সংসার পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
442

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১৯ ও শেষপর্ব

নিপা বিশেষ ঔষধটা কিনে এনে অনুপমাকে খাওয়ানোর সুযোগ খুঁজছিল।
এমন ভাবে খাওয়াতে হবে, যেন কেউ সন্দেহ না করে! দিন পনেরো কেটে যাওয়ার পরও অনুপমাকে ঔষধটা খাওয়াতে পারেনি নিপা৷ ততদিনে নিজের ভেতর বেশকিছু পরিবর্তন অনুভব করছিল। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠে। পেটের ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠে, মাছ খেলেই বমি বমি লাগে, তবে বমি হয় না। জয়ন্তদা তো সময়-অসময় নেই। নিপাকে এখানে-সেখানে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফূর্তি করে। প্রথম প্রথম ভালোলাগা থেকে গেলেও ইদানীং ভয় থেকে জয়ন্তদার সাথে যায়। অনিয়মিত পিরিয়ড হয় দেখে, শুরু থেকেই সেভাবে সর্তক ছিল না নিপা।
হঠাৎ শারীরিক পরিবর্তন গুলো নিপাকে বড্ড বেশি ভাবাতো। নিজের অস্থিরতা, মানসিক টেনশন দূর করতে নিপা সাহস করে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করল। যা মনে মনে ভেবেছিল তাই সত্যি হলো। রেজাল্ট পজেটিভ এসেছে।
-‘এত কী ভাবছিস নিপা?
নিপা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। রূপায়ন চেয়ারে বসে আছে। অরুপ ভোরে বাড়ি চলে গেছে। নিপার ব্যপারটা এখনো রুপা, দিপাকে জানানো হয়নি। রূপায়ন কতবার, কতভাবে নিপাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাচ্চাটা কার? নিপার ঘুরেফিরে একটাই উত্তর : বাচ্চাটা না কী সৌরভের। রূপায়নের মস্তিষ্ক কাজ করে না। কেমন ঝিম মেরে বসে রইল। মায়ের শরীর ভাল না। নিপার ব্যপারটা কীভাবে নেবে কী জানে!

বেলা বাজে সাড়ে দশটা। সীমা রান্না করছে। অনুপমার রাতে ভাল ঘুম হয়নি। উঠতে বেশ বেলা গড়িয়ে গেল। ধীরে ধীরে রান্নাঘরে এসে, সীমাকে একা কাজ করতে দেখে বলল,
-‘মা এখনো উঠেনি?
-‘না তো।
অনুপমা চিন্তিতবোধ করল। বলল,
-‘মা তো এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। তুমি একবার দেখে আসো সীমা?
সীমা সবজি কাটতে কাটতে ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘ওনার ছোটমেয়ে এতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে না! লজ্জায়.. ঘর থেকে বের হতে পারছে না বড়দি।
-‘এভাবে বলো না সীমা। ওনি বয়স্ক মানুষ।
-‘রাখো তো! ওনার দোষেই ছেলেমেয়েগুলো আজ এত খারাপ হয়েছে। শুধু বড়দাভাইটাই মানুষের বাচ্চা হয়েছে। আর সবগুলো অমানুষ।
অনুপমা একগ্লাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে উঠে পরল। সীমা পিছু ডেকে বলল,
-‘সেদ্ধভাত খেয়ে যাও বড়দি।
-‘পরে খাব। দেখে আসি, মা কী করে!

