#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৭
পৃথিবীটা সত্যিই খুব অদ্ভুদ। কোথায় কখন কার সাথে দেখা হবে বুঝা মুশকিল। পৃথিবীটা না-কি গোলাকার। পথে ঘাটে হাজারো মানুষ চলাচল করে। কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না। ব্যাস্ত শহরের মানুষগুলোও বড্ড ব্যাস্ত। মন খুলে কথা বলার মত কাওকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সব কিছুতেই মানুষ কিছু না কিছু বাহানা খুঁজে। এই যেমন তুমি এক অদ্ভুদ বাহানা ধরে বসে আছো শুভ্রতা। কতক্ষণ ধরে তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি আর তুমি এই বাহানা সেই বাহানা করেই যাচ্ছো। মেয়ে মানুষদের মন এত কঠোর হওয়া ঠিক না।
শুভ্রতা এতক্ষণ বসে বসে মিস্টার ফায়াজের বকবক শুনে যাচ্ছে। এই লোকটা উপন্যাসিক কথা বলে। শুভ্রতার কাছে ভালো লাগে কথা গুলো কিন্তু লোকটা অন্য কিছু ইঙ্গিত করে সব বুঝেও শুভ্রতা মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল…..
—” স্যার, আমি আপনাকে ‘তুমি’ করে বলার জন্য অনুমতি দেই নি। হতে পারে আমি সামান্য একজন এমপ্লয় কিন্তু আমারও নিজস্ব মতামত আছে।”
ফায়াজ নিজের অবস্থান চেঞ্জ করল। লজ্জা পাওয়া সত্ত্বেও লজ্জা ভাব না নিয়ে হেঁসে উঠল।
—” সরি মিস।”
—” সরি স্যার, মিস নয় মিসেস হবে। ভুলে যাবেন না আমি মিস্টার স্পন্দন স্যারের স্ত্রী।”
—” ওহ্ সরি, মিসেস শুভ্রতা আপনি একা কেন এসেছেন? মিস্টার স্পন্দন কোথায়?”
—” উনি এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমরা একসাথেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম বাট রাস্তায় উনার এক ইম্পর্টেন্ট ফোন আসে তাই উনি চলে যায়।”
–” কিসের ইম্পর্টেন্ট ফোন?”
—” উনি আজ এক মাদ্রাসায় কিছু অর্থ প্রধান করবেন তাই ওইখানে চলে গিয়েছেন।”
—” আচ্ছা। তাহলে চলুন আমরা একটু আড্ডা দেই মিস্টার স্পন্দন না আসা অব্দি।”
—” সরি স্যার, আমার অনেক কাজ আছে আজ আড্ডা দিতে পারবো না। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”
—” ওকে।”
ফায়াজ আজ কোনো কাজ না থাকা সত্বেও স্পন্দনের সাথে দেখা করতে আসে। দেখার করার প্রধান কারণ শুভ্রতা। শুভ্রতার কণ্ঠ তার অনেক ভালো লেগেছে। সেই কণ্ঠ শোনার জন্য অজুহাত দেখিয়ে অফিসে আসলো সে…….
শুভ্রতা কাজ করছে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে কলম বার বার ঘুরাচ্ছে । খুব মনোযোগ সহকারে কাজ করছে সে। হটাৎ একটি ফোনে শুভ্রতার সমস্ত মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেলো….
—” হ্যালো কে বলছেন?”
—” আপু আমি সাধনা বলছি। কেমন আছিস?”
—” সাধনা তুই? এইটা কি নিউ নাম্বার তোর?”
—” হ্যাঁ আপু। বল না কেমন আছিস?”
—” খুব ভালো আছি। তোর ফোন পেয়ে খুব খুব ভালো লেগেছে। এখন বল তুই কেমন আছিস?”
—” আমিও খুব ভালো আছি আপু। আপু একটা সু-খবর আছে?”
—-” কি সু-খবর?”
