হঠাৎ প্রণয় পর্ব-০১

0
381

#হঠাৎ_প্রণয়
প্রথম পর্ব
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বীলেখনীতে

অথৈ আপুর বিয়ে উপলক্ষ্যে আম্মুর সাথে জাহানারা আন্টির বাসায় এসেছি। আমার নানাবাড়ি ও জাহানারা আন্টির বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই আম্মুর সাথে উনার সম্পর্ক অনেক ভালো।

গাজীপুর শহর থেকে একটু দূরে তাদের বাসা, শহরের ছিটেফোঁটা থাকলেও একে ঠিক শহর বলা চলে না। আবার একেবারে মফস্বল গ্রাম বললেও ভুল হবে। তবে শহরের ও গ্রামের সংমিশ্রণে এই জায়গাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

বাসায় ঢুকতেই জাহানারা আন্টি আমাদের দেখে একপ্রকার দৌড়ে আসেন। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে হাসিহাসি মুখে কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে আম্মুকে বললেন,
“মিতু, ও তন্নু না?”

আম্মু আমার দিকে ফিরে আন্টিকে বলে,
“হ্যাঁ, তন্বী।”

আন্টি আমার দুগালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বললেন,
“ওমা তন্নু মা, কত বড় হয়ে গেছে। এর আগেরবার যখন দেখেছিলাম তখন মনে হয় সেভেনে পড়তো। আর ছবিতে তো বোঝাই যায় না এতো বড় হয়ে গেছে। এখন কিসে পড়ে রে?”
“এইতো এবারে এইচএসসি দিবে।”
“মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ, অনেক বড় হয়ে গেছে। তা তানিমাটাকে আনলি না কেন?”
“ওর অনলাইন ক্লাস আছে, আবার ওর আব্বুর অফিসও খোলা। সবাই চলে আসলে কি হয়?”

আমি মুচকি হেসে আন্টিকে সালাম দিলাম,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আসো, আসো, ভিতরে আসো।”

আম্মু ও আন্টির পিছুপিছু আমিও ভিতরে চলে গেলাম। আন্টির কর্মকাণ্ড কিছুটা অবাক করার মতোই লাগলো আমার কাছে। আজব মহিলা একটা, আমার সাথে এমন ভাব করছে যেন আমি এখনো ক্লাস সেভেনেই পড়ি। মানে বছরের পর বছর কি আমি শুধু সেভেনেই পড়বো? আদুভাই নাকি আমি, থুরি ওটা আদুবোন হবে।

এর মধ্যে একগাদা নাস্তা নিয়ে হাজির হলো আন্টি। রুমে আম্মুর বয়সী আরো জন সাতেক নারী গালগল্পে মশগুল। আমি আম্মুর কানের কাছে গিয়ে বললাম,
“আম্মু?”

আম্মু চোখ রাঙিয়ে বলে,
“এতো মানুষের মাঝখানে কানাঘুষা কোন স্বভাব?”
“এখানে ভালো লাগছে না, বাইরে যাই?”

জাহানারা আন্টি বলে উঠেন,
“কি বলছে রে মিতু?”

আম্মু জোরপূর্বক হেসে বলল,
“বলছে অথৈকে দেখবে।”
“ওহ, এই কথা। আমাকে বললেই তো পারো। দোতলায় উঠে প্রথমরুমটা অথৈয়ের। যাও, দেখা করে আসো।”
“আচ্ছা, আন্টি।”

বলেই কোনোরকম রুম থেকে বের হলাম আমি। আপাতত এখান থেকে একটু দূরে গেলে বাঁচি। মহিলাদের পারিবারিক আলাপনে আমি বেমানানই ছিলাম বটে।

করিডোরে নেমে বাড়িটা দেখতে লাগলাম। দোতলা এল সাইজ বাড়ির সামনের দিকে মোটামুটি বড় একটা উঠান। একপাশে একটা বড় বাগান, আরেকদিকে গেইট। গাউনটা একটু উঁচু করে ধরে উঠানে নেমে আসলাম। মানুষ এখানেও নেহাত কম নয়। তাই এখানে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হলো না। সোজা চলে গেলাম বাগানে।

