সংসার পর্ব-০৯

0
148

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৯

অরুপ রেগে গেল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘বৌদি ভালোই ভালোই দরজাটা খুলে দাও? আমি যদি এখন দরজা ভেঙে ফেলি, তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে!

সীমার মাইগ্রেনের ব্যথাটা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এত কোলাহল আর ভাল লাগছে না। অল্প একটু খেয়েই, বাড়ির পথে হাঁটা দিল। এখন ঔষধ না খেলে চলবেই না। অতিরিক্ত মাথা ব্যথায় কেমন পাগল পাগল লাগছে।
বাড়ির সামনে এসে দেখল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সীমা বার কয়েক অরুপকে ডাকল। কেউ সারা দিল না। ব্যাগের চেইন খুলে, নেড়েচেড়ে এক্সট্রা চাবি পেল। দরজাটা খুলে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে, সীমা বেশ অবাক হলো। লাইট জ্বেলে দিল। উপরের ঘর থেকে অরুপের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। একা একা কার সাথে কথা বলছে অরুপ? সীমা ভেবে পেল না। কৌতূহলবশত সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেল। বড়দাভাইয়ের ঘর থেকে অরুপের কথা ভেসে আসছে! হঠাৎ সীমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। হন্তদন্ত পায়ে ছুটে গিয়ে দেখল, অরুপ বেলকনির দরজা ধরে ধাক্কাচ্ছে আর বৌদিকে নানা ভাবে ভয় দেখাচ্ছে। বার বার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য কখনো রিকুয়েষ্ট করছে তো কখনো গালাগালি করছে। এই প্রথম নিজের স্বামীর ভয়ংকর রুপ দেখে, ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল সীমা। বৌদিকে নিজের সজ্জাসঙ্গী করার জন্য মানুষটা, কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সীমার পা চলে না। এগিয়ে গিয়ে যে মানুষটাকে থামাবে, যেন সেই শক্তিটুকু শরীরে অবশিষ্ট নেই।
সম্মতি ফিরে পেয়ে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে অরুপের শার্টের কোণা টেনে করে, ক্লান্ত গলায় বলল,
-‘তুমি এমন করছো কেন?
অরুপ পেছন ফিরে তাকাল। সীমাকে দেখে, চমকে উঠল। ভয়ে মুখটা পাংগুবর্ণ হয়ে গেল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি কখন এলে…?
সীমা ধপ করে মেঝেতে বসে পরল। নিজের চুলের গাছি টেনে ধরে, শব্দ করে কেঁদে দিল। অরুপ হাঁটু মুড়ে সীমার মুখোমুখি বসল। সাহস করে সীমার একহাত ধরতেই, সীমা অরুপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইচ্ছেমতো আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিল অরুপের বুক, হাত, মুখ। অরুপ সীমার হাতদুটো চেপে ধরে, চিৎকার করে বলল,
-‘তুমি কী পাগল হয়ে গেলে সীমা..?
-‘আমাকে আর কী পাগল হওয়ার বাদ রেখেছো তুমি? তোমার মতো চরিত্রহীন, লম্পট, জানোয়ারের সংসার করছি আমি এতদিন ধরে? ছিঃ..ভাবতেই আমার লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
-‘তুমি যা দেখেছো, সব ভুল, সব মিথ্যা! ওই মেয়েটাই আমাকে নিজের ঘরে ডেকে এনেছে।
সীমা হেসে দিল। তাচ্ছিল্যের হাসি। চিৎকার করে বলল,
-‘মানলাম বৌদি তোমায় ডেকেছে? ফাঁকা বাড়িতে এতক্ষণ দেবরের সাথে টান টান উত্তেজনা নিয়ে, রঙ্গলীলায় মেতে না উঠে।
ওই বেলকনিতে একাকী দরজা আটকে কী করছে মানুষটা? আমায় বলতে পারো অরুপ? কথা বলছো না কেন? উত্তর দাও?
-‘সীমা ঘরে চলো..? আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি?
সীমা চোখের জল মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
-‘আর কী বোঝাতে বাকি রেখেছো, তুমি আমায়? তোমার নয়/ছয় বোঝানোতে এতক্ষণ নিজের চোখে যা দেখেছি, না শুনেছি! সব মিথ্যে হয়ে যাবে না অরুপ! আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে, তোমার মতো লম্পট, চরিত্রহীন, কাপুরুষ আমার বর।
নীচে রুপা, দিপার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। বোধহয় ওরা সবাই চলে এসেছে৷ অরুপ জোর করে সীমাকে পাজকোলা করে, নিজের ঘরে নিয়ে গেল।

