সম্মোহনী সেই মেয়েটি পর্ব-১৮+১৯+২০

0
431

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি

“আমি অনিলাকে বিয়ে করতে চাই আংকেল!”

জুনইদের কথাটা যেনো বাজ পড়ে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ার মতো লাগলো আলিফ হোসেনের কাছে।তিনি করুনঘন দৃষ্টিতে তাকালেন জুনইদের দিকে।তার মেয়ের সঙ্গে এতো কিছু হয়ে গিয়েছে সব টা জেনেও কেন বিয়ে করতে চাইছে এই ছেলেটা।তার মেয়েকে কি দয়া করতে চাইছে নাকি।যত যাই হোক সেদিন যেটা হয়েছে সেজন্য তো আর তার মেয়ে দায়ী নয়।তাই তিনি কিছুতেই কারোর কাছেই নিজের মেয়েকে দয়ার পাত্রী হিসেবে গন্য করবেন না।একজন যোগ্য মানুষের হাতেই তিনি তার মেয়েকে তুলে দিতে চান।যে তার মেয়েকে এভাবেই ভালোবাসবে।তিনি তার সামনে থাকা যুবকের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

“তুমি আমার মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চাইছো সব টা জেনেও?যেখানে অন্যান্য ছেলেরা আমার মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা শুনেই পিছু হটে যায়।তাছাড়া আমার মেয়েটা এখনো মানসিক ভাবে সুস্থ না।দয়া করতে চাইছো তুমি আমার মেয়েকে?”

জুনইদ মাথা নত করে অবসন্ন কন্ঠে বলে,”আংকেল আমি অনিলাকে ভালোবাসি।এটা বলতে আমার কোনো রকম দ্বিধা নেই।আর ওর অবস্থা যেমনই হোক না কেন আমার জন্য ও সব সময়ই একই থাকবে।আজকে ওর জায়গায় যদি আমার বোন থাকতো তাহলে?ওর সব রকম পরিস্থিতিতে আমি সব সময় পাশে থাকতে চাই আংকেল।এর থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ!”

আলিফ হোসেন কিছুটা অবাক হলেন জুনইদের কথায়।ভেতরে ভেতরে অবসন্নও হলেন বটে।জুনইদ ছেলেটার চোখে মুখে কোনো রকম ছলনা নেই।যা আছে তা শুধুই মায়া তার মেয়ের জন্য ভালোবাসা।তিনি এরমম ই একজন কে নিজের মেয়ের জন্য খুজছিলেন।যে তার মেয়ের সত্যি টা জেনেও তার প্রতি অবহেলা করবে না।জুনইদ ছেলেটাকে তার কাছে ভীষণ বিচক্ষণ আর স্পষ্টভাষী মনে হলো।তাছাড়া এই ছেলেটা তার জীবনও বাচিয়েছে।সেই থেকে ছেলেটাকে ভালো লাগে তার কাছে।কিন্তু তাও সব টা ক্লিয়ার হয়ে যাওয়াই ভালো।তার মেয়ে যে বাড়িতে বউ হয়ে যাবে তাদেরও তো একটা মতামত এর ব্যপার আছে তাই না।

“তোমার বাবা মাকে ডেকে পাঠাও।উনারা যদি মেনে নেন তবে আমিও আপত্তি করবো না!”

জুনইদ দৃঢ়চিত্তে দৃষ্টি স্থীর করলো আলিফ হোসেনের মুখ পানে।পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন মনিরা বেগম।তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জুনইদের দিকে।জুনইদ গলায় দৃঢ়তা টেনে বলে,

“আমার ফ্যামিলিকে আমি বুঝিয়ে বলবো।আমি জানি আমার এই সিদ্ধান্ত কে আমার ফ্যামিলির সবাই মেনে নেবে।আমি এই মুহুর্তে বাড়িতে কিছুই বলতে চাচ্ছি না কারণ আমি এখন কিছু বললে ওরা হিতে বিপরীত বুঝবে।আমি অনিলাকে নিয়ে গেলে তারা আর অস্বীকার করবে না এটা আমার বিশ্বাস।তাই আজই আমি অনিলা কে নিয়েই ফিরবো।অনিলাকে ছাড়া আমি এখান থেকে এক পা ও নড়বো না আংকেল।আমি আমার জীবনের সবচেয়ে অমুল্য জিনিস কে হারাতে পারবো না কোনো ভাবেই না!”

আলিফ হোসেন এবারে কিছুটা আক্ষেপের সহিত বলেন,”আমি নিশ্চিত না হয়ে তো আর তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারি না বলো।বিয়ের পর যদি কোনো ভাবে তোমার পরিবারের কেউ মেনে না নেই তার দায় কে নেবে?অনেকেই বলবে আমরা আমাদের মেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি।আমাদের মেয়েকে তো আর আমরা ফেলে দিই নি।ও যেমন আগে আমাদের কাছে ছিলো ঠিক তেমনই সারা জীবন আমাদের কাছেই রাখবো।তাও কারোর কাছে বোঝা হিসেবে থাকুক আমার মেয়ে সেটা আমি চাইবো না।”

জুনইদ এবার তেছড়া এক রোখা ভাবে বলে,
“আচ্ছা আংকেল আজ যদি আন্টির কিছু হয়ে যায় তাহলে কি আপনি আন্টিকে ছেড়ে দেবেন?”