ভেবেছিলাম শৌখিন অথৈ আপুর সাজানো গোছানো ফুলের বাগান হবে এটা। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে বাগানটা। বাগানের এলোমেলো আম-কাঁঠালের গাছগুলো জানান দিচ্ছে এটা উড়াধুরা জাহানারা আন্টির বাগান।

বিকালের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। লাল আভা বাগানের মাটিকেও লাল করে তুলেছে, যেন এগুলো আগুণের স্ফু°লি°ঙ্গ। অন্যরকম ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল।

বাগানের একপাশে কয়েকটা ফুলের গাছ দেখে সেদিকে গেলাম। কয়েকটা বললে ভুল হবে, হয়তো আমি গোলাপের রাজ্যে চলে এসেছি। লাল, সাদা, গোলাপী গোলাপে এপাশটা ঠেসে আছে। একটা সাদা গোলাপ ছিঁ°ড়ে বেনীতে গাঁথতে নিলেই পেছন থেকে কেউ টা°ন দিয়ে ফুলটা নিয়ে নিলো। ফুলের সাথে কয়েকটা চুলও আটকে যায় বলে একটু ব্যথাও পাই।

“ওই কে?”

রেগে পিছনে ফিরতেই দেখি একটা ছেলে। ছেলেটার পা থেকে মাথা অব্ধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। আমার থেকে বেশ খানিকটা লম্বা ছেলেটা, পড়নে সাদা টিশার্ট আর জিন্স, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলোকে খুব গুছিয়ে আঁচড়ে রেখেছে, মুখে খোঁ°চা খোঁ°চা দাড়িও আছে।

ফুলটা হাতে নিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
“কে রে তুই? অনুমতি ছাড়া আমার বাগানে কি করছিস?”

আমি চোখ ছোটছোট করে সরে দাঁড়ালাম, এ কেমন মানুষ? চেনে না জানে না একটা মেয়েকে ডিরেক্ট তুই করে বলছে। চশমাটা ঠেলে একটা ঢোক গিলে বললাম,
“আপনার বাগান? কই কোথাও লেখা দেখলাম না তো?”

ফুলের বোঁটা দিয়ে দাড়ি চুলকে বললেন,
“মেনে নিলাম লেখা নেই। তাই বলে এভাবে ফুল ছেঁ°ড়া কি ঠিক? ফুল গাছে সুন্দর জানিস না এটা?”

আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,
“আমিও মেনে নিলাম, আমার ভুল হয়ে গেছে। সরি।”
“তোর সরিতে কি ফুলটা গাছে লেগে যাবে?”

ঠোঁট বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রাগ উঠছে প্রচন্ড, কোথাকার কোন ছেলে আমাকে ব°কাঝ°কা করছে। কপাল কুঁচকে বললাম,
“আপনি কে?”

ছেলে ফুলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
“অয়ন, অথৈয়ের বড় ভাই। তোর নাম?”

অয়ন, তার মানে উনিই জাহানারা আন্টির ছেলে আর অথৈ আপুর একমাত্র বড় ভাই। অনেক আগে এই ছেলের সাথে আমার দেখা হয়েছিল, যদিও বর্তমানে তার বলা কিছু আ°জা°ই°রা জোকস ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারলাম না।

আমি আমতাআমতা করে বললাম,
“ত.. তন্বী।”

“তন্বী, তন্বী” নামটা কিছুক্ষণ জপে অয়ন চলে যেতে যেতে বললেন,
“ফুলটা গাছে না লাগানো পর্যন্ত বাগান থেকে বের হবি না।”

ফুলটার কা°টা বেছে এটাকে গাছের একটা ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে সোজা দোতলায় চলে আসলাম।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আরেক ঝামেলায় পড়লাম। সিঁড়ির দুপাশেই দুটো ঘর, আন্টি বলেছিলো প্রথমরুমটা অথৈ আপুর। অনেক চেষ্টা করেও আন্টি কোনো দিক বলেছিল কিনা মনে করতে না পেরে ডানদিকের ঘরে ঢুকে পড়লাম।

ঘরে কেউ নেই, তারমানে এটা অথৈ আপুর রুম নয়। বের হতে নিয়ে আমার অবস্থা যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। আবারো সেই অয়নের সামনেই পড়লাম। দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডানহাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাগিরাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি কিছু বলার আগেই ভ্রূ নাচিয়ে বলে উঠেন,
“কিরে, আমার রুমে কি করছিস?”

