#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২০
মুগ্ধের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে পুড়ে দিলো সাধনা…….
খাবার মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই বমি করে দিলো সাধনা। মুগ্ধ খাবার রেখে সাধনাকে জড়িয়ে ধরলো। কঠিন গলায় বলল…..
—” আমার কথা না রেখে কি মজা পাও তুমি বলতো? আগেই বলেছি খাবে না শুনলে না আমার কথা। নিজেকে আর আমার বাচ্চাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তাই না? বুঝো না তোমাদের কষ্ট আমার কাছে পাহাড় সমান কষ্ট লাগে।”
মুগ্ধ সাধনাকে কোলে উঠিয়ে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেল। সাধনা মুখে পানি দিয়ে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন অখাদ্য খাবার কিভাবে এত সুন্দর করে খেলো মুগ্ধ ভেবে পাচ্ছে না সাধনা। নিজের হাতে রান্না করা খাবার প্রথম লোকমা মুখটা দিতে না দিতেই সে বমি করে একাকার আর সেখানে মুগ্ধ কোনো অভিযোগ ছাড়াই গপাগপ খেয়ে যাচ্ছিলো।
—” এমন বিচ্ছিরি খাবার কিভাবে খাচ্ছিলে?”
—” খাবারকে বিচ্ছিরি বলতে নেই। আর আমার কাছে ভালো লেগেছে আমি খেয়েছি তোমার তাতে সমস্যা থাকার কথা নয়।”
—” হলুদ আর রসুনের পরিমাণ খুব বেশি হয়ে গেছে। তাছাড়া লবণ তরকারিতে নেই বললেই চলে। ঝালের পরিমাণও বেশি ছিল। এক কথায় খুব জঘন্য তম রান্না হয়েছে। আমি মুখে দিতে পর্যন্ত পারলাম না।”
মুগ্ধ সাধনাকে আবার কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিল। সাধনার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলতে খেলতে বলল…..
—-” তুমি কি জানো,হলুদে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন সি থাকে ও কারকিউমিন নামক রাসায়নিক থাকে যা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়।ভাবছি এখন থেকে তুমি আর আমি প্রতিদিন সকালে কাঁচা হলুদ খাবো কেন জানো,সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁচা হলুদ খেলে যে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, খাবার ঠিকমতো হজম হয় তার উপর হৃদরোগ ভালো হয়।হলুদকে অনেকসময় ‘মিরাকল হার্ব’ বা অলৌকিক ভেষজ বলা হয়ে থাকে।”
—” কিন্তু আজ তো হলুদ একদম অতিরিক্ত হয়ে গেছে যা খাওয়া তো দূর মুখে নেওয়াই যাচ্ছে না।”
সাধনার কথা শুনে মুচকি হাসলো মুগ্ধ। হাসি দেখে মনে হচ্ছে যে সাধনার কথায় বেশ মজা পাচ্ছে। সাধনা রেগে গিয়ে বলল….
—” হাসার মতো কিছু কি বলেছি আমি?”
—” শুনো মেরি জান, হলুদ তরকারিতে বেশি হয়েছে বাট এতটাও বেশি হয় নি যে খাওয়া যাবে না। তুমি প্রেগনেন্ট তাই তোমার কাছে এমন লাগছে। জানো যারা প্রেগনেন্ট তারা মাছের গন্ধ নিতে পারে না। হালকা ঘ্রাণ থাকলেও তাদের কাছে অতিরিক্ত ঘ্রাণ মনে হয়। প্রথম কয়েকটা মাস এইভাবেই কাটাতে হবে পরে ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো তোমার তরকারিতে মসলার পরিমাণ সামান্য দেই যেনো তোমার খেতে কোনো সমস্যা না হয়। এই জন্যই তো বলেছি তোমার রান্না করা খাবার আমি খাবো আর আমার রান্না করা খাবার তুমি খাবে।”
—” মানলাম হলুদ ঠিক আছে তোমার জন্য কিন্তু লবণ,মরিচ এইগুলোর পরিমাণ নিয়েও কি কোনো সমাধান আছে তোমার কাছে?”