এহেন প্রশ্নে আলিফ হোসেন বেশ বিচলিত হলেন।তিনি বুঝলেন সামনের যুবকটি কোনো ভাবেই তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে না।বড্ড এক গুয়ে আর জেদি ছেলেটা।ওর কথার ধাচ এমন যে ওর সঙ্গে কথায় পেরে উঠলেন না আলিফ হোসেন। তিনি অনুদ্ধত কন্ঠে বললেন,

“আমার মেয়ে যে মানসিক ভাবেও সুস্থ নয়।মেন্টালি,ফিজিক্যালি সিক,সব টা জেনেও তুমি বিয়েটা করবেই তাই তো।তাহলে আমার মেয়ের ভালো থকার নিশ্চয়তা দিতে পারবে তুমি?তাকে কখনোই কষ্ট পেতে হবে না তোমার কাছে এটার কি গ্যারান্টি আছে?এসব কথা তুমি আবেগের বসে বলছো পরে আবার আফসোস করবে না তো?”

জুনইদ এবার নৈশব্দে হাসলো।সে তো হাল ছাড়ার পাত্র নয়।ওঁকে যে আলিফ হোসেন নানান ভাবে প্রশ্ন করে পরীক্ষা করতে চাইছে সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে।তাই এবারো সে খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিলো,

“আপনার কথায় নেতিবাচক দিক আছে কারণ আপনি অনিলার বাবা আপনি আপনার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু আমরা আমাদের আবেগ,অনুভূতি তথা আক্ষেপ,আফসোস,হতাশা,দুঃখ,বেদনা,আনন্দ,বিশেষ অনুভূতির গুলো প্রকাশ করতে প্রায়ই অক্ষম।তাই আমরা আমাদের এসব তিক্ত কিছু অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না সহজেই।কিন্তু যারা প্রকাশ করতে পারে তারাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি সুখী।আবেগ,অনুভূতি,আক্ষেপ,আফসোস,হতাশা,দুঃখ,বেদনা,আনন্দ,এসব কিছুকে নিয়েই কিন্তু আমাদের সকলের জীবন।আমি অনিলাকে এসব কিছু নিয়েই মেনে নিয়ে বেচে থাকবো সারাটা জীবন।আমি আপনার কাছে অনিলাকে ভিক্ষে চাইছি আংকেল ওঁকে ছাড়া আমার এক মুহুর্ত ও চলবে না প্লিজ আংকেল!”

মনিরা বেগম এতক্ষণ নিরব দর্শকের ন্যায় সব কথোপকথন শুনছিলেন।জুনইদ যে নাছোড়বান্দা তা তিনিও বুঝলেন।এরকম ছেলে তো কখনোই পাবেন না তার মেয়ের জন্য।তিনি বললেন,

“ছেলেটা যখন এতবার করে বলছে ওঁকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া টা কি ঠিক হবে।আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন!”

স্ত্রীর কথা শুনে আলিফ হোসেন আর কিছু বললেন না।জুনইদকে তিনি এই এক মাসের মধ্যে খুব ভালো করেই বুঝেছেন।আর আজ এই ছেলেটা যখন বলেছে তখন অনিলাকে নিয়েই যাবে।তিনি এরকম ছেলে এর আগে কক্ষনো দেখেন নি।এরকম জেদি আর স্পষ্টভাষী ছেলে খুবই কম দেখেছেন তিনি।ওর কথায় যে কতটা জোর আছে তা তিনি টের পেয়েছেন।এরপর উনার আর অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই।তিনি নিরবে ড্রইংরুমে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলেন।ফোন করে কাজীকে ডাকলেন।

জুনইদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।তৃপ্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে এলো।চোখের তৃষ্ণায় ধুঁকছে সে একটি বার প্রেয়সীকে চোখের দেখা দেখবে বলে।আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা মাত্র।গত এক মাসে জুনইদ কম চেষ্টা করে নি একটি বার অনিলাকে দেখার জন্য। লাষ্ট হসপিটালের সাদা ধবধবে বিছানায় তার নিথর শরীর টা পরে থাকতে দেখেছিলো।মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকাই পুরো মুখ টাও স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারেনি।রোজ এই বাড়ির সামনে এসে থেকেছে কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে দেইনি কোনো ভাবেই।আজ এক প্রকার যুদ্ধ করেই বাড়িতে ঢুকেছে।এসেই মুখোমুখি হতে হয়েছে আলিফ হোসেনের।এতো দিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি তার।তার মনের মধ্যে কি চলছে এক মাত্র সেই ই জানে।সম্মোহনী সেই মেয়েটিকে দেখার সাধ,তৃষ্ণা যে কোনো দিন ই যাবেনা।উম্মাদের মতো সারা বাড়িতে তার দৃষ্টি শুধু মাত্র একজনকেই খুজে যাচ্ছে।


প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হলে জুনইদ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনিলাকে নিয়ে আসা হলো।এর মধ্যে কাজীও চলে এসেছে। আইন মোতাবেক ও বিয়ে টা সারা হবে।

অনিলা কে আনতেই জুনইদ তাকালো তার দিকে।অনিলাকে দেখতেই বুকের বা পাশ টা শুন্য হয়ে গেলো তার।সেই সম্মোহনী মেয়েটির একি অবস্থা হয়েছে আজ।লম্বা চুলের দুটি বিনুনি দুই পাশে ঝুলছে।পরনে টপস স্কার্ট।গলায় আটসাট করে একটা উড়না জড়ানো।ক্ষনে ক্ষনে হাতের নখ গুলো মুখে নিয়ে দাতে কাটছে।এই কি সেই অনিলা যাকে সে ফার্স্ট ডে দেখেছিলো।এরকম চঞ্চল মেয়েকে এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখবে সে তো কল্পনার বাইরে ছিলো।কি রকম বাচ্চাদের মতো করছে মেয়েটা। দেখেই মনে হচ্ছে ভয়াক্রান্ত মুখ।বহুক্ষণ শক্ত, কঠিন থাকার এক পর্যায়ে দেহের অন্তঃস্থল হতেই নরম হয়ে এসেছে বহির্ভাগ তার প্রেয়সীর মুখ দেখেই।সেই অশুভ দিনের সেই অসময়ের আগমনী তিক্তক কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে আজ এই হাল মেয়েটির।জুনইদ তার ভালোবাসার মানুষ টাকে এমন অবস্থায় দেখে চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো তার অজান্তেই।

