সংসার পর্ব-০৬

0
290

#সংসার
#Bobita_Ray
পর্ব- ০৬

অনুপমা, রূপায়নের হাতদুটো নিজের গালে চেপে ধরল। ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল,
-‘যে কোন পরিস্থিতিতে আমরা দুজন দুজনের পরিপূরক হয়ে থাকব। এত তুচ্ছ কারণে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না।

রূপায়ন, অনুপমাকে বুকে টেনে নিল। জড়িয়ে ধরে রইল অনেকক্ষণ। এতগুলো বছর পর মানুষটা নিজের কথা ভেবেছে। ভাইবোন গুলোর কী উচিৎ ছিল না! মানুষটার স্ত্রীকে সসম্মানে মেনে নেওয়া?

-‘অনুপমা?
-‘বলুন?
-‘ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, ঘরে বসে থাকো। আমি রাতের খাবার নিয়ে আসি!
-‘খাবার আনতে হবে না। আসার সময় টিফিনবাক্সে করে দিদি রাতের খাবার দিয়ে দিয়েছে।
-‘ওহ। তুমি চেঞ্জ করে নাও তাহলে!
রূপায়নের ঘরে আলাদা বাথরুম নেই। অনুপমার খুব লজ্জা লাগছে। রূপায়ন বুঝতে পেরে হেসে দিল। বলল, ‘আমি বেলকনিতে যাচ্ছি।’
রূপায়ন বেলকনিতে গিয়ে ফোনে একটা নাম্বার ডায়াল করে, কানে চেপে ধরল। ফোনটা রিসিভ হতেই অভিযোগের সুরে নারীকণ্ঠ বলে উঠল,
-‘এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল রুপ? তোরা তো আমাকে ভুলেই গিয়েছিস।
-‘ফুল পিসি কেমন আছো?
-‘আছি কোনরকম। তোদের কী অবস্থা?
রূপায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘আর আমাদের অবস্থা। তুমি এখন কোথায়? কোলকাতা না ঢাকা?
-‘গত সপ্তাহে ঢাকা এসেছি। কেন রুপ?
-‘কাল একবার আমাদের বাড়ি আসতে পারবে পিসি?
-‘তোর মা তো আমার যাওয়া পছন্দই করে না। আমি না কী, তোর বিয়ের কথা বলে বলে কান ভাঙাই। মহিলা সবকয়টা ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। শুধু বড়ছেলেটার বিয়ের কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। শুনতে পারবে কেন! বড়ছেলেটার ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খেতে খেতে স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে।
রূপায়ন ইতঃস্তত করে বলল,
-‘পিসি আমি বিয়ে করেছি।
পিসি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
-‘সত্যি রুপপ…?
-‘হ্যাঁ গো।
-‘কবে, কখন, কীভাবে?
রূপায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সংক্ষেপে বলল।
ফুলপিসি শুনে বলল,
-‘একেকটা বদের হাড্ডি। বিয়ে করেছে শুনে কোথায় খুশি হবে, আমদ ফূর্তি করবে। তা না! বদমায়েশ গুলো উল্টো ঝগড়া করেছে। তুই কোন চিন্তা করিস না রুপ। আমি কাল সকালেই পৌঁছে যাব। বৌমা কোথায়? তাকে দে? একটু কথা বলি!
রূপায়ন ফোনটা কান থেকে নামিয়ে আস্তে করে অনুপমাকে ডাকল। বলল,
-‘হলো তোমার? পিসি কথা বলবে!
অনুপমা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। ইশারায় মাথা নেড়ে বলল, হয়নি৷ অনুপমা ফোনটা কানে ধরে, আস্তে করে বলল,
-‘নমস্কার পিসিমনি কেমন আছেন?
-‘বাহ্ ভারি মিষ্টি কণ্ঠ মা তোমার। আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছো?
-‘ভাল আছি।
-‘আমাদের রুপটা অনেক ভাল ছেলে মা। ওকে কখনো কষ্ট দিও না। অনেক অনেক ভালোবেসো আর আগলে রেখো। শোন, বৌমা?
-‘বলুন পিসিমনি?
-‘আজ কিন্তু কালরাত্রি। রুপের কাছে যা শুনলাম! তোমাদের আলাদা ঘরে শোবার মতো পরিস্থিতি নেই। তবে এক বিছানায় শোবার দরকার নেই। আমি রুপকে বলে দেব। ও নীচে ঘুমাবে। আর ওর সামনে বড় করে ঘোমটা টেনে রেখো! শুধু আজকের রাতটা।
অনুপমা লজ্জা পেল। আস্তে করে বলল,
-‘আচ্ছা।
-‘দাও.. রুপকে ফোনটা দাও?