অনুপমা ধীর পায়ে নন্দিতাদেবীর ঘরে গেল। এখনো লাইট জ্বলছে। ঘরের লাইট নিভিয়ে, বিছানার কাছে গেল। নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘ও..মা উঠুন? বেলা হয়ে গেছে।
নন্দিতাদেবী সারা দিল না। কেমন টান টান হয়ে ঘুমিয়ে আছে। অনুপমা কী মনে করে, নন্দিতাদেবীর ডানহাত আলতো করে ধরল। বরফের মতো ঠাণ্ডা কেন মায়ের হাতখানা? অনুপমার মনের ভেতর কেঁপে উঠল। বুঁজে আসা কণ্ঠে বলল,
-‘ও..মা কী হয়েছে আপনার? উঠুন না?
অনুপমা, নন্দিতাদেবীর হাত ধরে বেশ জোরেই টান দিল। নন্দিতাদেবী তবুও উঠল না। হাতটা ছেড়ে দিতেই হেলে পরল। অনুপমা ভয়ে ভয়ে নন্দিতাদেবীর নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল, নিঃশ্বাস চলছে না কী!
অনুপমা শব্দ করে কেঁদে দিল। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘ও সীমা কোথায় গেলা.? মায়ের যেন কী হয়েছে! মা তো উঠছে না।
অরুপ পাশের ঘরেই ছিল। অনুপমা কণ্ঠস্বর পেয়ে ছুটে এলো। ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মায়ের? ও..মা কী হয়েছে তোমার? বলতে বলতেই নন্দিতাদেবীর কপালে হাত রাখল। মুখ ধরে ঝাঁকালো। মা আর নেই.. অরুপের বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
সীমা ভয় পেয়ে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে ছুটে এলো। বুক ধড়ফড় করছে। অরুপকে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে দেখে, নিজেও কেঁদে দিল।
প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছে। দুজন মহিলা অনুপমাকে টেনে ধরে উঠালো। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-‘শান্ত হও বৌমা। এত কাঁদলে বাচ্চাটার ক্ষতি হবে।
অনুপমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ও কাকিমা.. মা আর নেই গো। ওনার বড়ছেলেকে কী জবাব দেব আমি? মাকে আমার দায়িত্বে রেখেই যে বোনকে নিয়ে হাসপাতালে পরে আছে মানুষটা।
প্রতিবেশী এক কাকীমা অনুপমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে একে একে আত্মীয়-স্বজন সবাইকে জানিয়ে দিল। সবার প্রথমে রূপায়নকে ফোন দিল। বলল,
-‘এখনই নিপাকে নিয়ে বাড়ি চলে আয় রূপায়ন।
রূপায়ন ভয় পেল। ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে কাকিমা? মা বা অনুপমার কিছু হয়েছে কী?
-‘তুই শিগগিরই বাড়ি চলে আয় বাবা।
-‘বলো না কাকিমা? কার কী হয়েছে?
-‘ তোর মায়ের অবস্থা ভাল না। তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। রূপায়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাকিমা ফোন রেখে দিল।
রূপায়নের বুকের রক্ত ছলকে গেল। চোখদুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেল। ডাক্তার নিপাকে ছাড়তে চাইল না। আরও একটা দিন ভর্তি রাখতে চাইল। রূপায়ন কেঁদে দিল। মলিন কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি বুঝতেছেন না কেন? আমার মায়ের কী জানি হয়েছে! আর একটা সেকেন্ডও আমার এখন হাসপাতালে থাকার মানসিক অবস্থা নেই। হয় নিপাকে রিলিজ দেন! আর নাহয় আমি একাই চলে গেলাম! ডাক্তার বাধ্য হলো, নিপাকে রিলিজ দিতে।
রূপায়ন বোনকে ধরে ধরে হাসপাতাল গেইট পর্যন্ত নিয়ে আসল। একটা সিএনজি ডেকে তাতে উঠে পরল।
-‘ভাই একটু তাড়াতাড়ি গাড়ি চালান না?

