#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১০]
নিশীথ ঢাকা এসে পৌঁছাল শেষ রাতে। ঘড়ির কাটা তখন তিনটের ঘর টপকে চারে পদার্পণ করতে মড়িয়া। রজনী তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় স্তব্ধ রাস্তাঘাট। বায়বীয় আকাশ যেন জলন্ত নক্ষত্রদের বুকে নিয়ে ধরনীকে পাহারা দিচ্ছে। জনমানবহীন পথের বুকে অবিন্যস্ত হয়ে শুয়ে আছে কুকুরের দল। নিশীথ আপন ভুবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে কেমন ক্লান্তি বোধ করল। প্রতিবার বাড়ি এসে তার মনে হয় জীবনের গন্তব্য এখানেই। বাকিসব মিথ্যা ছুটে চলা। তবুও নতুন দিনের আলোয় সেই ছুটে চলাকেই পুঁজি করে এগোতে হয়। নিশীথ কলিংবেল চাপল। একটু দ্বিধা জাগল মনে। মা জেগে যাবে নাতো? এই মুহূর্তে তার দ্বারা মায়ের ঘুম ভাঙলে অ’প’রা’ধবোধ আরো খানিকটা বাড়বে বৈকি।
দরজা খুলল টুকটুকি। নিশীথ একটু চমকাল। দীর্ঘ জার্নিতে এই মেয়েটির কথা সে প্রায় ভুলেই বসেছিল। টুকটুকি দৃষ্টি নামিয়ে নিরবে দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। নিশীথ ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে। নৈশব্দকে সম্মান প্রদর্শন করতেই বোধহয় মৃদু স্বরে ফিসফিসানির মতো বলল,
“মা ঘুমিয়ে আছে?”
টুকটুকিও একই স্বর অবলম্বন করল,
“হু, অনেক আগে।”
“শরীর এখন কেমন?”
“ভালো।”
টুকটুকি রিতা আন্টির অবস্থা দেখে আজ এ বাড়িতেই থেকে গেছে। ক্লিনিক থেকে ফেরার পর টুকটুকির বাড়ির লোকও এসেছিল রিতা আন্টিকে দেখতে। একলা,অসুস্থ মানুষ বলে উনারাও মেয়ের এখানে থাকা নিয়ে দ্বিমত করেননি। টুকটুকি মনে মনে আরো একটা ঝ’গড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। সেই জন্যই বোধহয় অবচেতনে সে নিশীথের পথ চেয়ে ছিল। ফলে বাকিরা ঘুমের দেশে পাড়ি জমালেও সে নিশীপোকা হয়ে জেগে ছিল। একসময় চোখ হালকা লেগেও গেছিল। কলিংবেল নৈশব্দে চিড় ধরাতেই তার মন সচকিত হয়। ছুটে এসে দরজা খোলে। যার সঙ্গে ঝ’গড়া বাধানোর জন্য এই রাতজাগা তার ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন মুখটা দৃষ্টির সম্মুখে প্রস্ফুটিত হতেই টুকটুকি সেই সব কথা রাতের নির্মল হাওয়ার সঙ্গে গুলিয়ে খেয়ে ফেলল।
নিশীথ বলল,
“স্যরি, আমার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হলো। আপনার রাতের ঘুমটা নষ্ট করলাম!”
