সবটাই তুমিময় পর্ব-১০

0
915

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১০

-এএসএ!

তানহার কথাটা শুনে আস্তেধীরে পিছন ফিরলাম।গ্রে শার্টের উপর গাঢ় নীল কালারের ব্লেজার,শার্টের হাতা ফোল্ড করা,হাতে ঘড়ি,চোখে কালো সানগ্লাস আর ঠোটে টেডিস্মাইল নিয়ে অঙ্কুর দাড়িয়ে।বলিষ্ঠ দেহে আটকে রয়েছে শার্টটা।হাতের পেশিগুলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।মুঠোতে থাকা কালো স্মার্টফোনে রোদ পরেছে,সেটার প্রতিফলন সোজা চোখে এসে লাগছে আমার।অঙ্কুর সানগ্লাসটা খুলে এগোলেন আমাদের দিকে।একদম আমার সামনে এসে দাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন,

-জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটা পেয়ে গেছো তুমি অদ্রি।আর সেটা আমি!বর হই‌ তোমার।আর তাই তোমার সব সিচুয়েশনে তুমি আমাকেই ডাকবে।অন্য কাউকে নয়!

হাত মুঠো করে দাড়িয়ে রইলাম।বাকিসবের কথা মনে পরতেই আবারো পিছন ফিরলাম আমি।তানহা এখনো বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে,আস্থার হা হওয়া মুখ এখনো বন্ধ হয়নি।তিহান অবিশ্বাসের চোখে অঙ্কুরকে দেখে চলেছে।মাথা নিচু করে নিলাম আমি।অঙ্কুর একটু জোরে হেসে দিয়ে বললেন,

-আরে,এতো সিরিয়াসনেস কেনো?অদ্রি?চুপ কেনো তুমি?পরিচয় করিয়ে দাও ওদের সাথে আমার?তোমার…বরের সাথে!

চুপই রইলাম।তানহা একটু এগিয়ে বললো,

-এসব…এসব কি আন্নু?

অঙ্কুর বললেন,

-আসলেই অদ্রি,এসব কি বলোতো?এএসএ কে তো সবাই চেনে।নিজের বরকে তো চেনাও এবার!

তানহা বললো,

-আন্নু?কিছু তো বল?এএসএ এভাবে….

তিহান শক্ত গলায় বললো,

-দেখুন স্যার?হতে পারেন আপনি একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার।তা বলে আমাদের মতো সাধারন মানুষজনদের নিয়ে এভাবে কথা বলার অধিকার আপনার নেই।

-আরে,আমার বউ হয় অদ্রি!আর কিভাবে কি বলবো?স্ট্রেইন্জ!

এবার তিহান চেচিয়ে বলে উঠলো,

-উনি এসব কি বলছেন আন্নু?আর এই অদ্রি?তোকে অদ্রি কেনো বলছেন উনি?

অঙ্কুর যা করেছেন,তাতে এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে আমাকে।আর এখান থেকে অস্বীকারের কোনো উপায়ও নেই।চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম,

-উনি ঠিকই বলছেন।আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।আমাকেই অদ্রি বলে ডাকেন উনি।

-কিহ্?

তানহার বিস্ময়।চোখ মেলে তিহানের দিকে তাকালাম।ওর এসব কথা যে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তা বোঝাই যাচ্ছে।অঙ্কুর বললেন,

-হ্যাঁ গাইস,এটাই তো বলছি কতোক্ষন হলো আমি!চলো এবার অদ্রিও বলে দিয়েছে!এবার বিশ্বাস হলো তো?আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।আসলে কি বলোতো,লাভ এট ফার্স্ট সাইট।প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।আর অদ্রিও হ্যাঁ বলে দিয়েছে।তাই আর দেরি করি নি।তবে হ্যাঁ,ধুমধাম করে বিয়ে করে তোমাদের পেটপুর্তি করাতে না পারার জন্য সরি হ্যাঁ?আসলে,বোঝোই তো লাইফের প্রথম ভালোবাসা।কোনো রিস্ক‌ নিতে চাইনি।

এটুক শুনে তানহার দিকে তাকালাম।ও তিহানের দিকে তাকিয়ে।তিহানের ছলছল করতে থাকা চোখজোড়া যেনো চেচিয়ে বলছে,এটা হতে পারে না।চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।আস্থার হেলদোল নেই।আগের মতোই কিঞ্চিত হা হওয়া চেহারা নিয়ে মুগ্ধ চোখে অঙ্কুরকে দেখতে ব্যস্ত ও।

-বুঝেছি।অদ্রি চায় আ‌মি নিজে থেকে পরিচিত হই তোমাদের সাথে।মেবি চেক করতে চায়,ওর বর্ননা শুনেই আমি তোমাদের‌ চিনি কি না।ওয়েট,লেট মি গেইস!