পঁচিশ মিনিট পর,
গাড়ি থেকে নেমে, ভাড়া মিটিয়ে নিপাকে ফেলেই দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল রূপায়ন। রীতিমতো এত মানুষ, কান্নাকাটি দেখে প্রচুর ভয় পেল। বুকের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরেছে। কোত্থেকে অনুপমা ছুটে এসে আচমকা রূপায়নকে জড়িয়ে ধরল। শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘আমি পারলাম না গো। তোমার মাকে দেখে রাখতে!
রূপায়ন ভয় জড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
-‘আমার মায়ের কী হয়েছে অনুপমা? আমার মা কোথায়?
রূপা, দিপা ছুটে এসে রূপায়নকে আঁকড়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা আর বেঁচে নেই রে বড়দাভাই! মা আর নেই।
রূপায়নের পুরো শরীর টলে গেল। মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল।
খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে মায়ের সাথে দূরুত্ব কমে গেল। চলার পথে হোঁচট খেলে, মন খারাপ করে মাকে বললে! মা সবসময় বন্ধুর মতো ছায়া দিয়ে আগলে রাখতো। ভরসা দিতো। সঠিক পথ দেখিয়ে দিত। সেই জন্মদাত্রী মা না কী! আজ কাউকে কিছু না বলে, চিরবিদায় নিয়েছে! মৃত্যু এতই সহজ বুঝি?

রূপায়ন এলোমেলো পায়ে, মায়ের ঘর পর্যন্ত হেঁটে গেল। বুকের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। অসহ্য ব্যথা করছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মাকে ঘিরে একের পর এক শৈশব, কৈশোরের মধুমাখা স্মৃতিগুলো ছায়াছবির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। রূপায়ন, মায়ের পায়ের কাছে বসে, মায়ের দুপা জড়িয়ে ধরল। নিজের মাথাখানা ঠুকতে ঠুকতে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কেউ রূপায়নকে ধরে রাখতে পারল না। কেমন নিজের বুক জোরে জোরে চাপকে কাঁদতে লাগল।
ফুল পিসি এসে রূপায়নকে আঁকড়ে ধরল। মুখটা মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এমন পাগলামি করে না রুপ। তুই তো বৌদির ভাল ছেলে। এভাবে কাঁদতে বৌদির আত্মা কষ্ট পাবে তো বাবা।
-‘ও পিসি? আমার মাকে উঠতে বলো না? আজকের পর থেকে কে আমার কাছে আবদার করবে? ফোন করে এটা-সেটা আনার কথা মনে করে দিবে? এমন তো কথা ছিল না পিসি?
-‘এমন করে না বাবা। উপর থেকে যখন ডাক আসবে তখন তো আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে।
-‘আমি পারব না পিসি। যে হাত দিয়ে রোজকার করে, মায়ের মুখে ভাত তুলে দিয়েছি। সেই হাত দিয়ে মাকে দাহ করতে পারব না পিসি। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মাকে উঠতে বলো না পিসি?
পিসি চোখের জল মুছে বলল,
-‘তুই না বৌদির বড় সন্তান? বড়দের এত ভেঙে পড়লে চলে বাবা? তোর উপর এখন কত দায়িত্ব। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে, ছোট ছোট ভাইবোনদের দেখে রাখবি কীভাবে? নিজেকে শক্ত কর।

গোবিন্দ এসেই শ্মশানে চলে গেছে। সেখানে সবকিছু ঠিকঠাক করে, খাটিয়া নিয়ে এলো।
নন্দিতাদেবীকে ঘর থেকে বের করে বসার ঘরে, শীতল পাটিয়ে শুইয়ে দিল। চোখে তুলসি, বুকে গীতা দিয়ে, সাদা চাদর দিয়ে মুখটা ডেকে দিল।
আত্মীয়-স্বজনরা একে একে সবাই চলে আসতেই আর দেরি করল না। নন্দিতাদেবীর মরাদেহ শ্মশানে গিয়ে যাওয়া হলো।

ঠাকুরমশাই নিয়ম বলে দিল। রুপা, দিপা মাকে শেষ স্নান করিয়ে দিল। কপালে চন্দন, গায়ে সাদা থান পরিয়ে দিয়ে, মাকে চিতেই তুলে দেওয়া হলো। রূপায়ন, অরুপ নিয়ম মেনে মায়ের মুখাগ্নি করল। তারপর মায়ের মাটির দেহখানা আগুনে জ্বালিয়ে দিল।
মাকে আগুনে পুড়তে দেখে রূপায়ন সহ্য করতে পারল না। চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমায় ক্ষমা করো মা। আমি এমনই ব্যর্থ বড় সন্তান। তোমার শেষ সময়ে তোমার পাশে থাকতে পারলাম না।

