#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১০
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
বাবার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। উনার জ্ঞান এখনো ফিরেনি। ডাক্তার বলেছে আরো কিছুদিন রেখে অবজারবেশন করতে হবে,তারপর বাসায় নিয়ে যেতে পারবে বাবাকে। সেটা কোনো বড় কথা নয়,এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় কথা হলো বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আজ অনেকদিন বাদে তাদের পরিবারের মানুষগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। মা আর হেনা সকাল সকাল নাস্তা নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে। তাদের চোখেমুখেও খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। তা দেখে শ্যামার মনটাও খুশিতে ভরে যায়।
এই মুহুর্তে শ্যামা বাবার কেবিনে বসে নাস্তা করছে শ্যামা,মা বাবার বেডের পাশের টুলটিতে বসে বাবার দিকে চেয়ে আছেন,আর হেনা?সে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তখন থেকে শ্যামার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু জরিপ করে চলেছে।
শ্যামা খাবার থেকে মুখ তুলে হেনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কিরে?এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?কিছু বলবি?”
হেনা তার থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে গোয়েন্দাদের মতো বললো,”আপু তুই কি তোর মুখে কিছু দিয়েছিস?”
শ্যামা মাঝপথে খাওয়া বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে তাকালো হেনার দিকে,”মানে?কি বলছিস খোলসা করে বল”
“না মানে,তুই কালকে ফেরার পর থেকে মনে হচ্ছে তোর মুখের রঙ আগে থেকে একটু হালকা হয়ে গেছে,তখন ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেইনি আমি। কিন্তু এখন কাছ থেকে দেখে এবার আমি নিশ্চিত হয়েছি। বলনা আপু তুই মুখে কিছু দিয়েছিস?”
“কিসব যা তা বলছিস?কখনো আমাকে দেখেছিস মুখে কিছু মাখতে। এক কাজ কর,এই হাসপাতালের চক্ষু বিভাগ খুঁজে তোর চোখ দেখিয়ে আয় যা। তোর চোখে সমস্যা আছে।”
“উফফ আমার চোখ ঠিকই আছে,বিশ্বাস হচ্ছেনা তো আমার কথা? মা তুমিই দেখে বলো, আপুর গায়ের রঙ আগের থেকে হালকা লাগছে না?”
মা এবার বিরক্তির সাথে জবাব দেয়,”আহ হেনা,সকাল সকাল কি শুরু করলি? মেয়েটা এতোক্ষণ পর খেতে বসেছে,খাওয়ার পাতে জ্বা’লাসনা তো ওকে।”
হেনা মায়ের বকুনি খেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে,আর শ্যামা তা দেখে হাসতে হাসতে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
খাওয়া শেষে মায়ের গলা ভেসে আসে,” শ্যামা এবার তুই আমাদের বলবি এতোগুলো টাকা কিভাবে যোগাড় করলি?”