—-” তুই খালামণি হতে যাচ্ছিস।”
শুভ্রতা কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ঘোরে চলে গেলো। শুভ্রতা জানে সাধনা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। তারমানে বিয়ে মাত্র বিশ দিন এই বিশ দিনে কিভাবে সাধনা প্রেগনেন্ট হতে পারে?
—” কিন্তু তোর বিয়ে তো মাত্র……!”
—” আপু আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আবেগের বশে প্লিজ রাগ করিস না। চিন্তা করিস না আমার বেবির বাবার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে। জানিস ও না খুব ভালো আমার অনেক যত্ন করে। খুব ভালোবাসে আমাকে।”
—” যে ছেলে বিয়ের আগে এইরকম নোংরা একটি কাজ করতে পারে সে কখনো ভালো হয় না সাধনা।”
—” এইখানে তো শুধু ওর দোষ নেই আমারও দোষ আছে তারমানে কি আমিও খারাপ আপু? বল আমি খারাপ?”
—” তুই আমার বোন হয়ে এমন নোংরা একটি কাজ করবি কোনোদিন ভাবতে পারেনি। ছিঃ লজ্জা করে না তোর এক ছেলের সাথে প্রেম করে অন্য ছেলের সাথে এমন করতে? বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল কিন্তু তুই কি করলি বিয়ের আগে আব্বু আম্মুর বা আমাদের পরিবারের চিন্তা না করে ওই বাজে ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেলি। এখন কোন সাহসে ফোন দিচ্ছিস আমাকে? তোর কাজের পরিণতি এখন আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে। আমার সাথে এমন না করলেও পারতি তুই।”
—” আপু আমি মানছি আমি ভুল করেছি এই জন্য যা শাস্তি আমাকে দে তুই কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে তোর আর আব্বু আম্মুর আদর থেকে বঞ্চিত করিস না প্লিজ আপু প্লিজ।”
শুভ্রতা বাচ্চার কথা শুনে নিজের পাহাড় সমান রাগ পানিতে মিশিয়ে সাধনাকে বলল……
—” কোথায় আছিস এখন তুই?”
—” জায়গাটা চিনি না আপু। কিন্তু কোন এক জঙ্গলের ভিতরে পুরান বাড়ি এইটা। খুব সুন্দর বাড়িটা আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে।”
—” ছেলেটির নাম কি?”
—” ওর নাম মুগ্ধ আপু। বিশ্বাস কর আপু খুব ভালো ও। আমার অনেক খেয়াল রাখে। প্রতিদিন নিজ হাতে খাইয়ে দিবে সময়মত মেডিসিন খাওয়াবে। কোন কাজকর্ম আমাকে করতে দেয় না।”
—” কি করে মুগ্ধ?”
—” আমি তো জানি বিজনেস করে কিন্তু কিসের বিজনেস তা জানি না।”
—” শোন তুই আমাকে মুগ্ধের সব ইনফরমেশন আমাকে দিবি। আমি খুঁজ নিয়ে দেখবো ছেলেটা কেমন ওকে?”
—” আপু তুই ওকে সন্দেহ করছিস?”
—” সন্দেহ করার মতোই তো কাজ কর্ম করেছিস তোরা। শোন, এখন আমি অফিসে আছি পরে কথা বলবো। আব্বু আম্মুকে ফোন দিবি না একদম। উনারা কিন্তু তোকে বাজে কথা বলবে তোর যা অবস্থা এখন ওইসব কথা ভালো লাগবে না।”
—” ওকে আপু। লাভ ইউ।”
—” লাভ ইউ টু। বায় পরে কথা হবে।”
—” ওকে আপু।”
।।
শুভ্রতা ফোন কেটে দিয়ে ঝিম ধরে বসে রইলো। সাধনা বিয়ে করেছে এতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু বিয়ের আগে যে ও এমন ধরনের বাজে কাজ করবে ভাবতেই কষ্ট লাগছে ওর। অভাগা যেদিকে তাকায় নদীও নাকি শুকায় ঠিক এখন শুভ্রতার সাথে যা ঘটলো শুভ্রতার তাই মনে হলো। স্পন্দন ম্যাসেজ দিয়েছে….