—-” শুনো আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কোনোদিন খাবার নিয়ে সমালোচনা করেন নি। যদি রান্না ভালো না হতো তাহলে উনি উনার স্ত্রীদের কিছু বলতেন না খুশি মনে চলে যেতেন। কেননা, রান্না এক সময় ভালো হবে এক সময় খারাপ হবে এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করা ঠিক না।”
—” সত্যিই তোমাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। মাঝে মাঝে তোমার কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে। আমার তো মনে হয় তোমাকে বিজনেস ম্যান নয় ডক্টর ম্যান হলে বেশি ভালো মানাতো। তোমাকে তো আমার ডক্টর ডক্টর লাগে। চেহারায় যেনো ডক্টর ডক্টরের ভাব আছে একটা।”
—” আমি বিজনেস করি এইটাই আমার কাছে ভালো আছে। এইসব ডাক্তারি করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
সাধনাকে রুমে পাই-চারি করতে দিয়ে মুগ্ধ সোজা রান্না ঘরে চলে গেল। প্রেগনেন্ট অবস্থায় সামান্য হাঁটা দরকার তাহলে মা ও সন্তান দুইজনেই সুস্থ থাকে।
।।
।।
।।
শুভ্রতা স্পন্দনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সে তার মাকে হেল্প করতে রান্না ঘরে চলে গেল….
—” আম্মু এত সকালে এত কিছু কিভাবে রান্না করলে?”
—-” এত কিছু কই করলাম? নতুন জামাই এসেছে তার জন্য তো কিছু রান্না করতে হয়। জানিস ছেলেটা রাতে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বার বার কলিং বেল বাজাচ্ছিল। এই শীতে ছেলেটা বাহিরে দাঁড়িয়ে কত কষ্টই না করছিলো। অনেকবার কলিং বেল বাজার পর তোর আব্বু আর আমি আসি এসে দরজা খুলে স্পন্দনকে দেখে অবাক হই। ছেলেটা খুব ভালো তোকে খুব ভালোবাসে।”
মায়ের কাছ থেকে এমন কথা শুনে ভীষন লজ্জা পেলো শুভ্রতা। লজ্জাকে ধামা চাপা দেওয়ার জন্য বলে উঠল……
—” তোমাদের জামাইকে রাতে এত খাবার খাইয়েছ বেচারার একদিনেই ভুরি হয়ে গেছে। তোমার যে কত সুনাম করলো আর তোমার রান্নারও।”
—” আর বলিস না ছেলেটা মনে হয় কিছু না খেয়েই চলে আসছিল। মুখটা কেমন যেনো লাগছিলো । দেখেই মনে হয়েছে সারাদিন কিছু খায় নাই। খাবারের কথা প্রথম বলাতে না করেছিলো কিন্তু পরে হ্যাঁ বলে।”
শুভ্রতা স্পন্দনের কথা মনে মনে চিন্তা করতে লাগল…….
—” এই মানুষটা কাজের প্রতি এত মনোযোগী যে নিজের শরীরের কথা মনে থাকে না। গতকাল হয়তো কাজ বেশিই ছিলো তাই সারাদিন না খেয়েই পার করে দিয়েছে।অসভ্য লোক একটা।”
—” কি ভাবছিস? ”
—-” কিছু না আম্মু।”
—” আজ কি অফিস যাবি?”
—-” আজ শুক্রবার অফ ডে জানো না?”
—-” ইসসসসসস রে ভুলে গেছি। আমি তো ভেবে রাখছিলাম আজ স্কুল থেকে ছুটি নিবো নতুন জামাই এসেছে বলে। দেখ আজকের দিনটা আমাদের সবাইকে কিভাবে এক সাথে বেঁধে দিলো।”
কথাটা বলে মিসেস রেহেনা বেগম চোখ মুছলেন। নিজের ছোট মেয়ের জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানেন না উনি। শুভ্রতা মায়ের চোখের কোনায় জমে থাকা পানি দেখে বলল……
—-” সাধনা ভালো আছে আম্মু। তাছাড়া ও প্রেগনেন্ট।ওর স্বামী ওর খুব খেয়াল রাখে ছেলেটা না-কি খুব ভালো।”
—” কিসের বিয়ে? প্রেগনেন্ট কিসের? স্বামী কি বলছিস বুঝিয়ে বল।”
শুভ্রতা তার মাকে সব ঘটনা খুলে বলল। নিজের ছোট মেয়ের এমন কু-কীর্তির কথা শুনে আঁচল দিয়ে মুখ ডাকলেন। কেঁদে কেঁদে বললেন…..
