সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
1138

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-১)

৬৯.
ডক্টরের‌ বলা কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সমুদ্র। তার ভাবমূর্তি একদম স্থির হয়ে গিয়েছে। মিসেস জেবা বেগমের চোখে মুখে বেশ উৎফুল্লতার‌ ছাপ‌। অতি পরিমাণ বিস্ময়‌তা কাটিয়ে উঠতে পুনরায় থমথমে গলায় সামনে বসে থাকা গাইনোকলজিস্টকে‌ জিজ্ঞেস করে ওঠে সমুদ্র,
– “রিয়েলি? আপনি কি সত্যি বলছেন ডক্টর? প্রাচী কি আসলেই,,?”
– “ইয়েস মিস্টার আরহাম‌, আপনার ওয়াইফ মিসেস প্রাচী মা হতে চলেছে এন্ড শি ইজ প্রেগন্যান্ট ফর টু মান্থস্।”
নিজের কানকে‌ বিশ্বাস করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে সমুদ্রের পক্ষে। তবুও তার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। ডক্টরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে; উদ্দেশ্য প্রাচীর কেবিন। কেবিনের‌ সামনে যেতেই প্রাচীর ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার‌। নিষ্পলক চাহনি তার; যেন খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে। অতি সন্তর্পণে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সমুদ্র। বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে প্রাচীর বাম হাত ধীরে ধীরে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিতেই হালকা নড়েচড়ে ওঠে প্রাচী।
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে একটা বদ্ধ কেবিনের উপর আবিষ্কার করে প্রাচী। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই সমুদ্রের চিন্তিত মুখশ্রী চোখ এড়ায় না তার।
– “সমুদ্র, আপনি? আমি এখানে কি করছি?”
ভয়ার্ত কন্ঠে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে ওঠে প্রাচী।
– “কবে থেকে চলছে এসব? এত বড় কথা আমাকে একবারও জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করো নি তুমি?”
সমুদ্রের এমন থমথমে গলায় বলা কথা শুনে চুপসে যায় প্রাচী। কি লুকিয়েছে সে সমুদ্রের কাছ থেকে? তার কি কিছু হয়েছে?
– “ক,ক্,কিসের‌ কথা বলছেন আপনি সমুদ্র? কি জানাইনি আমি আপনাকে? আর কি হয়েছে আমার?”
– “যা লুকিয়েছ‌ তা অনেক বড় অপরাধ; আর এর জন্য শাস্তি ও পেতে হবে তোমাকে‌।
তোমার ভেতর ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে; আমাদের অনাগত সন্তান, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন!”
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই পলক ফেলতে ভুলে যায় প্রাচী। চোখ দুটো তার কোটর‌ থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেট স্পর্শ করে সে। আসলেই কি সমুদ্র যা বলছে তা সত্যি? তার মাঝে কি আসলেই ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে? কেউ তাকে মা বলে ডাকবে ভাবতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে প্রাচীর।
সমুদ্র প্রাচীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
– “মেহু পাখি?”
সমুদ্রের ডাক শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী‌।
– “থ্যাঙ্ক ইউ‌ সো মাচ, মেহু পাখি! আমাকে আমার জীবনের এত বড় একটা সারপ্রাইজ দিতে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কত কত খুশি হয়েছি। থ্যাঙ্ক ইউ সো‌ মাচ‌।”
প্রাচী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রুমে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে ইশরাক, জেবা বেগম। তখন রিসিপশনে যাওয়ায় প্রাচীর খবর পায় নি সে।
– “প্রাচী? তুই ঠিক আছিস? মা যে বললো বাইরে করিডোরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি?”

– “ভাইয়ু, তুই শান্ত হ! আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু একটু মাথা ঘুরে এসেছিল আর এখন আমি একদম ঠিক আছি তো!”
বেডে শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে উঠে প্রাচী। ইশরাক এগিয়ে আসতেই সমুদ্র উঠে গিয়ে ইশরকাকে‌ জড়িয়ে ধরে।
– “চিন্তা করিস না ইশরাক‌। তোর বোনের কিছু হতে দিব না আমি। আর তোর বোনের কিছুই হয়নি; বরং তুই মামা হতে চলেছিস!”
সমুদ্রের কথা মুহূর্তের মধ্যেই পুরো কেবিন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এক খুশির খবর আসতে না আসতেই দ্বিতীয় খুশির খবর চলে আসায় উপস্থিত সবাই যেন খুশিতে উৎফুল্ল।
দুপুরের দিকে ফিহার‌ জ্ঞান আসতেই সবাই ধীরে ধীরে ফিহার‌ কেবিনে প্রবেশ করে। চোখ খুলেই প্রথমে ইশরাককে‌ নজরে পড়ে ফিহার‌।
পাশেই দোলনায় তোয়ালে জড়ানো ছোট একটা ফুটফুটে বাচ্চা। একজন নার্স এসে বাচ্চাটাকে ফিহার‌ কাছে এগিয়ে দিতে ফিহাও সযত্নে বাচ্চাটাকে আগলে নেয়‌। মুখশ্রী দেখতে অনেকটাই ইশরাকের‌ মতোন‌, নরম তুলতুলে হাত, পা।

