#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩২
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকালো শুভ্রতা এই দৃষ্টি দেখে ভয়ে চুপসে গেল। স্পন্দন সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বললো……
—” তাজরীন মারা গেছে তাহলে ও কিভাবে তোকে চকোলেট গিফট দিচ্ছে?”
শুভ্রতা এইবার ভয়ানক ধরনের চমকে গেল। মরা মানুষ চকোলেট গিফট দিচ্ছে কথাটা ভাবতেই তার শরীর বার বার শিহরিত হচ্ছে। সন্ধ্যা সে তো একবার চকোলেট বক্স আরেকবার স্পন্দনের দিকে তাকাচ্ছে। সে ভাবছে এতদিন সে মৃত মানুষের গিফট দেওয়া চকোলেট গুলো খেয়ে এসেছে ভাবতেই তার শরীর কাঁপতে লাগলো। শুভ্রতা তখন স্পন্দনকে বলল…..
—” মৃত মানুষ কিভাবে চকোলেটে ড্রাগস ব্যাবহার করবে? আচ্ছা এই চকোলেট কি মৃত মানুষের জন্য বানানো হয়? এই জন্যই তো খেতে বাজে। ডক্টর মনে হয় মেয়াদ উত্তীর্ণ গাঁজা সেবন করেছে তাই মৃত কোম্পানির চকোলেট উনি বুঝতে পারে নাই।”
শুভ্রতার বোকা বোকা কথায় ভীষণ রেগে যাচ্ছে স্পন্দন। যেখানে তার বোন এখন এত বড় বিপদের মুখে সেখানে এমন বোকা বোকা কথা কিভাবে বলছে শুভ্রতা।
—” মেয়াদ উত্তীর্ণ গাঁজা তুমি সেবন করেছ শুভ্রতা তাই এই রকম আবল তাবল বলছো। মৃত্যুর পর কেউ পৃথিবীতে আসতে পারে না। মৃত মানুষের কোনো কোম্পানি নেই ওকে।”
—” তাহলে চকোলেট কে পাঠালো? ভুত নিশ্চয় পাঠাবে না?”
—” কেউ একজন পাঠিয়েছে কিন্তু সে তাজরীনের নাম ব্যাবহার করে এইসব করছে। কিন্তু কে?”
—” স্যার এই তাজরীন মেয়েটা কে কিভাবে চিনেন ওকে?”
—” ওর সাথে আমার শপিং মলে দেখা হয়েছিল । সেদিন ও আমার অনেক বড় হেল্প করে।”
নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনলে যে কেউ রেগে যাবে। শুভ্রতাও রেগে গিয়ে বলল…..
—” কি হেল্প করেছে?”
—” আমি ভুল করে এটিএম কার্ড বাসায় রেখে চলে যাই। রাস্তায় আবার পকেট মার সব টাকা নিয়ে চলে যায়। ওইদিন তাজরীন-ই আমার মান সম্মান রক্ষা করে। সেদিনের পর থেকে ওর সাথে আমার প্রায় কথা হতো। আমরা দুজন প্রায় দেখা করতাম। খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিলাম আমরা। আমি তাজরীন-কে জাস্ট বন্ধু ভেবে এসেছি কিন্তু ও আমায় একবার প্রপোজ করে অনেক মানুষের সামনে। আমি ওকে কোনোদিন ভালোবাসার মানুষের নজরে দেখি নাই তাই সেদিন ওকে আমি রিজেক্ট করি। আমি বলেছি ওকে যে আমরা খুব ভালো বন্ধু আমাদের মাঝে প্রেমিক প্রেমিকা, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কিছুতেই হবে না। কিন্তু সেদিন ও খুব কষ্ট পেয়ে চলে যায় আমি আটকাতে চেয়েও আটকাই নি। ও চলে যাওয়ার দুইদিন পর জানতে পারলাম ও সুইসাইড করেছে।”
স্পন্দন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল…..
—” যে মারা গিয়েছে সে কিভাবে কাওকে কিছু গিফট করতে পারে? কিভাবে সম্ভব?”
স্পন্দন তার ভাবনার জগতে চলে গেলো ঠিক তখনি তাজরীন নামক মেয়েটি ফোন দিল। সন্ধ্যা চিৎকার করে বলল…..
—” এইতো তাজরীন আপু ফোন দিয়েছে।”
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি স্পন্দন খুশি হয়ে বলল….
—” স্পিকার বাড়িয়ে কথা বল আর আগে যেভাবে কথা বলতি ওইভাবে বলবি কেমন?”
—” হুম ভাইয়া।”
তাজরীনের ফোন ধরার পর ওইপাশ থেকে তাজরীন চেঁচিয়ে উঠে বললো…..
