#শ্রাবণের_সে_অপেক্ষা
লেখা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১৫ (অন্তিম পর্ব)
১৬!!
আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হসপিটালের আইসিইউতে। পাশে একজন নার্স বসা। আমি নার্সের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘সিস্টার!’
নার্স আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো। তবে মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে।’
‘কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন।’
তিনি আমার কাছে এসে হাত পা নাড়াতে বলে বললেন,
‘হাত পা ঠিকভাবে নাড়তে পারছেন তো?’
‘জি।’
‘কোনো অসুবিধা তো হচ্ছে না তো?’
‘না, কিন্তু কথা কেমন জড়িয়ে এসতে চাচ্ছে। স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছি না।’
‘টেনশন নিবেন না। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমি কি স্টোক করেছিলাম.’
‘জি। তবে এখন ভয়ের কিছু নেই। আপনি একদম সুস্থ। শুধু মুখের বামদিকটা হালকা একটু বেঁকে গেছে। সে কারণে কথা এমন অস্পষ্ট হচ্ছে। কদিন থেরাপি নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমার পরিবার?’
‘বাইরে আপনার মা আর স্ত্রী আছে। সাথে আরও কয়েকজন আছে।’
‘তাদের ডেকে দেওয়া যাবে?’
‘আপাতত না। আপনি বিশ্রাম নিন। সুস্থ হলে তারপর কথা বলবেন তাদের সাথে।’
দুদিন পর বাড়ি ফিরলাম।
ঐশী আমার সেবা যত্নে সামান্য ত্রুটি হতে দিচ্ছে না। আমাকে এমনভাবে আগলে রাখছে যেন আমি ওর মহা মূল্যবান কিছু। দুদিনের চিন্তা আর পরিশ্রমে ওর চোখের নিচটা কালো হয়ে গেছে। ঘরের সবার মুখ গম্ভীর। কেউ আমাকে কিছু বলছে না। তবে সবার মুখের গম্ভীরতা দেখে এতটুকু বুঝতে পারছি আমার পরিবার আর ঐশীর সাথে কিছু একটা হয়েছে। সেটা আমাকে জানতে হবে।
সামিহাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ও-ই কেবল সব সত্যিটা বলবে। কয়েকদিন পর সামিহার সাথে কথা বলে বুঝলাম। আমি অসুস্থ হওয়ার পর শান্ত শিষ্ট ঐশীর ভয়াবহ এবং কঠিন একটা রূপ সবার সামনে এসেছিল। আমাকে হসপিটালে নেওয়ার পরও সামিয়া নাকি অনর্গল ঐশীকে দোষী করে যাচ্ছিল। শফিক সায় দিচ্ছিল সামিয়ার কথায়। ওদের মতে, ঐশীর কারণে নাকি আমি স্টোক করেছি। আবার নাকি এ-ও বলেছিল টাকা বুঝিয়ে দেবার ভয়ে আমি স্টোক করার নাটক করেছি।
এসব শুনতে না পেরে ঐশী সামিয়া আর শফিক দুজনার গালেই কষে চড় মেরেছে। তারপর নাকি চিৎকার করে বলেছে,
‘একটা মানুষ সারাজীবন তোদের মতো অকৃতজ্ঞ, বেইমানদের শুধু দিয়েই গেল। বিনময়ে তোরা কেবল তাকে কষ্টই দিলি। সব তো তোদের দিয়েই দিয়েছিল, তারপরও কী লাগবে তোদের? যা ওর ভাগের সব জায়গা জমি নিয়ে যা। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে ভিক্ষা করে খাব, তোদের মুখও দেখব না। তা-ও মানুষটাকে বাঁচতে দে। কী দোষ ছিল ওর? আমাকে ভালোবেসে তোদের অমতে বিয়ে করেছে এটা? তাহলে তোদের জন্য আমাকে যে চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করালো তার দায় কাদের। তোদের গুষ্টিকে গেলাতে গিয়ে, আমার জীবন থেকে যে চৌদ্দ বছর নষ্ট হয়েছিল তার দায় কে নিবে? তোদের কাছে হাত জোর করে ভিক্ষা চাইছি মানুষটার জীবন। ওর থেকে দূরে থাক।
আর মা, আপনি? আপনি নাকি মা? ছি ছি ছি। থু এমন মায়েদের মুখে যে, নিজের একই পেটের সন্তানদের মাঝে ভেদভেদ করে। একচোখাগিরি করে। আপনার স্বামী মারা যাবার পর সায়ন যদি নিজের শখ, আল্হাদ, জীবনের সুখ বিসর্জন না দিয়ে সংসারের হাল না ধরত তখন কী হতো আপনাদের? এই যে রাজার হালে থাকছেন তখন তো ভিখারির মতো থাকতেন। যে ছেলেটা এত করল শেষ পর্যন্ত মা হয়েও তার সকল ত্যাগ অস্বীকার করলেন? ছি! এমন মা থাকার চেয়ে এতিম হওয়া ভালো।’
তারপর আরও অনেক কথা নাকি ঐশী বলেছিল। বুঝতে পারছি মেয়েটা আমার অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে গেছিল। শুনেছিলাম মেয়েরা স্বামীর উপর বিপদ আসলে নিজের পরিবারকেও নাকি ছাড়ে না। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কাকে কী বলে বুঝতে পারে না।
১৭!!