শ্যামা মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”আমি এই ব্যাপারে এখনি কথা বলতে চাইছিলাম।”
শ্যামা মনে মনে সবটা আবার গুছিয়ে নেয়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে ফিরে যাবে নির্জনা কুঠিতে। সে পুরো দুনিয়া আর সেই মানুষটির মধ্যে মানুষটিকে বেছে নিয়েছে।
সম্পূর্ণ আবেগের বশে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সে,এর পরিণতি কি হবে এইটা তার কাছেও অনিশ্চিত এখনো।
তাই এখনি সে তার পরিবারকে জানাতে চায়না যে সে একটি চুক্তির বিয়ে করতে চলেছে। মিথ্যা বলার অভ্যাস একদম নেই শ্যামার,তবু সে অনেক মাথা হাতড়ে একটা জবাব তৈরি করেছে।
“মা আমি কাল অনেক ভালো একটি চাকরি পেয়েছি।
কাল টাকার যোগাড় করতে গিয়ে এক ঘটনার সম্মুখীন হই আমি। এক ভদ্রলোক কালকে রোড এক্সি’ডেন্টে মা’রা যাচ্ছিলো,উনি রাস্তার পাশে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। মানুষজন সবাই তামাশা দেখছিলো তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে। তো আমিই আর না পেরে কয়েকজনের সহযোগিতায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তার ফোন ভেঙ্গে যাওয়ায় তার পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এখন আমিতো উনাকে এভাবে একা ফেলে চলে আসতে পারিনা তাইনা। তো আমি সারারাত হাসপাতালেই ছিলাম।
মধ্যরাতে উনার জ্ঞান ফিরে তখন আমি সবটা উনাকে জানাই উনি এখানে কেমনে এলেন। এখন উনার জ্ঞান ফিরলেও আমিতো মাঝরাতে একা মেয়ে ফিরে আসতে পারিনা। অগত্যা সেখানেই বসেছিলাম।
সেখানেই কথায় কথায় তিনি আমার সমস্যার কথা জানতে পারেন। তারপর তিনি আমাকে তার কোম্পানিতে চাকরি অফার করেন। এই টাকাগুলো তিনি আমাকে এডভান্স হিসেবেই দিয়েছেন,বেতন থেকে কে’টে নিবেন মাসে মাসে।”
এক নাগাড়ে এতোগুলো মিথ্যে বলে হাঁপিয়ে উঠেছে শ্যামা। সে নার্ভাস হয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ফিল্মি কাহিনি বলে মনে মনে তার নিজেরই অনেক লজ্জা লাগছে। ছোটবেলায় বিটিভিতে আলমগীর আর জসীমের যত ফিল্ম দেখেছে তার সবটা ঢেলে দিয়েছে তার এই কাহিনির মধ্যে। মা আবার ধরে ফেলবেন না তো মিথ্যেটা? আস্তে আস্তে চোখ খানিকটা তুলে মায়ের দিকে তাকায় সে,মা কেমন বড় বড় চোখ করে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তার মানে কি উনি বুঝে ফেলেছেন তার মিথ্যেটা?
একসময় মায়ের গম্ভীর গলা ভেসে আসে,”উপরওয়ালার খেলা দেখেছিস?তিনি ঠিক কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের সাহায্য করতে। তোর বাবা পুরোপুরি সুস্থ হলে আমি কতগুলো মিস’কিন খাওয়াবো ঠিক করেছি।
লোকটা কোন হাসপাতালে আছে রে?গিয়ে একবার নিজ থেকে ধন্যবাদ দিতাম,আমারদের এই দুর্দিনে লোকটি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন,তাকে তো অন্তত ধন্যবাদটা দিতে হয়।”
শ্যামা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে,তার মা টা সত্যিই অনেক সরল মনের,এমন ফিল্মি কাহিনি উনি বিশ্বাস করে নিয়েছেন। হেনা এদিকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শ্যামা জবাব দেয়,
“না মা তার দরকার নেই,তোমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ আমিই দিয়ে দিবো পরে। এখন উনার পরিবার এসেছেন হাসপাতালে। আমরা অপরিচিতরা গিয়ে ভীড় করলে ব্যপারটা বেমানান দেখাবেনা?”
মা মাথা নেড়ে বললেন,”হুম তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তা কাজ টা কিসের?অফিস কোথায়?”
“আসলে মা আমার পোস্টিং টা গ্রামে হয়েছে,হাজার হোক নতুন তো আমি। ওখানেই কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব জয়েন দিতে বলেছে। কাজটা সেখানে গেলে বুঝিয়ে দিবে। আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো একদিন।”
“সে কি?শহরের বাইরে যেতে হবে তোকে?তুই একা মেয়ে কিভাবে থাকবি?” মা চিন্তিত সুরে বলে উঠে।
“কিছু হবেনা মা,ওখানে আমার মতো আরও অনেকেই আছে। আমি ঠিক মানিয়ে নিব,তুমি চিন্তা করোনা।”
মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”চিন্তা হলেও তোকে থামানোর মুখ নেই আমার। লোকটি তোকে বিশ্বাস করে চাকরি দিয়েছে,এতোগুলো টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। এখন তো তার বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারিনা। শোন মা,মন দিয়ে কাজ করবি। কখনো নিরাশ করবিনা লোকটিকে।”
“হ্যাঁ মা আমার মনে থাকবে। আমি তাহলে আজই রওয়ানা দিতে চাই মা। বাবা পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। তুমি আর হেনা নিজেদের আর বাবার খেয়াল রেখো। তোমার একাউন্টে আমি কিছু টাকা পাঠিয়েছি। বাবার ওষুধ আর ডাক্তার খরচ নিয়ে কোনো চিন্তা করবেনা।” এই বলে শ্যামা মাকে জড়িয়ে ধরে।
মাও তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আজই চলে যাবি?”