মনিরা বেগম অনিলা দুই বাহু বন্ধনে সুন্দর করে ধরে এগিয়ে আনছেন।অনিলা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে আসছে ছোট ছোট পা ফেলে।অনিলা কে এনে বসিয়ে দিলেন মনিরা বেগম।তিনিও পাশেই বসলেন।জুনইদ ধপ করে বসে পরলো সোফায়।অতঃপর বিয়ে পরানো শুরু করলেন।

জুনইদ কবুল বলে দেওয়ার পর অনিলার পালা।কিন্তু অনিলা তো তেমন কথাই বলে না।
কাজী সাহেব বার বার কবুল বলতে বললেন কিন্তু অনিলা নিজের মতো নখ কাটতে ব্যস্ত।তার তো কোনো দিকেই খেয়াল নেই।একমাত্র মায়ের কথা শুনে সে শুধু।মনিরা বেগম জুনইদ সহ বাকিদের কে আস্বস্ত করলেন চোখের ইশারায়।আর বললেন,

“মা অনি কবুল বলো মা! এই যে আংকেল দেখছো ইনি খুবই ভালো মানুষ।একদম তোমার বাবার মতো! আংকেল এর কথা শুনতে হয় তুমি তো আমার লক্ষী মেয়ে তাই না”

অনিলা মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো।তার মা কি বলছে!তারপর তার মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে শুধালো,

“কবুল কি আম্মু?বললে কি হয়?”

জুনইদ অবাক পানে তাকিয়ে রইলো অনিলার দিকে।যদি অনিলা কবুল না বলে তবে কি সে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবে মেয়েটাকে।ভয় হচ্ছে তার খুব ভয় হচ্ছে,প্রানেশ্বরীকে হারানোর ভয়।বিয়ে ছাড়া যে তাকে সে রাখতে পারবে না নিজের কাছে।তাতে সমাজের চোখে অনিলার সম্মানহানী হবে।আলিফ হোসেন এক বার জুনইদ আর আরেকবার নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন।কাজী সাহেব অধৈর্য্য হলেন।তিনি তাড়া দিলেন।

মনিরা বেগম অনিলার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

“কবুল হলো একটা পবিত্র শব্দ।এই একটি শব্দের মাধ্যমে সারাজীবনের মতো দুটো মানুষের মনের মিল হয়।একটা পবিত্র বন্ধন তৈরি হয় এই একটি শব্দের মাধ্যমে।এই যে ছেলেটাকে দেখছো ও হবে তোমার স্বামী।তুমি কবুল বললেই তোমাদের বিয়ে হবে বুঝেছো!তাই কবুল বলো মা!”

অনিলা মায়ের কথায় জুনইদের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টি স্থাপন করে।নিজের কোমল নিষ্প্রাণ ঠোঁট গুলো উলটে কিছু ভেবে ভ্রু কুচকে বলে,

“ওঁকে,ওঁকে তো আমি চিনি!কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পরছে না জানো?কেন মনে পরছে না আম্মু।আম্মু ও কি ভালো লোক নাকি পঁচা লোক!”

মনিরা বেগম বললেন,”ও খুব ভালো লোক।এবার কবুল বলো মা।আংকেল টা চলে যাবেন তো!”

অনিলা মোলায়েম হেসে হাত তালি দিতে দিতে কবুল বললো।তারপর সাইন করলো জুনইদ আর অনিলাও সাইন করলো।সে তো সারাদিন ই খাতায় কি যেনো আঁকিবুকি করতেই থাকে।তার নাম লিখতে বললে সে এখানে কোনো বাধ সাধে নি।লিখতে তো তার ভালোই লাগে।

বিয়ে শেষ হতেই উপস্থিত সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললেন।আলিফ হোসেন নিশ্চিন্ত হলেন মেয়েকে যোগ্য মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরে।

জুনইদের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো।এটা ভেবে যে অনিলার তাকে একটু হলেও মনে আছে।এবার আর কেউ তাদের কে আলাদা করতে পারবে না।যেভাবেই হোক সে তার অনিলাকে, না না তার মিসেস সুনামি কে আগের মতো সুস্থ করেই তুলবে।যেকোনো ভাবে সেই চাঞ্চল্যতাকে হারাতে দেবে না এভাবে।সেই আগের অনিলাকে এক অসহায় মা বাবাকে ফিরিয়ে দেবে।

অনিলাকে ওর ঘরে নিয়ে গেলে জুনইদ ও পিছু পিছু গেলো।সে শুধু ভালো করে তার পাগলি বউ টাকে দেখবে বলে।

