সংসার পর্ব-০৭

0
142

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৭

অনুপমা কাঁপা হাতে থালাটা নিল। রুম্পা অনুপমাকে ধরে বসিয়ে দিল। বলল,
-‘খেতে নাও?
অনুপমা বলল,
-‘এতগুলো খাবার একা খেতে পারব না।
রুম্পা ফিসফিসিয়ে নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘খাও খাও। যত খাবা.. তত শক্তি পাবা।
-‘ধেৎ।
পিসি বলল,
-‘রুপ বৌমার সাথে খেতে বসে যা?
রূপায়ন, অনুপমার পাশে গিয়ে বসল। হাত ধুয়ে ভাত মেখে, অনুপমার মুখের সামনে তুলে ধরল। রূপায়নের হাতে খেতে, অনুপমার খুব লজ্জা লাগছে। আবার ভালোও লাগছে। রুম্পা বলল,
-‘তুমিও দাদাকে তুলে খাইয়ে দাও?
রূপায়ন বলল,
-‘থাক। ও লজ্জা পাচ্ছে।
-‘আরেহ্.. আমরা আমরাই তো! দাদাকে খাইয়ে দাও প্লিজ?
রূপায়ন হেসে দিল। খুব আগ্রহ নিয়ে অনুপমার মুখপানে তাকাল। অনুপমা কাঁপা হাতে রূপায়নের মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ধরল। রূপায়ন ভাতগুলো খাওয়ার সময় আলতো করে অনুপমার আঙুলে ঠোঁট ছোঁয়াল। অনুপমা কেঁপে কেঁপে উঠল। চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে, লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল।

অরুপের অফিস বন্ধ। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখল। বাড়িতে ঘটা করে বৌভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুপমার দিকে চোখ পড়তেই অনুপমার বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য দেখে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক ধ্যাণে তাকিয়ে রইল অরুপ। এত সুন্দর মেয়েটা বড়দাভাইয়ের বউ হয়েছে? এই মেয়েটাকে আজ সারারাত বড়দাভাই ভোগ করবে? ওই তো সীমা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটার সৌন্দর্যের কাছে সীমাকে বড্ড ম্লান লাগছে। কথাগুলো ভাবতেই মনটা তিক্ততায় ভরে গেল। ছোটবেলা থেকেই বড়দাভাইয়ের সব জিনিস ব্যবহার করে অভ্যস্ত অরুপ। এই মেয়েটাকেও এক দেখায় অরুপের প্রচণ্ড ভাল লেগে গেছে। সুযোগ পেলে এই মেয়েটাকেও ছাড়বে না অরুপ। এক রাতের জন্য হলেও নিজের সজ্জাসঙ্গী বানাবে। তবে বড়দাভাইয়ের আগে, টেস্ট করতে পারলে বেশি ভাল হতো। বড়দাভাই না চাইতেও সবসময় বেছে বেছে সেরাটাই পায় কেন, কে জানে!

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে রূপায়ন দোকানে চলে গেল। অনুপমা, পিসি আর রুম্পার সাথে সারাটা বিকেল গল্প করে কাটালো। অবুঝ মন, চাতকপাখির মতো রূপায়নের ফিরে আসার প্রহর গুনছে। মানুষটা চোখের আড়াল হওয়ার পর থেকেই কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কিছুই ভাল লাগছে না। এত কাজ পাগল কেন মানুষটা? আজকে কাজে না গেলে কী এমন ক্ষতি হতো?

