সবটাই তুমিময় পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
1458

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব

অঙ্কুরের বুকে মাথা গুজে‌ নিরবে কাদছি।উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার।আমার এই নিরব কান্না গত তিনবছর হলো সয়ে এসেছেন উনি।এভাবেই।আমার হাজারো আকুতির ফলস্বরুপ তিন তিনটে বছর পর মানুষটা আবারো ক্রিকেটজগতে ফিরতে রাজি হয়েছে।সবে ক্রিকেট বোর্ডের মিটিং ছেড়ে এসেছেন উনি।সারাদিন অনেকটা ধকল গেছে তার,জানি।তবুও এটুকো ছাড় আজ তাকে দিতেই হবে।নেবোই আমি।উনি বললেন,

-আর কতো কাদবে অদ্রি?

-কাদতে দিন আমাকে।প্লিজ অঙ্কুর!

-কেনো কাদছো?কতোবার বুঝিয়েছি তোমায়,আমার বিশ্বাস হারে না।কেনো সে বিশ্বাসে এতোটা অবিশ্বাস তোমার অদ্রি?বলতে পারো?বলেছি তো,খুব তাড়াতাড়িই তোমার কোলে বেবি আসবে।মা হবে তুমি।আমিও বাবা হবো।এই তোমার কান্না দেখার জন্যই কি আড়াইবছর দেশের বাইরে ছিলাম,বলো?আল্লাহর অশেষ দয়ায়,অপারেশনটাও সাকসেসফুলি হয়ে গেছে তোমার।তোমার নিজের পড়াশোনা,স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছো।তুমি এভাবে ভেঙে পরলে আমার কষ্ট হয় অদ্রি।এতোসবের পরেও তোমার কষ্ট এতোটুকো কমাতে পারি নি আমি।দাদুভাইকে বলেছিলাম,সুখের বলয়ে মুড়িয়ে রাখবো তোমাকে।পারি নি।এটা তো আমারই ব্যর্থতা।আমি তো….

-আপনি বাবা হতে চলেছেন অঙ্কুর।

উনি থেমে গেলেন।আস্তেধীরে ছাড়িয়ে নিলেন নিজেকে।জলভরা চোখে তাকিয়ে দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো কিছুক্ষন।দুফোটা চোখের জল ফেলে প্রেগনেন্সি রিপোর্টটা এনে সামনে ধরলাম তার।হাতে না ধরে ওভাবেই টলোমলো চোখে কাগজটায় তাকালেন উনি।হ্যাঁ,সত্যিই তার বিশ্বাস জিতে গেছে।তার তিনবছরের লড়াই জিতে গেছে।আমাকে ঘিড়ে স্বীকার করা তার সমস্ত ত্যাগ,কষ্ট জিতে গেছে।

.

সেদিন নিপা আন্টির কথা শুনে বাসায় চলে আসার সময় প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়।গাড়ি ছেড়ে রাস্তাুয় নেমে আসি।বেখেয়ালিভাবে ফাকা রাস্তা পার হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো আমার।কিন্তু বরাবরের মতো অঙ্কুরই বাচিয়ে নিয়েছিলেন আমাকে।ধ্যান কাটেনি তখনো আমার।মরলে কি খুব ক্ষতি হতো?অঙ্কুরের সাদা শার্ট,খয়েরী ব্লেজার ভিজে উঠেছে।কপালের সামনের চুলগুলো‌থেকেও পানি গরাচ্ছে।উনি আমার দুহাতের কনুইর উপরে ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,

-কি হয়েছে কি তোমার?এতোটা কেয়ারলেস কেনো?এখানে কেনো এসেছিলে তুমি?কিছু হয়ে গেলে?আন্সার মি ড্যামিট!তুমি আমার….