শ্যামা আনমনা ভাবে উত্তর দেয়,”হ্যাঁ মা,আমি তাকে আর অপেক্ষা করাতে চাইনা…”
“ঠিক আছে,সাবধানে থাকিস তবে মা”
_____________________
স্টেশনের বেঞ্চে বসে তার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে শ্যামা। বাড়ি ফিরে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে স্টেশনে আসতে আসতে বেলা একটা বেজে গেছে। পরের ট্রেন দুইটা বাজে ছাড়বে। তাই এক ঘন্টা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
দুপুরের খাবারটা এক প্যাকেট বিস্কিট আর কলা দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে। বাইরের রেস্তোরাঁর খাবার একদম সহ্য করতে পারেনা সে।
খাওয়া শেষ করে তার হবু স্বামীকে ফোন দেয় শ্যামা। সে যে আসছে তা অন্তত জানিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে হলো তার।
তার নাম্বার ডায়াল করে কানে ধরে শ্যামা, ওপ্রান্তে রিং হচ্ছে ফোনে, রিং পড়তে পড়তে বন্ধ হয়ে যায় তবু কেউ ধরলোনা ফোন। পরপর দুবার ফোন দিয়ে রেখে দেয় ফোনটি, ফোনে না পেয়ে সে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দেয় সে আসছে বলে।
নিজে নিজে আনমনে বিড়বিড় করে বলে,
‘অসময়ে আপনি ফোন করে আমাকে চমকে দেন,আর আমার সময়ে ফোনটাও ধরলেন না। এটা কি অবিচার নয়?’
এই সময়ে কোথাও হট্টগোলের আওয়াজ শুনতে পায় সে, তার উৎস খুজতে গিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে একটি টং এর সামনে এক বুড়ো ফকিরকে দেখতে পায় সে।
ফকিরটি কাতর স্বরে অনুরোধ করছে,”বাছা দুটো কিছু খেতে দে না,বহুত ক্ষিধে পেয়েছে। উপরওয়ালা তোর ভালো করবে।’
এদিকে দোকানদার লোকটা নি’র্দয়ভাবে তাকে ভা’গিয়ে দিচ্ছে,”এই চাচা যান তো,এহন ধা’ন্দার টাইম আমার,অন্য কোথাও গিয়া মা’গেন। আমার কাছে পাইবেন না।”
ফকিরটি আবার কাতর স্বরে বলে,”এমন বলিসনা বাছা,বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে আমার,আমাকে উপরওয়ালার ওয়াস্তে কিছু দে না।”
“এই শা’লা বুড়ো,তোরে ভালাই ভালাই যাইতে বলছি,কথা কানে যায় না? দাঁড়া তুই,তোরা ফকিররা তো ভালো ভাষা বুঝস না”
এই বলে দোকানদার লোকটি একটা চিকন ঝাড়ু নিয়ে বুড়ো লোকটিকে মা’র’তে আসে।
এসব দেখে আর সহ্য করতে পারলোনা শ্যামা,দ্রুতকদমে হেটে গিয়ে বুড়ো লোকটির গায়ে আঘাত লাগার আগেই ঝাড়ুটি ধরে ফেলে সে। ঝাড়ুটি লোকটির হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একপাশে ছুড়ে ফেলে শ্যামা। তারপর তেজি গলায় বলে উঠে,
“আপনি কি মানুষ নাকি পশু? এমন বয়স্ক একজন মানুষের উপর প্রহার করতে আপনার লজ্জা করেনা?”