—” কেনো না-কি কেন?”
এমন অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না শুভ্রতা। এমনিতে সাধনার চিন্তায় সে শেষ এখন আবার স্পন্দনের অদ্ভুদ প্রশ্ন।
—” দুইটার মানে তো একটাই তাই না?”
—” তোমাকে বাংলা কে শিখেছে? কার কাছে বাংলা পড়তে?”
—” স্কুলের এক ম্যাম শিখেছেন কেনো?”
—” আবারো ‘কেনো’ লিখছো কেন? ‘কেনো’ অর্থ কোনো কিছু কিনার কথা বুঝায় আর ‘কেন’ অর্থ প্রশ্ন করাকে বুঝায়। আশ্চর্য! তুমি পড়ালেখা শেষ কিভাবে করলে?”
শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে বলল……
—” শুনুন এইগুলো টাইপ মিসটেক।”
—” হুহহ বুঝছি।”
—” এখন বলেন কেনো ম্যাসেজ দিলেন?”
—” শুনো, আমার আজ আসতে দেরি হবে তুমি আমার কেবিনে গিয়ে নীল রঙের একটি ফাইল পাবে । ওই ফাইলে কিছু সমস্যা আছে কম্পিউটারে চেক করে সমস্যা সমাধান করো।”
—” ওকে স্যার।”
শুভ্রতার কাছে আজকাল কাজ করতে একটুও ভালো লাগে না। কাজের চাপ দেখলেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে তার। কোনো উপায় না পেয়ে স্পন্দনের কেবিনের দিকে হাঁটা শুরু করলো, মনে মনে দোয়া করছে যেনো ফায়াজ না থাকে। অফিসের আরেকজন এমপ্লয় এসে বললেন….
—” মিস্টার ফায়াজ স্যার হটাৎ করেই আজ চলে আসলেন আবার চলেও গেলেন কিছু কি জানেন শুভ্রতা?”
—” নাহ ইমরান ভাইয়া কিছু তো জানি না। হতে পারে স্পন্দন স্যার নেই তাই চলে গেছেন।”
—” ওহহ আচ্ছা। বায় এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে স্যারকে বলে ছুটি নিয়েছি। আজ বউয়ের বাবার বাড়ি যেতে হবে। বিয়া যে কত্ত প্যারা।”
ইমরান চলে যাওয়ার পর শুভ্রতা হাঁস-লো। বাবার বাড়ির কথা মনে পড়ছে তার। কিন্তু এখন সে আর যেতে পারবে না।
স্পন্দনের কেবিনে ঢুকে টেবিলে নীল রঙের ফাইল দেখতে পেয়ে হাতে নিলো। টেবিলে স্পন্দনের ছবি ফ্রেম দেখে হাতে নিয়ে স্পন্দনের ছবির নাক ধরে টান দিল…..
—” এই নাক কেটে ফেলে দিবো। আমার পিছনে লাগা ছাড়া কোনো কাজ নেই তাই না? উগান্ডার হনুমানের মতো দেখতে, সাদা জিরাফ, তাল পাতার সেপাই। ”
শুভ্রতার খুব ইচ্ছা করছে স্পন্দনের ছবির ফ্রেমে ভালোবাসার পরশ একে দিতে। রিয়েল ভাবে কোনোদিন পারবে কি-না জানে না তাই ছবিটা হাতে নিয়ে ছবির স্পন্দনের কপালে চুমু দিয়ে বলল…..
—” আপনাকে এত ভালোলাগার কারণ কি জানেন?”
নিজে নিজেই কল্পনা করতে লাগলো শুভ্রতা। কল্পনা জগৎ কে রিয়েল অনুভব করতে লাগলো……
—” কারণটা কি বলো?”