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি

মেদুর আকাশে নেই আজ নক্ষত্রের মেলা। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে শুক্লপক্ষের পূর্ণ চাঁদটি৷ আবছা অবয়ব দৃশ্যমান। প্রকৃতির বুকে ফাল্গুনী বাহারে-চাঞ্চল্য শেষে চলছে চৈতালি উন্মত্ততা। নিশাচর জীব-জন্তুর হাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে।ঘড়ির কাঁটা চলছে দশের ঘরে।জুনইদ অনিলার নিকট আসতে চাইছে।কিন্তু কোনো কিছু নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে সে।যদি অনিলা তাকে ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়।রাত বাড়লে মেয়েটার নাকি ভয় বাড়ে।হাত পা কম্পন তুলে জ্বর উঠে।রাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে থাকে।চিৎকার চেচামেচি করে।সে সময় অনিলাকে মিসেস মনিরা ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না।সে কি পারবে সামলাতে অনিলাকে।অনিলা নিষ্পাপ বাচ্চাদের ন্যায় বসে বসে আপন মনে ট্যাডি বিয়ার নিয়ে খেলছে।ডিম লাইটের লালচে ধুসর আলোয় মেয়েটির মুখ টি আরও স্নিগ্ধ আরও সম্মোহনী লাগছে।অথচ দীর্ঘ দুই মাস থেকে মেয়েটার মধ্যে দুনিয়ার ধ্যান ধারণা নেই।সেদিনের তিক্ত অনুভূতির কথা মনে পরলেই মেয়েটি ঘাবড়ে যায়, চেচামেচি করে,ভীরু রুপি হয়ে যায়।
সে জানে অনিলাকে ফিজিশিয়ান দের কাছেও রাখা হয়েছিলো।এস্যাইলামে নাকি অনিলার আচরণ আরও অস্বাভাবিক হয়ে উঠে।মনিরার ওদের চিকিৎসা পছন্দ হয়নি তাই নিজের কাছে এনেছেন।এভাবেই সুস্থ করার চেষ্টা করছিলেন তিনি।তাই জুনইদ প্রথম এক মাস অনিলার কোনো রকম খবর চেষ্টা করেও পাইনি।পরে যখন জানতে পারে অনিলা বাড়িতে তখন থেকেই উঠে পরে লেগেছিল অনিলাকে দেখার জন্য।আচ্ছা সে কি পারবে তার ভালোবাসার পরশ পাথর দিয়ে নতুন করে মেয়েটিকে রাঙিয়ে দিতে।জুনইদ ঘরের লাইট জ্বালালো।আলো জ্বলতে দেখেও অনিলার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না।জুনইদ কন্ঠে খাদ টেনে মোলায়েম গলায় ডাকলো অনিলাকে,

“মিস সুনামি?এদিকে দেখো একবার?

পুরুষালি কন্ঠ শুনে অনিলা চট করে মাথা তুলে চাইলো জুনইদের দিকে।ফ্যাল ফ্যাল করে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জুনইদের দিকে।তাকে ছেলেটা এমন করে দেখছে কেন।কি চাই সে।তখন তার আম্মু বলেছিলো ছেলেটা তার স্বামী হবে কবুল বললে।স্বামী কি?নিজেই নিজেকে মনে জিজ্ঞেস করলো।এর উত্তর সে জানে না।কিন্তু তার এই স্বামী টা এখানে কেন।এই সময় তো তার মা থাকে তার সাথে।সে রিনরিনে গলায় শুধালো,

“এই স্বামীটা তুমি এখানে কি করছো?আমার আম্মু কই?”

জুনইদ অনিলার কথা শুনে চোখের পলক ঝাপটালো।ঠোঁটের কোণে একটু খানি হাসি দেখা দিলো মুহুর্তের।জুনইদ নিজেকে ধাতস্থ করে অনিলার কাছে গিয়ে বিছানায় ওর পাশে বসলো।অনিলা হকচকিয়ে একটু দুরে সরলো।হাতের ট্যাডি টাকে শক্ত করে চেপে ধরলো।ভ্রু কুচকে ভীত হয়ে তাকিয়ে রইলো জুনদের দিকে।জুনইদ বুঝতে পারলো অনিলা তাকে ভয় পেয়ে সরে গেলো।জুনইদ অনিলাকে শান্ত করার জন্য বলে,

“ভয় পেয়ো না!আমি তো তোমার বন্ধু।তাই আমি আজ থেকে তোমার সাথেই থাকবো।আর আম্মুর তো শরীর টা ভালো নেই।উনাকে তো রেস্ট কর‍তে হবে তাই না?”

অনিলা একটু স্বাভাবিক হলো।তারপরে ফোলা ফোলা ঠোঁট গুলো উলটে কাদো কাদো হয়ে বলে, কিন্তু আমি আম্মুকে ছাড়া একদম থাকতে পারি না।দুষ্টু লোক আসে যে!”

জুনইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেভানো গলায় বললো ,”আমি থাকতে কোনো খারাপ লোক তোমার কাছে আসবে না।আমি তো তোমার খুব ভালো বন্ধু।আর বন্ধুকে ভয় পেতে নেই।তুমি ভরসা করতে পারো আমাকে।আজ থেকে আম্মুর ছুটি।আমি তোমার দেখাশোনা করবো ঠিক আছে।”

অনিলা বায়না করে বললো, “না না আমি আম্মুর কাছেই থাকবো।তোর কাছে থাকবো না যাহ”বের হো এখান থেকে!”

জুনইদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।কি সাংঘাতিক।আগে আপনি বলতো।কিছুক্ষন আগে তুমি বলেছে,তুমি না হয় ঠিক আছে কিন্তু এখন সরাসরি তুই বলছে।মন টা খারাপ হয়ে গেলো ওর।রাত হয়েছে বিধায় সে তার বাড়িতে যায়নি।শশুড় বাড়িতেই রয়েছে। বাড়িতে জানিয়েছে সে একটা কাজে আটকে গেছে আজ ফিরবে না।বাড়িতে এখনো কিছুই জানে না।কাল একেবারে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে।কিন্তু অনিলার যা অবস্থা দেখছে সে মেয়েটা কি তার সাথে যেতে চাইবে।না অনিলাকে ভালো করে বোঝাতে হবে যে সে তার খারাপ চাই না।অনিলা এখন একটু ভয় কম পাচ্ছে বলে ভালো করে বসলো।জুনইদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“আচ্ছা তুমি কি চাও আম্মুর শরীর খারাপ হোক?না তো?”

