছে তো, নতুন করে মান-অভিমান গড়ে উঠছে।

মিরার আঙুলের ভাঁজে, নিজের হাতের আঙুল গুজে দিয়ে, ইমান বলে উঠে, তোমার উপর কিন্তু শোধ তোলা বাকি আছে।

মিরা আদুরে গলায় বলে, কিভাবে শোধ তুলবেন? হু?

ইমান হেসে দিয়ে বলে, আপাতত অসুস্থ জন্য তোমাকে সাময়িক ভাবে ক্ষমা করে দিচ্ছি। প্রতিশোধ কিন্তু নিবই! শাস্তি তুমি পাবাই। ছাড় পাবে না একবিন্দু! শাস্তি পেন্ডিং এ থাকলো।

মিরা নাক ফুলিয়ে বলেন,কি শাস্তি দিবেন?

ইমান দুষ্ট হেসে মিরার কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে, কানের ওপাশে গুজে দিয়ে, নিজের মুখটা মিরার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, বাসাতেই ফুটবল টিম বানাবো!

মিরার ভ্রু কুচকে গেল। তার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না সে। ইমান তার গালে হাত রেখে বলে, শাস্তিটা কেমন? জোশ না?

— এটা আবার কেমন শাস্তি? আপনি কি ফুটবল খেলার কোচ যে টিম বানাবেন?

ইমান তার কথায় হতাশ হলো। মেয়েটা কেন যে এতো ডাম্প! মাঝে মাঝে একারণেই বিরক্ত লাগে। বোকা মেয়েদের সঙ্গে ভাবের কথা বলে মজা পাওয়া যায়না এটা যেমন সত্য তেমনই আরেকটা সত্য হলো বোকা মেয়েরা সংসারী হয়!

কেবিনের দরজা খুলার শব্দে ইমান ছিটকে আসে মিরার নিকট থেকে। ঘটনাটা ঘটতে দুই সেকেন্ড লাগালেও তাদের কাছাকাছি অবস্থান করাটা একজোড়া চোখকে আড়াল করতে পারেনি।

কেবিনে সাদ আর ইরা ঢুকেছে। ইরা হালকা হলেও আভাস পেয়েছে। সে বুঝে পাচ্ছে না হুট করে আপু আর ইমানের মধ্যে কি হলো যে তাদের এতোটা কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে?

মিরা তাদের দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। আজ চোখে চশমা নেই তার।

ইমান সরে আসলেও ডান হাতটা দিয়ে মিরার ডান হাত এখনো ধরে আছে তবে তাদের দুইজনের হাতের উপর বালিশ রাখা। দেখা যাচ্ছে না। ইমান দূরে এসে চেয়ারে বসলেও, হাত ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। বহুদিন পর হাতটা ধরার অধিকার পেয়েছে আর ছাড়া যাবে না।

মিরা হাতটা ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ইমান আগের তুলনায় আরো শক্ত করে ধরে বসে আছে। সে একবার তার দিকে করুন চোখে তাকালো। তাতেও লাভ বিশেষ হলো না। ইমান হাত ছাড়বে না মানে ছাড়বে না!

ইরা মৃদ্যু গলায় বলে, তোমাদের ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?

ইরার কণ্ঠ আর বলার ধরনটা ইমানের কাছে ঠিক লাগলো না। সে যথাসম্ভব বিনীত গলায় বলে, ডিস্টার্ব করার কি আছে?

ইরার প্রচুর রাগ লাগছে। ইমান যে তার বোনের হাত ধরে বসে আছে সেটা তার চোখ এড়ায়নি। সাদ না দেখলেও সে ঠিকই দেখে ফেলেছে। এ দৃশ্যপট দেখার পর থেকে তার বুকে যেন কেউ পাথর নিক্ষেপ করছে।বড়-ছোট সব সাইজের পাথর ছোঁড়ার মতো তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার।

ইমানের কথায় সে চুপ মেরে গেল। সামনে বসে থাকা মানুষটাকে পাওয়ার কোন আশাই সে রাখে না তবুও মনের কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম ভরসা বা সান্ত্বনা ছিল যে মানুষটার সঙ্গে তার কিছু একটা হলেও হতে পারে।

এই “হলেও তো হতে পারে” অনুভূতিটা করাতের ন্যায় ধারালো, যার আঘাতে সব সুখ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

ইরা মুখ কালো করে আপুর দিকে তাকালো। অসুস্থ থাকার পরও আপুকে আজকে একটু বেশিই রূপবতী লাগছে যেন। কারনটা কি ইমান?