টুকটুকির মুখে এবার পর্যাপ্ত শব্দ জুটল। বলল,
“আপনার জন্য নয়। যা করেছি সব আন্টির জন্য। আমি দরজা না খুললে আন্টির ঘুম ভেঙে যেত।”
নিশীথ নিরবে মেনে নিল। বলল,
“আপনি গিয়ে মায়ের সঙ্গে শুয়ে পড়ুন।”
টুকটুকি গেল না। নিশীথ ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে দেখল টুকটুকি সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। মুদিত চক্ষুদ্বয়। কপালে কিঞ্চিৎ কুঞ্চনের রেখা। নিশীথ নিরবে চলে গেল রান্নাঘরে৷ না খেয়ে জার্নি করেছে পুরোটা পথ। এখন দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাটুকুও যেন হজম হয়ে যাচ্ছে। টেবিলে খাবার রেখে নিশীথ মৃদু কাশল। বলল,
“মিস হুমায়রা, খিদে পেলে জয়েন করতে পারেন।”
নিজের ভালো নামটা শুনে খুব একটা অভ্যস্ত নয় টুকটুকি। খাতা-কলমে তাকে সেই নাম ব্যবহার করতে হয়। তবে বেশিরভাগ মানুষ তাকে টুকটুকি বলেই ডাকে। ফলে এই নির্জন রাতের শেষ প্রহরে এসে একটি গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠে নিজের ভালো নামের প্রতিধ্বনিতে সে একটু চমকে উঠল। একটু ভালোও কী লাগল?
নিশীথ চেয়ার টেনে খেতে বসেছে। ঠান্ডা ভাতে সদ্য গরম করা তরকারি তুলে নিতে নিতে এক পলক মেয়েটিকে দেখে নেয় সে। টুকটুকির একদমই খিদে পায়নি। ঘুমানোর আগে রিতা আন্টি তাকে ঠেসেঠুসে খাইয়েছে। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। আন্টির এই একটা অ’ত্যা’চার টুকটুকির কাছে অনুরোধ ঢেকি গেলার মতোন। সেই খাবার বোধহয় এখনো পুরোপুরি হজম হয়নি। টুকটুকি তবুও প্রস্তাবটা গ্রহণ করল। নিশীথের বিপরীতে বসে এক চামচ ভাত তুলে নিল প্লেটে। খাবার টেবিলে চামচের টুংটাং, গ্লাসে পানি ভরার শব্দ ও নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ হলো না কিছুক্ষণ। টুকটুকি একটু উশখুশ করছিল অবশ্য। তবে কোন কথাটা এই সময় আলোচনা করা যেতে পারে সে বুঝল না। খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে তখন নিশীথই আগে কথা বলল,
“নো অ’ফে’ন্স! আপনার সঙ্গে এ যাত্রার কোনো ঝামেলা হয়নি। আগেরগুলো নাহয় এ মুহূর্তে বাদ দিলাম। ধীরস্থির হয়েই জানতে চাইছি আমাকে শুরুতেই অসামাজিক ট্যাগ দিলেন কেন?”
টুকটুকি যেন উত্তেজিত হয়ে প্রত্যুত্তর না করে তাই সঙ্গে যোগ করল,
“আশা করছি আপনিও উল্টোপাল্টা আচরণ না করে ধীরস্থির হয়েই উত্তর দেবেন।”
টুকটুকি যেন বেকায়দায় পড়ে গেল। এমন সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবে ঘূনাক্ষরেও যদি বুঝত ভরা পেটে জোর করে খেতে বসত না। নিশীথের স্থির দৃষ্টি তার পানে। চোখে চোখ রাখতেই টুকটুকি আরেকটু জড়োসড়ো হয়। সেই তেজটা সঞ্চার করার চেষ্টা করেও কেন যেন পারছে না? এ কী তার অবক্ষয় নাকি রাতের মহিমা? নির্জন রাত যেন ইচ্ছে করেই সকল তেজ হরন করে প্রকৃতিকে শান্ত রাখতে চাইছে। টুকটুকি আমতা আমতা করে বলল,
“আপনিও তো আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন। আমি যেহেতু সেসব কথা তুলছি না আপনি কেন তুলছেন?”