-আমি…আমি আপনার অপুর্নতার কারন অঙ্কুর।

উনি থেমে গেলেন।চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিললেন একটা।হয়তো উপলব্ধি করলেন,আমি সবটা জেনে গেছি।একটানে বুকে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।এতোক্ষন না কাদলেও এবার চিৎকার করে কাদতে লাগলাম আমি।আর ফাকা রাস্তার বৃষ্টির আওয়াজে মিশে যেতে লাগলো সে আর্তনাত।উনি আমার দুগাল ধরে কপালে চুমো দিয়ে বললেন,

-কষ্ট পেয়ো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।

-কিচ্ছু ঠিক হবে না অঙ্কুর! কিচ্ছু ঠিক হবে না!আমি পারবো না আপনাকে পরিপুর্ন করতে অঙ্কুর!আপনি ফিরিয়ে নিন আপনার কথা!আপনার জীবনের সবটাই হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই অঙ্কুর!

-এসব কি বলছো তুমি অদ্রি?

-ঠিকই বলছি।আমি চাই আপনার সে সব সুখ হোক,যা আপনি ডিসার্ভ করেন।কিন্তু আমি আপনার সুখের কারন হতে পারবো না অঙ্কুর।বাবা হওয়ার সে সুখ আমি দিতে পারবো না আপনাকে।আমি পারবো না আপনাকে পিতৃত্ত্বের স্বাদ দিতে!কোনোদিনও মা হতে পারবো না আমি!

কাদতে লাগলাম আরো জোরে।উনি একটু থেমে থেকে বললেন,

-ওয়েট!তুমি কোনোদিনও মা হতে পারবে না মানে?এটা কে বললো তোমাকে?

-আমি‌ নিপা‌ আন্টির সব কথা শুনেছি অঙ্কুর!

-কচু সব শুনেছো!

বিস্ময়ে তাকালাম আমি।এ সময়ে‌ এ কথাটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো।উনি চোখ পাকিয়ে বললেন,

-কান্না থামাও,হাটা লাগাও!

কান্না থামে নি।তবে উনি হাত ধরে হাটা লাগিয়েছেন।নিপা আন্টির কেবিনে এনে বসিয়ে দিলেন আমাকে।আন্টি তাড়াতাড়ি তোয়ালে বের করে দিয়ে বললেন,

-একি?ভিজেছো কেনো দুজনে?

অঙ্কুর মাথা মোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।বললেন,

-একে বোঝাও!এ নাকি কোনোদিনও মা হতে পারবে না?তুমি নাকি এটাই বলেছো?তোমার সব কথা নাকি এ শুনে নিয়েছে?

উনি মাথা মোছায় সম্পুর্ন মনোযোগ দিলেন।এবার বিস্ময়ে কান্নাই থেমে গেছে আমার।নিপা আন্টি মৃদ্যু হেসে বললেন,

-সবটা শুনলে এসব বোকাবোকা কথা কেনো বলছো আহানিতা?

-ম্…মানে?আপনিই তো বললেন,এই হেল্থ ইস্যু নিয়ে আমি কনসিভ করতে পারবো না।আর….

-এই হেল্থ ইস্যু নিয়ে!সেটা না থাকলে তো তুমি অবশ্যই কনসিভ করতে পারবে।তাইনা?

শ্বাস থেমে গেলো আমার।অঙ্কুর স্বাভাবিকভাবে মাথা মোছানো শেষ করে আমার চুলগুলো নাড়তে লাগলেন।মাথা তুলে তারদিকে তাকিয়ে আমি।উনি আকস্মাত আমার কপালে ঠোট ছুইয়ে দিলেন।নিপা আন্টি এবার হেসে দিয়ে বলতে লাগলেন,

-হ্যাঁ,এটা ঠিক,তোমার কিছু ফিজিক্যাল আনএবিলিটি আছে।এজন্যই সারোগেশনের জন্য রেডি ছিলে না তুমি,নাইবা গত দেড় বছরে কনসিভ করতে পেরেছো।তবে সেটা এমন নয় যে তুমি কোনোদিনই মা হতে পারবে না।মেডিকেল সাইন্স এখন অনেক এডভান্সড আহানিতা।তোমার একটা টিনি অপারেশন হয়ে গেলেই তুমি কনসিভ করতে পারবে বলে আশা রাখছি আমরা।আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো মা হতে পারবে তুমি।

কথাগুলো স্বপ্নের মতো লাগছিলো।বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নিজের কানে শোনা কথাকে।অঙ্কুরের দিকে তাকাতেই উনি মাথা নাড়িয়ে বুঝালেন এমনটাই হবে।তার কোমড় জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম।কিছুটা সময় পর উনি আমার মাথায় চুমো দিয়ে বললেন,

-চলো বাসায় যাই।ভিজে আছো,অসুখ করবে।

কান্না থামিয়ে উঠে দাড়ালাম।হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বললাম,

-আন্টি?আমার অপারেশনটা….