এক বছর পর,
আমি আর ঐশী এখন আলাদা থাকি। প্রথমে আমি বাবার বাড়িতে থাকতে চাইলেও ঐশী বেঁকে বসল। ও কখনো আমার কোনো কথায় না বলেনি, অভিযোগ করেনি, কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে আলাদা থাকাতে কঠিনভাবে আপত্তি করছিল। বলেছিল এ বাড়িতে থাকলে একসাথে থাকবে। আর যদি আলাদাই থাকতে হয় তবে বাড়িও আলাদা হবে। একই বাড়িতে দুই চুলায় দুই হাড়ি বসবে সে আমি দেখতে পারব না। তোমার একসাথে থাকায় কিংবা আলাদা থাকায় কোনোটাই আমার আপত্তি নেই। যদি আলাদা থাকি তবে তেমন আলাদা-ই থাকব। নয়তো না।
তখন ওর কথায় সম্মতি প্রদান করলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ও আমাকে নিয়ে সবসময় খুব ভয়ে থাকে। ডাক্তার আমাকে একদম টেনশন ফ্রি থাকতে বলেছে। বাড়িতে থাকা মানে সামিয়া, শফিক গায়ে পড়ে ঝগড়া করবে। কথা বাড়াবে। তাতে আমার টেনশন বাড়বে। যেটা ঐশী চায়নি।
প্রায় রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করে। নয়তো নামাজের পাটিতে বসে কাঁদে। ও যে আমাকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে তা আমি খুব বুঝতে পারি, কিন্তু আমি এখনও এটা বুঝতে পারি না, ও আমাকে এত ভালো কী করে বাসতে পারে? আমার কারণে কম তো সহ্য করেনি ও। তবুও সবসময় আমাকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখে, আগলে রাখে।
আমার মা আমার সাথে থাকেন না। মা শফিকের সাথে থাকেন। তবে আমার স্টোক করার পর মা যে খুব অনুশোচনায় ভুগেন তা তার চেহারা দেখলে বুঝতে পারি। তবে আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে চলি। মা আমার সাথে কেন থাকেননি তা আমি জানি না। তবে মা রোজ আমায় ফোন করে। সপ্তাহে দু তিন দিন দেখতে আসেন। প্রতিদিন-ই বাড়ি যেতে বলেন। ভাড়া বাসায় থাকতে নিষেধ করেন। আমি মাকে বলেছি,
‘নিজে বাড়ি করে তারপর সে বাড়িতে যাব। সেখানেও তুমিও আমার সঙ্গে থাকবে।’
আমি আর ঐশী খুব করে টাকা জমাচ্ছি নিজেদের একটা বাড়ি করব করে। বাবার দেওয়া জমি আছে অনেক। শুধু নিজেদের মন মতো একটা ছোট্ট বাড়ি বানানোর অপেক্ষা।
ইদানিং মা আর ঐশীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। তবে খোঁচা মেরে কথা বলার স্বভাব তার যায়নি আজও। ঐশী অবশ্য তাতে কিছু মনে করে না। কোনো প্রতিউত্তরও করে না। মা আমাদের সাথে না থাকলেও মায়ের প্রতি দায়িত্ব কিন্তু অবহেলা করি না। মা যখন যা চায় সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করি। সেদিন বললেন অনেকদিন গরুর মাংস খান না। বললাম বাসায় আসো। ঐশী মাকে সুন্দর করে গরুর মাংস রেঁধে খাওয়ালো। যাবার সময় দুই কেজি মাংস, দুটো ইলিশ মাছ মাকে দিয়ে দিলো। পরে রেঁধে খাবার জন্য।
শফিক বিয়ে করে বউ নিয়ে বেশ আছে। শফিকের বউ মায়ের খুব পছন্দের। শুনেছি মেয়েটাও খুব ভালো। তবে বিয়ের পর শফিক ধারদেনা হয়েছে খুব। নির্দিষ্ট বেতনে ধারের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খায়। মা ইনিয়ে বিনিয়ে ওকে সাহায্য করার কথা বলে। তখন আমিও ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দি, ওর বুঝা দরকার কষ্ট কাকে বলে? সংসারে বসে বসে খাওয়া আর সংসার পরিচালনা করা এক কথা না। নিজের ইনকামের টাকায় সবদিক সমানভাবে চালানো মুখের কথা না। এখন হয়তো শফিক একটু হলেও বুঝবে আমি ওদের জন্য কী কী করতাম?