দোকানদার লোকটি তাকে একবার উপর নীচ পরখ করে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠে,”দেখেন আফা,আপনি মাঝখানে আইসেন না। আপনি মাইয়া মানুষ,আপনি এসব থেকে দূরে থাকেন।”
“আমি মেয়ে মানুষ ঠিক আছে। কিন্তু আপনি একজন দুর্বলের উপর প্রহার করে আপনার কোন পুরুষত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন?”
ঝামেলা দেখে ততক্ষণে আশেপাশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে,সবাই যে যার জায়গা থেকে ঝগড়া দেখতেছে। দোকানদার আশেপাশে লোকজন দেখে নীচু গলায় বললো,
“দেখেন আফা আপনি জানেন না এসব ভিক্ষুকদের,এরা সবসময় ফাউ চাইতে আসে। আমি গরিব মানুষ,আমি সবাইরে ফাউ খাওয়াইলে আমার চলবো কি দিয়া?”
“তাই বলে প্রহার করবেন? মানুষ পেটে ক্ষিধের জ্বা’লা সহ্য করতে না পারলে, খাবারের জন্য চুরি ছিনতাই করতেও ছাড়েনা। তিনিতো আপনারর সাথে সেসব কিছু করেনি, একটু খাবার নাহয় চেয়েছে। আপনি না দেন,তাই বলে তাকে মা’র’বেন আপনি?”
“আচ্ছা আফা আমার ভুল হইয়া গেছে,মাথা ঠিক ছিলোনা। চাচা আপনেও মাফ কইরেন আমারে,তয় আমি ফাউ দিতে পারমুনা। আমার পোষাবেনা তাইলে।”
“আপনার ফাউ নিতে দিবোও না আমি উনাকে। উনাকে খাবার দিন,টাকা আমি দিবো”
বুড়ো লোকটি এতোক্ষণ শ্যামার দিকে তাকিয়ে ছিলো,শ্যামা লোকটির দিকে ভালোভাবে তাকালো।
লোকটির বয়স ৭০-৮০ তো হবেই,এক গাল সাদা দাঁড়ি,বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে হাটেন,হাতে একটি পুরোনো লাঠি যেটিতে ভর দিয়েই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কোনোমতে,পড়নে তার ছেড়া ময়লা এক আলখেল্লা,মাথায় লাল রংচটা এক গামছা বাধা,কাধে ঝোলানো আছে আছে একটি কাপড়ের বানানো ময়লা পুটলি,তার মধ্যে না জানি কি রেখেছেন উনি।
লোকটি তার ধূসর রঙের চোখ দুটি দিয়ে শ্যামার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
শ্যামা লোকটির দিকে একটু কুঁজো হয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে,”চাচা এখান থেকে কি খাবেন বলেন?আজ আমি খাওয়াবো আপনাকে।”
লোকটি ফ্যাসফ্যাসে গলায় একটু হাসার চেষ্টা করে,কিন্তু তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা দুর্বল উনি। লোকটিকে দেখে শ্যামার অনেক মায়া হয়।
লোকটি তার বৃদ্ধ কুঁচকে যাওয়া হাত বাড়িয়ে শ্যামার মাথায় হাত বুলায়,শ্যামা তা সরিয়ে দেয়না। সে এখনো হাসিমুখে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে।
লোকটি তার ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে,”উপরওয়ালার অনেক ভালো একজন বান্দা রে তুই মা। তোর মনটা ভারী সুন্দর।
আমি ফকির মানুষ মা,আমাকে তুই নিজ থেকে যা দিবি তা ই যথেষ্ট।”
শ্যামা হেসে উত্তর দেয়,”ঠিক আছে,আপনি একটু অপেক্ষা করেন। আমি খাবার আনছি আপনার জন্য।”