নিপা আন্টি মুখ কালো করে ফেললেন।অঙ্কুরও অন্যদিক ফিরে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন।আন্টি আমার কাধে হাত রেখে বললেন,

-তোমার অপারেশনটা এ দেশে হবে না আহানিতা।

-ও।দেশের বাইরে যেতে হবে?অঙ্কুর?তাহলে আমরা কবে যাচ্ছি?

অঙ্কুর চুপ।নিপা আন্টি আবারো বললেন,

-শান্ত হও আহানিতা।তোমার অপারেশনটা এই মুহুর্তে সম্ভব না।একচুয়ালি…ইউ হ্যাভ এনিমিয়া।রক্তশুন্যতা।এন্ড ইটস্ আ সিরিয়াস ইস্যু।অঙ্কুর তোমার রিপোর্টস্ নিয়ে এসেছিলো।এখনই অপারেশনের সব ব্যবস্থা করতে চাইছিলো ও।কিন্তু এই রক্তশুন্যতার জন্য,তোমার কোনোরকমের অপারেশনের জন্য কোনো ডক্টর সাহস পাচ্ছে না।এটা অনেকটাই রিস্কি তোমার জন্য।

নিপা আন্টির কথায় হতাশ হয়ে পরেছিলাম আমি।কিন্তু অঙ্কুর বরাবরই স্ট্রং ছিলেন।তার বিশ্বাস নিয়ে।এরপর সব ছেড়েছুড়ে উনি দেশের বাইরে চলে আসেন আমাকে আর মনিমাকে নিয়ে।ছায়ার মতো পাশে ছিলেন সবসময়।বিদেশে যাওয়ার প্রায় দু বছরের মধ্যেই এনিমিয়া কাটিয়ে উঠি আমি।আর ডক্টর রাজি হয়ে যায় আমার অপারেশনের জন্য।অঙ্কুরের যত্ন,ভালোবাসায় অপারেশনটাও খুব ভালোভাবে মিটে যায়।ফিরে আসি বিডিতে।উপরওয়ালার কাছে অনেক চেয়েছি।অঙ্কুরের সামনে,অগোচরে অনেক কেদেছি।যে মানুষটা আমার জন্য এতোকিছু করলো,অন্য কাউকে জীবনে জরানোর বিষয়ে সাহস হয়নি তাকে একবারও বলার।তবে আত্মগ্লানি তো ছিলোই।বরাবর!

এতোগুলো দিন পর হঠাৎই নিজের কিছু পরিবর্তন খুজে পাই।সাহস করে প্রেগনেন্সি টেস্ট করাতেই যখন তা পজিটিভ এসেছে চোখে পরলো,তা ঠিক কেমন অনুভব ছিলো,তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।কেদেছি আর শুকরিয়া আদায় করেছি আল্লাহ তায়ালার।আমি সম্পুর্ন!আমার নারীত্ব সম্পুর্ন!আর তার সাথে যা সবচেয়ে সুখের!অঙ্কুর সম্পুর্ন!

.

গালে দুহাতের আলতো স্পর্শে সেই ঝড়ঝন্ঝার অতীত থেকে বেরিয়ে এলাম।অঙ্কুর আস্তেধীরে আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।হাটুগেরে মেঝেতে বসেছেন উনি।আমার পেটে হাত রেখে কিছুক্ষন অনুভব করলেন কিছু।তারপর মৃদ্যুভাবে ঠোট ছুইয়ে‌ বলে উঠলেন,

-তুমি আসছো?