৭০.
বিকেলের পর পরই বাসায় এসে পড়ে প্রাচী, সমুদ্র। বাসায় ফিরতেই কোহিনুর চৌধুরী ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রাচীকে নিয়ে। দুপুরের দিকে সমুদ্রের সাথে ফোনে কথা হয় তার‌। বাসায় পৌঁছাতেই প্রাচীর বেশ খাতির যত্ন শুরু করে দেন তিনি। এর জন্য অবশ্য বেশ কয়েকদফা সমুদ্রকে কথাও শুনিয়ে দিয়েছে প্রাচী। সমুদ্র চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে।

– “এখন থেকে তোমার সব কাজ বন্ধ, প্রাচী। তুমি শুধু এখন থেকে বেড রেস্ট নিবে‌ আর শুধু হেলদি খাবার খাবে। আর সমুদ্র তুই প্রাচীর সবসময় খেয়াল রাখবি। যখন যা লাগবে তখন ই তা এগিয়ে দিবি।”
সমুদ্র ও ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
– “কিন্তু মা এখনি এত কিছু করার কি প্রয়োজন? সবে তো দু মাস হয়েছে। এখনো তো ছয় সাত মাস বাকি‌। আর সারাদিন বসে থাকতে বোরিং লাগবে‌।”
অসহায় দৃষ্টিতে কোহিনুর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে প্রাচী‌।
– “নো মোর এক্সকিউজ‌! ইটস মাই অর্ডার।”
প্রাচীকে বুঝিয়ে দিয়ে কোহিনুর চৌধুরী এক প্লেট ভর্তি ফল প্রাচীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। এদিকে কোহিনুর চৌধুরী রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের দিকে তেড়ে গিয়ে ঝাঁজালো কন্ঠে বলে উঠে,

– “এই, এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো! মাকে এত তাড়াতাড়ি বলার কি দরকার ছিল? আর বলেছেন ভালো কথা, এখন আপনার জন্য সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতে হবে; কোনো কাজ ছাড়াই‌। ভালো লাগে না, ধ্যাত!”
রাগে আপনমনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “তো কি ভুল বলেছে মা? এখন থেকে নো কাজ। আর একদিক দিয়ে আমার ভালোই হয়েছে। সারাদিন নিজের ওয়াইফির‌ সাথে রোম্যান্স করতে পারব, সময় কাটাতে পারব। অ্যাম আই রাইট, ওয়াইফি‌!”
– “আপনিইইই!”
– “মা?”
পিহুর‌ কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই থেমে যায় প্রাচী। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই পিহু দৌড়ে এসে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয়। পিহুও খুশিমনে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু দিয়ে বসে।

কেটে যায় দুই মাস। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পিহুর ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। গত কয়েক দিন বেশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে তার। আকাশ আর হৃদিতার‌ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে গতকাল। আর বিয়ে জড়িত সকল অনুষ্ঠানে এটেনডেন্ট করায় শরীর বেশ দুর্বল হয়ে এসেছে তার‌।
– “তুমি গিয়ে নিচে গাড়িতে গিয়ে বসো। প্রাচীকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমরা ডক্টরের‌ কাছে যাব‌।”
হঠাৎ সমুদ্রের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী।
– “ডক্টর? কিন্তু কেন সমুদ্র?”
– “আজকে ডক্টরের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট আছে। তোমার চেকআপের‌ জন্য‌।”
প্রাচীও আর কোনো কথা বাড়ায় না। চুপচাপ ব্যাগ আর পিহুকে‌ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। তবে ভেতরে কোনো এক অজানা কারণে বেশ নার্ভাস ফিল হচ্ছে। যেন কোনোকিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
পিহুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে হসপিটালের দিকে যায় সমুদ্র। মিনিট চল্লিশেক পর গাড়ি এসে হসপিটালের সামনে থামে। গাড়ির সিটবেল্ট খুলতে খুলতে প্রাচীর দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। উদাসী চেহারায় অন্যমনস্ক হয়ে যেন কিছু একটা ভেবে চলেছে প্রাচী।
– “প্রাচী?”
পরপর কয়েকবার ডাক দিতেই ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর।
– “কি হয়েছে? এনিথিং প্রবলেম? অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবছিলে?”
– “ক,কি,কিছুনা তো।”
– “আচ্ছা ঠিক আছে। চলো হসপিটালে এসে পড়েছি।”
সমুদ্রের কথা শুনে প্রাচীও ধীর পায়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।