এই বলে শ্যামা টং এ খাবার হিসেবে কি আছে দেখতে থাকে। বিস্কুট,পাউরুটি,কলা এসব ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলোনা সে,স্টেশনের টং গুলোতে এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়া ও যায়না। সে এক পাকেট পাউরুটি,দুটি কলা আর একটি পানির বোতল কিনে দাম মিটিয়ে তা বৃদ্ধ ফকিরটির দিকে এগিয়ে দেয়।
লোকটি কাঁপা কাঁপা হাতে তা নিতে নিতে এক দিকে তাকিয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কিরে বাছা,তুইও খাবি নাকি?আয় আয় একসাথে খাই।”
শ্যামা পিছনে তাকিয়ে দেখলো একটি ছেড়া কাপড় পড়া ৫-৬বছরের বাচ্চা তাদের দিকে চেয়ে আছে। এই ছেলেটি বোধহয় স্টেশনে ভিক্ষা করে। ছেলেটি খাবারগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। বৃদ্ধের ডাক পেতেই ছুটে আসে তার দিকে।
বৃদ্ধ নীচে মাটিতে বসে পড়ে, তারপর পাউরুটি আর কলা থেকে ছেলেটিকে অর্ধেক দিয়ে,বাকি অর্ধেক নিজে খাওয়া শুরু করে। শ্যামা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সবটা। এর থেকে সুন্দর দৃশ্য হতেই পারেনা পৃথিবীতে। মানুষ মানুষের প্রতি মায়া দেখাচ্ছে,এর চেয়ে সুন্দর কিছু আর হতে পারে নাকি।
শ্যামা হেসে লোকটিকে বললো,”চাচা এই এতটুকু পাউরুটিতে আপনার ক্ষিধে মিটবেনা,আমি আরেকটা কিনে দিই?”
ফকিরটি আবার ফ্যাসফ্যাস করে হেসে জবাব দেয়,”না রে মা,এই বৃদ্ধ ফকির খাবারের চেয়েও ভালোবাসার কাঙাল। তুই যা দিয়েছিস তাতে আমার পেট মন দুটোই ভরে গেছে।”
শ্যামা মিষ্টি হেসে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে নেয়না,বলে উঠে,”আমি ভিক্ষে নিই না রে মা। মানুষের দয়া আর ভালোবাসা নিই। ক্ষিধে লাগলে উপরওয়ালার নামে কিছু চেয়ে নিই। তখন তার প্রিয় বান্দাগুলো ভালোবেসে কটা অন্ন দিলে তাতেই আমার চলে যায়।”
শ্যামা লোকটিকে যত দেখছে,যত শুনছে ততো অবাক হচ্ছে। বাহ এমন মানুষও রয়েছে পৃথিবীতে?লোকটির জন্য মনের মধ্যে সম্মান সৃষ্টি হয় তার।
ট্রেন চলে আসায় চলে আসতে নিচ্ছিলো সে তখন সে আবার বৃদ্ধটির কন্ঠ শুনতে পায়,সে কন্ঠে এক ধরনের গম্ভীরতার ছাপ রয়েছে যা এতোক্ষণ ছিলোনা।
“তুই কি নিশ্চিত মা?”
শ্যামা অবাক হয়ে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,”আমাকে কিছু বললেন চাচা?”
” তুই যে পথে যাবি বলে ঠিক করেছিস,তুই কি নিশ্চিত? যাওয়ার আগে আরেকবার ভালো করে ভেবে নে মা”
শ্যামা কথাগুলোকে তেমন গভীরভাবে চিন্তা করেনি। সে ভেবেছে,সে চলে যাচ্ছে বলে লোকটি কষ্ট পাচ্ছে,তাকে না যেতে বলছে। শ্যামা হেসে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ চাচা, আমাকে যেতেই হবে। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে,দোয়া করবেন আমার জন্য”
এই বলে শ্যামা দ্রুত পায়ে হেটে চলে যায় ট্রেনের দিকে।
পিছনে সেই বৃদ্ধ ফকিরের চেহারায় বেদনামিশ্রিত অভিব্যক্তি ফুটে উঠে,সে এক ধ্যানে শ্যামার গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে,
“তুই মানুষটা বড্ড ভালো কিন্তু বড়ো কঠিন ভাগ্য রে তোর মা,
যে পথ তুই বেছে নিয়েছিস সেই পথ তোকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিবে…”
(চলবে)