কেদে দিলাম আবারো।অঙ্কুরও কাদছিলেন।হাতের পিঠে তৎক্ষনাৎ চোখ মুছে আমার চোখও মুছিয়ে দিলেন উনি।বললেন,

-আরেকদিন কেদেছো তো খবর আছে মিসেস পর্বতশৃঙ্গ!আমার আর বেবির কনভার্সেশনে ডিস্টার্ব হচ্ছে।প্লিজ ডোন্ট ডু দিস!

আমি চুপ রইলাম।উনি আবারো নিজের মতো করে কোমড় জরিয়ে বসলেন।পেটে কান ঠেকিয়ে বললেন,

-ইউ নো হোয়াট বেবি?তোমার মাম্মা খুব পচা!শুধুশুধু কাদে!কতো বুঝিয়েছি,তোমার পাপার বিশ্বাসের কথা,মানে নি!তোমার পচা মাম্মা কেদেই যাচ্ছে,কেদেই যাচ্ছে।বাট আই প্রমিজ ইউ!আ’ইল বি দ্যা বেস্ট পাপা!আই সোয়ার!আই প্রমিজ ইউ দ্যাট!

এভাবেই তার বাচ্চামো আর পাগলামোতে কেটেছিলো ওই দিনগুলি।কতোটা যত্নে যত্নে ভরিয়ে রেখেছিলেন আমাকে উনি আর মনিমা মিলে,তার হিসেব নেই।বেবি পৃথিবীতে আসার পর প্রানভরে দেখেছিলাম ,পরিপুর্ন অঙ্কুরকে।তার আরেক পরিপুর্নতা,তার মেয়ে,আরিয়ানা সিদরাতুল অঙ্কন!

🍂
ছয় বছর পর,

-নয়ছয়?এই নয়ছয়?কোথায় রে তুই?

মমো ফুসতে ফুসতে তাহিয়ানের সামনে এসে কোমড়ে হাত গুজে দাড়ালো।তাহিয়ান ভ্রু কুচকে বললো,

-ওমন মুখ বানিয়েছিস কেনো?খেয়ে নিবি আমাকে?

-তুমি পচা তাহিয়ান ভাইয়া!আমাকে পচা নামে দাকো!

-কেনোহ্?নয়ছয় নামটা পারফেক্ট তোর জন্য।মনিমা শুধুশুধু মমো ডাকে তোকে।তুই মমো,মানে আমার বলার মতো কোনো জিনিস?আর এএসএ কি নাম রেখেছো তোর?অঙ্কন!আমি বলি কি শোন!অঙ্কনের ইংরেজী তো আর্ট!আর তুই যা ড্রামেবাজ,নাম জিজ্ঞাসা করলে বড় হলে ঠিক মুখ বাকিয়ে বলবি,ইয়ে আট হে আট!ওসব আটফাট লাগবে না,তোকে আমি নয়ছয়,মানে অপচয় বলেই ডাকবো!পুরোই ওয়েস্ট একটা!

পুরোই বোকাবনে গেছি তাহিয়ানের লজিক দেখে।এতোক্ষন চুপচাপ মমো কি বলে তা দেখার জন্য দরজায় দাড়িয়েছিলাম।ওকে আমরা অঙ্কন না ডেকে মমো ডাকি।বারবার আমার মেয়ে,আমার মেয়ে করতে করতে,আমার আমার করতে করতে অঙ্কুর ওর নামটাই মমো বানিয়ে দিয়েছে।আজ আস্থা আর রোহান ভাইয়ার জমজ ছেলেমেয়ে আহান রুহিতার জন্মদিন।ও দুটোর বয়স পাঁচবছর।তানহা তিহান তাহিয়ানকে রেখে গেছে গিফট কিনতে।এরমধ্যেই তাহিয়ানের মমোকে ভয় দেখানো শুরু।কিন্তু সেও নির্ভীক!অঙ্কুরের মতে মায়ের মতোই!আমিও আশ্চর্য হয়ে যাই,এমন খুব কম জিনিসই আছে যাতে মমো ভয় পায়।নিজেকে সামলে এগোলাম দুটোর দিকে।মমো কড়া গলায় বললো,

-মাম্মা?দেখেতো?আমাকে বকলো তাহিয়ান ভাইয়া!

