সবটা অন্যরকম পর্ব-৪৫+৪৬

0
3212

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_৪৫
Writer-Afnan Lara
.
বাসায় ফেরার পর দিবা চমকে গেছে।সাথে আহনাফ ও
কারণ সাদাত স্যার সোফায় বসে আছেন ওদের দিকে তাকিয়ে
দিবা উনাকে দেখে হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেললো
সাদাত স্যার দরজায় হাত রেখে বললেন”দিবা দরজা খুলো।আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।দিবা?”
.
-আপনি প্লিস চলে যান।আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।
.
স্যার মাথা নিচু করে আবারও সোফায় এসে বসলেন
ওপাশে খালামণি আরিফের ফোনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কিসব করতে বলছেন
আহনাফ চুপচাপ নিজের রুমে গেলো।মিনি অসহায়ের মতন দিবার রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে আহনাফের রুমের দরজা খোলা পেয়ে আপাতত ওদিকেই গেছে
আরিফ দিবার মাকে ভিডিও কল করে ফোনটা সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো একদম সাদাত স্যারের বরাবর
দিবার মা তখন ভাত খাচ্ছিলেন।হাত ধুয়ে ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে বসে হাসিমাখা মুখে রিসিভ করলেন তিনি।রিসিভ করার সাথে সাথে তার ভালোবাসার মানুষটিকে তিনি দেখতে পেলেন
সাদাত স্যার ও চুপ করে তাকিয়ে আছেনন
নিজের ভেতরকার চাপা কষ্টটাকে সামনে এনে দিবার মা চেয়েছিলেন লাইনটা কেটে দিতে কিন্তু পারলেন না।চুপ করে শুধু দেখেই যাচ্ছেন
মানুষটাকে তিনি এত ভালো চেনেন যে এক দেখাতেই চিনে ফেলেছেন
স্যার চশমাটা খুলে বললেন”মৌসুমী।কেমন আছো?”
.
দিবার মা চুপ করে শুধু দেখছিলেন। চোখের পানি হাতের ওপিঠ দিয়ে মুছে লাইন কেটে দিলেন তিনি। তার পক্ষে আর চেয়ে থাকা সম্ভব না
তাছাড়া বুঝতে বাকি নেই যে সাদাত দিবাকে পেয়েছে এবং চিনে ও ফেলেছে।
সব কিছু তিনি বুঝে গেছেন।তাই ফোনটা রেখে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন তিনি এখন
দিবা ফ্লোরে বসে তার ফোনটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।মা কখনও ফোন ধরবে না জেনেও সে মাকে ফোন করলো
আজ
কিন্তু আজ তাকে অবাক করে দিয়ে মা কল রিসিভ করলেন
কাঁপা গলায় দিবা বললো”মা!”
.
-তোর বাবা তোর খালামণির বাসায়?
.
-হ্যাঁ
.
-যদি তোকে নিতে চায় যাবি না।আমি চাই না তুই ঐ লোকটার সংসারে গিয়ে আরও কষ্ট পাস।এখানেই থাক।আমার আপু অন্তত সাদাতের বউয়ের থেকে ভালো।
.
-উনি বিয়ে করেননি মা
.
এটা শুনে মৌসুমীর চোখ দিয়ে আবারও পানি পড়লো।
বুকের ভেতরটা জ্বলছে তার।বুকে হাত দিয়ে তিনি বললেন”তার মা আমায় পছন্দ করতেন না।তোকে আর কি পছন্দ করবে।তুই তার সাথে যাবি না মানে যাবি না।আমার বোনের কাছেই থাকবি।আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।রাখছি”
.
দিবা ফোন রেখে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।তারপর আস্তে করে দরজার কাছে এসে ছিটকিনি নামালো।দরজা খোলা পেয়ে সাদাত স্যার ছুটে আসলেন এদিকে
দিবা হাত দিয়ে উনাকে থামিয়ে বললো”আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।আমি এখানেই থাকবো
এতদিন পর এসে বাবা হওয়ার নাটক করতে হবে না আপনাকে।আপনি এখান থেকে চলে যান তা নাহলে আমার দুচোখ যেদিকে যাবে আমি সেদিকেই যাব”
.