অঙ্কুর তানহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

-তুমি তানহা।রাইট?তোমার কথা অনেক বলেছে অদ্রি।তান্নু তান্নু করে একদম পাগল করে রেখেছে এ কয়দিন আমাকে।

অঙ্কুরের এতো সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলা দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।তানহাও তারদিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে।অঙ্কুর তুড়ি বাজিয়ে বললেন,

-তানহা?

তানহা ধ্যান ভেঙে বললো,

-হুম?জ্ জ্বী।জ্বী স্যার।

-নাইস টু মিট ইউ!

-থ্ থ্যাংক ইউ স্যার।

-আরে আরে,স্যার কেনো বলছো?স্যার বলতে হবে না।জীজু হই তোমাদের।ভাইয়াই ডাকো।

-জ্ জ্বী স্যার।আইমিন ভ্ ভাইয়া।

অঙ্কুর তিহানের দিকে এগিয়ে বললেন,

-তুমি তিহান।রাইট?

তিহান আমার দিকে তাকিয়েই‌ মাথা দুলালো।ওর চোখ ভরে আছে পানিতে।কিভাবে আটকে রেখেছে তা ওই জানে।অঙ্কুর বললেন,

-তোমার কথাও অনেক শুনেছি।

-আমার কথা বলেছে আন্নু আপনাকে?

-হ্যাঁ।বলেছে তো!অদ্রির একমাত্র ছেলেবন্ধু বলে কথা!

তিহান আমার দিকেই তাকিয়ে পুরোটা সময়।চোখ ‌মেলাতে পারিনি ওর সাথে।ও বললো,

-তারমানে এ কয়দিন তুই এএসএ’র সাথে ছিলি আন্নু?

অঙ্কুর বললেন,

-রাইট ইউ আর!আমার কাছেই ছিলো ও!তুমি বেশ ইন্টেলিজেন্ট তিহান।

তিহান তাচ্ছিল্যে হাসলো।বললো,

-বুদ্ধিমত্ত্বা কাজে লাগানোর জায়গাটা আর রইলো কই?কি করবো আর ইন্টেলিজেন্সি দিয়ে?মনিমাকে আন্নুর জন্য জবাবদিহি করার জন্য মানুষ এসে গেছে যে!এনিওয়েজ,কনগ্রাচুলেশনস্।উইশ ইউ আ ভেরি হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।দোয়া করি,খুব ভালো থাকুন আপনারা।

-থ্যাংক ইউ।

-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।

-স্যার কেনো বলছো তিহান?তানহা তো….

-ভাইয়া বলার জন্য আমাকে জোর করবেন না প্লিজ।তানহার বিষয় আলাদা।আমি বিশ্বাস করি আমার মতো নিম্নবিত্তের আপনাকে ভাইয়া ডাকার যোগ্যতা নেই।স্যারেই কম্ফোর্টেবল আমি।

অঙ্কুর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,আস্থা এগিয়ে এসে একদম সামনে দাড়ালো তার।মুগ্ধচোখে দেখেই চলেছে ওনাকে।তানহা ইতস্তত করে বিরবিরিয়ে বললো,

-আস্থা?বিহেভ ইয়োরসেল্ফ!

-হু।

হু বলেও হুশ নেই ওর।অঙ্কুর একটু ঠোট টিপে হেসে বললেন,

-হ্যালো আস্থা।

এতোক্ষনে যেনো মাটিতে আসলো ও।লাফিয়ে চারপা পিছিয়ে গিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ওরেএএএএ!আন্নু তান্নু!কার হাতের‌ চিমটির জোর বেশি?আমাকে চিমটি লাগা কেউ!নইলে চুল ছেড় আমার!নইলে কিছু একটা কর যাতে আমি স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসি!আল্লাহ গো!আমি কই গো!তিহানের বাচ্চা!কই তুই?সার্কেলে তুইই একমাত্র পোলা!একটু এনশিওর করতো,এএসএ ‘র মতোন দেখতে এইটা কে?