—” আজকাল আমার দেওয়া চকোলেট কি খাচ্ছিস না? যেখানে আমার তিন-চার দিন পর পর চকোলেট পাঠাতে হতো সেখানে আজ দশদিন হয়ে গেল চকোলেটের কথা বলছিস না ফোন দিলেও দেখি বিজি থাকছিস আমার সাথে যোগাযোগ করা কি বন্ধ করে দিচ্ছিস? এইরকম করলে আর চকোলেট দিবো না তখন তোর ওই ভাবী তোকে মেরে ফেলবে জানিস ওই মেয়ে কত খারাপ।”
শুভ্রতার সম্পর্কে বাজে কথা শুনে স্পন্দনের ইচ্ছা করছে এক্ষুনি ফোনের ওপাশের মেয়েটিকে ইচ্ছা করে মারতে। যে মুখে শুভ্রতার নামে খারাপ কথা বলছে ওই মুখ ভেঙ্গে ফেলতে। নিজেকে খুব কষ্টে সামলিয়ে নিলো।
সন্ধ্যা তখন উচু গলায় বললো…..
—” লাগবে না তোমার চকোলেট তাছাড়া ভাবী খুব ভালো। তুমিও তো ভালো তাহলে ভাবির নামে খারাপ কথা বলছো কেন?”
—” বাহ এখন তো দেখছি ভাবির খুব গুণগান করতে শিখে গেছিস। কি যাদু করলো তোর ভাবী তোকে আর তোর ভাইকে। স্পন্দন তো বউ বলতে অজ্ঞান আর তুইও দেখছি ভাবী ভাবী বলতে অজ্ঞান।”
স্পন্দন এইবার বলেই ফেলল……
—” মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ তাজরীন। সুইসাইডের মিথ্যা নাটক করে এখন আমার সংসার ভাঙতে এসেছো? তোমাকে কতো ভালো মেয়ে জানতাম আমি আর তুমি তো দেখছি খুব খারাপ মেয়ে ছিঃ আমি কি-না তোমাকে খুব ভালো বন্ধু ভেবে এসেছি। তোমার মৃত্যুতে বার বার নিজেকে দোষারোপ করেছি। সত্যিই বলছি তোমার মত খারাপ মেয়ের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
ফোনের ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল…..
—” আমার বোন বাজে মেয়ে ছিল না। সে আপনাকে ভালোবাসতো। আপনাকে ভালোবেসেই এখন সে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আপনি আমার বোনকে ধোঁকা দিয়েছেন। প্রতারণা করেছেন আপনি আপুর সাথে। আপনি যেমন আমার কাছ থেকে আমার আপুকে কেড়ে নিয়েছেন আমিও আপনার কাছ থেকে আপনার আদরের বোন আর বউকে কেড়ে নিবো।”
স্পন্দন এইবার জোরে জোরে হাসা শুরু করল। হাসি দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করে সে আনন্দের হাসি হাসছে।
—” তুমি কি ভেবেছিল মিস তাবরীন। তোমাকে আমি ধরতে পারবো না। এই স্পন্দন এত বোকা নয় যে তার সাথে তুমি গেমস খেলবে আর সে ধরতে পারবে না।”
তাবরীন খুব অবাক হলো এই ভেবে স্পন্দন তার নাম জানলো কিভাবে সে তো তার পরিচয় তাজরীন দিয়েছে।
তাবরীন-কে বেশ অবাক করে দিয়ে স্পন্দন বলল…..
—” তাজরীনের সাথে আমার বন্ধুত্ব খুব ভালো ছিল । তাজরীন আমাকে তার পরিবারের সব কথাই বলতো। তোমার কথাও অনেক বলেছে। তুমি না-কি তাজরীন-কে খুব ভালোবাসো। তোমার অনেক ছবিও সে দেখিয়েছে কিন্তু তোমার সাথে আমার কোনোদিন কথা হয় নি। তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছিলে তাজরীনের জানাজায় আমি অংশ গ্রহণ করেছি। এখন ভাবছো যেখানে আমি তাজরীনের জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছি তাহলে আমি কেন বললাম মিথ্যা সুইসাইডের কথা।”
কথাটা বলে স্পন্দন হাসলো তারপর আবারো বলল…..