দিবার এমন কথা শুনে স্যার মাথাটা নিচু করে চুপচাপ চলে গেলেন বাসা থেকে।
দিবার কষ্ট হচ্ছে তার বাবার জন্য।মায়ের কথা শুনে বাবাকে কড়া করে কথাটা তো সে বলে দিলো। এখন তারই খারাপ লাগছে।দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সে বাবার চলে যাওয়া দেখছে
আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।বালিশের কোণার দিকে হাতের সাথে তুলোর মতন কি যেন লাগলো মনে হয়
মাথা উঁচু করে তাকাতেই সে দেখলো মিনি লুকিয়ে আছে সেখানে
তাই আর সেদিকে খেয়াল না করে সে উঠে বসে রুমের বাহিরের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করলো।কারোর মুখে কোনো কথা নাই কেন?
কৌতুহল নিয়ে আহনাফ বিছানা থেকে নামলো।রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মা চেয়ারে বসে দিবার দিকে তাকিয়ে আছেন সাথে আরিফ ও
আর দিবা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের সাথে লেগে
.
-আবার কি হলো?
.
হুস আসতেই দিবা নিজের রুমে চলে গেলো চুপচাপ।তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইলো।পাঁচ মিমিট বাদে খালামণি রুমে আসলেন।দিবার ঘাঁড়ে হাত রেখে বললেন”বাবার জন্য কষ্ট হয়?”
.
দিবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অনবরত।খালামণি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন”সাদাত তোর মাকে ঠকিয়েছিল কথাটা সত্যি।এর ক্ষমা হয় না।তবে সে তোর কথা জানলে হয়তবা কিছু একটা করতে পারতো।মৌসুমী যদি একবার জানাতো ওকে!”
.
-কি করে জানাবে খালামণি?ঠকানোর পরই তো নানা মাকে জসিম বাবার সাথে বিয়ে দিয়েছিল।তখন আর কিছু বলে লাভ থাকতো?
.
-লাভ লস না।তুই সাদাতের মেয়ে এটা ওর জানার অধিকার ছিল।
.
-আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা।মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হয়।
.
খালামণি দিবার মাথার চুলগুলোকে হালকা টেনে দিয়ে বললেন”চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে।একটু বস আমি চা আনছি”
.
দিবা চোখ মুছে মিনিকে খুঁজলো এদিক ওদিক
খালামণি চা বানাতে গেছেন।সে বিছানা থেকে নামলো মিনিকে খুঁজতে। ওকে বেশি সময় ধরে না দেখলে মন কেমন কেমন করে
রুম থেকে বের হতে নিতেই আহনাফের বুকের সাথে ধাক্কা খেলো সে
দিবা সরতে নিতেও পারলো না।ঐ অবস্থায় আহনাফ ওকে আগলে ধরে ফেললো
দিবা চোখ বন্ধ করে রেখেছে
আহনাফ বললো”এক মিনিটের জন্য সব ভুলে যাও।দেখবে সবটা অন্যরকম লাগবে তোমার।আহনাফের বুকে সবার জায়গা হয় না।তোমার হয়েছে, সেই খুশিতে হেসে ফেলো দেখি”
.
দিবা মুখটা আহনাফের টিশার্টের সাথে লুকিয়ে বললো”মাথা ব্যাথা করে আমার।ওসব ফিল করার মন মানসিকতা নাই এখন”
.
-তাহলে মুখ লুকালে ক্যান?
.
আহনাফ দিবার কাঁধ ধরে ওকে ঝাঁকিয়ে সামনে এনে ধরলো
.
দিবা ভ্রু কুঁচকে বললো”দিলেন তো মুড আরও নষ্ট করে?এতক্ষণ ভালোই ছিলাম”
.
-তুমি তো বললে কিছু ফিল করার সময় নাই তোমার।তাই তো সরাই দিলাম।এখন আবার আরেক কথা বলছো।স্বীকার করতে কষ্ট হয় যে আহনাফকে তোমার ভাল্লাগে?
.
দিবা বোকার মতন আহনাফের কথা শুনে দাঁড়িয়ে আছে
আহনাফ মুচকি হেসে পিছনে তাকিয়ে মাকে রান্নাঘরে দেখে দিবাকে টেনে আবারও কাছে নিয়ে আসলো।
দিবা মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বললো”আপনি স্বীকার করেন না আমি করতে যাব কোন দুঃখে?”