বসার ঘরে নন্দিতাদেবী থমথমে মুখে বসে আছে। নিপা মাকে মুখে যা আসছে তাই বলছে। দিপা বলল,
-‘এখনো কিচ্ছু দেরি হয়নি মা। বড়দাভাইয়ের রাশটা শক্ত করে টেনে ধরো। ওই মেয়েটা সংসার করার ধান্দায় না কিসের ধান্দায় বড়দাভাইকে বিয়ে করেছে, কে জানে! একদিনেই আমাদের বড়দাভাই কেমন পর হয়ে গেল! দেখলে মা তুমি?
রুপা বলল,
-‘কাল ভুলেও বউভাতের রান্না কেউ রাঁধবানা বলে দিলাম। তোমার বড়ছেলের খুব তেল হয়েছে। একা একাই বউকে রান্না করে খাওয়াবে, দেখি কেমন পারে।
অরুপ নাক ছিটকে বলল,
-‘ওই মেয়েটা কী এই বাড়িতেই থাকবে না কী?
দিপা রাগে চিড়বিড় করে বলল,
-‘না। ওই মেয়েকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েটা দেখতে কেমন কেউ দেখেছিস?
সীমা ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘না। মুখ দেখা যায়নি। হবে আর কেমন, দাদাভাইয়ের মতোই বুড়োধাড়ি হবে হয়তো।
নন্দিতাদেবী বলল,
-‘আহ তোরা থামবি? আমার আর ভাল লাগছে না। ছেলেটা কিছু খেয়েছে না কী কে জানে!
-‘খবরদার মা! তুমি কিন্তু এখন ঢঙ করে খাবার দিতে যাবে না।
-‘কেন দেব না? ওর টাকায় কেনা খাবার আমরা সবাই গিলছি। ও কেন খেতে পারবে না?
তিনবোন একসাথে বলল,
-‘তুমি আমাদের খাবারের খোটা দিলে মা? ভাল.. বউ বাড়ি আসতে না আসতেই সবার রঙ পাল্টে যাচ্ছে। তুমি মা হয়ে আমাদের কথা শোনালে, পরের মেয়েতো সুযোগ পেয়ে বসবে।
-‘চুপ কর তোরা?
নিপা চিৎকার করে বলল,
-‘কেন চুপ করব? এটা আমাদের বাবার রেখে যাওয়া বাড়ি। আমার বাবার বাড়িতে আমরা সবসময় আসব, যতদিন খুশি থাকব। তাতে কার কী?
নন্দিতাদেবী ক্লান্ত বোধ করছে। শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘তোদের কী কেউ আসতে মানা করেছে?
নিপা বলল,
-‘করেনি! করতে কতক্ষণ? তোমার বড়ছেলে যে খেল দেখালো আজ। বুড়ো বসয়ে খুব সংসার করার শখ হয়েছে। সব শখ মিটিয়ে দেব। মেয়েটাকে এমন জব্দ করব না…
-‘খবরদার.. রূপায়নের বউয়ের সাথে কেউ লাগতে যাস না। রূপায়ন কিন্তু তোদের কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।

অনুপমা আঁধমাথা ঘোমটা টেনে রুপায়নকে ঘরে আসতে বলল। রূপায়ন শব্দহীন হাসল। বলল,
-‘আটটা বাজে। চলো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরি।
অনুপমা মাথা নেড়ে সায় দিল। দুজন ভরপেট খেয়ে নিল। অনুপমা এঁটো থালাবাটি এক সাইডে গুছিয়ে রাখল। রূপায়ন ফ্লোরে বিছানা পেতে শুয়ে পরল। বলল,
-‘তুমিও ঘুমিয়ে যাও। শুভ রাত্রি।

