শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-০৯

0
314

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৯]

অনুভব অবাকতার রেশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোরা একে অপরকে আগে থেকে চিনিস?”

নন্দিনী ঠোঁটের কোণা কাম’ড়ে দেখছে পায়েলকে। উত্তরটা পায়েল দিল,
“আমরা তো প্রতিবেশী। ছোটো থেকে আপুদের পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশেই বড়ো হয়েছি।”

ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার বুকে বিস্ময় ছড়িয়ে ওরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এরপর তাকাল নন্দিনীর দিকে। নন্দিনী বলল,
“তাই সেইদিন চেনা লাগতাছিল। স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে দেখছিলাম বইলা পরিণত চেহারাটা ঠাহর করতে সময় লাগছে। কেমন আছিস?”

“ভার্সিটি এসে তোমার দেখা পাব ভাবিনি। কতদিন পর দেখলাম তোমায়। সেই যে বাড়ি ছাড়লে! আর ফিরলে না। কাকিমনি তোমার জন্য রোজ কান্নাকাটি করে করে অন্ধ হওয়ার যোগাড়। তুমি খুব নি’র্দয়।”

নন্দিনী কোনো উত্তর দিল না। এ নিয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছুকও নয় সেটা বন্ধুরা স্পষ্টই বুঝল। অনুভব বলল,
“দেখা হলো, আলাপ অনেক হবে। এখন চলো কোথাও বসি।”

টুকটুকি বলল,
“শিকু পায়েলকে নিয়ে আগে যা, আমরা পেছনে আসছি।”

পায়েল আরো অনেককিছু বলতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু অনুভব যে নন্দিনী আপুর বন্ধু এবং তার সঙ্গে সে দেখা করছে, কথা বলছে তা খেয়ালে আসতেই কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেল সে। নন্দিনী অভয় দিয়ে বলল,
“পরে কথা হবে। যা তোরা।”

পায়েল অনুভবের সঙ্গে পা বাড়ায়৷ টুকটুকি, দিগন্ত ও নন্দিনী রয়ে গেল। টুকটুকি নন্দিনীর কাছে এগিয়ে আসে। বলল,
“বাড়ির কথা মনে পড়ে না তোর?”

“সত্যি কইতাম?”

“সত্যিটাই জানতে চাই।”

“একটুও মনে পড়ে না।”

টুকটুকি ব্যথির নয়নে তাকায়। দিগন্ত বলে,
“তুই এত পা’ষাণ কী করে? একটুও মায়া নেই?”

নন্দিনী মাঝে দাঁড়িয়ে দুহাতে দুজনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে দিগন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মায়া না থাকলে কী তোর মতো ভেড়ার লগে বন্ধুত্ব করি? পাষাণ হইলে লা’ত্থি খাইয়া কবেই মাজামুজা ভাইঙ্গা ফালাইতি!”

“তুই শুধরাবি না!”
_______________

বন্ধুদের বিদায় দিয়ে টুকটুকির বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গেছে। সবে বাড়িতে পা রেখেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভাসল রিতা আন্টির নাম। টুকটুকির কপালে একাধিক সমান্তরাল ভাজ উদিত হয়। ফোন রিসিভ করতেই বুঝতে পারে এটা রিতা আন্টির কণ্ঠস্বর নয়। বাড়ির কাজের মেয়েটা ভীত, স’ন্ত্র’স্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“আপা, আপা, রিতা খালার শ্বাসকষ্ট উঠছে। হাসপাতালে নেওন লাগব। আমি কিছু বুঝতাছি না আপা।”

টুকটুকি সচকিত হয়। চিত্তে ছড়ায় চঞ্চলতা। সে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
“ঘাবড়িয়ো না। এক্ষুণি ইনহেলার দাও আন্টিকে। আমি আসছি।”

টুকটুকি সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই ছুট দিল সামনের বাড়িটায়। বাসায় ঢুকে দেখল রিতা আন্টির অবস্থা বেগতিক। তিনি বুকে হাত রেখে হাঁ’সফাঁ’স করছেন। চোখ উল্টে যাচ্ছে। ভয়ে টুকটুকির অবস্থা হলো কেঁদে ফেলার মতো। কাজের মেয়েটিকে ধ’মকে বলল,
“ইনহেলার দাওনি কেন?”

“ইনহেলার শেষ!”

টুকটুকির মাথায় যেন ব’জ্রা’ঘাত হয়। রিতা আন্টি আঙুল তুলে নিশীথ নিশীথ করে কিছু বলছেন। শ্বাসনালীর বায়ু চাপে তা শোনায় হাওয়ার মতো ফ্যাসফ্যাসে। টুকটুকি এক মুহূর্তে দেরি না করে কাজের মেয়েটির সাহায্যে রিতা আন্টিকে বাড়ি থেকে বের করে এলাকার নিকটস্থ ক্লিনিকে নিয়ে ইনহেলার দিতেই ধীরে ধীরে তিনি শান্ত ও নিস্তেজ হয়ে এলেন। টুকটুকি শান্ত হয়ে কাজের মেয়েটিকে বলল,
“ইনহেলার শেষ আগে খেয়াল রাখবে না? দেখো কী একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো!”