.
-তো স্বীকার করিও না।এভাবেই থাকো।আম খাও, গাছের খবর লাগবে না
.
দিবা মুচকি হেসে বললো”লাগবে খবর।আপনি এমন কেন?কোন সিচুয়েশনে কিসের কথা বলছেন এসব?আমি বাবাকে নিয়ে ভাবছিলাম না?”
.
-কত কষ্ট করে ওসব ভুলিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি আবার সেই সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেলে।ধুর এখন আমারই মাথা ব্যাথা করছে
মা!!! আমার জন্য ও এক কাপ বানাও
.
দিবা হেসে দিয়ে আহনাফকে ছেড়ে রুম থেকে চলে গেলো
আহনাফ ঘাঁড় ঘুরিয়ে ওকে দেখছে।দিবা সোফায় বসে মিটমিট করে হাসছে শুধু।খালামনি চায়ের কাপের ট্রে নিয়ে এসে বললেন”কিরে ওমন হাসছিস?কিছুক্ষণ আগেও তো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলি”
.
আহনাফ এগিয়ে এসে একটা চায়ের কাপ নিয়ে দিবার সামনে বরাবর বসে বললো”মঙ্গল গ্রহের প্রভাব”
.
-কি জানি।তোদের কখন কি হয় ঠিক বুঝতে পারিনা আমি।
যাই হোক গরম গরম চা খা আর মাথা ব্যাথা কমা।আমি যাই কাজে
.
দিবা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আহনাফের রুমের দিকে তাকালো মাথা বাঁকিয়ে।বিছানায় মিনির লেজ ঝুলছে তার মানে সে ওখানে
.
আহনাফ দিবার উপর চোখ রেখে চায়ে চুমুক দিচ্ছে
দিবা ব্রু কুঁচকে বললো”চায়ের কাপের দিকে চেয়ে চুমুক দিতে পারেন না?এরকম তাকিয়ে আছেন কেন?আপনার জন্য কি চা ও খেতে পারবো না?”
.
-আমি তাকাচ্ছি সেটা আমার ব্যাপার।তুমি কেন তাকাচ্ছো সেটা বলো তো?
.
দিবা কথায় না পেরে মুখটা ঘুরিয়ে চা শেষ করছে জলদি জলদি
চা শেষ করে উঠে চলে যেতে নিতেই তার লাল শাড়ীর আঁচল মুঠো করে ধরে ফেললো আহনাফ
দিবা থেমে গিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো”খালামণি রান্নাঘরে”
.
যেমন ভাবলো তেমনটাই হলো।খালামণি সেই সময়ে ডাইনিংয়ে এসেই দেখলেন আহনাফ দিবার শাড়ীর আঁচল ধরে আছে।আহনাফ মাকে দেখে আঁচল ছেড়ে দিয়ে মুখে হাত দিয়ে ফেলেছে।দিবা এক দৌড়ে চলে গেছে
মা মুচকি হেসে প্লেট গুছাতে গুছাতে বললেন”তাহলে আমার অগোচরে এসব হয়?”
.
আহনাফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো”মিনি কোথায় রে আমার কিউট বেড়ালটা।মিনি??”
.
মা হাত ভাঁজ করে এগিয়ে এসে আহনাফের কান টেনে ধরে বললেন”যে বেড়ালকে একটুও পছন্দ করতি না।হাঁচির উপর হাঁচি দিতি আর এখন ও তোর কিউট বেড়াল হয়ে গেলো?এখন আর হাঁচি আসে না তোর?”
.
আহনাফ দাঁত কেলিয়ে বললো”না আসলে এলার্জির ঔষুধ খাই নিয়ম করে।এখন হাঁচি কম হয়”
.
-যে মেয়েটাকে সহ্য করতে পারতি না এখন তার আঁচল ধরিস??মাকে এই কথা জানালে মা তোকে খেয়ে ফেলতো?
.
-না মা এসব কিছু না।আমি তো মানে….
আমার না একটা কাজ মনে পড়ে গেছে।আসি কেমন?
.
মা মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলেন।আহনাফ এক ছুটে তার রুমে চলে এসেছে।
.