“উহুম, আপনি আজ রাতেই কিন্তু আমাকে আবারো অসামাজিক শব্দটার প্রলেপ দিয়েছেন। এবং প্রথমদিন থেকে শুরুটা আপনিই করেছিলেন। আমি কোনোরূপ তর্কে না গিয়ে শুধু কারণটা জানতে চাইছি। দুজন ম্যাচিওর মানুষ এই রাতের বেলা বাচ্চাদের মতো আর্গুমেন্ট করাটা সমীচীন নয়।”
যুক্তিযুক্ত কথা। ইতিমধ্যে দুজনের খাওয়া শেষ। নিশীথ নিজের হাতেই সবটা গুছিয়ে নিল। পূর্বাকাশে শুকতারাটি মিটমিট করে জ্ব’লছে। আঁধার ধীরে ধীরে তার ঘনত্ব হারাচ্ছে বুঝি! টুকটুকি জানালা দিয়ে পূর্বাকাশ দেখে। নিশীথ হাত ধুয়ে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। বলে,
“কী বলবেন না? নাকি উত্তর আপনারই অজানা?”
টুকটুকি ফিরে তাকায়। নিশীথের পরনে কালো রঙের পোলো শার্ট। দুহাত ভাজ করে বুকে গোজা। দৃষ্টি তার মুখেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। টুকটুকি বাতাসে একটা অন্যরকম সুবাস পায়। পুরুষালি স্নিগ্ধতা ভর করে ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে। টুকটুকি বলে,
“আপনার সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখাটা কীভাবে হয়েছিল বলুন দেখি।”
নিশীথ ক্ষণকাল ভাবল। এরপর উত্তর দিল,
“নিপার বিয়ের দিন, মা ডেকে সামনাসামনি পরিচয় করাল…”
“পরিচয় আদৌ হয়েছিল?”
“হ্যাঁ কিন্তু পামকিন হঠাৎ দৌড় দিল যে আমাকেও ওর পেছনে ছুটতে হলো।”
“কারেক্ট! আপনি একজনের সঙ্গে পরিচিত হতে এসে তাকে উপেক্ষার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুমদাম করে চলে গেলেন।”
“ওয়েট, আপনি সেজন্য আমায় অসামাজিক, নাক উঁচু, অহং’কারী আখ্যা দিয়ে বসে আছেন?”
“এরচেয়ে ভালো শব্দ থাকলে দিয়ে কৃতার্থ করুন।”
নিশীথ কপাল চাপড়ে উঠল। বলল,
“ইয়া আল্লাহ! সেদিন তো বিশাল খাবারের আয়োজন হওয়ায় বাড়ির আশেপাশে প্রচুর স্ট্রিট ডগ ঘোরাঘুরি করছিল। পামকিন তাদের দ্বারা আহ’ত হতে পারে বলে কোল থেকেই নামাইনি সেদিন। তখন ছুটে যাওয়ায় তড়িঘড়ি করে ধরতে গিয়েছিলাম।”
“লেইম!” টুকটুকির কণ্ঠে শ্লেষের সুর। কথাটা তার যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। নিশীথ বলল,
“বিশ্বাস না হলে আপনার আন্টিকে জিজ্ঞেস করবেন। তিনি নিজেই এর আগে পামকিনকে কু’কুরের আ’ক্র’মণ থেকে বাঁচিয়েছে। ও আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আদুরে সদস্য।”
“যাওয়ার সময় অন্তত সৌজন্য দেখিয়ে যাওয়া যেত৷ আচ্ছা সেটা নাহয় বাদ দিলাম ফিরে এসে কথা বলা যেত না?”