তানহা মার লাগালো ওকে।দাতে দাত চেপে বললো,

-ওভারএক্টিংয়ের দোকান!এইটা এএসএ ই!থাম ইয়ার!উনি আসার পর থেকেই চোখ দিয়ে গিলে চলেছিস ওনাকে।প্লিজ স্টপ ইট!

আস্থা রোবটের মতো একপলক ওরদিক তাকালো।পরপরই হাত ছড়িয়ে একদৌড় লাগালো অঙ্কুরের দিকে।যেনো জরিয়ে ধরবে এমন ভাবে এগোচ্ছিলো ও।তানহা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-থাম আস্থা!ইয়ার!কি করছিস তুই!ওনার আর আন্নুর ব্ বিয়ে হয়ে গেছে।আন্নুর বর হন উনি!

আস্থা থেমে গেলো।গাল ফুলিয়ে ওরদিক তাকিয়ে কাদোকাদো গলায় বললো,

-ইউ আর জোওওওকিং!

তিহান একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

-তান্নু?তুই যাবি?আমি বাসায় যাবো।আব্বুর ঔষুধ কিনতে হবে।এখন না গেলে লেইট হয়ে যাবে।

তানহার কিছুটা অবাক চাওনি।সাথে আমিও।কিছুক্ষন আগ অবদিও ও রাজি ছিলো না ওকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে।এখন ওর সাথে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছে।অঙ্কুর বললেন,

-তানহা?তুমি চলে যাও।অদ্রির কাছে আমি আছি তো!ডোন্ট ওয়ারি।বাকি কথা পরে হবে?

তিহান হনহন করে চলে আসলো ওখান থেকে।তানহার বিস্ময় তখনও কাটেনি আমি জানি।অঙ্কুরের সাথে আমার সম্পর্ক,তিহানের ওকে নিয়ে যেতে চাওয়া দুটোই কতোটা শকিং ওর জন্য তা আন্দাজ করতে পারছি।এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-এখন আয় তুই তান্নু।

তানহা ঘাড় নাড়ালো।সৌজন্যের হাসি হেসে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আ্ আসছি স্যার।

-ভাইয়া!

-জ্ জ্বী।আ্ আসছি ভাইয়া।

-এসো।

ওরা চলে গেলো।দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।ওদেরকে একসাথে দেখে এতোসব অশান্তির মধ্যেও অদ্ভুত শান্তি লাগছে।আস্থা ফিসফিসিয়ে বললো,

-ইয়ে আন্নু,আমি বলছিলাম কি….

-বাসায় চলে যা!পরে কথা হবে।মনিমার কাছে যাচ্ছি আমি।

চলে এলাম ওখান থেকে।একবারও আর পিছন ফিরে তাকাইনি।বিয়ের কথাটা ওদের অঙ্কুর নিজে জানিয়েছেন।তাই এরপর কি হবে,উনি কি করবেন সবটাই ভেবে রেখেছেন নিশ্চয়ই।যা করার করুক উনি।আপাতত মনিমার সুস্থ্য না হওয়া অবদি অন্য কিছুই ভাবতে পারবো না আমি।কিছুই না!

.

মনিমাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম কেবিন থেকে।বাইরে বেরোতেই দেখি করিডোরে রাখা চেয়ারে মাস্ক পরিহিত কেউ বসে।চিনতে খুব একটা সময় লাগেনি।এটা অঙ্কুর।চলে আসছিলাম।উনি উঠে দাড়িয়ে মাস্ক খুলে সামনে দাড়ালেন আমার।ব্যস্তভাবে বললেন ,

-খাইয়েছো?

-হুম।

-খেয়েছো?

-হ্যাঁ।মনিমা জোর করে…

-আমি খাইনি।

ভ্রুকুচকে তাকালাম।কি বোঝাতে চাইছেন উনি?অঙ্কুর করুনভাবে বললেন,

-কবে যাবে ও বাসায়?