আমি মাথানিচু করে চোখ এদিক ওদিক নিচ্ছি। হুট করে বলে উঠলাম,
“আমি ভেবেছি একটা অথৈ আপুর রুম।”

উনি এগিয়ে এসে বলেন,
“ফুলটা গাছে লাগিয়েছিস?”

আমি ঘাড় বাকিয়ে একটু সুর ধরেই বললাম,
“হ্যাঁ।”

উনি হাসলেন। খাটে বসতে বসতে জিজ্ঞাস করলেন,
“কোন ক্লাসে পড়িস রে?”
“ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার, (একটু থেমে) আ.. এবারে পরীক্ষার্থী।”

অয়ন ঠোঁট বাঁকিয়ে মাথা নাড়লেন,
“কোন গ্রুপ?”
“সাইন্স।”

পা দিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারটা এগিয়ে এনে চোখের ইশারায় বসতে বলেন। আমি ধীরে ধীরে বসলাম। অয়ন উনার ডান হাঁটুতে হাতের কনুই রেখে সামনের দিকে হেলে বললেন,

“সাইন্সের স্টুডেন্ট হয়েও মাথায় এইটুকু বুদ্ধি? কোন কলেজ তোকে সাইন্স দিলো রে? মিথ্যা-টিথ্যা বলছিস না তো আবার?”

আমার মেজাজের চৌদ্দটা বেজে গেল। বারবার চোখের পাতা ফেলছি আর পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে জুতায় খুটখুট শব্দ করছি। উনি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,
“নাক টিপলে দুধ পড়বে এই মেয়ের কত রাগ? বাপরে। যা, তোর অথৈ আপুর কাছে না যাবি। যা, যা।”

জোরে জোরে শ্বাস ফেলে উঠে আসার সময় উনি জিজ্ঞাস করেন,
“তুই কি মিতু আন্টির মেয়ে না?”

আড়চোখে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে আসতে নিলেই অয়ন উঠে এসে আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
“কিরে, উত্তর না দিয়ে যাচ্ছিস যে। ভারী বে°য়া°দ°ব তুই।”

আমি চোখ বড়বড় করে হাতের দিকে তাকাতেই উনি হাত ছেড়ে দেন। আমি কপালের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে একটু ব্য°ঙ্গ সুরেই বললাম,
“হ্যাঁ, আমি আপনার মিতু আন্টিরই মেয়ে।”

বলে আর এক মিনিটও অপেক্ষা না করে বেরিয়ে আসি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে, কার উপর রাগ উঠছে ঠিক বুঝতে পারছি না। নিজের উপর নাকি ওই অয়নের উপর?

অথৈ আপুর রুমে গিয়ে দেখি আপু তার কাজিন আর ফ্রেন্ডদের সাথে বসে মেহেদীর ডিজাইন সিলেক্ট করছে। আমি রুমের পর্দা সরিয়ে ওদেরকে দেখে চুপচাপ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

অথৈ আপু মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এদিকে আয়, বস আমার পাশে।”

আমি এগিয়ে গেলে আপুর পাশে বসা মেয়েটা উঠে গিয়ে আমাকে বসার জায়গা করে নেয়। চুপচাপ আপুর পাশে বসে সবার মুখ দর্শন করতে থাকি। এতো এতো অচেনা মুখের মাঝে নিজেকে সদ্যজাত শিশু বলে আবিষ্কার করলাম।

অথৈ আপু আমার হাতে হাত রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“ওর নাম তন্বী, আদর করে তন্নু ডাকি আমরা। আমার মিতু আন্টির ছোট মেয়ে। আমাদের থেকে অনেক ছোট, তোরা আবার ওকে জ্বালাতন শুরু করিস না।”

অথৈ আপুর অন্যপাশে বসা মেয়েটা বলে উঠে,
“ছোট মানে? কত ছোট?”
“বিনি, ও এইবার মনে হয় এইচএসসি পাশ করেছে। তাই না তন্নু?”

আমি সেন্টি মার্কা হাসি দিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“না, এইবার এক্সাম দিবো।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

সামনের চেয়ারে বসা সুন্দরী আপুটা বলে,
“এতো ছোট মেয়ে এখানে কি করবে?”