“নিজের বাড়িতে বিয়ে, কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর যখন এসে কথা বলব ততক্ষণে আপনার এবং আপনার বন্ধুবান্ধবদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি অবগত হয়ে গেছিলাম। সো বুঝতেই পারছেন…”
টুকটুকি যে উত্তরে সন্তুষ্ট নয় সেটা তার অভিব্যক্তিই স্পষ্ট জানিয়ে দিল। পায়ের কাছে নরম কিছুর অস্তিত্ব পেয়ে নিশীথ নিচু হলো। পামকিন ঘুম ভেঙে মালিকের কণ্ঠস্বর শুনেই ছুটে এসেছে। নিশীথ তাকে কোলে তুলে চুমু খেয়ে বলল,
“আমাদের কথা আর না বাড়ানোই উচিত। দুই কথা বাদেই ঝ’গড়া বাধিয়ে বসবেন। রাতের বেলা উচ্চবাচ্য হলে মায়ের ঘুম ভাঙতে সময় লাগবে না।”
“আমি ঝ’গড়া বাধাই?” টুকটুকি ছ্যাঁত করে উঠল। নিশীথের ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি খেলে গেল তা দেখে। যাওয়ার আগে বলে গেল,
“ঝ’গড়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঘুম উপকারী। এখন আপনি কোনটা চুজ করবেন আপনার ব্যাপার। আমি উপকারের পথেই হাঁটছি।”
______________
সকাল দশটা বাজতেই রিতা আন্টির বাড়ি গমগম করে উঠল। টুকটুকির কাছে খবর পেয়ে দিগন্ত, অনুভব, নন্দিনী ফুলের তোরা ও ফলমূল নিয়ে চলে এসেছে রিতা আন্টিকে দেখতে। বলাবাহুল্য বিয়ের দিন এই মিশুক মানুষটাকে ওরা সবাই খুব পছন্দ করেছে। টুকটুকির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা থাকায় ওরাও খবর পেয়ে চলে এলো। রিতা আন্টিও তাদের পেয়ে খুশি হলেন। তবে ফুল ও ফলমূল দেখে কপট রাগের ভান করে বললেন,
“তোমরা সব দেখি আমায় আইসিইউ-এর রোগী বানিয়ে দিলে! আমার ততটাও গুরুতর কিছু হয়নি।”
নন্দিনী প্রশস্ত হেসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“আরে আন্টি আপনি যেন আইসিইউতে যাওয়ার মতো অসুখ না বাধান তাই আগে থেকে প্রতিরোধ করতে এসব খাবেন।”
রিতা আন্টি হাসলেন। বললেন,
“তোমাদের সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। আজ সারাদিন থাকবে কিন্তু।”
ওরা সবাই ড্রইংরুমে বসল। পামকিনকে হাতের নাগালে পেয়ে দিগন্ত ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়৷ অনুভবও তাকে চুমু খায়। নন্দিনীর কু’কুর বিড়ালের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ নেই। তাই পামকিন তার দিকে আদর খাওয়ার জন্য আশাবাদী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকলে নন্দিনী ওর কানে একটা টোকা দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছুই করল না। দিগন্ত গদগদ হয়ে বলল,
“দোস্ত আমার একটা বিড়াল পালার ইচ্ছে হচ্ছে।”
নন্দিনী ঠোঁট বেঁকিয়ে আস্তে করে বলল,
“তুই ওইডাই পালতে পারবি। গার্লফ্রেন্ড তো আর পালতে পারবি না। পারবি কেমনে? মাইয়ারা তোরে পাত্তা দিলে তো।”
“আমার গার্লফ্রেন্ড পালার শখও নাই। তোমারে দেইখা মাইয়া জাতির উপর থেকে এমনিতেই বিশ্বাস উঠে যাইতেছে।”
নন্দিনী রহস্যময়ী একটা হাসি দিয়ে বলল,
“আমি তো অন্য গন্ধ পাই মামা।”
“কী?” দিগন্ত ভ্রু কুচকায়। অনুভব ও টুকটুকিও আগ্রহে তাকায়। নন্দিনী বলে,
“সেই ফার্স্ট ইয়ার থাইকা দেখতাছি তোর মাঝে মাইয়াগো দেইখা কোনো মুগ্ধতা নাই। একটা ক্রাশও জীবনে খাস নাই। দোস্ত, তোর কী পোলাগো উপরে ক্রাশ?”