৭১.
ডক্টরের‌ কেবিনে,,
ডক্টর আয়েশা বেশ সরু দৃষ্টিতে সামনে থাকা রিপোর্ট গুলো পরখ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি টেস্ট করা রিপোর্টের পাতা উল্টাতেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে গভীর ভাবে। চশমার আড়ালে রিপোর্ট গুলো পরখ করে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। একটু আগেই প্রাচীর প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করিয়েছেন তিনি।
ডক্টরকে‌ এমন চিন্তিত হতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল সমুদ্র। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? ডক্টরের মুখে এত চিন্তার ছাপ কিসের?

– “ডক্টর? ইজ এভরিথিং ওকে? প্রাচীর সব রিপোর্ট কি ঠিক আছে?”
সমুদ্রের কথায় ডক্টর আয়েশা সহ প্রাচীও মাথা তুলে তাকায়‌। অতিরিক্ত টেনশনে গলা শুকিয়ে আসছে প্রাচীর।
– “দেখুন মিস্টার জুনায়েদ, মিসেস প্রাচী আপনার ওয়াইফ‌। আর অনাগত সন্তান ও আপনাদের দুজনের। তাই বেবির এবং মায়ের হেলথ সম্পর্কে জানার অধিকার ও আপনাদের দুজনের আছে‌।
আমি কিছু লুকাব না আপনাদের কাছ থেকে। এসব টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী যা দেখছি তাতে বেবিদের অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না।”
ডক্টর আয়েশার বলা কথা শুনে হতভম্ব হয় সমুদ্র। কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “বেবিদের মানে?”
– “ইয়েস, মিস্টার জুনায়েদ! আপনার ওয়াইফের গর্ভে একটা না বরং দু দুটো ভ্রূণ বেড়ে উঠছে। আর দুটো বেবি কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো বেবিদের হেল্থ নিয়ে‌। রিপোর্ট অনুযায়ী, মিসেস প্রাচীর প্রেগন্যান্সি তে বেশকিছু কম্প্লিকেশন‌ রয়েছে; তার উপর তিনি দু দুটো বাচ্চা ক্যারি করছে‌ন‌। এমতাবস্থায় উনার ডেলিভারিতে বেশ কিছু কম্প্লিকেশন আসতে পারে। আর যার জন্য এমনও হতে পারে আমরা মা ও বাচ্চাদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে বাঁচাতে পারব‌।”

ডক্টর আয়েশার কথা শুনতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রাচীর। সমুদ্র ও নিশ্চুপ। অতি পরিমাণ আশংকা আর আশ্চর্যতা তাকে একসাথে ঘিরে ধরেছে যেন।………….

#চলবে 🍂

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চবিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-২)