বার কয়েক ঘন ঘন পাপড়ি ঝাপটা দিলো অনিলা।তার স্বামী টাকে তো ভালো লাগছে খুব দেখতে।বেশ সুন্দর তো।তাছাড়া তার মা বলেছে তার স্বামী টা খুব ভালো লোক।বাজে লোক নয়।তাই সে বলে উঠলো,”না আমি চাই না তো আম্মুর শরীর খারাপ হোক! ঠিক আছে তুই ই থাকবি আমার সঙ্গে।তাহলে আগে বল তুই আমাকে আম্মুর মতো করে আদর করে ঘুম পারিয়ে দিবি?”

জুনইদ নিঃশব্দে হাসলো,বললো,”হ্যাঁ ঘুম পারিয়ে দেবো আমি!”

অনিলার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে আয়েশ করে শুয়ে পরলো।জুনইদ গিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো।টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে রাখবে।অনেক অন্ধকারে অনিলা ভয় পেয়ে যায়। আর আলোতেও থাকতে পারে না বেশি।

জুনইদ দুরত্ব বজায় রেখে খাটের এক পাশে আধশোয়া হয়ে আস্তে আস্তে অনিলার মাথায় হাত রাখলো।অনিলা একটু কেপে উঠলো। ভয় পেয়ে নয়।এই স্পর্শে বাজে ইঙ্গিত নেই।ঠিক তার মা যেমন টা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই সেভাবেই জুনইদ ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আর ফিচেল গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কাল তুমি আমার সঙ্গে যাবে অনিলা?”

অনিলার চোখ বন্ধ ছিলো।সে জুনইদ এর কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকালো,

“কোথায় যাবো?ঘুরতে?”

জুনইদ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় তাকালো ওর দিকে,”আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে?সেখান গিয়ে ঘুরতে যাবো।যাবে আমার সঙ্গে? ”
অনিলা একটু ভাবলো কি যেনো।তারপর জুনইদ কে জিজ্ঞেস করলো,”তোর বাড়িতে বাজে লোক নেই তো? আমার না খুব ভয় করে।মাকে ছাড়া তো থাকতে পারি না আমি!”

জুনইদ হেসে ফেললো।অনিলা এখনো তুই ই বলছে এটা ভেবে।আজকে যদি মেয়েটা স্বাভাবিক থাকতো তাহলে হইতো আজকের রাত টা অন্য রকম হতো।জুনইদ বাসর ঘরে ঢুকতো।অনিলা লজ্জায় ইয়া লম্বা একটা ঘোমটা টেনে বসে থাকতো।তার কথায় বার বার লজ্জায় আবিষ্ট হতো।আর সে মুগ্ধ হয়ে সেই লজ্জামাখা সম্মোহনী মুখো পানে তাকিয়ে থাকতো।কতই না মধুর হতো সময় টা।হঠাৎ হাতে ব্যথা অনুভব হতেই ঘোর কাটলো জুনইদের।মৃদু আওয়াজে বললো,”আউচ!”

জুনইদ চুপ করে আছে দেখে অনিলো ওর হাতে জোরে চিমটি দিয়েছে।তারপর মিহি আওয়াজে বললো,

“এই স্বামী টা কিছু বলছিস না কেন?তোর বাড়িতে সবাই তোর মতোই ভালো তো?”

“হ্যাঁ সব্বাই খুব ভালো।তোমাকে সবাই আদর করবে খুব!ভালোবাসবে সবাই।এবার আর কথা নয়।ঘুমাও তো লক্ষীটি হয়ে।”

অনিলা বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বুঝলো ঘুমানোর জন্য।জুনইদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।কান্না পাচ্ছে তার আজকে।ভীষণ ভাবে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।কেন সেদিন সে ঠিক মতো পৌঁছতে পারে নি।কেন?এই দুই হাতে সে অনিলার ফিনফিনে রক্তাক্ত শরীর টা তুলেছিলো।আরেকটু আগে গেলে হইতো সেদিন সে অনিলা কে ওই জানুয়ার টার হাত থেকে রক্ষা করতে পারতো।অনিলা গালে দুই হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে।কতই না নিষ্পাপ সেই মুখশ্রী।জুনইদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।এই সৌন্দর্যের প্রশংসা করার মতো যোগ্য শব্দ ভান্ডার তার ভাষায় মজুদ হয়নি।এই মেয়েটিকে সে যখন যেভাবে দেখেছে সেভাবে যেনো তার সম্মোহনীর মায়ায় জড়িয়ে পরে।মুখে এখনো কিছু কিছু তিক্তক দাগ রয়েছে যেটা ওই জানুয়াড়ের দেওয়া।তাও মেয়েটির দাগময় মুখেও অজস্র শুখন মায়া দেখতে পাচ্ছে।অনিলাকে দেখতে দেখতে সে ও ঘুমিয়ে গেলো।

মাঝরাতে ছটফটিয়ে উঠলো অনিলা।সে ঘুম থেকে উঠেই চেচাতো শুরু করলো।দপদপ দপদপানি বাড়ছে।ছটফট করছে।ভয়ে অনবরত কাপছে সে।ওর চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে জুনইদ।জুনইদ ওঁকে ধরতে গেলে অনিলা জুনইদ কে দেখেই ধাক্কা দিলো শরীরের সব শক্তি দিয়ে।অদ্ভুত ভাবে চোখ গুলো লাল টকটকে হয়ে আছে ওর।জুনইদ সেই দৃষ্টিতে ভয় পেলো।বিচলিত হয়ে অনিলার দিকে এগোতে নিলেই অনিলা আরও ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে।খাটে থেকে নেমে গুটিয়ে নেই নিজেকে।জুনইদ ও নামে অনিলার দিকে এগিয়ে যায় একটু।অনিলা পাগলের মতো প্রলাপ করতে থাকে।নিজেকে আরও গুটিয়ে নিতে নিতে বলছে,

