শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-০১

0
338

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১|

[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]

মাঝরাতে প্রাক্তন আর তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি দেখে আঁতকে উঠল প্রিয়। ফোন ছিটকে বিছানায় পড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসল। সাইডবক্স থেকে গ্লাস উঠিয়ে জল খেয়ে আবার ফোনটা হাতে নিল।

কিছুদিন পূর্বে যখন সে প্রাক্তনের বিয়ের খবর পায়, তখনই তার সাথে সংযুক্ত সকল কিছু নষ্ট করে ফেলে; পুরোনো সিম ভেঙে ফেলে, পুরোনো আইডি ডিলিট দিয়ে ফেলে। সব ছবি, ডায়েরি পুড়িয়ে তবেই নিশ্চিন্ত হয়।
গত রাতে নতুন এই অ্যাকাউন্টটা খুলেছে। মেসেঞ্জারে লগ ইন করে আজ। আর আসতেই, একটা ম্যাসেজ রিকুয়েস্টে চোখ আটকে যায়।
জ্বলজ্বল করে সেন্ডার আইডির নামটি, “আশফিক রহমান।”

সাত বছরের পরিচিতি, ছ’বছরের প্রেম শেষে বিচ্ছেদের এগারো মাস চলছে। হুট করে স্বীয় প্রাক্তনের আইডি থেকে এগারো মাস পরে ম্যাসেজ পেয়ে সে বিস্মিত হলো। না দেখে ব্লক করে দিতে চাইল, কিন্তু পারল না। কৌতূহল বড়ো সাংঘাতিক জিনিস।

প্রিয় আবারও ইনবক্সে প্রবেশ করল। এবার নিজেকে সামলাল। ছবিগুলোকে লক্ষ করলে, দেখতে পেল দুজন মানব-মানবীকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় একে-অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকতে। মেয়েটার চেহারা অস্পষ্ট। সে ছেলেটার বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। অনাবৃত গায়ের পিঠ অবধি চাদরে আবৃত। ছেলেটা তাকে একহাতে জড়িয়ে আরেক হাতে ওপর থেকে সেলফি তুলেছে। মুখে তার ভারি তৃপ্তির হাসি।
অজানা কারণে প্রিয়র বুকটা কেঁপে উঠল। রিপ্লাই করবে না সে, একদম না।

রাত আড়াইটা বাজে। প্রিয় দরদরিয়ে ঘামছে। বুকের মাঝে কেমন একটা হচ্ছে। সে না চাইতেও আবার ম্যাসেজটা দেখল। কান্নারা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ সে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সবকিছুর মুখোমুখি করার জন্য প্রস্তুত করল। বড়োসড়ো ক’টা শ্বাস টানল।
যখন দেয়াল ঘড়িটা তিনটার কাটা ছুঁয়ে শব্দ করে উঠল, জানান দিলো চতুর্থ প্রহরের শুরু—ঠিক তখন প্রিয় শান্ত হলো। রাতের গভীরতা জানে যন্ত্রণারা কতটা ভয়াবহ। সে রাতকে সাক্ষী রেখে প্রিয় যন্ত্রণাকে কোনো এক আবর্জনার সাথে তুলনা করে দূরে ছুড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত, স্নিগ্ধ ও অবিক্ষিপ্ত বানিয়ে নিল।

গুনে গুনে তিনটা ছবি, তার রিপ্লাই ম্যাসেজে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে নিজের নির্লিপ্ততার জানান দিলো। বোঝাল—“ওহে নষ্ট পুরুষ, গত হওয়া প্রিয়শ্রী জ্বলন্ত আগুন হয়ে থাকলেও, উপস্থিত এই প্রিয় নির্লিপ্ত; তোমার গায়ে পড়া অন্য নারীর ছায়া প্রিয়শ্রীর সহ্য হতো না, অথচ প্রিয় নিজেই অন্য নারী। বিশেষণটি লক্ষ করো—অন্য নারী!”