অনুপমা ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে বসে কাঁদছিল আর আকুল হয়ে ঈশ্বরকে ডাকছিল। হঠাৎ সীমার কণ্ঠস্বর শুনে, জানে প্রাণ ফিরে পেল। তবে দরজা খোলার সাহস পায়নি। চুপটি করে, সীমার কথাগুলো শুনছিল। হাতে ধরে রাখা ফোনে চোখ পড়তেই রূপায়নের প্রতি প্রচুর অভিমান হলো। মানুষটা এতই ব্যস্ত যে, অনুপমা এতবার ফোন দেওয়ার পরও ফোন রিসিভ করেনি। সঠিক সময়ে সীমা না এলে যে, আজ কতবড় সর্বনাশ হয়ে যেতো, ভাবতেই অনুপমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল।

রূপায়ন মাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। মাকে বিছানায় সাবধানে বসিয়ে দিয়ে, নিজেও পাশে বসল। রাতে কী কী ঔষধ খেতে হবে, দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
দরজা হাঁট করে খোলা। সারাঘর এলোমেলো। অনুপমা ঘরে নেই। রূপায়ন বেশ অবাক হলো। সেই কখন এসেছে রূপায়ন। অনুপমা কী শুনতে পাইনি? একবার মায়ের ঘরেও তো গেল না।
কয়টা বাজে! সময় দেখার জন্য ফোন বের করে স্ক্রীণে অনুপমার নাম দেখে, চমকে উঠল৷ ৬৯টা মিসডকল। আশ্চর্য অনুপমা এতবার ফোন দিয়েছে কেন? ফোনটা সাইলেন্ট হয়ে ছিল৷ রূপায়ন শুনতে পায়নি। সারাঘর পায়চারী করে, বেলকনির সামনে গিয়ে দেখল, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ। এবার একটু ভয় ভয় করতে লাগল। রূপায়ন দরজায় টোকা দিয়ে, ভীত কণ্ঠে বলল,
-‘অনুপমা? দরজা খুলো? কী হয়েছে?
রূপায়ন এসেছে? এতক্ষণে মানুষটার আসার সময় হলো বুঝি? প্রচণ্ড অভিমানে নিঃশব্দ কাঁদতে লাগল অনুপমা।
রূপায়ন অস্থির হয়ে বলল,
-‘দরজাটা খুলো লক্ষ্মীটি? ফোন সাইলেন্ট হয়ে ছিল। স্যরি..
-‘(নিশ্চুপ)
-‘অনুপমা..?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘এবার কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছে অনুপমা। কী হয়েছে তোমার? কেউ কিছু বলেছে?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘আরেহ্.. না বললে বুঝব কীভাবে?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘এবার কিন্তু আমি দরজা ভেঙে ফেলব অনুপমা? এত টেনশন আর নিতে পারছি না।
আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল। বিধ্বস্ত অনুপমাকে দেখে, রূপায়ন আঁতকে উঠল। মেয়েটার মুখখানি লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। চোখদুটো কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে। মাথার চুল এলোমেলো। অনুপমাকে এই বেশে দেখে, রূপায়নের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে অনুপমার দুগালে হাত রেখে বলল,
-‘কী হয়েছে তোমার..?
অনুপমা, রূপায়নের বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পরল। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, শব্দ করে কাঁদতে লাগল। রুপায়ন ঘাবড়ে গেল। একহাতে অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে, একটু পিছিয়ে গিয়ে, দরজা লাগিয়ে দিল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে? না বললে বুঝবো কীভাবে?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘কিছু দেখে ভয় পেয়েছো?
অনুপমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘আমি আর এখানে এক মূহুর্ত থাকব না। আমার জেঠু, জেঠীর কাছে রেখে আসো প্লিজ?
রূপায়নের মনটা ছোট হয়ে গেল। শুকনো মুখে বলল,
-‘বলো না.. কী হয়েছে?
অনুপমা কান্নারত ফোলা চোখদুটো তুলে তাকাল। মলিন কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি আমার ফোনটা ধরলে না কেন রূপায়ন? এতবার কেউ কাউকে এমনি এমনি ফোন দেয় না, নিশ্চয়ই? তোমার অনুপস্থিতিতে আমার তো অনেক বড় বিপদও হতে পারতো। আজ যদি কোন অঘটন ঘটতো। ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি, আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম।
রূপায়ন, অনুপমাকে জাপ্টে ধরল। বুকের মাঝে পিষে ফেলতে ফেলতে অস্থির হয়ে বলল,
-‘এভাবে বলো না অনুপমা। তোমার কিছু হলে.. আমি মরে যাব। সেইফ মরে যাব।
অনুপমাকে আঁকড়ে ধরে, কপালে কপাল ঠেকাল রূপায়ন। চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে তোমার? কেউ আজেবাজে কিছু বলেছে? বলো… শুধু একবার বলো আমাকে?
অনুপমা কেঁপে উঠল। চোখদুটো নামিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে অরুপ কী কী বলেছে, কেমন উগ্র ব্যবহার করেছে। একে একে সব ধীর গলায় বলল রূপায়নকে। অতিরিক্ত রাগে রূপায়নের চোখ, মুখ লাল হয়ে গেছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। অনুপমার একহাত মুঠো করে ধরে বলল,
-‘চলো আমার সাথে?
-‘আমি যাব না।
রূপায়ন শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘অনুপমা চলো বলছি?
অনুপমা ভয়ে ভয়ে রূপায়নের পিছুপিছু গেল।