৭২.
ডক্টর আয়েশার উক্ত কথায় অতি পরিমাণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সমুদ্র। টেবিলের উপর থাকা রিপোর্ট গুলো উঠিয়ে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। প্রাচীও‌ পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের। মুখে টু শব্দটির ও নেই।
গাড়িতে সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি সমুদ্র। প্রাচীও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলেনি। দীর্ঘ সময় পর বাসার সামনে এসে গাড়ি থামতেই সিটবেল্ট‌ খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী। অন্যদিন হলে সমুদ্র নিজেই তাকে সিটবেল্ট খুলে বাইরে বের হতে সাহায্য করত। প্রাচী বাইরে বের হতেই সমুদ্র দ্রুত গাড়ি ফুল স্পীডে ইউটার্ন নিয়ে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও পরমুহূর্তে প্রাচী বেশ কয়েকবার সমুদ্রকে পিছু ডাকলেও সাড়া দেয় নি সে। প্রাচীও ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় ভেতরের দিকে। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত এমন অদ্ভুত কঠিন কেন?
রাতে পিহুকে‌ ঘুম পাড়িয়ে রেখে রুমের দরজার দিকে তাকায় প্রাচী‌। ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা বেজে এসেছে ইতোমধ্যে; কিন্তু সমুদ্রের বাসায় ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। বিচলিত হয়ে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে পড়ে সে। উদ্দেশ্য টেবিলের উপর পড়ে থাকা ফোন। ফোন হাতে নিয়ে সমুদ্রকে ফোন করতে যাবে তখনই রুমে প্রবেশ করেন মিসেস কোহিনুর চৌধুরী।
– “প্রাচী?”
কোহিনুর চৌধুরীর ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকায় প্রাচী।
– “মা, আপনি? আসুন না ভেতরে আসুন।”
– “সমুদ্র এখনো ফিরে নি?”
কোহিনুর চৌধুরীর প্রশ্নে মুহূর্তেই মুখ চুপসে যায় প্রাচীর। অতঃপর মাথা নিচু করে না বোঝাতেই ফুস করে দম ফেলেন কোহিনুর চৌধুরী। এগিয়ে এসে প্রাচীর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা স্বরূপ বলে উঠেন,
– “চিন্তা করো না, সমুদ্র এসে পড়বে। একদম টেনশন করবে না; বেবিদের সমস্যা হবে।
পিহু ঘুমিয়ে পড়েছে?”
– “জি মা।”
প্রাচীর উত্তর পেয়ে বিছানায় থাকা ঘুমন্ত পিহুকে অতি সন্তর্পণে কোলে তুলে নিলেন কোহিনুর চৌধুরী। প্রাচীও আটকায় নি; কেননা তিনি হুটহাট ই পিহু ঘুমিয়ে পড়লে পিহুকে‌ নিজের ঘরে নিয়ে যান‌। পিহুকে নিয়ে যেতেই প্রাচী সমুদ্রের নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হচ্ছে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর কোনো প্রতিক্রিয়া না হতে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে হলরুমের দিকে পা বাড়ায় প্রাচী। হলরুমে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দুশ্চিন্তায় পায়চারি করতে করতে দরজার দিকে বারবার তাকাচ্ছে সে। মিনিট বিশেক এভাবে কাটাতে কাটাতেই অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রাচীর।
অগোছালো চুল, শার্টের বোতাম খোলা, হাতে বিয়ারের বোতল। নেশায় আসক্ত হয়ে ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সমুদ্র। সমুদ্রের এহেন দশা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আতকে উঠে প্রাচী। কেননা বিয়ের পর কিংবা এ পর্যন্ত কোনোদিনই সে সমুদ্রকে এভাবে নেশায় বুঁদ হতে দেখে নি। হলরুমে আসতে গিয়ে একপর্যায়ে মেঝেতে পড়ে যেতে নিলেই প্রাচী দ্রুত পায়ে গিয়ে সমুদ্রকে আগলে নেয়।

– “সমুদ্র! আপনি কি ঠিক আছেন? কি অবস্থা করেছেন নিজের! আর আপনি ড্রিঙ্কস করে এসেছেন, সমুদ্র?”
সমুদ্রকে ঘিরে প্রলাপ বকে প্রাচী। এদিকে প্রাচীর কথা শুনে সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে। সমুদ্রকে এমন বাচ্চাদের মত হাসতে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না প্রাচীর যে সমুদ্র এখন নিজের আয়ত্তে নেই। সমুদ্রকে কোনোমতে সোফার উপর বসিয়ে কিচেনে গিয়ে তড়িঘড়ি করে লেবুর শরবত তৈরি করে নিয়ে সমুদ্রকে জোর করে খাইয়ে দিতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় সমুদ্র। ড্রিঙ্কস এর প্রভাব কাটতে বেশ কিছু সময় চলে যায় চোখের নিমিষেই।

নিশুতি রাত। চোখে লেগে থাকা ঘুম কাটতেই সমুদ্র খেয়াল করে তার পায়ের উপর ভর দিয়ে কেউ শুয়ে রয়েছে। চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে সোফায় আর প্রাচীকে নিজের পায়ের কাছে আবিষ্কার সমুদ্র। হয়তো চোখ লেগে এসেছিল প্রাচীর। সমুদ্রের নড়েচড়ে ওঠার প্রভাব পড়ে প্রাচীর উপর ও।
– “সমুদ্র, আপনি ঠিক আছেন? আপনি ড্রিঙ্কস করেছেন? কিন্তু কেন?”
প্রাচীর প্রশ্ন শুনে উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র।
– “এত রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে কেন? উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়‌।”
প্রাচীর প্রশ্ন এভাবে এড়িয়ে যাওয়ায় বেশ ক্ষিপ্ত হয় প্রাচী। ইদানিং প্রেগন্যান্সি তে হুটহাট ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া তার নিত্যদিনের বিষয়।