আজ হুট করে এই মূহুর্তে ইরার মনে হতে লাগলো, মিরা আপু খুব ভাগ্যবতী। আপু হাজার টা ভুল করলেও, তাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই, অথচ সে কোন ভুল করেনা তারপরও যাকে ভালোবাসে, তার দিকে তাকানোর স্পর্ধা নেই।

ইমান হালকা গলায় বলে, জুস খাবে?

মিরা বলে, না। কিছু খাব না৷ আমি বাসায় যাব।

— রিলিজ দেয়নি।

— আপনি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি বাসায় যেতে চাই। হাসপাতালে থাকতে মন চাচ্ছে না।

— বেশ। রোগী যা চাইবে তাই হবে।

ইমান এবারে আস্তে করে মিরার হাত ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলে,মামাকে দেখে আসি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে রিলিজের ব্যবস্থা করছি।

ইমান যেতে ধরলে, সাদও দুই বোন কে একলা ছেড়ে ভাইয়ের পিছু নিলো।

কেবিনের বাইরে আসতেই সাদ মুখ কাচুমাচু করে বলে, ভাইয়া?

— কি?

— আমি ভাবীকে সব বলে দিয়েছি। সর‍্যি হ্যাঁ!

ইমাম ভ্রু কুচকে বলে, কোন ভাবী? আর কি বলেছিস?

সাদ মাথা উঁচু করে গর্বের সঙ্গে বলে, মিরা ভাবীকে বলে দিয়েছি সব।

— কি বলে দিয়েছিস?

— তুমি যে টিউশন পড়াতে গিয়ে তার প্রেমে পড়েছো সেটা বলে দিয়েছি। তুমি যে তাকে ভালোবাসো এটাও বলেছি। মোদ্দা কথা ভাবী তোমার মনের সব কথা জানে এখন।

ইমান বিষ্ময়কর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোকে মানা করছিলাম কিন্তু?

— দুই-এক আদেশ মান্য না করলে কিছু হবে না।

ইমান তার পেটে কিল মেরে দিল একটা। এরপর দুই ভাই একসাথে হেসে উঠে৷ হাসপাতালে খুব কম মানুষই হাসে। ইমানের ছোট্ট বেলা থেকেই হাসপাতাল খুব অপছন্দ। কিন্তু আজকে হাসপাতালও ভালো লাগছে।

সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে মিরাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে তারা সবাই বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো। মিরাদের গাড়ি হাসপাতালেই ছিল। শুধু মামাই হেঁ
টে বাড়ি ফিরলেন৷ এতে মিরার খানিকটা মন খারাপ হলো।

বাসায় ফিরতেই সোনালী আপু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, বোন কি হয়েছিল তোর? তোকে দেখার জন্য আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।

উনি মিরা গাল ধরে বেশ কিছুক্ষণ আদরে করে ইমানের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, তুই কাল সারারাত বাসায় ফিরিস নি কেন? আমার আর ভালো লাগে না। তোদের জন্য অস্থির আর টেনশনে আমার বাচ্চাটা শুকায় যাচ্ছে। আমি ঠিকঠাক ভাবে খেতেই পারছি না কিছু।

ইমান অসহায় মুখে বলে, সর‍্যি আপু। তুমি রেস্ট নাও। মামী বললো তোমার প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল। এখন কেমন লাগছে?

সোনালী আপু রেগেমেগে ফায়ার হয়ে বলে, ভালো নেই। তোরা আমাকে সুখে থাকতেই দিস না। সবসময়ই আমাকে জ্বালাচ্ছিস।

— কি করলে তুমি সুখে থাকবে?

— আমার ডেলিভারী হওয়া অব্দি তোরা সবাই আমার সঙ্গে থাকবি। তোরা আশেপাশে থাকলে সাহস পাই।

— তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করা হবে৷

সুপ্তি বেগম নাস্তা দিয়ে টেবিল সাজিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলেন। মিরার জন্য স্যুপ আর বাকিদের জন্য নুডুলস, পিয়াজু, বিস্কুট, পরেটা আর আলুর দম। সবারই কম-বেশি ক্ষুধা লেগেছে। টেবিলে সবাই বসে খাচ্ছে৷

ইমান মিরার বিপরীতে বসেছে। সে পরোটা খাচ্ছিল। হুট করে পায়ে যেন কেউ খোঁচা মারলো। তার তো নাকে-মুখে খাবার উঠে যাওয়ার উপক্রম।

সে মাথা নিচু করে দেখে মিরা পা দিয়ে খোঁচা মারছে তাকে। রোগী মানুষের কাজ দেখো! মিরাকে রোগী বললে সত্যিকারের রোগীরা কেঁদে বুক ভাসাবে। স্যুপ খাচ্ছে আর তাকে জ্বালানো হচ্ছে?