দিবা বারান্দায় এসে আহনাফের রুমের বারান্দাটা দেখছে আর হাত দিয়ে শাড়ীর আঁচলটাতে গিট্টু লাগাচ্ছে
আহনাফ পেছনে তাকিয়ে মা চলে গেছে কিনা তা দেখতে দেখতে সেও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে
দিবা আহনাফকে দেখে লুকিয়ে পড়লো সাথে সাথে। আহনাফ এগিয়ে এসে বললো”দেখে ফেলেছি”
.
-কথা বলবেন না।আপনার কারণে এখন খালামণির সামনে যেতেও লজ্জা করে আমার
.
-আমি কি করলাম।আঁচল ধরা মানে কি যে মা আমার কান টেনে দিলো।
.
কলিং বেল বাজছে।আরিফ গিয়ে দরজা খুললো।তার পরেই খালামণি দিবার রুমে এসে বললেন ওর সাথে দেখা করতে কেউ একজন এসেছেন।দিবা খালামনির সাথে রুম থেকে বেরিয়ে সোফায় তার দাদিকে দেখতে পেলো
সাদাত স্যার উনাকে নিয়ে এসেছেন।উনি দিবাকে দেখে কেঁদে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন”আমি জানতাম ওর সাথে সাদাতের কোনো সম্পর্ক আছে।ওদের চেহারায় একটুও বেমিল আমি দেখিনি প্রথমদিন।বারবার মনে প্রশ্ন জাগছিল আমার
আজ সেই প্রশ্ন সত্যি হয়ে গেলো
.
দিবা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।সোফায় এপাশে বাবা বসে আছেন।ভুলেও তাকাচ্ছেন না এদিকে।তার চোখ ফ্লোরের দিকে
আহনাফ ও কাছে এসে দাঁড়ালো
দাদি দিবার চুলে হাত বুলিয়ে ওর মুখটা ধরে বললেন”কত বড় হয়ে গেছে রে সাদাত
চিনতেই পারলাম না সেদিন।আমাদের রক্ত আমাদের সামনে ছিল আর আমরা চিনতেই পারলাম না।মৌসুমী জানালো না একবারও!
যাই হোক আমি এখন এসব বলতে আসিনি।তোমরা মৌসুমীকে ফোন লাগাও।ওর সাথে কথা আছে আমার।”
.
আরিফ ফোন বের করে খালামণিকে ফোন দিলো।
দুবার দেওয়ার পর রিসিভ করলেন তিনি
আরিফ বললো”খালামণি তোমার সাথে একজন কথা বলতে চায়”
কথাটা বলে সে দিবার দাদির হাতে ফেনটা দিলো
দাদি হ্যালো বললেন।মৌসুমী তাকে চিনতে পারলো না।তার পরেও সালাম দিলো সে
.
-মৌসুমী, আমি সাদাতের মা বলছি
.
মৌসুমী চমকে গেছে তারপরেও চুপ করে থাকলো।দাদি বললেন”দিবার কথা এতদিন আমাদের থেকে লুকিয়ে তুমি একদমই ঠিক করোনি!ভুল করেছো।তোমার ঐ অভিমানের কারণে দিবার জীবন এরকম হয়ে আছে।অভিমান ভুলে একটিবার যদি আমাদেরকে দিবার কথা জানাতে তাহলে আজ এই দিনটা আসতো না।অন্তত দিবা একটা ভালো জীবন পেতো।তোমার কারণে এখন দিবা আমাদের ভুল বুঝছে”
.
-এক মিনিট!!কার ভুল??আমার মায়ের ভুল??আপনি আমার মাকে দোষারোপ করছেন যেখানে এর সম্পূর্ণ ভুল আপনাদের সবার!!এখন আমার মাকে দোষ দিচ্ছেন।আপনারা কি ধোয়া তুলসি পাতা ছিলেন???
আমার মা আমার কথা আপনাদের জানায় নি একদম ঠিক করেছে।আপনাদের জানার কোনো অধিকার নাই ছিল ও না
চলবে♥

সবটা অন্যরকম♥
#পর্ব_৪৬
Writer-Afnan Lara
.
-এখন জেনেছি সুতরাং তুমি আমাদের সাথে যাবে
.