অথৈ আপু আলতো হেসে বলল,
“ছোট মরিচের ঝাল বেশি জানিস তো। তন্নুর গানের গলা কিন্তু খুব সুন্দর। আমাদের আড্ডা ভরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে রে সুমি।”
“তো তন্নু অর তন্বী, একটা গান ধরো।”

সুমি আপুর কথায় আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অথৈ আপুর আক্কেলও বলিহারি, এভাবে কেউ বলে? শখ করে মাঝে মাঝে গান গাই, তাই বলে যে আমার গলার সুর খুব ভালো তা তো আর নয়।

অথৈ আপুও সুমি আপুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, তন্নু। শুরু কর।”

আমি অসহায় দৃষ্টিতে অথৈ আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। সারাদিন গুণগুণ করে গান গাওয়া আমার মাথায় এখন একটা গানও আসছে না। পেছন থেকে এক আপু আমার পিঠ চা°প°ড়ে দিয়ে বলে,
“আরে বাচ্চা মেয়ে, ভয় পেয়ো না আমাদের। আমরা এখানে আনন্দের মুডেই আছি। শুরু করো, শুরু করো।”
“ওকে।”
অগ°ত্যা আমি রাজি হয়েই নিলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ বন্ধ করে গান শুরু করলাম,
“এ জীবনে যারে চেয়েছি
আজ আমি তারে পেয়েছি,
তুমি আমার সেই তুমি আমার
তোমারে খুঁজে পেয়েছি।

তুমি ছিলেনা ছিলনা আশা
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা
ফুটালে আমার মুখে সুখের ভাষা।
ও…ও…ও…ও…
এ জীবনে যারে চেয়েছি
আজ আমি তারে পেয়েছি,
তুমি আমার সেই তুমি আমার
তোমারে খুঁজে পেয়েছি। ”

“হো, হো” করে উঠে শিস বাজালো দুই একজন। অথৈ আপু আমাকে একপ্রকার জড়িয়ে ধরেই বলে,
“আমাকে মিন করলি নাকি?”

আমি হেসে বললাম,
“বিয়ে যখন তোমার, তোমাকে উদ্দেশ্য করাটাই স্বাভাবিক।”

মুখে হাসিটা রেখে দরজার দিকে চোখ যেতেই হাসিটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অথৈ আপু দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভাইয়া, ভিতরে আয়।”

অয়ন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“না, সুমি-মিমির আম্মু এসেছে ওদেরকে ডাকছে। এটাই বলে পাঠালো। এসে দেখি এক বিশ্ব বিখ্যাত সিংগার গান গাইছে তাই আর বিরক্ত করলাম না।”

মিমি আপু উঠে দরজার দিকে গিয়ে বলল,
“একদম ঠিক করেছেন ভাইয়া। ফ্রিতে এমন গান কিন্তু রোজ রোজ শুনতে পারবেন না।”

অয়ন মাথা নেড়ে হাসলো, সাথে নড়ে উঠলো উনার চুল। কয়েকটা চুল কপালে এসেও পড়লো। দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতও কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে এলো।

সুমি আর মিমি আপুকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
“যাও, আন্টি ডাকছে।”

দুজনে বেরিয়ে গেল। তারমানে এরা দুইবোন, চেহারায় মিল আছে এটা এতোক্ষণে খেয়ালে আসলো। আবারো সকলের দিকে তাকালাম, এতো মানুষ তারউপর সবাই অচেনা। মোটেও ভালো লাগছে না এখানে।

আপু বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। অয়নকে ডেকে বলে,
“ভাইয়া, এখন কি বাইরে যাবি?”

অয়ন এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
“হ্যাঁ, একটু ঘুরতে যাবো।”
“ভাইয়া, তন্নুকেও নিয়ে যা। বেচারী এতো মানুষের মাঝে থেকে অভ্যস্ত নয়।”

অয়ন নড়েচড়ে বসলেন,
“অসম্ভব, আমি বাইক নিয়ে যাবো। বাইকে চড়ায়ও হয়তো সে অভ্যস্ত নয়।”
“আরে ভাইয়া, বাইক নেয়ার দরকার কি? আশেপাশে একটু হেঁটে আয়, ওকে নিয়ে যা।”