—” তাজরীনের কণ্ঠ আমি খুব ভালো করে চিনি। এখন আমি যদি তোমাকে সোজা ভাবেই বলে দিতাম যে কে তুমি তাজরীন মারা গিয়েছে ওর নাম নিজে ব্যাবহার করে কি করতে চাইছ তোমার আসল পরিচয় দেও তাহলে কি তুমি সোজা ভাবে উত্তর দিতে? একদমই দিতে না তাইতো তাজরীন-কে খারাপ মেয়ে বলে তোমার আসল পরিচয় বের করলাম। যে মেয়ে তাজরীনের জন্য এত বড় রিস্ক নিতে পারে সে তো তাজরীনের বদনাম একদমে-ই শুনতে পারবে না। রাগের বশে সে তখন কি বলতে কি বলবে হয়তো নিজেই জানে না। আর কি যেন বলেছিল আমি তোমার বোনকে সুইসাইড করার জন্য ঠেলে দিয়েছি তাহলে বলবো ভুল জানো তুমি। আমি তাজরীন-কে বলেছি ও আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি ওকে সারা জীবন বন্ধু ভেবেই থাকতে চাই। আমাদের মাঝে অন্য সম্পর্ক সৃষ্টি হলে আমরা দুজন কোনোদিন সুখী হতে পারবো না। ভালোবাসা হলে দুটি মনের সেতু বন্ধন। এই সেতু বন্ধন যাকে তাকে দেখলেই বা পছন্দ করলেও তৈরি হবে না। এই বন্ধন এক মাত্র একজন অন্যজনকে অন্তর থেকে ভালোবাসলে তৈরি হবে। তাজরীন আমার কথার অর্থ বুঝতে পারে নাই তাই সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে তার জীবন ত্যাগ করে এইখানে আমার কোনো হাত নেই। আর তুমি যে আমার বোনের এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তার শাস্তি আমি তোমাকে নিজের হাতে দিবো। অপেক্ষা করো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে আমাদের।”
কথাটা বলেই স্পন্দন ফোন কেটে দিল। সন্ধার দিকে তাকিয়ে বললো…..
—“কেউ যদি কাওকে সত্যি কারের ভালোবাসে তার জন্য সে সব কিছু করতে পারে হোক সেই ভালোবাসা মা বাবার প্রতি বা ভাই বোনের প্রতি বা স্বামী স্ত্রীর প্রতি। এখন তুই যদি আমাকে সত্যিই খুব ভালোবেসে থাকিস তাহলে প্রমিজ কর ওই চকোলেট গুলো আর খাবি না।”
সন্ধ্যা এতদিন সমুদ্রের কথা শুনে চকোলেট খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছিল কিন্তু এখন স্পন্দন তাকে আর না খেতে বলেছে। যখন তার চকোলেটের নেশা লাগবে তখন তো সে পাগল পাগল হয়ে যায় তখন কিভাবে প্রমিজ রাখবে কিন্তু স্পন্দনকে তো সে খুব ভালোবাসে। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার পাল্লা চকোলেটের নেশার পাল্লা থেকেও ভারী তাই সন্ধ্যা প্রমিজ করল……
—” ওকে ভাইয়া আর খাবো না।”
স্পন্দন সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো…..
—” একটু পর নতুন ডক্টর আসছে। ডক্টরের সব কথা শুনবে আমি আসছি।”
—” ওকে ভাইয়া।”
স্পন্দন সন্ধ্যার রুম থেকে চলে যায়। শুভ্রতা এতক্ষণ স্পন্দনের কথা শুনে বুঝল স্পন্দনের মাথায় শুধু হিসাব না রাজনীতির সু-বুদ্ধি আর কু-বুদ্ধি দুইটাই আছে। এত বুদ্ধি নিয়ে কিভাবে ঘুমায় এই লোক শুভ্রতার মাথায় আসছে না। শুভ্রতার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে স্পন্দন বলল…..
—” ডক্টর আসলে সাধনা আর সন্ধ্যার দুইজনের সাথে তুমি থেকো। আমার আসতে দেরি হবে।”
—” কোথায় যাবেন আপনি?”
—” দরকারে যাচ্ছি এত প্রশ্ন করো না এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে পরে তোমার গায়ে হাত উঠে পড়বে।”
স্পন্দনের কথায় শুভ্রতা মনে মনে স্পন্দন চৌদ্দ গুষ্টির নাম উদ্ধার করল। এখন কিছু বলবে না যখন স্পন্দনের মন ভালো থাকবে তখন সে প্রতিশোধ নিবে। যখন পুরুষ আগুন হয়ে থাকে তখন স্ত্রীকে পানি হতে হয় আর যখন স্ত্রী আগুন হয়ে থাকে তখন স্বামীকে পানি হতে হয়। কেননা দুইজনেই আগুন হলে সংসার জাহান্নামে পরিণত হয়।
চলবে…….
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।