তারপর একটি বিনিদ্র রজনীর শেষ হলো, রাতের গভীরতার সাথে প্রিয়র মনে পড়তে লাগল ভার্সিটির সেই দিনগুলোর কথা।

_______
সাত বছর আগে…

সারারাত ভারি বর্ষণ শেষে সকালের দিকে আকাশটা পরিষ্কার হয়েছে। চারিদিক প্রাণবন্ত। কৃষ্ণচূড়ার একদম ওপরের ডালটিতে কিছু রক্তলাল ফুল। কী মোহময় লাগছে! প্রিয় আজ আর ওদিকে তাকাল না, কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে এগোতে লাগল। একদম কাছাকাছি চলে আসতেই তার ব্যাগ পড়ে গেল। মনে মনে হাজার দশেক গালি ক্রমাগতভাবে বলতে বলতে ঝুঁকে বসল। ব্যাগের ভেতর থেকে টুকিটাকি জিনিস বেরিয়ে গেছে। ভাগ্যিস রাস্তার এ-পাশটা শুকনো ছিল!
প্রিয় সেগুলো ওঠাতে লাগল, ঠিক তখনই পাশের টঙের দোকান থেকে চাপা হাসির সাথে কিছু গুঞ্জন তার কানে বাড়ি খেল।

প্রিয়র হাত দুটো কিঞ্চিৎ ক্ষণের জন্য থামল। পর পর চলমান হতে লাগল। কানে এখনও হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ আসছে। সে আঁড়চোখে দোকানের ভেতরটায় দেখল। চার-পাঁচজন ছেলে মিলে নিজেদের মধ্যে আসর জমিয়েছে। ব্যাগে সব ওঠাতে ওঠাতে তার চোখ থেমেছে সাদা শার্ট পরা ছেলেটার দিকে। গায়ের সাথে একদম মিশে থাকা সাদা শার্ট। খানিকটা অগোছালো চুল। কনুই অবধি ফোল্ড করা স্লিভস, কালো ওয়াচ! সব মিলিয়ে কী অসম্ভব সুন্দর!
একজন ছেলে সেই ছেলেটিকে উদ্দেশ্য বলল,

-“কীরে মামা, সারা জীবন ব্যাচেলর থাকার প্ল্যান নাকি? চারচোক্ষা রউফও মেয়ে পটিয়ে ফেলছে, তুই আর কত একা থাকবি? মেশিন-টেশিন ঠিক আছে তো? না থাকলে বল, তোর সর্বোচ্চ চিকিৎসা করাব আমরা। তাই-না?”

বাকিরা হো-হো করে হেসে উঠে সায় জানাল। কী লজ্জাজনক কথা! অগোচরে দাঁড়িয়ে এসব শুনে প্রিয়র গাল দুটোয় লালচে আভা ছড়িয়ে গেল। সে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল। দোকান ক্রস করতে করতে আরেকবার ভেতরে তাকাল। তখনই সাদা শার্টওয়ালা ছেলেটা তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,

-“আমি প্রেমে পড়ব না, প্রেমে মরব। জাস্ট ওয়েট, তাক লাগিয়ে দেবো।”

ঘন গলার জড়িয়ে যাওয়া স্বর। প্রিয়র ভেতরে কী যেন হলো। সে টঙের দোকানটি থেকে এখন অনেকটা দূরে এগিয়ে এসেছে। ক্যাম্পাসে যেতে যেতে একবার মনে হলো—ফিরে যেতে, সেই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, না দেখা চেহারাটা জনমের তরে দেখে নিতে। কী পাগলামো ইচ্ছে! প্রিয় লাজুক হাসে। বড়োসড়ো একটা ক্রাশ খেয়েছে সে। ইশ! আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকলেই নামটা শোনা যেত!

প্রিয় ডিপার্টমেন্টে প্রবেশ করতেই তাকে ঘিরে ধরল তার বন্ধুমহল। সচরাচর সেই বন্ধুদের মাতিয়ে রাখে। অথচ আজ সে চুপ। সবার গল্পের ভীড়ে সে মুচকি মুচকি হেসে দেখে যাচ্ছে। ব্যাপারটা লক্ষ করল তমা। কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো প্রিয়কে।

প্রিয় ঘাবড়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তমা সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

-“কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছিস? নাকি রটিয়েছিস? কী এমন করেছিস যা আমরা জানি না? শাওন, একে বলতে বল শিগগিরই! নয়তো আমার লাথি থেকে এর জুনিয়র ভার্সনও একে বাঁচাতে পারবে না।”

শাওন খেয়াল করল প্রিয়র আজ হাওয়ায় গা ভাসিয়ে ওড়াটা। জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু হইছে?”