অরুপের ঘর খোলা ছিল। রূপায়ন, অনুপমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই আচমকা, অরুপের গলা চেপে ধরল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘ ফাঁকা বাড়ি পেয়ে অনুপমার সাথে কী করতে চেয়েছিলি তুই? বল…কী করতে চেয়েছিলি?
অরুপ দমে গেল না। রূপায়নের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। চেঁচিয়ে বলল,
-‘আমি কিছুই করিনি। তোর বউই আমাকে তোর ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।
রূপায়ন ইচ্ছেমতো অরুপের সারা গালে থাপ্পালো। দাঁতে ঠোঁট চেপে বলল,
-‘আমার বউয়ের যদি তোর সাথে নোংরামি করার ইচ্ছে থাকতো। তাহলে আমরা কেউ ঠিকও পেতাম না। এই বন্ধ ঘরে, কী হয়েছে না হয়েছে।
দিপা, রুপা দৌঁড়ে এলো। অরুপকে, রূপায়নের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল,
-‘কী হয়েছে? ওকে অমানুষের মতো মারছিস কেন?
রূপায়ন বলল,
-‘আস্তে কথা বল রুপা, মা অসুস্থ। এই ঘরের বাইরে যেন সাউন্ড না যায়। ও কী করেছে! অরুপকে জিজ্ঞেস কর? মা অসুস্থ! আমরা সবাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করছি। আর জানোয়ারটা সেই সুযোগে বাড়িতে এসে অনুপমার সাথে নোংরামি করার চেষ্টা করেছে।
-‘সীমা কোথায় ছিল?
রূপায়ন বলল,
-‘ওই তো সীমা৷ ওকেই জিজ্ঞেস কর?
দিপা, সীমাকে বলল,
-‘তুমি কোথায় ছিলে?
-‘আমি পুপিন এর জন্মদিন খেতে গিয়েছিলাম। বাড়ি এসে দেখি, অরুপ বড়দাভাইয়ের ঘরে।
রুপা, অনুপামকে দেখিয়ে বলল,
-‘ও কোথায় ছিল?
-‘ওনি বেলকনিতে দরজা আটকে ছিল।
রূপায়ন আবারও তেড়ে গেল। অরুপের টুটি চেপে ধরে বলল,
-‘এত বড় সাহস কে দিয়েছে তোকে? বল..কে দিয়েছে? নীচে নামতে নামতে কোথায় নেমে গিয়েছিস! একবারও ভেবে দেখেছিস? অনুপমা তোর বড়বৌদি হয় রে।
রুপা, দিপা, রূপায়নকে টেনে সরিয়ে দিল। বলল,
-‘তোর বউও দোষ আছে। দুইদিনের মেয়ের জন্য তুই অরুপকে এভাবে মারছিস কেন?
-‘চুপপ…
এত জোরে ধমক খেয়ে কেঁপে উঠল দিপা। রূপায়ন বলল,
-‘অনুপমাকে নিয়ে যদি আর একবার কারো মুখে বাজে কথা শুনি। তাহলে আমিও ভুলে যাব তোরা আমার ভাইবোন। আর অরুপ তোকে যদি অনুপমার ধারেকাছেও দেখি না…তাহলে সেদিনই হবে তোর শেষদিন। বিয়ের আগে যা করেছিস.. করেছিস। এখন স্বভাবটা পরিবর্তন কর। সীমাকে নিয়ে ভালমতো সংসার কর।
কথাগুলো বলেই অনুপমাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল রূপায়ন। অনুপমাকে কোলের মাঝে বসিয়ে ঘাড়ে চিবুক রেখে বলল,
-‘কখনো আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকাবে না অনুপমা। যাই হয়ে যাক না কেন! সবসময় আমাকে সত্যিটাই বলবে। আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার ব্যপারে আরও সর্তক থাকা দরকার ছিল।
অনুপমা নিশ্চিন্তে রূপায়নের বুকে মাথা রাখল। রূপায়নের অতিরিক্ত ভালোবাসায় অনুপমার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট একটু একটু করে ধুয়েমুছে গেল।