কথাটা বুঝতেই দিগন্ত বি’স্ফো’রিত দৃষ্টিতে তাকায়। অনুভব নাটকীয় ভঙ্গিতে দুহাত আড়াআড়িভাবে বুকের ওপর বিছিয়ে আব্রু ঢাকার চেষ্টা করে বলে,
“দোস্ত সত্যি?”
দিগন্ত অনুভবের পিঠে সজোরে ঘু’ষি দিল। নন্দিনীর চুল টেনে ধরে বলল,
“তোর চুল আজ একটাও মাথায় রাখব না।”
টুকটুকি বিরক্ত হয়ে দিগন্ত ও নন্দিনীকে সরিয়ে ওদের মাঝে বসে বলল,
“বেড়াতে এসে কীসব করছিস? আমার মানসম্মান রাখবি তো নাকি?”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে গেল। দিগন্ত চোখ দিয়ে নন্দিনীকে হু’মকি দিল পরে দেখে নেবে। নন্দিনীও ঠোঁট বেঁকিয়ে বোঝাল সে পাত্তা দেয় না। রিতা আন্টি কাজের মেয়ের সঙ্গে রান্নাঘরে নাশতার তোড়জোড় দেখছিলেন। এদিককার গোলযোগ শুনলেও কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে তা বুঝলেন না। কিন্তু এই উচ্ছ্বাস, প্রাণবন্ত পরিবেশ, হাসি, মজা উনার কাছে ভালো লাগল। মনে হলো বাড়িটা যেন উজ্জীবিত হচ্ছে।
ভোর পাঁচটায় ঘুমিয়েছে বলে নিশীথ বেলা দশটা বাজেও বিছানাতেই নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল। হঠাৎ হইচই-এর শব্দ পেয়ে তার ঘুম ভাঙল। চোখ ডলে করিডরে আসতেই দেখল তার মা একদল ছেলে-মেয়ে নিয়ে গল্পগুজব করছেন। টুকটুকি সবার আগে নিশীথকে দেখল। রিতা আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আন্টি, তোমার অ-ছেলে উঠে গেছে।”
নন্দিনীও সেদিকে দৃষ্টিপাত করল। ক্ষীণ সুরে বলল,
“দোস্ত, সেদিন তো খেয়াল করি নাই। পোলা তো জোস!”
কথাটা শ্রবণ করে টুকটুকি চাইল ওর দিকে। নন্দিনীর চোখের মুগ্ধতা কেন জানি ওর মনে সুক্ষ্ম হুল ফোটাল।
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১১]
নিশীথের উপস্থিতিতে বন্ধুদের আড্ডায় একটু ভাটা পড়েছে। ইতিপূর্বে লোকটার সঙ্গে টুকটুকির ঝামেলার বিষয়টা তারা অবগত। তবুও সকলে একটু স্বাভাবিকভাবেই রইল। রিতা আন্টি নিশীথকে দেখে বললেন,
“উঠে গেছিস! দেখ না, সামান্য অসুস্থতার খবর পেয়ে ছেলেমেয়েগুলো ছুটে এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে।”
“দেখতেই পাচ্ছি। আমি ছাড়া এখন তোমার অনেক কাছের মানুষ হয়েছে।” টুকটুকিকে আড়চোখে দেখতে দেখতে গম্ভীর স্বরে কথাটা বলল নিশীথ। হলুদ রঙের কূর্তির আবরণে সজ্জিত খোলা চুলের মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
রিতা আন্টি হেসে বললেন,
“দেখ ছেলের হিং-সে! আয়, বোস ওদের সঙ্গে। আমার দুপুরের রান্না চুলায়। না খেয়ে কেউ যেতে পারবে না, খবরদার!”