খুব ভোরে অনুপমার ঘুম ভাঙল। মাথা তুলে দেখল, রূপায়ন কপালের উপরে হাত রেখে, টানটান হয়ে শুয়ে আছে। চোখের পাঁপড়ি তিরতির করে কাঁপছে। অনুপমা গালে হাত রেখে, আনমনে অনেকটা সময় একধ্যাণে রূপায়নের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কে যেন জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। অনুপমা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। রূপায়নের ঘুম ভেঙে গেল। ব্যস্ত পায়ে দরজা খুলে দিল। পিসি, রূপায়নকে দেখে একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। রূপায়ন হাসিমুখে বলল,
-‘কেমন আছো পিসি?
-‘ভাল আছি। তুই এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছিস কেন? আজ না বৌভাত? বাজারে যেতে হবে না?
অনুপমা মাথায় ঘোমটা টেনে, এগিয়ে এসে পিসিকে প্রমাণ করল। পিসি অনুপমার চিবুকে হাত রেখে চুমু খেলো। বলল,
-‘এত সুন্দর বউটা কোথায় পেলি রূপ? এ তো সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। নাম কী তোমার?
-‘অনুপমা।’
-‘বাহ নামটাও সুন্দর। রুপ আমাকে একটা খাতা আর কলম দে?
রূপায়ন পিসির হাতে খাতা কলম ধরিয়ে দিতেই পিসি ফর্দ্দ লিখতে বসল। লেখা শেষ হতেই বলল,
-‘চল আমিও যাব তোর সাথে বাজারে।
-‘আমি একাই পারব পিসি। তুমি অনুপমার সাথে থাকো।
-‘না আমার স্বর্ণের দোকানে একটু দরকার আছে। তুই চলতো! শোনো বৌমা, দরজা লাগিয়ে বসে থাকো। আমরা যতক্ষণ না আসব। কেউ ডাকলে দরজা খোলার দরকার নেই। বাজার থেকে আসার সময় জলখাবার কিনে আনব।
অনুপমা মাথা নেড়ে বলল,
-‘আচ্ছা।

রূপায়ন পিসিকে স্বর্ণের দোকানে রেখে সবজির বাজারে চলে গেল। পিসি ব্যাগ থেকে একটা পুরোনো মডেলের টিকলি বের করে বলল,
-‘দেখুন তো এখানে কতটুকু স্বর্ণ আছে?
-দু’আনা তিন পয়েন্ট।
-‘টিকবে কতটুকু?
-‘ভাঙলে বোঝা যাবে। তবে পুরোনো তো। খুব বেশি টিকবে না।
পিসি বলল,
-‘ঠিকাছে, তাহলে আমার সোনা আর আপনার সোনা ভরে একজোড়া কানেরদুল বানিয়ে দিবেন।
-‘মানে ঠিক বুঝলাম না ম্যাডাম?
পিসি তার কালো চশমাটা খুলে রেখে, চোখ গোল গোল করে তাকাল। বলল,
-‘আরেহ্ আমাদের দুইজনের সোনা মিলিয়ে ভাল কানেরদুল বানিয়ে দিবেন।
দোকানদার শুকনো ঢোক গিলল। আশেপাশে একবার চোখ তুলে তাকাল। সবাই মুখ টিপে হাসছে। দোকনার আস্তে করে বলল,
-‘আমার সোনা, আপনার সোনায় কতটুকু ভরব?
-‘যতটুকু ভরলে, জিনিসটা মজবুত হবে, ততটুকুই ভরবেন। বেশি খাঁদটাদ দিয়েন না কিন্তু।
-‘আচ্ছা।
-‘আমার কিন্তু কালকের ভেতরেই চাই?
-‘আচ্ছা পেয়ে যাবেন। কিছু টাকা এডভান্স দিতে হবে।
পিসি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার পাঁচটা নোট বের করে দোকানদারের হাতে তুলে দিল। একটা রিসিট নিয়ে উঠে পরল। ততক্ষণে রূপায়নও বাজার সেরে এসেছে। দুজনে রিকশা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল।