“আসবি না,কাছে আসবি না।একদম আসবি না।আমাকে মারবি তুই তাই না।দূরে যাহ।আমাকে বাচাও, বাচাও।ও আমাকে মারতে আসছে।আমাকে যন্ত্রণা দিতে এসেছে ও।আমি মরে যাচ্ছি।বাচাও না কেউ।আমাকে বাচাও না।ওই তো আসছে।ও আসছে আমাকে মারবে ও।”

জুনইদ হতভম্ব হয়ে গেলো।পা স্থির হয়ে থেমে গেলো।হতবুদ্ধিকর ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না অনিলার এমন আচরণে।অনিলা কি তাকে ভয় পাচ্ছে।ততক্ষণে মনিরা আর আলিফ হোসেন ছুটে এসেছে।দরজা খোলা থাকায় উনারা ভেতরে চলে এলেন।মনিরা বেগম মেয়ের দিকে এগোতে নিলেন অস্থির হয়ে।আলিফ হোসেন তীক্ষ্ণ কিন্তু শীতল ভাবে তাকিয়ে রইলেন জুনইদের দিকে।জুনইদ হাত উচিয়ে বাধা দিলো মনিরা বেগম কে।অনিলার দিকে যেতে না করলো সে।জুনইদ মনিরা বেগম কে জুনইদ শান্ত ভাবে অভয় দিয়ে বলে,

“আন্টি আজকের পর থেকে তো আমাকেই সামলাতে হবে অনিলাকে।প্লিজ আমাকে সামলে নিতে দিন।আমি দেখছি ব্যাপার টা।ভরসা করুন আমাকে প্লিজ!”

মনিরা বেগম শান্ত হলেন।আলিফ হোসেন ও আর কিছুই বললেন না।তার কেমন যেনো কষ্ট হয়।রোজ সে এই ছেলেটাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিতেন।তারপরেও ছেলেটা নেওয়াটা কুকুরের মতো পরে থাকতো এই বাড়ির আশেপাশেই।সেই অবমাননা থেকেই জুনইদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না তিনি।এটা কি লজ্জা থেকে নাকি অপরাধ বোধ থেকে বুঝলেন না।তিনি মনিরা বেগম কে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।জুনইদ আলো জ্বালিয়ে দিলো।অনিলা এখনো অনবরত থরথর করে কাপছে।জুবুথুবু হয়ে মেঝের এক কোণায় নিজেকে অনিষ্ট ক্ষেপনশীল ভাবে দুই হাতে আঁকড়ে আছে।জুনইদ এগিয়ে এসে শান্ত শীতল কণ্ঠে বললো,

“আমায় ভয় পাচ্ছো কেন?আমি না তোমার বন্ধু হয়!”

অনিলা চোখ তুলে তাকায় কন্ঠের অধিকারীর দিকে।হাপড়ের মতো উঠানামা করছে তার বুক।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।চোখে বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।চারিদিকে ভালো করে দেখে এটুকু বুঝে এটা তার ঘর।বার বার চোখে জলের রাশিরা খেলা করছে।এক্ষুনি বাধ ভাঙা নদীর মতো উপচে পড়বে বলে।জুনইদ অনিলাকে যথাক্রমে শান্ত করার জন্য অস্থিরতার সহিতে এক শ্বাসে বলে,

“ভালো করে তাকাও আমার দিকে।শান্ত হও দেখো কিছু নেই।কেউ আসে নি।খাটে এসে বসো।কিচ্ছু হবে না।ভয় পেও না আমি আছি তো।কেউ তোমাকে মারবে না।কেউ যন্ত্রণা দেবে না।আমি থাকতে কিচ্ছু হবে না।কেউ ছুতে পারবে না।”

অনিলাকে অনেক চেষ্টার পর জুনইদ শান্ত করতে পারলো।অনিলা গুটি গুটি পায়ে বিছানায় উঠে বসলো।জুনইদ ঝটপট উঠলো।পানি এনে অনিলার মুখের সামনে ধরলো।অনিলা পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।অনিলা চোখ বন্ধ করে জুনইদ কে আঁকড়ে ধরলো।যেমন করে সে তার মাকে জাপটে ধরে।জুনইদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আগলে নিয়ে ধীর গলায় বলে,

“আমি থাকতে আর কোনো বিপদ তোমাকে ছুতে পারবে না!আমি আছি তো লক্ষীটি!”অনিলা যেনো ভরসার একটা জায়গা পেয়ে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে জুনইদ কে।এমন মনে হচ্ছে যেন ছেড়ে দিলেই ছুটে পালিয়ে যাবে আঁকড়ে ধরা মানুষ টা।

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ২০
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

“শেষে কিনা এরকম একটা আধ পাগলি,ধর্ষিতা মেয়েকে এই বাড়ির বউ করে আনলি?লজ্জা করলো না তোর?”

“না মা লজ্জা করলো না।কারণ তুমি যাকে পাগলি, ধর্ষিতা বলছো তাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসি।তাকে ছাড়া আমার একটা মুহুর্ত ও চলবে না।আমি অচল এই পাগলি মেয়েটাকে ছাড়া!”

