#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২৮
মনে মনে কথাগুলো বলে হেসে দিল। এইরকম জটিল ও কঠিন কথা কিভাবে তার মনে আসলো ভেবে পাচ্ছে না সে।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে নাদিয়া, সমুদ্র আর সন্ধ্যা। শুভ্রতা নাদিয়া আর সমুদ্রের সাথে দেখা করে আবার চলে গেলো নাদিয়ার জন্য পিঠা বানাতে। সমুদ্র একা একজন ছেলে বসে আছে দুই মেয়ের সাথে। স্পন্দনের অফিসে ইম্পর্টেন্ট কাজ থাকায় সে চলে গিয়েছে। মিসেস সাবিনা বেগম আর মিস্টার আজম কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে গেল।
ড্রয়িং রুম জোরে আড্ডা হাসিতে মেতে উঠেছে। নাদিয়া তার স্বভাব অনুযায়ী সন্ধ্যার সাথে খুব ভালোভাবে মিশে গিয়েছে। দুইজনের কথায় ড্রয়িং রুম বাজারে পরিণত হলো। ওদের দুইজনের সাথে যে সমুদ্র নামক তৃতীয় একজন ব্যাক্তি আছে ওরা দুইজন হয়তো ভুলে গিয়েছে সেই কথা। সমুদ্র একা একা বিরক্ত হয়ে নাদিয়ার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল……
—” এই মেয়েকে নিয়ে কোথায় আর কোনোদিন যাবো না। সব জায়গাতেই নিজের বাড়ি ভেবে বসে। ভদ্র হয়ে থাকবে কিন্তু তা না করে অভদ্রের মতো হাসছে আর জোরে জোরে কথা বলছে। এই দুই মেয়ে একসাথে থাকলে আর কাওকে লাগবে না।”
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা বলে উঠলো…..
—” আংকেল কি বলছ তুমি?”
আংকেল শব্দটি শুনে সমুদ্র ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। নাদিয়া তো হেসে কুটি কুটি। হাসি কষ্টে থামিয়ে বলল…..
—” ভাইয়া দেখ তোর এই ভুঁড়ির জন্য তোকে এখন আংকেল আংকেল লাগে। তুই এখন যেখানেই যাবি সবাই তোকে আংকেল ডাকবে হাহাহা।”
সন্ধ্যা নাদিয়ার দেখাদেখি হাসতে লাগলো।
—” আংকেল তুমি ভাবির জন্য হালিম কিনে এনেছ? জানো আমি খুব পছন্দ করি হালিম। ”
—” ও আচ্ছা। বেশি কিনে এনেছি খেতে পারবে।”
—” আংকেল এখন থেকে আমার জন্য হালিম আর চকোলেট কিনে আনবে যেদিনই আসো আমাদের বাসায় কেমন?”
—” হুম আচ্ছা আমাকে কি আংকেল আংকেল লাগে?”
—” হিহিহিহি হুম আংকেল কেন তুমি জানো না? আন্টি কিছু বলে নাই?”
—” আমি এখনও বিয়ে করেনি মিস সন্ধ্যা।”
—” ইয়াহু আংকেল তোমার বিয়েতে আমাকে নিয়ে যাবে তাহলে আমি তোমার বউয়ের কোলে উঠে পিক তুলবো আর তোমার কোলে উঠেও তুলবো ওকে।”
সমুদ্রের এখন সন্ধ্যার কথা শুনে কান্না পাচ্ছে। সমুদ্রের মনের অবস্থা বুঝে নাদিয়া সন্ধ্যাকে বলল…..