সকালে রূপায়ন জলখাবার খেয়ে দোকানে চলে গেছে। সীমা এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। অনুপমা, শাশুড়ীকে ঔষধ দিয়ে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। রুপা মায়ের পাশে বসে, ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘তোমার বড়ছেলে বউ পেয়ে এখন আমাদের ভুলে গেছে মা। তার এখন আর ভাইবোন লাগে না। শুধু বউ থাকলেই হবে।
রুপার জামাই আজ ভোরে এসেছে। টেবিলে বসে বসে তৃপ্তি করে বাহারি পদের জলখাবার খাচ্ছে। অনুপমা এগিয়ে গেল। হেসে দিয়ে রুপাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-‘শুধু আমার ননদ নিয়ে পরে থাকলেই হবে জামাইবাবু? এককাজ করুন, আমার ননদকে ছয়মাসের জন্য রেখে যান। আর আপনার সবগুলো ভাইবোনকে ফোন করে আপনাদের বাড়িতে আসতে বলুন। সবাই সবার ভাইবোন নিয়ে ছোটবেলার মতো সুখে, শান্তিতে মিলেমিশে ছয়মাস থাকুক। সব সময় বউ দিয়ে কী হয়? বউ মানেই প্যারা।
রুপা রেগে গেল। কড়া কন্ঠে বলল,
-‘এই মেয়ে কী বললে তুমি?
অনুপমা মুখ টিপে হেসে বলল,
-‘আমি কী কিছু ভুল বলেছি জামাইবাবু?

(চলবে)