প্রিয় অগত্যা স্বীকার করে নিল। কিছু একটা হয়েছে। কিছু একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছে। সে একটা সাদা শার্টের প্রেমে পড়েছে, সাদা রঙের প্রেমে পড়েছে, সাদা শার্টওয়ালা লোকটার সেই গম্ভীরমুখের ঘন ও জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজটির প্রেমে পড়েছে। তার দাঁড়িয়ে থাকার ধরণের প্রেমে পড়েছে। তার দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখার প্রেমে পড়েছে। সবকিছুতে যেন আফিম! প্রিয়র নেশা ধরে গেছে।

অবাক হয়ে গেল শাওন ও তমা। শুকনো ঢোক গিলে তমা শুধাল,
-“কপালপোড়া ছেলেটা কে?”

প্রিয় কল্পনার চাদর থেকে বেরিয়ে এসে শাসানো নজরে তাকাল। মুখভাব নিমিষেই গম্ভীর করে বলল,

-“চিনি না।”

চমকে উঠল শাওন, তমা নিজেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। শুধাল,
-“তার নাম কী?”
-“হবে কিছু একটা।”
-“থাকে কোথায়?”
-“তার বাড়িতেই।
-“দেখতে কেমন?”
-“মানুষের মতোই।”

তমা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বান্ধবীর দিকে তাকাল। ফোঁসফোঁস করতে করতে রাগিত আওয়াজে আবারও জিজ্ঞেস করল,

-“একটা ডিটেইলস কি জানিস? অন্তত একটা?”

সে জানে। চোখে-মুখে ফুটে উঠল উৎফুল্লতা। উত্তেজিত গলায় বলল,

-“জানি।”
-“কী?”
-“সে সাদা শার্ট পরা ছিল।”

কপালে হাত চলে গেল শাওনের। পালাক্রমে তমা আর প্রিয়র দিকে তাকাল। তমা নিজেও বুঝে গেল, তার বান্ধবীর সাথে প্রথমবারের মতো লাভগেইম হচ্ছে। গেইমের টাইমিং কতক্ষণ, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

_______
এক্সাম ছিল আজ। প্রিয় ক্লাসরুম থেকে বেরোল দেরি করে। বের হওয়ার পর পরই দরজার সামনে তিশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তিশা ওদের ডিপার্টমেন্টেরই একজন মেয়ে। ভীষণ মিশুক ও চঞ্চল, সবার সাথে মেশে কিন্তু কেন যেন প্রিয়দের সাথে বনিবনা হয় না। তিশা মেয়েটা একটু ছেলেদের গায়েপড়া ধরনের, এজন্য প্রিয় নিজেই এড়িয়ে যায়। স্বভাববশত এড়িয়ে যাওয়ার মতলবে পাশ কাটিয়ে পা বাড়াল। তিশা তখনই তাকে ডেকে উঠল।

প্রিয় দাঁড়াল। পিছু ঘুরে সরু দৃষ্টিতে তিশাকে অপ্রস্তুত করতে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল,
-“কী?”

তিশা ঘাবড়াল না, বরঞ্চ অন্যদিকে মুখ ভেঙচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। এই কাগজটা ধরো।”

হাত বাড়িয়ে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলো তিশা। প্রিয় বুঝতে পারছে না, এটা কীসের চিরকুট। তবুও নিল। তিশার সামনেই তা খুলল। চিরকুটটা খুলতেই গুটিকয়েক শব্দের দেখা মিলল। প্রিয় শব্দহীনভাবে পড়ল,

~“মিস জুনিয়র, এক্সাম কেমন হলো?”~

এ কেমন চিরকুট? এমনিতেই জঘন্য একটি পরীক্ষা দিয়ে এলো। এরপর এরকম নাম না জানা ব্যক্তি থেকে পাওয়া চিরকুট। বিরক্তিতে প্রিয়র মুখ কুঁচকে এলো। তিশার উপর সেই বিরক্তির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েও পারল না। সুমিষ্ট প্রিয় দাঁতে দাঁত চেপে তিশাকে বলল,

-“কাইন্ডলি বলবে কি, কে তোমাকে ডাকপিয়ন সাজিয়েছে?”

তিশার রাগ আসে না সহজে, সে আনমনেই ক্যাম্পাসের পশ্চিমে তর্জনী উঠিয়ে বলল,

-“ওই সাদা শার্ট পরা ভাইয়াটা।”

চলবে…