-আমার আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে।আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক।আমার নিজের জীবন নিয়ে সব সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিতে পারবো।আর আমি এখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আপনাদের সাথে কোথাও যাব না।আমি এখানে থাকবো।আজ আসতে পারেন আপনারা।
.
কথাটা বলে দিবা তার রুমে চলে গেলো হনহনিয়ে।সাদাত স্যার উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে ধরে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো
-হ্যালো মৌসুমী?কল কাটবে না।তুমি আমার মেয়েকে এখন কল করে বলবে আমার সাথে আসার জন্য
আমি খুব ভালোমতন বুঝতে পেরেছি তুমি ওকে মানা করেছো আমার সঙ্গে যেতে
.
-হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।আমি মানা করেছি।আর বলবো না তোমার সাথে যেতে।দিবাকে আমি মানুষ করেছি।ওর প্রতি তোমার কোনো অধিকার নেই।
.
-অধিকার খাটাইতে দিসো তুমি??আমি যে ওর বাবা একবার জানাইছো আমারে??আমি তো এতগুলো বছর পর আজ জানলাম আমার একটা মেয়েও আছে।এটা তুমি ঠিক করোনি
আর এখন উল্টো রাগ দেখাচ্ছো?ঠিকসময়ে দিবার কথা জানালে আমি জসিমের থেকে তোমায় নিয়ে আসতাম
.
-যে লোকটা আমায় ইউজ করে দুদিন পর বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলো তার মায়ের কথা ধরে।সে আমার পেটের সন্তানের কথা শুনে মায়ের অবাধ্য হতো??
.
-মা দিবার কথা জানলে অবশ্যই মেনে নিতেন
.
-যাই হোক
যখন আমি জানতে পেরেছিলাম আমার গর্ভে সন্তান তখন আর কিছু করার ছিল না।এখন এসব বলে লাভ নেই।যা কষ্ট করার সব করে ফেলেছি আমি।আর কষ্ট পেতে চাই না।
.
-তোমার যা খুশি করো জাস্ট আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই।ওকে ফোন করে বলো আমার সাথে আসতে নাহলে তোমার এখন যে সুখ আছে সেটাও উঠাই নেবো আমি
.
দিবার মা লাইনটা কেটে দিলেন।দিবার বাবা ফোন এনে আরিফকে সেটা দিয়ে বললো”মা চলো।দিবার মা ওকে বললে ও নিশ্চয় আসবে আমার কাছে।এখন আপাতত ও যেমনে থাকতে চায় তেমন করেই থাকুক”

দিবা তার রুমের ফ্লোর থেকে উঠে আসলো দরজা লাগাবে বলে।আহনাফ ওকে আটকিয়ে বললো”ওরা চলে গেছে”
.
চলে যাওয়ার কথা শুনে দিবা মাথাটা নিচু করে দরজার থেকে হাত সরিয়ে ফেললো।আহনাফ একটু এগিয়ে এসে বললো”চিন্তা করিও না।সাদাত স্যার বলেছেন তোমার ইচ্ছে হলে আসবে।আপাতত এই টপিক বাদ”
.
দিবা ওর কথাটা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিছানায় এসে বসলো।
খালামণি ফোনে নানুর সাথে কথা বলতে বলতে তার রুমে চলে গেছেন।নানা নানুকে দিবার কথা বলেননি উনি।এখন বলতে বাধ্য হয়েছেন
আহনাফ ও দিবার পাশে এসে বসলো।ওর হাতটা ধরে বললো”তোমায় একটা বুদ্ধি দেবো?”
.
দিবা মাথা তুলে বললো”কিসের বুদ্ধি?”
.
-তোমার মাকে আই মিন খালামণিকে বলো যে চলে আসতে তারপর সাদাত স্যারের সাথে তার অফিসিয়ালি বিয়ে হয়ে যাবে তারপর তোমরা তিনজন হ্যাপিলি লাইফ লিড করতে পারবা।ওয়াও!!
.
-কচু ওয়াও!!এসব ভুলভাল আইডিয়া দিয়ে মাথা খারাপ করবেন না তো।জসিম বাবার কি হবে?ইতির কি হবে?ইভান ভাইয়ার কি হবে?
.
-আরেহ ইভানের চিন্তা বাদ দাও।ও যেমন ওর বাপ ও তেমন
ওর বাপের চিন্তাও বাদ দাও।রইলো ইতি।তার বিয়ে হয়ে গেলে তার ও চিন্তা বাদ
.