—” কারণটা হলো মানুষের পাশে থাকেন। আমার নিজেকে গর্বিত মনে হয় কজ আমি আপনার স্ত্রী। আপনাকে কোনোদিন এত ভালোবাসতে পারবো ভাবিনি কিন্তু দেখুন আপনার মনুষ্যত্ব দেখে ভালো না বেসে পারলাম না। হ্যাঁ এইটা ঠিক কিছুদিন আগেও আপনাকে নিজের স্বামী বলতে আমার লজ্জা বোধ করতো তার কারণ আপনাকে তখনও আমি আমার নিজের আপন ছোট বোনের ভালোবাসার মানুষ ভেবে বসতাম। আপনাকে নিজের স্বামী বলতে এক প্রকার নিজেকে পাগল মনে হতো। ভাবতাম এই আমি কি করছি নিজের ছোট বোনের হবু স্বামীকে নিজের স্বামী ভাবছি। কিন্তু এখন আর সেই দ্বিধা বোধ আমার নেই স্পন্দন। কেননা, আমার বোন এখন সুখে আছে সে আপনাকে তার ভালোবাসার মানুষ ভাবে না। সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে খুশি আছে। যদিও বা আমার মনে একটা জটিল প্রশ্ন থেকেই থাকে যে, সাধনা যদি অন্যজনকে ভালোবাসে তাহলে আপনাদের ভালোবাসা,প্রেম এমনকি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত এইসব হলো কেন? প্রশ্নের উত্তর যে আমি এখন পাবো না খুব ভালো ভাবেই জানি। আচ্ছা আমি আসি আপনি তো আমার বসা দেখতে পারেন না হিংসুটে লোক একটা।”
একা একা বকবক করেই কেবিন থেকে বের হলো। প্রায় দু ঘণ্টা পর্যন্ত এই ফাইল দেখে হিসাব মিলিয়ে সামান্যতম রেস্ট নিলো। সমস্ত কাজ শেষ করে চা-এর কাপ-টা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। এক চুমুক দিয়েই বলল…..
—” তাজা হয়ে যা।”
শুভ্রতা কথাটা বলেই হেঁসে দিলো। দিনদিন বেশ রসিক হয়ে যাচ্ছে সে। স্পন্দন হলো গোমড়া মুখও ছেলে কিন্তু তার সাথে থেকে রসিকতা শিখা কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং হেঁসে বলবে…..
—” আমি বিশ্বাস করি না।”
শুভ্রতা এইগুলো বলে আবারো হাঁস-লো। মানুষ ঠিক বলে হাসির মাঝে কষ্ট গুলো লুকানো যায়। যে মানুষ যত বেশি হাসি খুশি থাকে তার মনে কিন্তু অনেক কষ্ট থাকে। হাসির আড়ালে আবডালে কষ্ট লুকানো ছাড়া অন্য কোথায় জায়গা নেই লুকানোর।মানুষ জাতি সত্যিই খুব অদ্ভুদ জাতি। কখন কি মাথায় আসে বুঝা মুশকিল।
শুভ্রতার এখন সব’চে বেশি কষ্ট করতে হবে নিজের বাবা মাকে বুঝানো। বোন যতই অন্যায় করুক কিন্তু বাচ্চাটার তো অধিকার আছে নিজের নানা নানু ও আন্টির ভালোবাসা পাওয়ার? কিছুতেই বাচ্চার অধিকার,পাওনা নষ্ট করতে চায় না শুভ্রতা। শুভ্রতা কিছুক্ষণ ভেবে বুঝ-লো এখন কিছুদিন কথাগুলো ধামা চাপা দিতে হবে। এত বড় একটা শক পেয়েছেন শুভ্রতার বাবা আগে সেই শক থেকে উঠা দরকার।
—” তোমাকে বাসায় এসে খুন করবো। তোমার জন্য ঝামেলা আমার পিছু ছাড়ছে না। বাসায় আসি বিচার হবে আজ তোমার।”
স্পন্দনের রাগান্বিত ম্যাসেজ শুভ্রতাকে ভয়ে চুপসে দিলো। ম্যাসেজ পড়ে ভাবছে…..
—” কি করলাম আমি? খুন কেন করবে?”
চলবে…….