আমি কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছি। এখন সত্যিই আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে, এখানের রাস্তাঘাট চিনি না বলে যাচ্ছি না।

হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় অথৈ আপু বলে,
“ভাইয়া, তন্বীকে ওই দীঘির পাশে নিয়ে যা। জায়গাটা সুন্দর।”

অয়ন ভাই ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রূ চুলকে বললেন,
“ওকে, চলেন।”

অথৈ আপু আমাকে ঠেলে বলে,
“যা, ভাইয়া কিন্তু অপেক্ষা করবে না।”

অয়নের পিছুপিছু রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। একটু আগে আমাকে “তুই তুই” করছিল এখন আবার “আপনি”? বাপরে, মানুষ এতো দ্রুত রং বদলায় কেমনে? গি°র°গি°টিকেও হার মানাবে এই লোক।

অয়ন হনহনিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। আমি দুনিয়ার বেক্কল হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। হালকা গোলাপী রঙের শার্টটা পড়ে বেরিয়ে এলো অয়ন। সাদা টিশার্টের উপর গোলাপী শার্ট, ছেলেরাও বুঝি এমন সুন্দর হতে পারে। উনার দিকে প্রথমবারে চোখ আটকে গেলেও মুহূর্তেই নিজের চিন্তা চিন্তাভাবনার জলাঞ্জলি দিলাম, উনাকে দেখতে যেমনই লাগুক, তাকাবো না আমি।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে উঠানে আম্মু ও জাহানারা আন্টির সাথে দেখা হয়ে গেল। আম্মু আমাকে বাইরে যেতে দেখে বলে,

“একা একা কোথায় যাচ্ছিস?”

অয়ন পাশ থেকে বলে উঠেন,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”

আম্মু চমকে উঠে তাকায়,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। অয়ন না?”
“জি, আন্টি।”
“ওহো, কতদিন পর দেখলাম।”

অয়ন হাসলো। আম্মুকে বলেন,
“আপনার মেয়ে নাকি বাইরে যাবে বলে অথৈয়ের সাথে বায়না ধরেছে, তাই নিয়ে যাচ্ছি।”

আম্মু রেগে আমার দিকে তাকায়। আমি ইনোসেন্ট এক্সপ্রেশন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক কখন আমি অথৈ আপুর কাছে বায়না করেছি আল্লাহ মালুম।

জাহানারা আন্টি অয়নকে বলল,
“শুন, একদম ওকে রেখে একা একা হাঁটবি না। মেয়েটার আবার এখানে ওখানে পড়ে যাওয়ার ব°দঅভ্যাস আছে। আর দীঘির ওদিকে গেলে দীঘির কাছে যেতে দিস না, পড়ে যেতে পারে।”

অয়ন হেসে আড়চোখে আমার দিকে তাকায়। আন্টি আমার ইজ্জত সম্মান শুকনা বাঁশ বানিয়ে দিলো। আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“ওকে, ওকে। এখন যেতে দাও, না হলে ঘুরাঘুরি মাটি হবে।”

আমার দিকে ফিরে বললেন,
“চলুন, ম্যাডাম।”

অয়নের পিছুপিছু গেইট দিয়ে বেরোতেই জাহানারা আন্টি একটু উঁচু গলায় বলছেন,
“সন্ধ্যার আগে ফিরে আছিস, রাতে কিন্তু মেহেন্দির অনুষ্ঠান। তন্নু রেডি হবে।”

অয়ন হাত উঠিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার আগে আগে হাঁটা লাগালেন। মাটির কাঁচা রাস্তা, একপাশে টিনের বাড়ি আর আরেকপাশ একেবারেই খালি। তবে মাটিতে লাগানো সাইনবোর্ডগুলো জানান দিচ্ছে এগুলো প্লট, যা অলরেডি বিক্রি হয়ে গেছে।

আধঘন্টা হেঁটে গিয়েই দেখা মেলে এক মস্তবড় দীঘির। বিশাল দীঘির পানি যে অনেকটা গভীর তা আন্দাজ করে ফেলি সহজেই। তবে তীরের দিকে ওতোটাও গভীর না, পায়ের পাতা ডুবার মতো পানি আছে।

কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই অয়ন বলেন,
“ছোট থেকেই ঢাকায় থাকিস?”
“হুম, একবছর বয়স থেকে। আপনিও তো ঢাকায়ই থাকেন।”