-হইছে লাগবে না আপনার এরকম বুদ্ধি।
.
-আচ্ছা কাউকেই আনতে হবে না।ওসব বাদ দাও।একটু হাসো
.
-হাসি আসছে না আমার।আপনি এখানে কি করেন?নিজের রুমে যান বলছি।খালামণি কিংবা আরিফ ভাইয়া দেখলে কি হবে বুঝতে পারছেন?
.
-কেউ দেখবে না। সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত
.
-আপনি আপনার রুমে যান।আমি একা বসে থাকলে এমনি এমনি মুড ঠিক হয়ে যাবে
.
-আমি ডিউটিতে যাব এখন।যাবে আমার সাথে?
.
দিবা চুপ করে থেকে কি মনে করে মাথা নাড়ালো।আহনাফ ওকে রেডি হতে বলে নিজের রুমে এসে টিশার্টের উপর দিয়ে জ্যাকেট পরে অফিসের ব্যাগটা নিয়ে সে বের হলো রুম থেকে।দিবা ও হাজির।
রইলো মিনি! তাকে বারান্দায় রেখে আসলো দিবা।যাওয়ার সময় খালামণিকে বলে গেলো।খালামণি বললেন ঘুরিয়ে আনতে যাতে ওর মন ভালো হয়
আহনাফ বললো তার অফিস ঘুরিয়ে দেখাবে
বাইকে বসার পর আহনাফ ওকে জিজ্ঞেস করলো আসলেই সে ঘুরতে চায় কিনা।দিবা বললো”নাহ”
সে আহনাফ যেখানে যাবে সেখানেই যেতে চায়
আহনাফ ও তাই ওকে নিয়ে বারে চলে এসেছে।রিসিপশানে তার চেয়ারের পাশে আরেকটা চেয়ার এনে রেখে দিবাকে ওখানে বসতে বললো সে
দিবা চুপচাপ আহনাফের পাশে বসে থাকলো।আহনাফ কাগজে লিখছে আর কম্পিউটারে টাইপ করে তুলছে সেসব
দিবা মাথা তুলে তুলে একবার একটা দেখছে।হঠাৎ একটা মেয়ে এসে ত্যাড়া ব্যাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত পাতলো আহনাফের দিকে
আহনাফ ওর হাত ধরে সিল মেরে দিতেই ও চলে গেলো আবার
দিবা ব্রু কুঁচকে বললো”রোজ এভাবে কত মেয়ের হাত ধরেন আপনি?”
.
-৪০/৪২
.
-এত??কেন ধরেন?আর কেউ নাই ধরার?শুধু আপনি কেন ধরবেন?
.
-আমার কাজই হলো এটা।হাত ধরে সিল মারলে কি এমন হয়ে যাবে?
.
-আমিও মারবো ছেলেদের।সরুন আপনি
.
দিবা চেয়ার টেনে বসলো।একটা ছেলে আসতেই ও ছেলেটার হাত ধরে সিল মেরে দিলো।ছেলেটা নিজের থুতনি ঘষতে ঘষতে বললো”মেয়ে ম্যানেজার তাও বারে??আবার শাড়ী পরা?ইন্টারেস্টিং তো!চলো আজ তোমাকে দিয়েই দিন শেষ করি”
.
-আআআজিব তো!
.
আহনাফ হাসছে মিটমিট করে
দিবা ভয়ে ওর পিছনে এসে লুকিয়ে পড়লো।আহনাফ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাতেই ছেলেটা চলে গেলো বারের ভেতর
.
-কি?সিল মারবা না?
.
-নাহ থাক।আপনি মারেন। এটা আমার কাজ না
.
বোরিং লাগছে বলে দিবা উঠে গিয়ে হেঁটে হেঁটে বারটা দেখছে এখন।বেশিরভাগই কাপল।একটা ইংলিশ গানে নাচছে তারা।ঠাণ্ডা নাচ।ধুরুম ধারুম নাই।
আহনাফ কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিবার দিকে নজর রাখছে
নাহিদ এসে বসেছে আহনাফের পাশে তারপর বললো”যা মজা কর।আমি আছি”
.