মাকে দাহ করে, পুকুর থেকে এক ডুব দিয়ে, একপ্যাচে সাদা ধুতি পরে বাড়ি ফিরল, রূপায়ন, অরুপ।

পিসি ফল কেটে নিয়ে এলো। রূপায়নকে বলল,
-‘ফলগুলো খেয়ে নে বাবা।
-‘আমার মা আর কোনদিনও খাবে না পিসি। মাকে রেখে আমি কীভাবে খাব বলোতো?
পিসি, অনুপমাকে কোত্থেকে যেন ধরে নিয়ে এলো। অনুপমার পেটের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-‘তাকা রুপ? যে গেছে সে তো চলেই গেছে। বৌমার শরীরে তোর নতুন অংশ বেড়ে উঠছে। তার জন্য তোকে সুস্থ থাকতে হবে বাবা।
দরজায় নিপা দাঁড়িয়ে ছিল। নিপাকে দেখে রূপায়ন রেগে গেল। চিৎকার করে বলল,
-‘ও এখানে কী করছে? ওকে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলো পিসি। আজ ওর অপকর্মের জন্যই আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
নিপা ভয় পেয়ে, মুখ চেপে ধরে কেঁদে দিল। একে একে সবাই নিপার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন? নিপা বুঝতে পারছে না। দিদিরাও নিপার সাথে ভাল করে কথা বলছে না।

আজ বাড়িতে, নন্দিতাদেবীর শ্রাদ্ধ উপলক্ষে বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। দুদিন আগেই ঠাকুরমশাই শ্রাদ্ধ করেছে। আজ শুধু শতেক আটশো লোক খাওয়ানো হবে। মানুষজন ভরপেট খেয়ে কোথায় নন্দিতাদেবীর আত্মার শান্তি কামনা করবে। তা না করে, কোন তরকারিতে ঝাল বেশি হয়েছে, কোনটায় লবন বেশি হয়েছে, মাছটা আরেকটু ভাজা দরকার ছিল। মোটকথা খাবার নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা করছে। রূপায়ন শুনতেই মলিন হাসল। হায়রে মানুষ! এরা শ্রাদ্ধ খেতে এসেও সমালোচনা করছে।

দেখতে দেখতে কতগুলো মাস চলে গেছে। এখন রূপায়নের বোনেরাও খুব কম আসে। নিপা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। শুধু খাওয়ার সময়টুকু বাদে সবসময় নিজের ঘরে থাকে। সীমা নিজের মতো রান্নাবান্না করে। অনুপমার হওয়ার ডেট ঘনিয়ে এসেছে। পেটটা বেশ বড় হয়েছে। রূপায়ন অনেকটাই শোক কাটিয়ে উঠেছে। দোকান থেকে এসে দেখল, অনুপমা খাবার টেবিলে বসে, রূপায়নের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। অনুপমাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। মাথায় হাত রেখে বলল,
-‘কত করে বলি, আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যেও।
অনুপমা ঘুমঘুম চোখ তুলে তাকাল। মুচকি হেসে বলল,
-‘খেয়েছি তো! আবারও খিদে লেগেছে।
রূপায়ন হেসে দিল। হাতমুখ ধুয়ে এসে, নিজে খেলো, অনুপমাকেও তুলে খাইয়ে দিল। বলল,
-‘ ডাক্তার কবে যেতে বলেছে?
অনুপমা ইতঃস্তত করে বলল,
-‘হওয়ার ডেট সাতদিন পার হয়ে গেছে।
-‘কী.. তুমি আমায় এখন বলছো এই কথা?
-‘আসলে ভেবেছিলাম, নরমালেই হবে।
-‘এখন আর আগের দিন নেই অনুপমা। কালকেই আমরা ডাক্তারের কাছে যাব।