শান্তা বেগম ক্ষোভের সহিত অনিলার দিকে তাকালেন।মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই পারলে ভষ্ম করে দেবে।অনিলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনেক কষ্টে এই বাড়িতে এনেছে জুনইদ।এই মুহুর্তে জুনইদ এর কাকা,বাবা,দু’জন অফিসে আছেন।নিশা আর শান্তা বেগম ছাড়া বাড়িতে এখন কেউই নেই।নিশা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে জুনইদ আর অনিলার দিকে।পরানের বান্ধুবীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে কয়েকবার।কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করতে পারে নি সে জুনইদের বোন বলেই।আর ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে অনিলা তাই ঠিক করে মনে নেই নিশাকে।নিশা তার ভাইয়ের এই কাজে খুশি হলেও শান্তা বেগম পারছেন না মেনে নিতে।তার হীরের টুকরা ছেলে।গায়ের রঙ টাই তো শুধু শ্যামলা।নইলে তার ছেলের খাড়া নাক,সরু পাতলা ঠোঁট, বড় বড় চোখ,ভ্রু যুগল কতই না সুন্দর।বলতে গেলে একদম সুপুরুষ তার ছেলে অথচ শেষে কিনা তার ছেলে এরকম একটা মেয়েকে ঘরের বউ করলো।এটা তিনি মানতে পারছেন না।সমাজ কি বলবে।আশেপাশের মানুষ এসে তাদের কে কটু কথা শুনাতে ভুলবে না।এতো কুতশা এই তিনি সহ্য করতে পারবেন না।

অনিলা শান্তা বেগমের এমন তেজি আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভয় পেয়ে জুনইদের হাত খামচে ধরে আছে।ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো সে শান্তার দিকে।তার স্বামীটা তো বলেছে তার বাড়ির সবাই অনেক ভালো। তাহলে এই আন্টিটা কেন এভাবে দেখছে তাকে।সে যে ভয় পাচ্ছে তাকে দেখে।অনিলা ফোপাঁতে থাকলো ঠোঁট উলটে।অনিলার ফোপাঁনো শুনে জুনইদ অস্থির হয়ে গেলো।সে অনিলাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।সে অনিলাকে আঁকড়ে ধরে বলে,

“মা আমি অনিলাকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি আর কোনো কথা হবে না।আমার যা বলার বলে দিয়েছি।অনিলাকে ছাড়া আমার থাকা সম্ভব নয়।আর তোমাদের যদি আমার স্ত্রী কে নিয়ে এতটাই অসুবিধে হয় তবে বলে দিও আমি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।আর হ্যাঁ এখন আমি রুমে যাচ্ছি ওঁকে নিয়ে।কাকা,বাবা যদি না মেনে নেন তবে সত্যিই আমি এই বাড়ির চৌকাঠ মাড়াবো না।এক কাপড়ে বেরিয়ে যাবো এই বাড়ি থেকে!”

জুনইদ অনিলাকে সন্তর্পনে অনিলার দুই কাধে হাত রেখে আস্তে আস্তে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।

শান্তা স্তব্ধ হয়ে গেলো ছেলের কথায়।এটা তিনি কাকে দেখছেন।যে ছেলে টা কোনো সময় তার মুখের উপর কথা পর্যন্ত বলে নি আজ অব্দি।এখন কিনা এই মেয়েটার জন্য তাকে এভাবে কথা শুনালো।শান্তা ছেলের যাওয়ার পানে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন।
নিশা নিরবে সব টা শুনেও কিছু বললো না।তার ভাইয়ের এই সিদ্ধান্ত কে সে সম্পুর্ন সমর্থন করে।

“দেখলি নিশা তোর ভাইকে কেমন বস করেছে এই মেয়েটা।আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে এই পাগলি মেয়েকে আর নিজেদের বোঝা হালকা করেছে।আর আমার ছেলে টা এই মেয়ের জন্য আমাকে কথা শুনিয়ে চলে গেলো কিভাবে দেখলি তুই?”

নিশা ওর মায়ের কথা শুনে বলে, “মা তুমি এরকম ছিলে না।অনিলা যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলো প্রথম বার তখন তো তুমি ওঁকে খুব পছন্দ করতে আর এখন একটা এক্সিডেন্ট ওর জীবনে ঘটেছে বলে তুমি এভাবে বলছো যেখানে অনিলার কোনো দোষ ই নেই।ছিঃ মা!”

শান্তা কাদতে কাদতে বললেন,”হ্যাঁ এখন তো তুই ও কথা শুনাবি।আমি তো তোদের খারাপ চাই। মা হয়ে ছেলের জন্য ভালো মেয়ে চাওয়াটা তো আমার ভুল।তাছাড়া পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে আমাদের কে জানিস তুই?”

নিশা শান্ত ভঙ্গিমায় মায়ের দিকে তাকালো, “কে কি বললো তার পরোয়া আমরা করিনা।তাছাড়া যে ঘটনা টা অনিলার সাথে ঘটেছে আজ যদি তোমার মেয়ে সেই জায়গায় থাকতো তাহলেও কি তুমি এই একি ভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে?আমাদের জীবন টা খুব ছোট। এই ছোট জীবনে আমাদের চলার পথে অনেক ঘটনায় ঘটবে।যে ভালো তার সাথে যে শুধুই ভালো হবে তা কিন্তু ঠিক নয়, উচিত ও নয়!ভালো খারাপ মিলিয়েই জীবন। তাই বলে সেই খারাপ কে পাত্তা দিয়ে ভালো মুহুর্ত কে নষ্ট করতে হবে তা কিন্তু নয় মা।খারাপ কে পাশে রেখেই ভালো মুহুর্ত কে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবা মা।দেখবে সব কিছু ভালো হবে।পাড়া প্রতিবেশির কথায় কি যায় আসে!”