-কিসের মজা করুম?
.
-তোর একটামাত্র গফ আসছে বারে।ওরে নিয়ে বারে ঘুর।ঐ যে আমাদের রেস্টুরেন্ট সাইট যেটা আছে ওটাতে যা
আমি আছি এখানে
.
-ওকে তাহলে ঘুরে আসি
.
আহনাফ উঠে চলে গেলো দিবার দিকে।দিবা একটা দেয়াল দেখছিলো
সম্পূর্ন দেয়াল জুড়ে বিয়ারের বোতল সাজানো।আহনাফ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো”চলো ওদিকে যাই।ওখানে সুন্দর ভিউ বেশি”
কথা শেষ করে সে দিবার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ওদিকে।
অনেকগুলো চেয়ার টেবিল সেখানে।আর গাছপালা টবে ভর্তি তো আছেই।এটা দোতলায় করা।সাইট ভিউ জোস আসে
আহনাফ দিবাকে একদম কোণার সিটটায় নিয়ে বসালো তারপর ওর পাশে নিজেও এসে বসলো।রাত তখন আটটা বাজে।রেস্টুরেন্টে লাল নীল বাতি জ্বলে।নিচে বার থেকে গানের আওয়াজ আসছে।রেস্টুরেন্টে আবার দুই একটা কাপল দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের কথা বলা নিয়ে ব্যস্ত
দিবা হাতের চুড়িগুলোতে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বাহিরে রোডের উপরের চলন্ত যানবাহন দেখছে
আহনাফ তার হাতটা দিবার পিঠের পাশ দিয়ে নিয়ে দিবার পরের চেয়ারটার উপর রাখলো
দিবা সেটা টের পেয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললো”কি হচ্ছে?”
.
-কিছু না তো?হাত রাখাও কি দোষের নাকি?
.
-না দোষের না।আপনাকে ঠিক বুঝি না।আমার উপর দিয়ে আজ কতবড় ঝড় বয়ে গেছে আর আপনার কিনা খালি প্রেম প্রেম পাচ্ছে?
.
-না তা নয়।জাস্ট ফিলিংস যুক্তিসংগত হয়ে গেছে
.
-সেটা কি আবার
.
-মানে কেমনে বুঝাই তোমারে।বুঝে নাও না
.
দিবা আগ্রহ নিয়ে আহনাফের কথা শুনছে।আহনাফ ঢোক গিলে নড়েচড়ে বললো”ভুলে গেছি যা বলার।কি খাবে বলো”
.
-কিছু খাব না।খিধে নেই আমার।
.
-হ্যালো নাহিদ।আচ্ছা! আচ্ছা! মেয়ে আসতেছে কতগুলো?ওকে আমি আসছি
.
দিবা হনহনিয়ে আহনাফের সামনে গিয়ে পথ আটকিয়ে বললো”খবরদার যাবেন না”
.
-কেন?
.
-না আপনি ওদের হাত ধরবেন না।
.
-তাহলে কার হাত ধরবো?তোমার তো পিঠের পাশ দিয়ে হাত রাখলেও রেগে যাও
.
দিবার খোলা চুলগুলোর কয়েকটা মুখের সামনে এসে পড়েছিল বলে সেগুলোকে সে কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো”আমার হাত ধরবেন তাও ওদের হাত ধরবেন না।নিন ধরেন”
.
আহনাফের হাতে নিজের হাত রেখে দিবা ওর পাশে বসলো আবার
আহনাফ মুচকি হাসছে শুধু।
মাথায় দুষ্টু একটা বুদ্ধি আসায় সে দিবার সাথে একটু চেপে বসে বললো”কিছু কাস্টমার বললে তাদের কোমড় ধরে নাচতেও হয় মাঝে মাঝে।জানোই তো আমি কত ফেমাস”
.
দিবা কপাল কুঁচকে বললো”এখন নাচতে হবে নাকি আপনাকে?”
.
-হতেও তো পারে
.
-না নাচবেন না।আসুন আমি আপনার সঙ্গে নাচবো
.
আহনাফ খিলখিল করে হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।দিবা বোকার মতন ওর হাসা দেখছে শুধু
আহনাফ হাসি থামিয়ে বললো”এত জেলাস?বাপরে বাপ।আই এম ইম্প্রেসড্।”
.