ইমানও কম না, সেও মিরার পায়ে গুতো মারার জন্য পা এগিয়ে দিয়ে, তার পায়ে বেশ জোরেই গুতো মারলো। ইমান তাকিয়ে ছিল মিরার দিকে। মিরার প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় ছিল। কিন্তু গুতো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরার বদলে বড় মামা ও বাবা বলে চেচিয়ে উঠলো।

ইমানের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মামার পাশেই মিরা বসেছে। সবার চোখ এখন মামার দিকে।

মামা বলে উঠে, আমার পায়ে গুতা দিল কেন?

ইমান পানি পান করে আমতাআমতা করে বলে, বিড়াল গুতা দিয়েছে মামা।

বড় মামা ভ্রু কুচকে বলে, ফ্ল্যাট বাসায় বিড়াল আসবে কোথা থেকে?

মামার কথায় পুরা টেবিলের মানুষ হাসলো।

ইমান চুপসে গিয়ে বলে,কথা ঠিক।

সে মিরার দিকে তাকালো। মিরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে চোখ টিপ মারলো এবং দুষ্টু হাসলো। তা দেখে ইমানের মুখ হা হয়ে গেল। মিরা তো এমন দুষ্ট কিসিমের নয়। হুট করে মেয়েটার হলো কি?

যাইহোক খাওয়া শেষ করে সব কাজিনরা ড্রয়িং রুমে বসলো। সোনালী আপুর বেবি শাওয়ারের প্লানিং চলছে। সবাই অনেক এক্সাইটেড। বিশেষ করে মিরা।

আড্ডার কিছু সময় পর ইরা উঠে চলে গেল। তার নাকি মাথা ধরেছে। সে যাওয়াতে মিরা বার কয়েক তাকে ডাকলো৷ সাড়া পেল না। এদিকে সাদ ও ঝিমিয়ে কাটালো।

ওমন সময় ইমান মিরাকে ম্যাসেজ দিল, আড্ডা শেষ করে ছাদো আসো। কথা আছে।

মিরা ম্যাসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। ইমান ম্যাসেজ সেন্ড করেই উঠে বাইরে চলে যায়।

তারও আধ ঘন্টা পর সোনালী আপু শুতে গেলে, সে লুকিয়ে বের হলো ছাদে যাওয়ার জন্য। বাসায় পড়া কাপড় পরেই সঙ্গে স্কার্ফ নিয়ে ছাদে উঠতে লাগলো।

ছাদে উঠতেই মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। ছাদের মাঝখানে মোমবাতি দিয়ে আই লাভ ইউ লেখা৷

সে সামনে আগাতেই কেউ তাকে পাজকোলে তুলে নিল। সে ভয় পেয়ে যায়। চিৎকার করতে গেলে পরিচিত সুরটা ভেসে আসলো কানে।

— ভয় পেয়ো না৷

মিরা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, এসব কখন করলেন?

— এইতো তুমি যখন আপুর সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত ছিলে তখনই করলাম।

মিরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি অদ্ভুত সুন্দর সবকিছু! সে মুগ্ধ। খোলা আকাশে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে এভাবে চমকে দিবে সে ভাবতেও পারেনি৷

ইমান তাকে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে, পকেট থেকে লাল গোলাপ ফুল বের করে তার সামমে ধরে বলে,আমার তিন হালি হতে এক কম বাচ্চাদের মা হবে? আমার বাবুদের সর্দি হলে, নিজের ওড়না দিয়ে নাক মুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিবে? রাতে ঘুম না এলে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা গুনতে সাহায্য করবে আমাকে?

কথাগুলো ইমান খুবই আস্তে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বললো। বলার সময় খানিকটা কেঁপেছে তার কণ্ঠস্বর।

মিরার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগে। সবকিছুই তার স্বপ্নের মতো লাগছে। সে ভীষণ আবেগী হয়ে, ফুলটা ছোঁ মেরে হাতে নিলো। এবং গোলাপটাকে বুকে চেপে কাঁদো স্বরে তিনবার হ্যাঁ বললো।

ইমান উঠে দাঁড়ালো এবং বলল, গোলাপটাকে বুকে না জড়িয়ে, আমাকে জড়িয়ে ধরলেও পারতে শেহজাদী।

মিরা সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেঁদে দিল।

কি অদ্ভুত সুখ খেলে যাচ্ছে তাদের দুইজনের হৃদয়ে! এমন সুখ,অনাবিল আনন্দ আর কবে পেয়েছিল তারা?

খোলা আকাশে, বিশটা মোমবাতির টিমটিমে আলোয় ইমান তার শেহজাদীকে একেবারে আপন করে পেল। এবারে আর হারাবার ভয় নেই কারন মনের মিলন ঘটে গেছে।

চলবে।