সামিয়ার সাথে তারপর আমার আর কোনো কথা হয়নি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি এখন সংসারে মন দিয়েছে। আমাদের আলাদা হওয়ার পরও মায়ের কাছে এসে পড়ে থাকত, কিন্তু প্রথম কিছুদিন যাবার পরই শফিক নাকি কড়া গলায় বলে দিয়েছে, বেড়াতে এসে দু-তিন দিনের বেশি থাকতে পারবে না। আর ঘন ঘন বেড়াতে আসতে পারবে না। তারপর থেকে নাকি ওখানেও তেমন যায় না।
এতে অবশ্য সামিয়ার বর খুশি। আমাকে কল করে একদিন ধন্যবাদ দিলো। তারপর বলল,
‘সামিয়া এখন সংসারে ঠিকমতো মন দিয়েছে।’
এতে সামিয়ার শ্বশুর শাশুড়িও খুব খুশি। তবে সামিয়ার সাথে আমার কিংবা ঐশীর কোনো রকম যোগাযোগ নেই। ঐশী, শফিক এবং সামিয়া খুব অপছন্দ করে। ওদেরকে একদিন কথায় কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে ওরা দুজন যেন আমার থেকে দূরে থাকে। নয়তো হসপিটালের থাপ্পর রিপিট করতে ওর সময় লাগবে না। ওরা দুজন যে ঐশীকে প্রচণ্ড ভয় পায় তা ওদের চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।
শফিক, সামিয়ার সাথে কথা না বললেও ঐশীর সাথে শফিকের বউ তানুর খুব ভাব। দুই জা প্রায়ই ঘুরতে যায়। তানু প্রায়ই আমাদের বাসায় আসে। দুজন জমিয়ে আড্ডা দেয়। মেয়েটা সত্যি মিষ্টি। শফিক গাধাটা জীবনে এটাই বোধহয় ভালো কাজ করছে। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে পটাতে পারছে।
সামিহা আগের মতোই খুব সুখে আছে। সামিয়া, শফিককে ঐশী পছন্দ না করলেও সামিহাকে মাথায় করে রাখে। সামিহা বা ওর বর আসলে কী করবে না করবে ভেবে পায় না। আদর আপ্যায়নে তখন হুলুস্থুল কান্ড করতে থাকে। ভাবি ননদের মাঝে বিশাল ভাব। দুজন একত্র হলে আমাকে চিনে না। দুজন মিলে আমাকে নিয়ে মজা করে, টিচ করে, বুলি করে। বুঝতে পারছেন এদের সম্পর্ক? একে তো সমবয়সী, তারপর দুজনের চিন্তাধারা একরকম। দুজন এখন সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। কেউ কাউকে ভাবি ননদ ডাকে না। দুজন দুজনকে নাম ধরে ডাকে। তারা বান্ধবী, আমি আর সামিহার বর অসহায় অপরিচিত।
১৮!!
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ে দেড় বছর হয়ে গেল। আমরা শুরু থেকেই বাচ্চা নেওয়ার ট্রাই করছিলাম, কিন্তু আমার কিছু সমস্যার কারণে ঐশী কনসিভ করছিল না। তবে আমার হতাশার সে চরম মুহূর্তে ঐশী আমার পাশে এমনভাবে থাকল যেন আমার ছায়া। আমার অস্তিত্বে ওর বসবাস। আমাকে মানসিকভাবে একটুও ভেঙে পড়তে দেয়নি। আর এ কারণে মেয়েটা ভয়াবহ একটা মিথ্যা বলছে। ওর পরিবারের সবার কাছে বলেছিল, সমস্যা ওর, আমার মাঝে কোনো সমস্যা নেই।
শ্রাবণের প্রথম সকাল।
আমাদের জীবনে শ্রাবণের মধুময় অপেক্ষার অবসান হয়নি বরং আমি সারাজীবন একে অপরের ভালোবাসাময় শ্রাবণ হয়ে থাকব। শ্রাবণের ভালোবাসাময় বৃষ্টিতে ভিজব জীবনের প্রতিটা দিন, প্রতিটা শ্রাবণ মাস। শ্রাবণের প্রথম সকালে বৃষ্টি হবে এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু আজ বৃষ্টি হলো। ঝমঝমিয়ে মুশলধারে বৃষ্টি হলো আজ। সকালের এ বৃষ্টি আমাদের দুজনকেও দারুণ রোমাঞ্চিত করে গেল। একে অপরের ততটা আকর্ষিত হলাম যতটা চুম্বক লোহা একে অপরকে আকর্ষণ করে।
প্রবল ভালোবাসার স্নিগ্ধতা শেষে ঐশী আমার কানে ফিসফিস করে বলল,
‘এখন থেকে যখন তখন এসব করা যাবে না, জনাব।’
আমি মৃদু হেসে বললাম,
‘কেন?’
‘কেউ আসছে। যার কারণে আগামী সাত মাস আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। আর আমাকে সাবধানে থাকতে সাহায্য করবেন আপনি। খুব খেয়াল রাখতে হবে আমার।’
আমার অজান্তেই আমার হাতটা চলে গেল ঐশীর নগ্ন পেটে। হ্যাঁ, এখানেই সে। একটা ভ্রুন, ছোট্ট একটা ভ্রুন। সে আমার আর ঐশীর অংশ। সে আসছে আমাদের জীবনে নতুন সকাল নিয়ে। নতুন আনন্দ নিয়ে। নতুন আশা, বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন নিয়ে। পথ চলার নতুন আলো হয়ে।
সমাপ্ত