দিবা কাঁদো কাঁদো মুখ করে আহনাফের হাতটাকে কাছে টেনে সেটাতে মাথা রেখে বললো”চাকরিটা ছেড়ে দিন।আমি পান্তা ভাত খেয়ে থাকবো”
.
-তোমায় পান্তা খাওয়াতে পারলেও মাকে কি করে খাওয়াই বলো?মাকে তো কষ্ট দিতে পারি না।যতদিন না এর চেয়েও ভালো চাকরি পাচ্ছি ততদিন এই জবটা আমায় করতে হবে
.
দিবা আহনাফের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বললো”বাসায় যাব”
.
-আমি যখন যাব তখন।এখন তোমায় একাও ছাড়তে পারি না আর আমিও সহ যেতে ও পারবো না
ডিউটি টাইম শেষ হয়নি
.
দিবা আর কিছু বললো না।আহনাফ চলে গেলো বারের দিকে
দিবা ওর চলে যাওয়া দেখেও ডাকলো না।গাল ফুলিয়ে এক জায়গায় বসে থাকলো
-আহনাফ তো ঠিকই বলেছে।এই চাকরি ছাড়লে হুট করে তো নতুন চাকরি আর পেয়ে যাবেন না উনি
আমি শুধু শুধু রাগ দেখাইলাম
.
দিবা উঠে আহনাফের পিছুপিছু ছুটে গেলো।আহনাফ রিসিপশানে এসে বসতেই দেখলো দিবাও ছুটে আসছে।দিবা আসার আগেই মিশকা এসে হাজির
আজ কতটাদিন পর সে আহনাফকে দেখেছে।আহনাফের দিকে ঝুঁকে সে বললো”আমায় মিস করলে?”
.
দিবা থমকে গিয়ে মিশকার কথা শুনছে চুপচাপ
আহনাফ চেয়ার নিয়ে পিছিয়ে বসলো আরও
মিশকা আবারও টেবিলে উঠতে যেতেই দিবা এসে ওকে দেখিয়ে আহনাফের পাশের সিটটায় বসলো
.
মিশকা দিবাকে দেখে রেগে আগুন!!দিবা আহনাফের হাতটা আবারও জড়িয়ে ধরে বললো”আজ ডিউটি সেরে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন?”
.
আহনাফ মুচকি হেসে বললো”যাব তো”
.
মিশকা রেগে রেগে বললো”ও এখানে কি করে?”
.
-কেন?আপনার কোনো সমস্যা? আমার হবু তো আমার বারে আসতেই পারে।
.
মিশকা রাগ করে দূরে গিয়ে বসলো একটা চেয়ারে।দিবা ওকে না দেখার ভান করে আহনাফকে আরও ঝাপটে ধরলো
আহনাফ ফিসফিস করে বললো”আমি কোথাও চলে যাচ্ছি না এরকম টাইটলি ধরতে হবে না আমায়”
.
-ওহ!
.
দিবা হাতটাকে ছাড়িয়ে আবার আলতো করে ধরে হেসে দিলো।সে মিশকাকে দেখে এমন ভাব করছিল যেনো মিশকা আহনাফকে তুলে নিয়ে যাবে
সেটা মনে করে নিজের মাথায় নিজে একটা কিল বসিয়ে দিলো দিবা
মিশকা নাহিদের সাথে কথা বলছে এখন।কতক্ষণ আহনাফ আর দিবাকে দেখছিল পরে যখন আর কোনো পাত্তা পেলো না তখন উপায় না পেয়ে নাহিদের সাথে কথা বলায় মন দিলো সে
.
দিবা গালে হাত দিয়ে আহনাফের কাজ করা দেখছে।কি সুন্দর লাগছে ওকে।নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ করছে সে।কোনোদিকে তাকাচ্ছে না
দিবা দুষ্টুমি করে ওর পিঠের উপর আঙ্গুল দিয়ে কিসব লিখছে আবার জ্যাকেটটা টানছে।যত জ্বালাতন আছে সব করে যাচ্ছে সে
আহনাফ শেষে এক হাত দিয়ে দিবার দুইহাতের কব্জি একসাথে মুঠো করে ধরে আটকে আরেক হাত দিয়ে নিজের কাজ করছে এখন
চলবে♥