মেয়েরা যতই বলুক রূপায়নের সাতেপাঁচে থাকার দরকার নেই। নন্দিতাদেবী ঘরে বসে থাকতে পারল না। আজ নন্দিতাদেবীর কিছু হলে এই মেয়েগুলো ফিরেও তাকাবে না। রূপায়নই সবার প্রথমে ছুটে আসবে। বাঙালী রীতি অনুযায়ী বিধবা মহিলারা বৌভাতের রান্না করে না। তাই নন্দিতাদেবী হাত দিল না। তবে তার ননদকে কীভাবে, কতটুকু রান্না করতে হবে, সাথে থেকে বলে দিল। সবজি কেটে বেছে দিল। মেয়েরা সকাল সকাল রাগ করে যার যার মতো শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। নন্দিতাদেবীকেও সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তিনি যাননি। ফুলপিসি বলল,
-‘বৌদি শোন, তোমাকে একটা কথা বলি, ছেলেমেয়েদের কথায় নেচে কখনো রুপের বউকে কষ্ট দিও না। আজ তোমার কিছু হলে, আর কেউ দেখবে না তোমাকে। একমাত্র রুপ ছাড়া। ছেলেটা এতদিন পর নিজের কথা ভেবেছে। আমাদের উচিৎ ওকে সাপোর্ট করা। তুমি নিজে বুঝো না? একা থাকা কতটা পীড়াদায়ক? তোমার তো তাও বুড়ো বয়সে দেখে রাখার জন্য ছেলেমেয়েরা আছে। রুপ যদি বিয়ে না করত। ওকে বয়স কালে কে দেখত? ওই বয়সটা আফসোস করেই কাটাতে হতো ছেলেটার।
নন্দিতাদেবী কেঁপে উঠল। সত্যিই তো এভাবে কখনো ভেবে দেখা হয়নি। রূপায়ন একাকী কীভাবে থাকতো?
ফুলপিসি বলল,
-‘বউ দেখেছো?
-‘না।
ফুলপিসি চিল্লিয়ে বলল,
-‘অনুপমা…? একবার নীচে আসো তো?
অনুপমা মাথায় ঘোমটা টেনে, ছোট ছোট পা ফেলে ধীরে ধীরে হেঁটে এলো। এত সুন্দর মেয়েটাকে দেখে নন্দিতাদেবীর দুচোখ জুড়িয়ে গেল। মেয়েটার সিঁথিতে রূপায়নের নামে পরা সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। দেখতে কী যে ভাল লাগছে। অনুপমা হেঁটে এসে শাশুড়ী মায়ের পাশে দাঁড়াল। পিসি বলল,
-‘ওনি তোমার শাশুড়ীমা হয়?
অনুপমা মিষ্টি করে একটুখানি হাসল। নন্দিতাদেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেল নন্দিতাদেবী। ইতঃস্তত করে বলল,
-‘থাক.. থাক প্রণাম করতে হবে না।
সীমা, অনুপমাকে দেখে এগিয়ে এলো। পরীর মতো সুন্দর মেয়েটা বড়দাভাইয়ের বউ হয়েছে? এই মেয়েটাকে কোথা থেকে ধরে এনেছে বড়দাভাই? কোন পরী রাজ্য থেকে নিশ্চয়ই? ভেতরে ভেতরে হিংসায় জ্বলে গেল সীমা। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে সীমার খুব অহংকার ছিল। এই মেয়েটার বাড়াবাড়ি সৌন্দর্যর কাছে সীমা তো চুনোপুঁটি। বেছে বেছে এত সুন্দর মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হলো বড়দাভাইকে?

গোবিন্দ বউ বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে। রূপায়ন মাকে দিয়ে বোনদের ফোন করে আসতে বলেছে। কেউ আসবে না। মাকে একগাদা কটুকথা শুনিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। রুম্পা নিজের হাতে অনুপমাকে খুব যত্ন করে সাজিয়ে দিল। সীমা পাশে মুখভার করে বসে বসে অনুপমার সাজানো দেখছে।
পিসি ভাত কাপড়ের থালা রুপায়নের হাতে তুলে দিল। বলল,
বউয়ের ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নে? রূপায়ন, থালাটা অনুপমার হাতে তুলে দিল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আজ থেকে তোমার যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিলাম অনুপমা। বিনিময়ে তুমি শুধু আমার হয়ে থেকো?

(চলবে)