তাহিয়ান বিরবিরিয়ে বললো,

-নাটক শুরু।

আমি একটু সিরিয়াস মুখ বানিয়ে বললাম,

-তাহিয়ান?আর বকো না মমোকে।আর ওকে নয়ছয় বলেও ডেকো না হুম?

-আচ্ছা মনিমা।ওকে বলো ও যেনো আমাকে শুধু ভাইয়া বলে ডাকে।তাহিয়ান ভাইয়া না!

মমোকে বললাম,

-মমো?শুধু ভাইয়া ডাকতে পারিস না?নাম ধরে ডাকিস কেনো?

-ছেড়ে দাও মনিমা।তোমার মেয়ের দ্বারা সম্ভব না।ও নিজের নাম উচ্চারন করতে পারে না,চারবছরের বড়,আমার নাম ধরে ঠিকই ডাকে।এই নয়ছয়?বলতো তোর নাম কি?

-এএসএ!

-ওইটা তো তোর পাপার নাম।তোর নাম বল!

-এটাও আমাল নাম।আরিয়ানা সিদলাতুল অন্তন।পাপা বলেছে,এএসএ হলো শটফম।

-এন্ড হেয়ার কামস্ আনাদার এএসএ!

অঙ্কুর ফিরেছেন।মমো দৌড়ে গিয়ে কোলে উঠলো তার।উনি কাধের ব্যাগটা বেডে রেখে মমোর দুগালে চুমো দিলেন।তাহিয়ানের মুঠোয় মুঠো ঠেকিয়ে বললেন,

-হেই চ্যাম্প!কখন এসেছো?

-কিছুক্ষন আগেই আঙ্কেল।

-তোমার আম্মু আব্বু কই?

-ওরা শপিংয়ে গেছে।আপনিও মেয়েকে ছাড়ুন,ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন!

আমার কথায় অঙ্কুর এগোলেন।মমোকে বললেন,

-দেখেছো মমো?তোমার মাম্মা জেলাস!

-কেনো পাপা?

-ওইযে,তোমাকে আদর করলাম,মাম্মাকে তো আদর করিই নি!মাম্মাকে একটু আদর করে দেই,কি বলো?

মমো হাসিমুখে নেমে গেলো ওনার কোল থেকে।আর বাকা হেসে অঙ্কুর এগোতে লাগলেন।হচকিয়ে গেলাম।একপা পিছিয়ে বললাম,

-ও্ ওয়েট!এ্ একবিন্দুও জেলাস নই আমি!

-ও রিয়েলি?বাট আই অ্যাম টায়ার্ড!টায়ার্ডনেস তো কাটাবোই!

-পাগল আপনি?বাচ্চারা….

ওনার পিছনে তাকিয়ে দেখি একটাও নেই রুমে।হতাশ শ্বাসত্যাগ করলাম।উনি এগিয়ে দুরুত্ব বজায় রেখে কপালে ঠোট ছুইয়ে দিলেন আমার।তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-বাকিটা তোলা থাক?

মৃদ্যু ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে বেরোলাম রুম থেকে।ড্রয়িংয়ে এসে দেখি তাহিয়ান আঙুল উচিয়ে মমোকে বলেছে,

-এই শোন নয়ছয়,তোর সব ফাজলামো মানবো।কিন্তু তোর চোখ তুলে তাকানো,কড়া গলায় কথা বলা আমার সহ্য হয় না!কথাটা মাথায় রাখবি।কোনোদিন এটা করবি না বলে রাখলাম!

তব্দা মেরে গেলাম কথাটা শুনে।চেনা কথাটা আচমকাই নাড়িয়ে দিলো ভেতরটাকে।অঙ্কন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে শুধু।আমি কিছু বলার আগেই তানহা তিহান চলে আসলো।তানহা তাহিয়ানের আঙুল তাক দেখেই তেড়ে এসে বকতে লাগলো ওকে।মনিমা সোফায় বসে ছিলো।বললো,

-তান্নু?ওকে বকিস না!সব দোষ এই মমোর!আমি নিজে সাক্ষী!ওই আগে ইলাস্টিক তেলাপোকা ঢিল মেরেছে তাহিয়ানের সামনে।বেচারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো!