(চলবে)

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
শেষপর্ব

যে মানুষটা সবার বিপদ-আপদ, ভাল-মন্দ, সুখে-দুঃখে সবসময় সবার আগে ছুটে যেতো। আজ তার বিপদের দিনে কাউকেই পাশে পেল না।
অনুপমাকে গতকাল সকালে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে রূপায়ন। গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আবার নতুন করে আল্ট্রাসনোগ্রাম টেস্ট দিয়েছে। রিপোর্ট দেখে বলল,
-‘পানি শুকিয়ে গিয়েছে। নরমালে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যতদ্রুত সম্ভব সিজার করতে হবে। রূপায়ন ঘাবড়ে গেল।

ফুসপিসি গতমাসে তার বড়মেয়ের কাছে ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছে। নিপা, রুপার সাথে রাজশাহী রুপার এক আত্মীয়রও বিয়ের অনুষ্ঠানে বেড়াতে গিয়েছে। এখন আসতে পারবে না। বাকি রইল সীমা আর দিপা। এতবড় বাড়ি ফেলে সীমার রাতদিন হাসপাতালে পরে থাকা সম্ভব না। তবুও রূপায়ন ফোন করে বলে দেখেছিল, অনুপমাকে সিজারে দেওয়া হয়েছে। সীমা কী এসে, একটু কষ্ট করে দুটো রাত থাকতে পারবে? অরুপ বাড়িঘর ফেলে সীমাকে আসতে দেয়নি। দিপাকেও এই একই কথা বলেছিল রূপায়ন। দিপা আসছে! তবে রাতে থাকতে পারবে না। একা একা কীভাবে কী করবে রূপায়ন ভেবে পেল না৷ চিন্তায় অস্থির লাগছে। অনুপমাকে ও.টি তে নিয়ে যাওয়ার সময়, রূপায়নের হাতটা চেপে ধরে মলিন হেসেছিল অনুপমা। মায়াবী চোখদুটো ছলছল করছিল। চাপা কষ্ট, অজানা ভয়ে বুক দুরুদুরু করছিল রূপায়নের। মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছে। একেকটা সেকেন্ড.. এক হাজার যুগের সমান মনে হচ্ছে।

অনুপমাকে ও.টি.তে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিল নার্স। হাতে পর পর খুব দ্রুত দুটো স্যালাইন শেষ করল। আরেকটা স্যালাইন সেট করে দিয়ে, মেরুদণ্ডতে ইনজেকশন পুশ করে দিল। এত ব্যথা পেল অনুপমা! চোখে জল এসে গেল। তবে পেট অবশ হলো না। আবারও আরেকটা ইনজেকশন পুশ করে দিল। পায়ে জোরে চিমটি কেটে বলল,
-‘কিছু অনুভব হচ্ছে?
অনুপমা মাথা নেড়ে না বোঝাল। একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে অনুপমার তলপেটের নীচের অংশে আড়াআড়ি ভাবে টান দিল। অনুপমা অনুভব করে ভয়ে কেঁপে উঠল। পর পর সাতটা পোঁচ দিল ডাক্তার। একজন নার্স অনুপমার ওইদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনুপমার সাথে গল্প করছে।
পেটটা দুহাত দিয়ে ফাঁকা করে ধরে, বাবুর মাথা কায়দা করে ধরে জোরে টান দিতেই অনুপমার মনে হলো পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুড়ি বেড়িয়ে আসছে! মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। গলার কাছে বমি বমি ভাব এসে ঠেকল। ধীরে ধীরে চোখটা বুঁজে আসছে। একজন নার্সের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ফিসফিস করে বলল, আপনার মেয়েবাবু হয়েছে। বাবুটা চিকুন স্বরে কাঁদছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল অনুপমা।