—-” আমার মেয়ে হয়ে এমন একটি বাজে কাজ কিভাবে করলো ও? আমাদের কথা,আমাদের ভালোবাসা,শাসন কিছুই কি মনে নেই ওর। ছিঃ! এইসব কথা যদি এখন তোর বাবা শুনে তাহলে যে কি হবে।”
—” আব্বুকে বলতে যাবে কেন? তাছাড়া সাধনার মুখে শুনেছি ছেলেটি মানুষ হিসেবে খুব ভালো। ভালো বিজনেস করে। আমাদের সাধনার যত্ন নেয় ওকে খুব ভালোবাসে। এখন আমাদের উচিত নয় ওর সন্তানের কথা ভেবে ওদের ভুল গুলো ক্ষমা করে দিয়ে আবার একসাথে মিলে মিশে থাকি।”
—-” তোর আব্বু কিন্তু এখন এইসব শুনলে খুব কষ্ট পাবে। ডক্টর বলেছেন বেশি টেনশন না করতে। কয়েকটা দিন যাক পরিস্থিতি ঠিক হোক পরে না হয় তুই আর আমি বুঝিয়ে বলবো উনাকে। এখন বললে পরে এতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে।”
—-” ওকে তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন চলো সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করে আড্ডা দেই।”
—” হুম চল।”
শুভ্রতার আব্বু আম্মু,শুভ্রতা ও স্পন্দন এক সাথে বসেই খাবার খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো। স্পন্দন আজ আর কোথায় যায়নি। শশুর বাড়িতে তার বেশ লাগছে। শালা শালী না থাকা সত্ত্বেও আড্ডা দিতে খুব ভালোই লাগছে স্পন্দনের। শুভ্রতার আব্বু আম্মু খুব মিশুক ও বন্ধুসুলভ মানুষ। মেয়ের জামাইকে খুব সহজেই বন্ধুত্বে রূপান্তরিত করলেন তারা।
আড্ডা শেষ করে শুভ্রতা তার রুমে এসে আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। স্পন্দন বিছানায় বসে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল…..
—-” বাসায় যাবে না?”
—-” আমার এইখানে কিছুদিন থাকতে ইচ্ছা করছে প্লিজ স্যার আমি যাবো না।”
—-” তুমি তো দেখছি আমাকে ঘর জামাই বানিয়েই ছাড়বে। কিছুদিন পর মানুষজন বলবে, ওই দেখ ঘর জামাই আসছে।”
—-” আমি এইখানে থাকার সাথে ঘর জামাই কোথা থেকে আসলো?”
—” তুমি যেখানে থাকবে আমিও তো সেখানেই থাকবো। ”
—-” আপনাকে কে থাকতে বলেছে আজব। আপনি চলে যান না আপনাদের বাড়ি। আমি কিছুদিন থেকে আবার চলে যাবো।”
শুভ্রতার কথা শুনে স্পন্দন পিছন থেকে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে গলার কাছে মুখ এনে বলল…..
—” অনেকবার বলেছি বউ ছাড়া থাকতে পারবো না।”
—” সিরিয়াসলি? আমি তো বউ পাগল লোক দেখেছি কিন্তু আপনার মত বউ পাগল লোক আমি আর একটাও দেখিনি। এত বউ পাগল হওয়া ভালো না। ধরুন হটাৎ করে যদি আমি মরে যাই তখন বউ ছাড়া থাকবেন কিভাবে?”
শুভ্রতার গালে পাঁচ আঙ্গুল বসিয়ে দিল স্পন্দন। শুভ্রতা মজার ছলে হোক আর বাস্তবতা বুঝানোর জন্যই হোক স্পন্দনের কাছে কথাটা ভালো লাগে নি। থাপ্পড় খেয়ে শুভ্রতা বলল…..
—-” এই নিয়ে দুইটা থাপ্পড় পড়লো গালে। বউ ছাড়া থাকতে পারবে না আবার বউয়ের গায়ে হাত তুলতে পারবে। এমন ভালোবাসা লাগবে না আমার।”
—-” তোমাকে কে বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি?”
—” ভালোবাসেন না তাই না?”
—-” একদম না।”
—-” ওকে তাহলে আমিও আপনার সংসার করবো না। আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবো তখন আমার অনেকগুলো আন্ডা বাচ্চা হবে তখন যদি আপনার সাথে দেখা হয় আমি আমার আন্ডা বাচ্চাদের বলবো, ওই দেখ তোদের এক্স বাবা যাচ্ছে যা কথা বল তোদের এক্স বাবার সাথে।”
আবারো পড়লো শুভ্রতার গালে আরেকটি থাপ্পড়। শুভ্রতা এইবার প্রায় কান্না করেই বলতে লাগলো……
—-” এখন কি ভুল করেছি যে থাপ্পড় মারলেন?”
—” আন্ডা বাচ্চাদের এক্স বাবা নয় বরং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাবা হবো আমি ওকে। এই রকম আজাইরা কথা আরেকবার বললে এক কথার জন্য তিনটা করে থাপ্পড় মনে থাকবে।”
শুভ্রতা ভয়ে মুখে আঙ্গুল দিয়ে মাথা হেলিয়ে বুঝা-লো সে বুঝেছে। স্পন্দন মনে মনে ডেভিল মার্কা হাসি দিলো……
—” আজ থেকে তোমার ক্লাস শুরু মিসেস শুভ্রতা। আমার পিছনে লাগা বের করছি তোমার হাহাহা। বাচ্চা মেয়ে একটা।”
চলবে……