সরু চোখে তাকালাম মমোর দিকে।ও ডোন্ট কেয়ার ভাবে আছে।অঙ্কুর একদম রেডি হয়ে এসে তানহা তিহানের সাথে কুশল বিনিময় করলেন।তারপর সবাই মিলে চললাম রোহান ভাইয়াদের বাসা।রোহান ভাইয়া যে রাগের আড়ালে আস্থাকেই পছন্দ করতেন,তা ঠিকই জানতাম সবাই।আস্থার সাথে বিয়েতে তাই অমত করেননি উনি।বিয়ের পর আস্থার সংস্পর্শে থেকে বেচারা এখন এতো রোমান্টিক হয়ে গেছে যে,সবাইকে বলে বেরায়,তাদের লাভ ম্যারেজ।

অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরলাম।মমো সবে ঘুমিয়েছে।ব্যালকনির মেঝেতে বসে অঙ্কুরের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছি।উনি দেয়ালে মাথা পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে।মমো ঘুমোলে,এমনটাই হয় নিত্যরাতে।উনি আমার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে হঠাৎই বলে উঠলেন,

-জানো অদ্রি?আমার জীবনে তুমি না আসলে,কোনোদিনও জীবনের এই সুন্দরতার সাথে পরিচয় হতো না আমার।তোমার আগমন,জীবনের মানে বুঝিয়েছে আমাকে।পরিপুর্নতা এনে দেওয়া যাকে বলে।

মাথা তুলে তারদিকে তাকিয়ে বললাম,

-হঠাৎ এসব বলছেন যে?কোনোভাবে আজ আবার উল্টোটা মনে হচ্ছে না তো?

উনি চোখ বন্ধ করে ছিলেন।আমার প্রশ্নে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বললেন,

-উল্টোটা মানে?

-মানে এই,আমার জন্য ভালোবেসে অনেকগুলো দিন কষ্ট পেয়েছেন,অনেক রিস্ক নিতে হয়েছে আপনাকে,বাবা হয়ে জীবনের সুন্দরতা দেরিতে দেখেছেন,আর…

উনি একটানে নিজের কাছে টেনে ঠোটজোড়া আটকে দিলেন আমার।অনেকটা সময় পর ছেড়ে দিলেন।হাপাতে হাপাতে কিল বসিয়ে দিলাম তার বুকে।বললাম,

-এমন করে কেউ?

-আমি করি!করবো!তুমিও এজন্যই এইসব উল্টাপাল্টা বলো।তাইনা?

ইতস্তত করতে লাগলাম।প্রচন্ড লজ্জা লাগছিলো।কথাটা কি আদৌও ভুল?উনি মুচকি হেসে আবারো জরিয়ে নিলেন আমাকে।দুগাল ধরে কপালে চুমো একে দিয়ে বললেন,

-ভালোবাসি অদ্রি।

-আমিও ভালোবাসি।

তার বুকে মাথা রাখলাম।নির্জন রাতের চাঁদহীন আকাশপানে চেয়ে নিজের প্রেয়সীকে বাহুডোরে জরিয়ে নিলো আমার সে প্রেমিকপুরুষ।বলে উঠলো,

“গন্তব্যহীন এ পথিকের পথে
গন্তব্য জুড়ে দিয়েছো তুমি…
অসম্পুর্ন এ আমাকে
পরিপুর্নতায় ভরিয়ে দিয়েছো তুমি…
তোমাতে বিলীন হয়ে
এ আমি নিঃস্ব…
তোমাতে নিঃস্ব হয়ে
এ আমি সমৃদ্ধ…
তোমাতে নিজস্বতা হারানো!
এ জীবনের সবচেয়ে সুমিষ্ট পরাজয়…
তোমাতে হারিয়েই আমার,
সবটাই তুমিময়…
সবটাই তুমিময়!”

🌸সমাপ্ত🌸

#মিথি