শান্তা বেগম নিশার কথা শুনে কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে।চোখের পানি মুছে নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন।জ্ঞান দিচ্ছে এখন তাকে তার ছেলে মেয়েরা।

নিশা জানে তার মা এখন রাগ দেখিয়েছে ঠিকই কিন্তু পরে আবার সব টা ঠিক ও হয়ে যাবে।আগের মতোই অনিলাকে মেনেও নেবে।তবে একটু সময়ের অপেক্ষা।তার মায়ের রাগ টা বেশিক্ষন স্থায়ী থাকে না।নিশা ভীষণ খুশি হয়েছে তার ভাইয়ের প্রতি।সে গর্ব করে তার ভাইকে নিয়ে।ঠিক কতটা ভালোবাসলে মানুষ এভাবে একজন কে আগলে রাখতে পারে।সে দেখেছে তার ভাইয়ের অনিলার জন্য কিভাবে ছটফট করেছে প্রতিটি মুহুর্ত।সে গর্বিত তার এরকম একটা ভাই আছে ভেবেই।সবার ঘরে ঘরে যেনো এমন ভাই হয়।

অনিলাকে ঘরে নিয়ে যেতেই অনিলা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।জুনইদ জানে সে কোনো দিন ও তার এই প্রিয় জিনিস টাকে ভুলবে না।তাই হলো। অনিলা স্ট্রুয়ার্ট কে দেখেই ছুটে এলো স্ট্রুয়ার্ট এর কাছে।একবার জুনইদের দিকে একবার খাচায় থাকা স্ট্রুয়ার্ট এর দিকে তাকালো। খাচার ভেতর থেকে স্ট্রুয়ার্ট কে বের করে বলে,”তুই কোথায় হাড়িয়ে গেছিলি স্ট্রুয়ার্ট। আমি তোকে কত্তো মিস করেছি জানিস।এই স্বামী টা এখানে না আনলে তো তোকে পেতাম ই না কখনোই।টুকুর টুকুর করে চেয়ে রইলো স্ট্রুয়ার্ট। অনিলা চোখের পানি ফেলছে স্ট্রুয়ার্ট কে জড়িয়ে ধরে।

জুনইদ দেয়ালে হেলান দিয়ে বুকে দুই হাত ভাজ করে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো অনিলার দিকে।স্ট্রুয়ার্ট ও অনিলাকে দেখেই, অনি, অনি বলে ডেকে উঠলো।অনিলা ঠিক কতটা খুশি হয়েছে তা জুনইদ ওর মুখ দেখেই বুঝেছে।এটাই তো সে চেয়েছিলো অনিলা খুশি হোক।একটু পর নিশা আসলো ঘরে।অদ্ভুত ভাবে নিশাকেও অনিলা কিছুক্ষনের মধ্যেই চিনে ফেলে।কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ করেনি।অনিলাকে নিশা জড়িয়ে ধরে আদর করলো বাচ্চাদের মতো করে।কান্না করে দিলো নিশা।প্রিয় বান্ধুবির এই অবস্থা সে যে মানতে পারেনি।আর দুটো মাস তারপর ই তাদের সামনে এক্সাম।অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল সেমিস্টারে এক্সাম।এভাবে যদি চলে তবে যে অনিলা পরীক্ষায় বসতেই পারবে না।কিছুক্ষন পর নিশা চলে গেলো।জুনইদ অনিলা কে ঘুমিয়ে পরতে বললো।পাশে বসে থেকে ঘুম পারিয়ে দিলো সে।

রাতে আলতাফ আহমেদ আর রমিজ আহমেদ বাসায় এসে সব টা শুনে কোনো রকম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান নি।তারা মেনে নিয়েছেন।আস্তে আস্তে শান্তাও মেনে নিয়েছেন।তার ছেলের সুখই সব তার কাছে।সে যায় হোক অনিলার সঙ্গে এখনো অব্দি ভালো করে কথা বলেন নি তিনি তবে খারাপ ব্যবহার ও করেন নি।জুনইদ বিষয় টা লক্ষ করেছে।সে খুব ভালো করেই জানে অনিলাকে তার মা আবার আগের মতোই পছন্দ করতে শুরু করেছে।

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেছে।অনিলা আগের তুলনায় অনেক সুস্থ।রাতে ভয় পেলে জুনইদকে জাপ্টে ধরে।জুনইদ প্রান পনে চেষ্টা করছে অনিলার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। ঠিক মতো ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে সকল খাবার নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া স্নান করিয়ে দেওয়া সব টাই সে নিজেই করে।আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।সে অনিলাকে গোসল করাতে চাইলে অনিলা সাফ সাফ জানিয়ে দিলো এখন থেকে সে নিজেই গোসল করবে।কিন্তু না জুনইদ তো দমবার পাত্র নয়।কিন্তু অনিলা এখন প্রায়ই সুস্থ তাই তার লজ্জা করে খুব।তখন অসুস্থ ছিলো জন্যই বোধহয় লজ্জার মধ্যে পড়তে হয়নি তাকে।সে জুনইদ কে ঠেলে ঠুলে ওয়াশরুম থেকে বের করে দিলো।ওয়াশরুমের দরজা ধড়াম করে লাগিয়ে দিলো অনিলা।জুনইদ মাথা চুলকে মুচকি হাসলো।সে একটু চেচিয়েই বলে,

হ্যাঁ বুঝেছি তো।এখন তো আর তোমার এই অধম স্বামীটার কোনো গুরুত্বই নেই।আমি তো এখন কোনো কাজেই আসবো না।আমাকে তো এখন একজন আমড়া কাঠের ঢেকি ভাবছে।আমি ও দেখবো হুহ্ এর পর আর আমাকে লাগে কিনা।

অনিলা লজ্জায় চোখ মুখ কুচকে ভেতর থেকেই বলে, আমার আর কাউকেই লাগবে না হুহ্। খোটা দেওয়া হচ্ছে আমাকে?”

জুনইদ কথাটা আমলে নিলো না।সে স্পষ্ট স্বীকারউক্তি করে বলে, “হ্যাঁ খোটা দিচ্ছি যাতে এতো দিন যত যত্ন আত্তি আমি করেছি সেগুলো রিটার্ন নিতে পারি তোমার কাছে থেকে!”

“এহ আমার বয়েই গেছে রিটার্ন করতে!”

“ঠিক আছে তাই দেখা যাবে! আমিও দেখি কার বয়েই যায় নাকি ভেসে যায়!”

#চলবে