রাত আটটার দিকে রূপায়ন বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে পা রেখেই কাকে যেন ডাকল। রূপায়নের মোলায়েম কণ্ঠস্বর শুনে অনুপমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। চঞ্চল চোখদুটো আঁতিপাঁতি করে মানুষটাকে খুঁজছে। অনুপমা এখনো শাশুড়ী মায়ের ঘরে বসে আছে। পিসি কতকিছু বলে গেল! একটা কথাও অনুপমার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে ঢুকলো না। পিসি হঠাৎ বলে উঠল,
-‘ওই তো রুপ এসে গেছে!
রূপায়ন গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে অনুপমার গা ঘেঁষে বসল। পুরুষালী উষ্ণ স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল অনুপমা। রূপায়ন হেসে দিয়ে বলল,
-‘কী খবর তোমাদের?
গোবিন্দ এতক্ষণ রূপায়নের ঘর ফুল টুল দিয়ে সাজাচ্ছিল। ঘরে এসে নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘খবর তো তোর হবে আজ রাতে! আমরা কাল শুনব সবাই!
রূপায়ন, চোখ গরম করে গোবিন্দর পিঠে আলতো করে থাপ্পড় মারল। পিসি মুখ টিপে হেসে দিল। বলল,
-‘কী খাবি রুপ?
-‘আমার শুধু চা হলেই চলবে। আসার সময় গরম গরম সিঙ্গারা, পুরি এনেছি। সীমা নিয়ে আসছে!
সীমা চা, সিঙ্গারা, পুরি এনে টি-টেবিলে রাখল। অনুপমার একটা ছেড়ে দুটো সিঙ্গারা খাওয়ার সময় চোখে জল এসে গেল। বাড়িতে জেঠী কখনো অনুপমাকে গোটা একটা সিঙ্গারা খেতে দিত না। সবসময় অর্ধেক ভেঙে দিতো। রূপায়ন খেয়াল করে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে অনুপমা? চোখে জল কেন?
অনুপমা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে, হেসে দিল। বলল,
-‘কিছু না। এমনিই ঝাল লেগেছে।
-‘দেখে খাও..আরেকটা দেব?
-‘না..না…
-‘তোমার যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে, সবসময় আমাকে বলবে! খাবার জিনিস নিয়ে কখনো লজ্জা করবে না।
‘এই মানুষটা এত ভাল কেন?’ ‘অনুপমার মন খারাপের কারণটাও মানুষটা ঠিক ঠিক বুঝে গেল।’
রাত নয়টা পর্যন্ত সবাই মিলে, টেলিভিশন দেখল, আড্ডা, গল্পগুজব চলল। রাতের খাবার খেয়েদেয়ে সবাই যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। গোবিন্দ বলল,
-‘চলো বন্ধু তোমাদের শোবার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি?
রূপায়ন, গোবিন্দর কাঁধে হাত রেখে বলল,
-‘কোলে করে দিয়ে আসবি? বেশ তাহলে তুই আমাকে কোলে নে?
-‘শালা…আমি তোকে নিবো কেন? তুই বৌদিকে কোলে নে?
-‘আমার বউ হাঁটতে পারে।
রূপায়ন হাত বাড়িয়ে দিল। অনুপমাকে ইশারায় হাতে হাত রাখতে বলল। অনুপমা আলতো করে রূপায়নের বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখল৷ রূপায়ন মুঠো করে ধরে বলল,
-‘চলো..?
ঘরের সামনে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি। রূম্পা, সীমা, পিসি ঘর আটকে দাঁড়িয়ে আছে। গোবিন্দ খিলখিল করে হেসে দিল। পিসি হাত বাড়িয়ে বলল,
-‘রুপ দশ হাজার টাকা দে?
-‘কেন পিসি?
-‘এটা নিয়ম। দিতে হয়?
-‘কোথায় লেখা আছে পিসি?
-‘এত কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। টাকা দিলে তবেই ঘরে যেতে দেব, বউ নিয়ে।
রূপায়ন, অনুপমার হাতটা মুঠো করে ধরে বলল,
-‘অনুপমা চলো.. আমরা আজকের রাতটা পিসির ঘরে গিয়ে শুবো। একরাত অন্যঘরে শুলে কিছুই হবে না।
পিসি চোখ গরম করে বলল,
-‘এই বয়সে আমার হাতে, কান মলা খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে তবেই যা।
রূপায়ন মুখ টিপে বলল,
-‘তুমি আমার পিসি হয়ে, বাসরঘরে ঢোকার বিনিময়ে আমার কাছে টাকা চাচ্ছো? তোমার লজ্জা লাগছে না পিসি?
-‘চুপ কর বেয়াদব ছেলে! আমি টাকা চেয়েছি না কী? গোবিন্দই তো বলেছে, আমাকে টাকা চাইতে! কালকে ট্রিট দিবে।
সবাই একসাথে হেসে দিল। রূপায়ন বলল,
-‘ওকে.. কাল সবাইকে আমি ট্রিট দেব। এখন ঘরে যেতে দাও প্লিজ? ঘুমাব। সকালে দোকানে যেতে হবে।
গোবিন্দ বিড়বিড় করে বলল,
-‘ঘুমাবে না কী… কী করবে আমাদের ভাল করে জানা আছে।
সবাই খুশিমনে যার যার ঘরে চলে গেল। রূপায়ন, অনুপমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। লাইট জ্বেলে দিতেই দুজনই অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সারাঘরের মেঝেতে অজস্র লাল বেলুন। বিছানা এত পরিমাণ বাহারী গোলাপফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। চাদর দেখা যাচ্ছে না। টেবিলে মোমদানীও ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা। রূপায়ন সবগুলো মোম জ্বেলে দিয়ে, ঘরের লাইট অফ করে দিল। লো ভলিউমে মিউজিক প্লেয়ার অন করে দিল। মোহনীয় সৌন্দর্যময় পরিবেশ, পাশে প্রিয় মানুষ, মিউজিক প্লেয়ারে পছন্দের গান। সব মিলিয়ে অনুপমার বুকের ভেতর নীরব ঝড় উঠেছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পরেছে। রূপায়ন চট করে কোলে তুলে নিল। অনুপমা, রূপায়নের গলা জড়িয়ে ধরে, কাজল রাঙা মায়াবী চোখ তুলে তাকাল। রূপায়ন, অনুপমার মুখপানেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনুপমা ওই গভীর চোখে চোখ রাখতেই চার চোখের মিলন হলো। রূপায়নের উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস, অনুপমার চোখে, মুখে উপচে পরছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মতো অনুপমার বুকের গভীরে শিহরণ বয়ে গেল। রূপায়ন, চোখে চোখ রেখেই বলল,
-‘অনুপমা…?
-‘হুম…
-‘এটা বোধহয় দিবাস্বপ্ন নয়। তাই না?
-‘কী মনে হয় আপনার?
রূপায়ন, আস্তে করে অনুপমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। কপালে কপাল ঠেকাল। অনুপমা আবেশে দুচোখ বুজে ফেলল। রূপায়ন আলতো করে অনুপমার দুগালে হাত রাখল। বলল,
-‘সেদিনও আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। অথচ আজ তুমি আমার কতটা আপন। কতটা কাছের মানুষ। যতটা কাছে থাকলে, একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা গভীর ভাবে অনুভব করা যায়। ঠিক ততটাই কাছের।
রূপায়ন, অনুপমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবেগী কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘আজ এই শুক্লপক্ষের মায়াবী রাত, আকাশে আলো ঝলমলে চাঁদ, চারপাশে অজস্র ফুলকে সাক্ষী রেখে, তোমায় আমি নিজের করে পেতে চাই অনুপমা?
অনুপমা আস্তে করে রূপায়নের বুকে নিশ্চিন্তে মাথাটা এলিয়ে দিল। অনুপমার মন জানে, পুরো নারী সত্তা জানে, এই মানুষটা কখনো অনুপমাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিবে না। উল্টো অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে নিজের মন মতো গড়ে নিবে। এই মানুষটাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়, ভরসা করা যায়। আর অনেক অনেক ভালোবাসা যায়। যতটা ভালোবাসলে মানুষটার আর কখনো আপেক্ষ হবে না, আফসোস হবে না, সর্বক্ষণ ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি লেগে থাকবে। তার থেকেও শতগুণ বেশি মানুষটাকে মন, প্রাণ উজার করে ভালোবাসা যায়।