—” ভাইয়াও হালিম খেতে পছন্দ করে দেখেছো তোমাদের দুজনের খাবারের কত মিল।”
—” হুম আন্টি। আমি আর আংকেল দুইজনেই হালিম খেতে পছন্দ করি কি মজা।”
সন্ধ্যার কথা শুনে নাদিয়া টি-টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। এতক্ষণ সন্ধ্যার কথাগুলো হাসি তামাসা ভেবে করে এসেছে কিন্তু এখন তাকে আন্টি বলাতে আর সইতে পারলো না জোরে জোরে চেঁচিয়ে শুভ্রতা-কে ডাকতে লাগলো……
—-” শুভ্রতা এই শুভ্রু শুভ্রু কোথায় তুই তাড়াতাড়ি এইদিকে আয় দেখ তোর ননদ আমাদের হার্ট অ্যাটাক করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমরা কিন্তু এক্ষুনি হার্ট অ্যাটাক করবো কোথায় তুই।”
সমুদ্র নাদিয়ার মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে বলল…..
—” এইটা তোর বাসা না যে এইভাবে চিল্লা-বি। শোন আজ থেকে তোর যা ফেসিয়াল টেসিয়াল করা লাগে করতে থাকবি আর আমিও জিমে যাবো যেভাবেই হোক একমাসের ভিতরে এই আংকেল নামক উপাধি ঘুচাতে-ই হবে।”
—” হুম ভাইয়া।”
রান্না ঘর থেকে নাদিয়ার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি করে ড্রইং রুমের কাছে এসে বলল…..
—” কি হয়েছে তোদের এইভাবে ডাকছিলি কেন?”
নাদিয়া শুভ্রতার কাছে গিয়ে সন্ধ্যার বলা সব কথাগুলো বলতে লাগলো। শুভ্রতা সন্ধ্যার কথা শুনে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল…..
—” সরি রে তোদের একটা কথা বলা হয় নাই। সন্ধ্যা অসুস্থ ও আমাদের মত স্বাভাবিক না। ওর আচরণ দশ বারো বছরের বাচ্চাদের মত প্লিজ ওর কথায় রাগ করিস না।”
শুভ্রতা সন্ধ্যার সমস্যাগুলো সমুদ্র আর নাদিয়ার কাছে বলল। নাদিয়া সন্ধ্যার কথা শুনে খুব মায়া হলো সন্ধ্যার প্রতি কিন্তু সমুদ্রের বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হলো সন্ধ্যার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পেরে। প্রথম দেখাই সন্ধ্যার জন্য এইরকম ফিলিংস কেন আসলো বুঝতে পারছে না সমুদ্র। সন্ধ্যা যখন তাকে আংকেল ডেকেছিল তবুও তার এত কষ্ট হয় নি কিন্তু সন্ধ্যার অসুস্থতার কথা শুনে খুব কষ্ট হলো তার।
—” শুভ্রতা ও কি কোনোদিন সুস্থ হবে না?”
—” জানি না রে সমুদ্র বাট মনে হয় যদি সুস্থ হতো তাহলে কি আর স্পন্দন তাকে সুস্থ করতো না।”
নাদিয়া সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো….
—” কি কিউট দেখতে ও একদম পুতুলের মত। জানিস শুভ্রু আমার দাদিমা বলতেন মহান আল্লাহ তায়ালা কাওকে পাঁচ দিক দিয়ে তৈরি করতেন না কোনো না কোনো দিক থেকে ত্রুটি বানাতেন। সন্ধ্যা সব দিক দিয়েই ঠিক ছিল কিন্তু দুর ভাগ্য বসত বুদ্ধির দিক দিয়ে সে প্রতিবন্ধী। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।”
সমুদ্র সন্ধ্যার দিকেই তাকিয়ে আছে এরেই ফাঁকে কাজের মহিলাটি আলু পিঠা,নুডলস, সেমাই, বিভিন্ন রকমের পিঠা, মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। খাবার টেবিলে রেখে শুভ্রতা সবাইকে বসতে বলল সন্ধ্যা হুট করে দৌড় দিয়ে হাকিমের বাটি আনতে গিয়ে সমুদ্রের সাথে পা লেগে পরে যেতে চাইলে সমুদ্র তাকে ধরে ফেলে।
—” তুমি ঠিক আছো?”