নার্স বাচ্চাটাকে পরিষ্কার করে ও.টি.র বাইরে নিয়ে গেল। বলল,
-‘অনুপমার বাড়ির লোক কে?
রূপায়ন এগিয়ে গেল। বলল,
-‘আমি।
-‘আপনার কাছে কাপড় আছে?
রূপায়ন ব্যাগ থেকে পরিষ্কার সুতি কাপড় বের করে দিল। নার্স বাবুটাকে পেঁচিয়ে রূপায়নের কোলে তুলে দিল। বলল,
-‘ এই নিন। অনুপমার মেয়েবাবু হয়েছে।
রূপায়ন কাঁপা কাঁপা হাতে বাবুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদে দিল। ফিসফিস করে বলল,
-‘আমার মা এসেছে..আমার মা।
নার্সকে বলল,
-‘আমার ওয়াইফ কেমন আছে?
-‘রক্ত লাগেনি। সেলাই চলছে। একটু পরেই সরাসরি বেডে দেওয়া হবে।
ততক্ষণে দিপা চলে এসেছে। রূপায়নের কোল থেকে ভাতিজীকে কোলে তুলে নিয়ে চেয়ারে বসল।
রূপায়নের মেয়ে হয়েছে। গোবিন্দ খবর পেয়ে রুম্পাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো। অনুপমাকে ও.টি. থেকে বের করে দেওয়ার সময় খিচুনি উঠে গেল। রুম্পা পাশের বেডের একজনের কম্বল চেয়ে নিয়ে অনুপমাকে চেপে ধরল। ধীরে ধীরে অনুপমা স্বাভাবিক হলো।
রুম্পা, বেশ কায়দা করে বাবুকে শালদুধ খাইয়ে দিল। বাচ্চা চোখ তুলে সবাইকে দেখছে। কখনো মিহি শব্দে কাঁদছে। সন্ধ্যার আগে আগে দিপা বলল,
-‘আমি এবার আসি বড়দাভাই। বেশি রাত করলে গাড়ি পাওয়া যাবে না।
-‘তুই রাতটা থেকে যা দিপা? আমি একা একা কী করব?
-‘আমার দিপকের পরিক্ষা চলছে। আমি কীভাবে থাকব? খাবার কিনে খাওয়ার দরকার নেই। আমি ভাত পাঠাব। ভাতিজীর হাতে হাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়েই দিপা চলে গেল। গোবিন্দ রাত আটটার দিকে রূপায়নকে বলল,
-‘রুম্পাকে রেখে গেলাম। আমি কাল ওর জামাকাপড় দিয়ে যাব। ও বৌদির সাথে থাকবে। এত টেনশন করো না বন্ধু। কারো জন্য কোনকিছু ঠেকে থাকে না।
রূপায়ন বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
অনুপমার ধীরে ধীরে অবশ ছুটে যাচ্ছে। এত পেট জ্বলছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে দিল। রূপায়ন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে লক্ষ্মীটি?
অনুপমা সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক মেয়ের দিকে তাকিয়ে, ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘কষ্টের থেকে স্বস্তি পাচ্ছি বেশি।
রূপায়ন ঝুঁকে অনুপমার কপালে চুমু খেলো, বাবুটার কপালেও চুমু এঁকে দিল রূপায়ন। অনুপমার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে বলল,
-‘আমার মাকে এনে দেওয়ার জন্য তোমায় অনেক ধন্যবাদ সোনা।
অনুপমা নিঃশব্দ হাসল। রূপায়নের ঠোঁটের কোণেও লেগে রইল তৃপ্তির হাসি।
মনে মনে বলল,
-‘ভাগ্যিস সেদিন ওই গ্রুপটাতে নিজের দুঃখের কথা লিখে, পোস্ট দিয়েছিলাম। তা নাহলে অনুপমাকেও নিজের করে পাওয়া হতো না। আর না..এত সুখী হতাম জীবনে! “কিছু কিছু দূর্ভাগ্য, কখনো কখনো সৌভাগ্যও বয়ে আনে!”

(সমাপ্ত)