অনুভব বলল, “এসেই তো কতকিছু খেয়াল আন্টি। আপনি দয়া করে অসুস্থ শরীর নিয়ে আর রান্নাঘরে যাবেন না।”
নিশীথ বলল, “আমি বাইরে থেকে অর্ডার করে আনিয়ে দেব। তোমায় আ’গুনের তাপে যেতে হবে না।”
“বাইরের কোনো খাবার আমার বাড়িতে ঢুকবে না বলে দিলাম। বরং রান্না করলে আমার মন ভালো থাকে। তোরা গল্প কর। আমি যাই।”
রিতা আন্টি চলে গেলে টুকটুকি ঠোঁট টিপে হেসে নিচু গলায় বলল,
“সবে তো ব্রেকফাস্টের পর্ব শেষ হলো। এরপর আন্টি ব্রাঞ্চ করাবে, তারপর লাঞ্চ। রাত অবধি আর কিছুই খেতে হবে না।”
“কি সাংঘাতিক!” নন্দিনী আঁতকে ওঠে।
পেটুক দিগন্ত ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এখন থেকে তাহলে এখানেই আড্ডা দিতে আসতে হবে দেখছি।”
নিশীথ নিগূঢ় চোখে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে বসল ওদের উল্টো দিকের সোফায়। সকলের মাঝে স্তিমিতভাব লক্ষ্য করে বলে,
“আমার উপস্থিতিতে আপনারা বিব্রতবোধ করছেন মেবি!”
“নাহ তেমন কিছুই না।” টুকটুকি প্রত্যুত্তর করল।
দিগন্ত ভদ্রতাসূচক হাত বাড়ায় নিশীথের দিকে। বলে,
“হেই ব্রাদার! আমি রায়হান দিগন্ত। নাইস টু মিট ইউ!”
নিশীথ হাত মেলায়। নিজের ব্যক্তিত্বঠাসা কাষ্ঠ স্বরে উত্তর দেয়,
“নিশীথ মাহমুদ। নাইস টু মিট ইউ টু!”
অনুভবও হ্যান্ডশেক করে বলে,
“আমি অনুভব হাসান। টুকটুকির বাচ্চাকালের বন্ধু।”
কথাটা শুনে নিশীথ টুকটুকির দিকে তাকায়। দৃষ্টিবদল হতেই দুজনে চোখ ফেরায়। ওদের হাত মেলাতে দেখে এবার নন্দিনীও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কোল থেকে হাত ওঠানোর আগেই টুকটুকি তা ধরে ফেলল। নন্দিনী সরু চোখে প্রত্যক্ষ করে ওর বিব্রত মুখখানা। এরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,
“আমি নন্দিনী। নবাব নন্দিনী নই, গরিবের নন্দিনী। আপনার সাথে আগে একবার আমার কথা হয়েছে।”
নিশীথ মৃদু মাথা নাড়ল। যদিও ওরা তার মাকে দেখতে এসেছে। তবুও ওদের দেখে নিশীথ একটু বিরক্ত বটে। বিয়েতে এসে বিস্তর হাসি, তামাশা করে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। নিশীথ সব জেনে যাওয়া সত্ত্বেও আবার নির্লজ্জের মতো বাড়ি চলে এসেছে। হ্যাঁ, নিশীথের কাছে ওদের একটু নির্লজ্জই মনে হলো। সে কাজের কথা বলে উঠে গেল। যেতে যেতে চোখ ঘুরিয়ে টুকটুকির দিকে একটা কটাক্ষের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেও ভুলল না। সেই চাহনি টুকটুকির নজর এড়াতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতর কিছু একটা বিঁ’ধল যেন। যা থেকে থেকে তাকে খোঁ’চাতে থাকে।
চারবন্ধু হইহই করে দুপুরের খাবার খেয়ে রিতা আন্টির বাড়ি ত্যাগ করল। তখন রোদেলা দুপুর দুহাত বাড়িয়ে বিকেলকে আহ্বান জানাচ্ছে। স্বচ্ছ আকাশের কোল ঘেঁষে উড়ে বেড়াচ্ছে বাউণ্ডুলে মেঘের দল। বন্ধুরা টুকটুকির বাড়িতে বসে আড্ডা দিল প্রায় ঘন্টাখানেক। এরপর বিদায় নিল। একলা বিকেলে টুকটুকির মনে থেকে থেকে নিশীথের সেই তীর্যক চাহনিটাই ঘুরছিল। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। টুকটুকি রিতা আন্টির বাড়ি যাওয়ার একটা বাহানা খুঁজল। কিছুক্ষণ ইতিউতি করে পেয়েও গেল। যদিও নড়বড়ে কিন্তু আপাতত কাজ চালানোর মতো। অতঃপর মিস হুমায়রা হক আবারো পা বাড়াল নিশীথদের ভূত বাংলোয়।