এমন অসহায়ভাবে প্রশ্ন একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো আমার।একবারের জন্য মনে হলো আমাকে ছাড়া এমনই অসহায় উনি।পরক্ষনেই ওনার বেবি চাওয়ার কথা মনে পরতেই নিজেকে সামলে নিলাম।আমার আবেগ এএসএ’র জন্য নয়।যেখানে আমাকে শুধুই তার স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে চাইছেন উনি।

-কথা বলছো না কেনো অদ্রি?কিছুতো বলো?কবে আসবে ও বাসায়?

-মনিমা স্….

-ডক্টর বলেছে তোমার মনিমা কালই বাসায় যেতে পারবে।

-আ্ আমার একটু সম্….

-সময় চাই তাইতো?বেশ।টেক ইউর টাইম।বাসায় যাও,মনিমার সাথে সময় কাটাও।ঠিক সময়মতো আমার বউকে নিতে পৌছে যাবো আমি।

মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।এগুলো অবিশ্বাস্য লাগছে।অঙ্কুর জোর করা,বাধ্য করা ছাড়াও আমার কথাকে দাম দিচ্ছেন,মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার।অঙ্কুর আবারো বললেন,

-বিয়েটা নিয়ে এখনই কাউকে কিছু বলো না।কথাটা পাব্লিক হলে প্রেস মিডিয়া তোমাকে তোমার বাসায় থাকতে দেবে না।যদিও আমার তোমাকে ঘরে তুলতে কোনো সমস্যা নেই।ইউ নো,তোমার মনিমা….

-কেউ কিছুই জানবে না।কিন্তু তানহা,তিহান বা আস্থা….

-ওরা কাউকে কিছুই বলবে না।

-আপনি আগে থেকেই চেনেন ওদের?

অঙ্কুর মাথা নিচু করে রহস্যময় হাসি দিলেন একটা।বললাম,

-কি হলো?বলুন?আগে থেকে চেনেন ওদের?

-তোমার জন্য চিনে নিয়েছি।

আমার বিস্ময় সীমা ছাড়াচ্ছে বারবার।উনি বললেন,

-তিহান এখানে…

-মনিমা ওকে পছন্দ করে।তাই…

-আর ও তোমাকে।

চুপ করে গেলাম।সবটাই জানেন উনি।খুব ভালোমতোই চিনে গেছেন আমার আশেপাশের সবাইকে।অঙ্কুর বললেন,

-ডাজেন্ট ম্যাটার।তুমি আমার বউ!আর তাই তোমার রাগ,ঘৃনা সবটা আমার প্রাপ্য।আমারই।কাল বাসায় ফিরে ভার্সিটি জয়েন করো।মন দিয়ে ক্লাস করো।এখন থেকে তুমি কোনো সিক্রেট রিপোর্টার নও।সাধারন একটা স্টুডেন্ট।আর হ্যাঁ,বাসার বাইরে সবসময় মুখ ঢেকে বেরোবে।

-মানে?মুখ ঢেকে কেনো?

-আমি বললাম তাই!

-দেখুন,এসবের কোনো মানে….

-কোনসবের কি মানে তোমাকে তা বুঝতে হবে না অদ্রি!যা বলেছি,তাই করবে।নইলে আস্তে করে তুলে নিয়ে যাবো।

আবারো ঘৃনায় বুক ভরে উঠলো।হুট করেই অঙ্কুর আরেকটু এগিয়ে এসে আমার দুগাল ধরলেন।ওড়না খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলাম।উনি বললেন,

-সাবধানে থেকো।

এটুক বলে আমার কপালে ঠোট ছুইয়ে দিলেন উনি।শরীরজুড়ে এক অদ্ভুত শিহরন।টের পেলাম,যেনো কেপে উঠলাম মৃদ্যু।হাতের মুঠো করা ওড়না আলগা হয়ে আসলো।কেমন এক দুর্বলতা ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে।গাল ছেড়ে দিয়ে মাস্কে মুখ ঢেকে‌ নিলেন উনি।পকেটে দুহাত গুজে আমার দিকে তাকিয়েই পেছোতে লাগলেন।মাস্কের জন্য তার অদৃশ্য মুচকি হাসিটা ওই গভীর চোখজোড়াতেই ফুটে উঠছিলো যেনো।হাসছিলেন উনি?কেনো?বরাবরের মতো আমার প্রশ্ন উত্তরহীনই রয়ে যায়।উনি বেরিয়ে গেলেন।

#চলবে….