—” হুম আংকেল আমি তো একটুও ব্যাথা পাই নাই থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু আংকেল।”
—” ওয়েল কাম মিস সন্ধ্যা। ”
চারজন মিলে বসে বসে খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। নাদিয়ার কথা শুনে শুভ্রতা হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাওয়ার মত। নাদিয়ার বয়ফ্রেন্ড এইটাও নাকি শেষ এখন সে দুইশত আট নাম্বারে কথা নিয়ে ব্যস্ত। এখন যাকে পছন্দ করেছে তার নাকি একটাই দোষ সে না-কি ভাব দেখায় বেশি। এই ভাবের কারণে ব্রেকআপ হতে হতে হচ্ছে না তাদের।
—” নাদু এইবার এইসব ছাড় দেখবি বিয়ে বা প্রেমের ফুল ফুটলে এমনি এমনি সব হয়ে যাবে। ”
—” আমার কপালে লেখা আছে নিজের পাত্র নিজে খুঁজতে হবে। কেউ আসবে না নিজে থেকে তাই আমি প্রেম করেই যাবো দেখি কয়টা হয়।”
—” হাজার বানাবি না-কি?”
শুভ্রতার কথায় নাদিয়া নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে বলল…..
—” আর বলিস না ভাইয়ার প্রেম করার ভাগ্য আমার কপালে বাঁধা হয়েছে তাই আমি আমার আর ভাইয়ার দুইজনের প্রেমেই করি একা হয়ে তাই সিউর বলতে পারছি কত তম বয়ফ্রেন্ড আমার লাস্ট বয়ফ্রেন্ড হয়।”
নাদিয়ার কথায় শুভ্রতা হাসলেও সমুদ্রের মুখে কোনো হাসি নেই। হাসি না থাকার কারণ সন্ধ্যার অসুস্থতা। কিছুতেই সে মানতে পারছে না সন্ধ্যা যে অসুস্থ। লাভ এট ফাস্ট সাইড ইফেক্ট তৈরী হয়ে গেছে সমুদ্রের বুকে। প্রথম দেখায় কাওকে মনে জায়গা করে দিয়েছে সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল সন্ধ্যা যেমনি হোক তার মনে এক মাত্র জায়গা সন্ধ্যারই থাকবে।
আজ রাতে সমুদ্র আর নাদিয়া থাকবে। মিস্টার আজম এর মিসেস সাবিনার কাছে নাদিয়া আর সমুদ্রকে খুব ভালো লেগেছে। সন্ধ্যা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে সমুদ্রের মতই একজন ছেলের সাথে বিয়ে দিতো। সমুদ্রের কথা,ভদ্রতা, বড়দের সম্মান দিয়ে কথা বলা খুবই মুগ্ধ করেছে তাদের দুজনকে । স্পন্দন অফিসে থেকে বার বার ফোন দিয়ে বলছে সমুদ্র আর নাদিয়া যেন আজ রাতে তাদের বাসায় থাকে। সে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
শুভ্রতা আজ স্পন্দনের জন্য কালো শাড়ি পরে সেজেছে। এই প্রথম আজ সে স্পন্দনের সামনে কালো শাড়ি পরে যাবে। শুভ্রতা-কে তার ফ্রেন্ড-রা সবাই বলতো কালো শাড়িতে তাকে খুব সুন্দর দেখা যায়। চোখ ভর্তি কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক,হাত ভর্তি কাচের কালো চুড়ি, কানে জুম-কো,গলায় মালা, কপালে ছোট কালো টিপ, চুল গুলো সামনে ফুলিয়ে বাঁকা সিঁথি করে খোঁপা করা। নিজেকে আয়নায় বার বার দেখে নিজেই চোখ সরাতে পারছে না শুভ্রতা।
—” নিজেকে দেখে নিজেই আহত হচ্ছি জামাই তো নিহত হবেই। ছিঃ কি বলছি নিহত কেন হবে উনি অনেকদিন বাঁচবে।”
—” কে অনেকদিন বাঁচবে?”