________
গতরাতে মায়ের অসুস্থতার সংবাদে অনেকটা ঘোরগ্রস্তের মতো চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি এসেছে নিশীথ। ফলে অফিসে ছুটি নেওয়া হয়নি। তাই প্রথমেই অফিসে একটা সিক লিভের ইমেইল করে দিয়েছে। এরপর মায়ের ঔষধ পত্রের হালচাল করতে চলে গেছিল ফার্মেসি। ফিরে আসতেই রিতা রুষ্ট গলায় বললেন,
“বাড়িতে মেহমান এলো, অথচ তুই তাদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বললি না? কী ভাবল ওরা?”
নিশীথ ঢকঢক করে পানি পান করে বলল,
“ওরা বেশিক্ষণ কিছু ভাবে বলে তো মনে হয় না। কাজেই চিন্তা কোরো না।”
“কত দিনের জন্য এসেছিস?”
“আগামীকাল তোমাকে ডাক্তার দেখিয়েই চট্টগ্রামের পথে রওনা হব।”
“এইটুকুন আসার কী আর দরকার ছিল? মে’ডি’সিন যা দরকার আমিই আনিয়ে নিতে পারতাম। টুকটুকি ঠিকই বলে, তুই আমার অ-ছেলে।”
নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল,
“ওই মেয়েটার সঙ্গে মেলামেশা করে তুমিও বাজে ব’কা শুরু করে দিয়েছ!”
রিতা অভিমান করে বললেন,
“মোটেও বাজে ব’কে না ও। তোর সঙ্গ টুকু ওই পরের মেয়েটাই মিটিয়ে দেয় বুঝেছিস!”
“তুমি আমার রিপ্লেসমেন্ট পেয়ে গেছ?” নিশীথের চোখেও অভিমানের দ্যুতি খেলে যায়।
“উহুম একাকিত্বের সঙ্গী পেয়েছি।”
নিশীথ এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
“সব ঠিক থাকলে নতুন মাসের শুরুতেই তোমার ঘরের ছেলে একেবারে ঘরে ফিরে আসবে। শুধু দোয়া করো।”
_________
টুকটুকি এসে সদর দরজা খোলা পেল। বাড়িতে ঢুকতেই দেখল নিশীথ সোফায় বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কাজে ডুবে আছে। পরনে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি, মাথার চুল অবিন্যস্ত। মিঠে বিকেলের আলোয় তার এই অগোছালো বেশটা বেশ মনোরম দেখায়। টুকটুকি ভ্রু কুচকে ভাবল এই লোক কী বাসায় পাঞ্জাবি পরে থাকে! তখনই নিশীথের শাণিত দৃষ্টির কবলে পড়ল তার মুখখানা। টুকটুকি আমতা আমতা করে বলল,
“চুলের ব্যান্ড নিতে এসেছিলাম। রাতে খুলে রেখে গেছি, আর মনে নেই।”
নিশীথ হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। টুকটুকি রিতা আন্টির সঙ্গে অহেতুক কিছু কথা বলে আবারও ফিরে এলো। নিশীথ একই ভঙ্গিতে বসে ল্যাপটপে একাধারে কিছু করে যাচ্ছে। টুকটুকি পাশে এসে বলল,
“শুনুন।”
নিশীথ মাথা তুলতেই আবার বলল,
“আপনার উচিত আন্টির সঙ্গে থাকা। এখানে থাকা পসিবল না হলে আন্টিকে সঙ্গে করে চট্টগ্রাম নিয়ে যান। বিপদ আপদ ঘটতে কতক্ষণ! নিজের মানুষ থাকলে ভরসা।”
নিশীথ মাথা নাড়ল, “হুম, খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা করে ফেলব। থ্যাংকস ফর ইয়োর কনসার্ন।”
এরপর আবারো নিরবতা। টুকটুকি সকালের সেই চাহনিটার কারণ নিয়ে কথা তোলার মতো বিষয় না পেয়ে উশখুশ করে বিরস মুখে চলে যাচ্ছিল। তখনই নিশীথের কণ্ঠস্বর তার গতিরোধ করল,
“মিস হুমায়রা, কিছু বলবেন কি?”