উনি হাসলেন। তারপর বলেন,
“হ্যাঁ, তবে ছোট থেকেই তো এখানে থাকি। দাদা যখন বেঁচে ছিল তখন তো সবাই একসাথেই ছিলাম। দাদা মারা যাওয়ার পর সংসার আলাদা হয়ে যায়। ঢাকায় থাকলেও মনটা এখানে বড্ড টানে।”
“স্বাভাবিক, জায়গাটা সুন্দর। যদিও আমার কাছে এগুলো ছবি।”

উনি মাথা নাড়িয়ে বলেন,
“তোর তো গ্রামের প্রাকৃতিক ছোঁয়া, জয়েন্ট ফ্যামিলির অভিজ্ঞতা নেই?”
“আ.. খুব একটা না। তবে ইদে বাড়িতে যাই।”

অয়ন ফিক করে হেসে দিলেন। আমি চোখ কুঁচকে তাকাতেই বলেন,
“বেশি রাগিস না, পানিতে পড়ে গেলে আমার দোষ হবে। এমনিতেই তুই নাকি এদিকওদিক পড়ে যাস আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিস।”

বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। উনার হাসি দেখে রাগে আমার গা জ্বলছে। এমনিতেও আমার রাগের রেকর্ড ভালো না, রাগ উঠলে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।

এগিয়ে গিয়ে উনার কলার চেপে ধরে বলি,
“চুপ, একদম চুপ। একদম আমাকে নিয়ে মজা নিবেন না। ঘু°ষি দিয়ে নাক ফা°টিয়ে দিবো।”

উনি লাফিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন, এখনো হেসেই যাচ্ছেন। হাসি থামিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
“কিরে এখনো রেগে আছিস?”

আমি বেনীর আগার চুলগুলো আঙ্গুলে পে°চাতে পে°চাতে বললাম,
“আপনি আমাকে বাগানে আর এখানে তুই করে বলছেন, কিন্তু সবার সামনে আপনি আপনি করেন কেন?”

উনি হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো এমন প্রশ্ন মোটেও আশা করেননি। আমি আবারো বললাম,
“অথৈ আপুর সাথে তো গতবছরও দেখা হয়েছিল আর প্রায়ই আন্টি-আপুর সাথে ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু আপনার সাথে অনেক আগে দেখা হয়েছিল। সে হিসেবে আমি আপনার তেমন পরিচিত কেউ না, তবে তুইতুকারি করার কি আছে?”

উনি এগিয়ে গিয়ে পানিতে পা ডুবালেন। পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ছোটদের আমি তুই করেই বলি, তনুশ্রী। কিন্তু সবার সামনে তোকে তুই করে বলতে ভালো লাগে না বিধায় আপনি বলেছি।”

“তনুশ্রী” নামটা শুনে আশেপাশে তাকালাম। আর কাউকে না দেখে জিজ্ঞাস করলাম,
“কাকে বলছেন?”

উনি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমি এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে দাঁড়ালাম। জুতা পেরিয়ে কিছু পানি আমার পা ছুঁয়ে দিলো।

অয়ন আমার হাত ধরে বলেন,
“পড়ে যাবি তো, এভাবে কাঁদায় দাঁড়াতে পারবি না।”

আমি মাথানিচু করে হাতের দিকে তাকালাম। অয়ন বললেন,
“নাম তন্বী, সকলের কাছে তন্নু হলে, আমার কাছে না হয় তনুশ্রী হলি। তোর কি খারাপ লাগবে?”

পরক্ষণেই হেলার ছলে বললেন,
“লাগলেই কি? আমি তনুশ্রীই বলবো।”

আমি মাথা তুলে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ছোটবেলা থেকে আদর করে অনেকে অনেক নামেই আমাকে ডেকেছে। কিন্তু আজ সবগুলোকে ছাড়িয়ে অন্য এক নাম পেয়ে গেলাম, যা বাকিগুলো থেকে আলাদা। তনুশ্রী, আমি তনুশ্রী। রাগগুলো সব নিমিষেই বরফের মতো গলছে, ক্রমাগত গলছে আর একটা সমুদ্র সৃষ্টি হচ্ছে।

চলবে…………..