সমুদ্রের কথা শুনে পিছন ফিরে সমুদ্রকে দেখে ভীষণ লজ্জা পেল শুভ্রতা। মনে মনে ভাবছে……
—” ইসসসসসস কেন যে আজ সাজলাম অন্য একদিন সাজলেও হতো। সমুদ্র কি ভাববে এখন?”
—” বাহ তোকে তো আজ মারাত্মক সুন্দর লাগছে। দুলাভাই তো আজ শেষ তোকে দেখে।”
—” লজ্জা দিবি না একদম।”
—” ওকে ফাইন কিছু বলবো না। শোন একটা ইম্পর্টেন্ট কথা বলবো যদি মাইন্ড না করিস।”
—” হুম বল?”
—” সন্ধ্যাকে বিয়ে দিবি না?”
—” ওর যা অবস্থা কিভাবে ওর বিয়ে দেওয়া হবে তাছাড়া কে বিয়ে করবে?”
—” যদি বলি আমি বিয়ে করবো তাহলে কি বিয়ে দিবি না?”
—” বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না সমুদ্র। ও এখন বিয়ে কি এই সম্পর্কে কিছুই বুঝে না আর তুই কি পাগল দুনিয়াতে মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিস না না-কি?”
—” প্লিজ এইভাবে বলিস না। প্রথম দেখাতে আমার সন্ধ্যাকে খুব ভালো লাগে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”
—” মোহ তে পরে বিয়ে করতে চাচ্ছিস যখন মোহ কেটে যাবে তখন আপসোস করবি। সন্ধ্যা কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কি বুঝার ক্ষমতা রাখে না। তখন তুই যদি জোর করিস তখন এর ফল খুব খারাপ হবে আর আমার মনে হয় স্পন্দন তার বোনকে কোনোদিন বিয়ে দিবে না। ”
সমুদ্র আর কিছু বলল না মন খারাপ করে চলে গেল। ও শুধু সন্ধ্যার কথা রাখার জন্য আর সন্ধ্যাকে দেখার জন্য এই বাড়িতে থেকেছে। এখন শুভ্রতার কথাগুলো তাকে খুব কষ্ট দিল।
শুভ্রতা স্পন্দনকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। সেই কখন বলল ও অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনও বাসায় আসছে না এমনকি ফোন রিসিভ করছে না। নাদিয়া আর সমুদ্র অনেক্ষণ বসে থেকে চলে গেলো তাদের বাসায়। এত রাতে সমুদ্র জেদ চেপে ধরে বসল যে সে বাসায় চলে যাবে ওর আম্মু নাকি ফোন দিয়েছে তার শরীর খারাপ। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে দুই ভাইবোন চলে গেল। শুভ্রতা খুব ভালো করেই জানে সমুদ্র কেন চলে গিয়েছে। সে সন্ধ্যার বিয়ের অমত পোষণ করায় সমুদ্র চলে গিয়েছে তার বুঝতে বাকি নেই।
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে শুধু মাত্র শুভ্রতা ড্রয়িং রুমে বসে স্পন্দনের জন্য ওয়েট করছে। রাত দুটো চিন্তায় ঘুম আসছে না শুভ্রতার। দুইটা পনেরো যখন বাজে তখনি কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে স্পন্দনকে দেখে জড়িয়ে ধরে অভিমানী সুরে বলল…..
—” এত রাত কেন হয়েছে আপনার আমার ফোন কেন ধরছেন না?”
স্পন্দন মাথা নিচু করে বললো…..
—” সরি শুভ্রতা। সাধনাকে রাস্তায় একা পেয়ে আমার সাথে নিয়ে আসি।”
সাধনার আসার খবর পেয়ে খুশি হলো খুব শুভ্রতা। এতদিন পর নিজের ছোট বোনকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরলো…..
—” বুঝতে পেরেছিস নিজের ভালো এই জন্য তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
চলবে…..
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।