টুকটুকি ফিরে তাকায়। নিশীথের শান্ত শীতল চাহনি তার ওপরই নিবদ্ধ। সেই সুগভীর চাহনি যেন চোখ ছুঁয়ে অন্তরে পৌঁছে যাওয়ার মতো গহীন। টুকটুকি একটু এলোমেলো হলো। ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বলে বসল,
“বলতে চাইছিলাম, আপনি আমাকে টুকটুকি না ডেকে হুমায়রা ডাকেন কেন?”
নিশীথ দাঁত দ্বারা ওষ্ঠ চেপে ক্ষীণ বিদ্রুপাত্মক হাসি আটকায়।
“ওহহ আপনি এটা জানতেই এসেছিলেন?”
টুকটুকি থতমত খেয়ে গেল। মনে হচ্ছে ওই চোখের সামনে সে স্পষ্টই ধরা পড়ে গেছে। নিভন্ত মুখটাকে জ্বলন্ত করার চেষ্টায় তেজের সঙ্গে বলল,
“মোটেও না! চলে যাচ্ছিলাম, আপনি ডাকলেন বলেই কৌতুহল বসত জানতে চাওয়া।”
নিশীথ বুঝতে পেরেছে এমন ভাবে মাথা নেড়ে বলল,
“টুকটুকি বলতে গিয়ে টিকটিকি বলে ফেলার সম্ভাবনা আছে। প্রায় সিমিলার ওয়ার্ড কি-না! তখন আবার আপনার মাথায় শর্টসার্কিট হবে। তাই হুমায়রা-ই ঠিক আছে।”
মনে হলো কেউ জ্ব’লন্ত আ’গুনে খুব দরদ মিশিয়ে ঘি অর্পণ করল। ঘি হোক কিংবা দরদ, টুকটুকির সর্বাঙ্গে তপ্ততা ছড়াতে সময় লাগল না। তার আদরের নামকে এহেন বিদ্রুপ! ক্ষো’ভের বশে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আর আপনি ইলেকটিরি মিস্তিরি হসুইন্যা… থুক্কু মাহমুইদ্যা।”
নিশীথ যারপরনাই হতভম্ব। ট্রিপল ই-তে পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হয়ে কিনা শুনতে হচ্ছে ইলেকটিরি মিস্তিরি! সঙ্গে মাহমুইদ্যা! নামের কী অধঃপতন! মুখ কুচকে গম্ভীর গলায় বলল,
“বলেছিলাম না মাথায় শর্টসার্কিট হবে। নেভার মাইন্ড। ইলেকটিরি মিস্তিরিরা ভালোমতো শর্টসার্কিট সারাতে জানে। আর আপনি তো প্রতিবেশী। বিনামূল্যে সারিয়ে দেব।”
যেচে পড়ে অপমানিত হতে আসায় রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো টুকটুকির। প্রত্যুত্তরে যুতসই বাক্য না পেয়ে অপমানে তার চোখ ছলছল করে উঠল। দৃষ্টি লুকাতেই সে তড়িৎ প্রস্থান করল।
চলবে…