“আমি কী এতো বুঝি? প্রত্যেকবার ভাইজান এইসব তদারকি করে। আমি খালি বাংলা লেখা দেইখা সময়মতো ঔ’ষধ দেই। এইবার ইনহেলার শেষ হওয়ার পর খালা ভাইজানরে জানাইতে ভুইলা গেছে। আর আনা হয় নাই। খালার শ্বাসটান উঠলে কি করমু না বুইজ্জা লগে লগে ভাইজানরে কল দিছিলাম। ফোন ধরে নাই। পরে আপনেরে দিছি।”

টুকটুকির ভেতরে ক্ষো’ভ জমল। একটা মানুষকে ভূতের মতো বাড়িতে একা ফেলে রেখে এ কেমন অবহেলা! যদি টুকটুকির ফোন এখন বন্ধ থাকত! কিংবা কোনো কারণে সে দূরে থাকত! রিতা আন্টির অসহায়ত্ব টুকটুকির কোমল মনে সহানুভূতির জোয়ার তোলে। সে রে’গেমেগে রিতা আন্টির ফোন থেকে নিশীথকে কল দিল। এবার অবশ্য ফোন রিসিভ হলো। নিশীথ ক্লান্ত স্বরে বলল,
“হ্যাঁ মা, বলো।”

টুকটুকি খ্যাক করে উঠল,
“আগেরবার আপনি ফোন কেন ধরলেন না?”

মায়ের স্থানে অপরিচিত এক নারীর রো’ষাগ্নি বাক্য শ্রবণ করে নিশীথ ভড়কে গেল। বলল,
“আপনি কে? মা কোথায়?”

“তার আগে আপনি বলুন ফোন কেন ধরলেন না?” টুকটুকির গলা চড়ে গেল। অবস্থা বেগতিক বুঝে নিশীথ বলল,
“মিটিংয়ে ছিলাম তাই…”

“রাত বিরেতে কীসের মিটিং চলে আপনাদের যে দূরে মাকে ফেলে রেখে প্রয়োজনে কলটাও ধরতে পারেন না?”

“দরকারি মিটিং ছিল বলে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। প্রয়োজনটা বলতে এখন আপনি কেন বিলম্ব করছেন? কে আপনি? আমার মা কোথায়?”

“আপনার মা এখন ক্লিনিকে। ক্লান্ত, বি’ধ্ব’স্ত মুখে শুয়ে আছেন। একটা আপন মানুষ নেই সঙ্গ দেওয়ার।”

“ক্লিনিকে মানে? কী হয়েছে মায়ের?” নিশীথের কণ্ঠে উৎকন্ঠা ঝরে পড়ে।

“আপনি শুধু একটা অসামাজিকই নন, একটা অ-ছেলেও। আপনার মাঝে বিন্দুমাত্র দায়িত্বশীলতা নেই। একটা মানুষকে একা বাড়িতে ফেলে সবসময় দূরে পড়ে আছেন। ফোন করেও সঠিক সময় পাওয়া যায় না। একটা ইনহেলার শেষ সেই খবরটাও রাখেননি। অথচ আন্টি অসুস্থতার মাঝেও আপনার নামটা ভোলেনি। কখনো ভেবেছেন খালি বাড়িতে আন্টির কতকিছু হয়ে যেতে পারে? এত কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন কী এই দিন দেখতে?”

বলতে বলতে টুকটুকির কণ্ঠটা ভিজে গেল। শেষের কথাগুলো শোনাল কাঁপা কাঁপা। নিশীথ তা স্পষ্ট টের পেল। অসামাজিক শব্দটা শুনেই বুঝেছে মেয়েটা কে। মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা এবং অ’প’রা’ধবোধেই কিনা, এই প্রথম নিশীথ নরম সুরে টুকটুকির সঙ্গে কথা বলল,
“হুমায়রা, আপনি কী এখন মায়ের পাশে আছেন?”

“আছি।”

“প্লিজ থাকুন। আমি এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি।”

“আসতে হবে না আপনাকে। দরকারের বেলায় নেই, অদরকারে আসবেন আহ্লাদ দেখাতে। আপনার নামের আগে পৃথিবীর সব অ জুড়ে দেওয়া উচিৎ।”

টুকটুকি ফোন কে’টে দিল। দেখল রিতা আন্টি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। টুকটুকি একটু বিব্রত হলো সেই চাহনির সামনে। রিতা আন্টি বললেন,
“তুই আমার ছেলের সঙ্গে এভাবে ধমকে কথা বললি?”

রিতা আন্টি এই প্রথম টুকটুকিকে তুই সম্বোধন করল। টুকটুকির সেই শব্দ কি যে আপন লাগল! সেও আপনি থেকে তুমিতে নেমে গাল ফুলিয়ে বলল,
“ছেলে না, ওটা তোমার অ-ছেলে।”

চলবে…