তীব্র ভালোবেসে, মধুময় যন্ত্রণা সহ্য করেও যে কতটা গভীরভাবে একজন আরেকজনের অস্তিত্বে মিশে যাওয়া যায়। রূপায়ন নামের সুপুরুষটি অনুপমার জীবনে না এলে, অজানাই রয়ে যেতো।

রূপায়নের ঘুম ভেঙে দেখল, অনুপমা, রূপায়নের বুকে মুখ গুঁজে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। কালরাতের কথা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। রূপায়ন আর একটু গভীরভাবে অনুপমাকে জড়িয়ে ধরল। এই মেয়েটা কালরাতে রূপায়নকে স্বর্গসুখের সন্ধান দিয়েছে। পরিচয় করিয়েছে, সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতির সাথে। রূপায়নের পুরুষ সত্তাকে করেছে পরিপূর্ণ। অনুপমা মিটিমিটি করে তাকাল। রূপায়নকে জেগে থাকতে দেখে, রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় চোখদুটো বুজে ফেলল। রূপায়ন হেসে দিল। ফিসফিস করে বলল,
-‘শুভ সকাল!
অনুপমা নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘ছাড়ুন? আমি উঠব।
-‘এখনো খুব বেশি বেলা হয়নি। আর একটু থাকো না?
-‘আচ্ছা।’
-‘অনুপমা..?
-‘হুম।
-‘গিফট পছন্দ হয়েছে?’
অনুপমা, রূপায়নের চোখের দিকে তাকাল। বলল,
-‘গিফট?
রূপায়ন ইশারায় অনুপমার গলা দেখালো। অনুপমা নিজের গলার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো। চেইনসহ লকেটটা নেড়েচেড়ে দেখল। সম্ভবত এক ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইন। সাথে লাভের ভেতর ‘R+A’ লেখা লকেট। অনুপমা ইতঃস্তত করে বলল,
-‘এসবের কী দরকার ছিল? শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করলেন।
-‘প্রিয়জন ভালোবেসে কিছু উপহার দিলে, ভালোবাসা দিয়ে গ্রহন করতে হয় অনুপমা।’ এভাবে বলতে হয় না।
-‘আমি দুঃখিত। আসলে কেউ কখনো আমাকে এত দামী উপহার দেয়নি তো।
-‘এখন থেকে আমি দেব অনুপমা। তুমি চাইলেও দেব, না চাইলেও দেব। তোমার কোন ইচ্ছে, কখনো অপূর্ণ রাখব না।
এই মানুষটার সুন্দর ব্যবহার, অমায়িক কথা, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে অনুপমাকে মুগ্ধ করে।

কান্নাকাটির শব্দ শোনা যাচ্ছে। রূপায়ন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। অনুপমার পুরো শরীর ব্যথায় নীল হয়ে আছে। উঠতে একটু দেরি হলো। ততক্ষণে রূপায়ন দরজা খুলে, ব্যস্ত পায়ে চলে গেছে। ভীত কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মায়ের?

(চলবে)