৭৩.
– “আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি, সমুদ্র! আপনি এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে? কিছু হয়েছে? আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন‌ আমার কাছ থেকে, সমুদ্র?”
– “জানতে চাও তো আমার সমস্যা কিসে? তাহলে শুনো! আমার সমস্যা আমাদের বেবিদের নিয়ে! আমার সমস্যা তোমাকে নিয়ে।”
সমুদ্রের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক প্রাচী। কি সব উল্টোপাল্টা বলছে সমুদ্র। কিছুক্ষণ বাদেই প্রাচী খেয়াল করে সমুদ্র নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় নিজের ভেতরে পুষে রাখা যন্ত্রণা গুলোকে অশ্রুর সাহায্যে ব্যক্ত করছে। এ প্রথম সমুদ্রকে কান্না করতে দেখে প্রাচী। প্রাচী খুব ভালো করেই জানে সমুদ্র খুব স্ট্রং‌; কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে তার মন ও বিষন্ন হয়। আলতো করে নিজের হাত সমুদ্রের চিবুক ছুঁয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকায় সমুদ্র।
– “কি হয়েছে সমুদ্র? আপনি কেন এসব বলছেন?”
– “আমি তোমাকে হারাতে পারব না মেহু পাখি! কোনোভাবেই না। তোমাকে হারালে আমি বাঁচব কি করে? প্লিজ এমনটা করো না; চলো এক কাজ করি। বাচ্চা তো পরেও হবে তাইনা? চলো এখন বেবি দুটো এবোরশন‌ করে ফেলি।”
সমুদ্রের এমন ভয়ঙ্কর রূপী কথাবার্তা কর্ণপাত হতেই ভয়ে আতকে দু কদম পিছিয়ে যায় প্রাচী। তড়িৎ গতিতে নিজের দুটো হাত দিয়ে নিজের পেট আঁকড়ে ধরে সে। কি বলছে এসব সমুদ্র?
– “আপনার মাথা ঠিক আছে সমুদ্র? কি সব বলছেন এসব? আপনি আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলতে চাইছেন!”
– “না, না মেহু পাখি! আমি বেবিদের মারতে চাই না; আমি তো শুধু তোমাকে বাঁচাতে চাই। চলো না প্লিজ।”
– “আপনার মাথা ঠিক আছে? আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? এই বেবি আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন সমুদ্র; আর সেই চিহ্ন কেই আপনি নিঃশেষ করে দিতে চাইছেন? এই আপনার ভালোবাসা! ছিঃ সমুদ্র ছিঃ!”

সমুদ্রের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে প্রাচী। এদিকে সমুদ্রের হাল বিধ্বস্ত। চোখ দুটো টকটকে লাল। রাগে ক্ষোভে পাশে থাকা টি টেবিলে সজোরে লাথি মারতেই সেটা ছিটকে পড়ে সুদূরে। এতে আরো একধাপ ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় প্রাচী।
– “তুমি মানবে না তো আমার কথা? তুমি করবে না এবোরশন তাই তো?”
– “না আমি মানব না আপনার কথা! আমি নিজ হাতে আমার বাচ্চাদের শেষ করে দিতে পারব না। এতে যদি আমার নিজের ও শেষ হয়ে যেতে হয় তাহলে তাও করব‌। আপনি আর এখন আমার সেই সমুদ্র নেই। আস্ত একটা বিবেকহীন মানুষে পরিণত হয়েছেন আপনি!”
– “আমার কথা মানবে না তুমি? ঠিক আছে না মানো! থাকো তোমার বেবিদের নিয়ে! আমিও আর থাকব না তাহলে এখানে!”
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরি করে না সমুদ্র। হনহনিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। এদিকে এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে অঝোরে কান্না করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে প্রাচী। জীবন তার এমন কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছে কেন?

৭৪.
সকালের আলো ফোটার পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রাচী। ফ্যানের বাতাস থাকা সত্ত্বেও দর দর করে ঘামছে সে। চোখ খোলার পর নিজেকে বেডরুমে আবিষ্কার করতেই একপ্রকার হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। পাশে তাকাতেই ব্যালকনিতে সমুদ্রকে বসা অবস্থায় দেখতে পায় প্রাচী। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে এককোণে চুপচাপ জড়সড় হয়ে চুপটি মেরে বসে থাকে সে। সমুদ্র ও প্রাচীকে উঠে যেতে দেখে নিজেও উঠে পড়ে। গতকাল রাতের পর থেকেই মেয়েটা যথেষ্ট ভয় পেয়েছে আর এ সময় এমন ভয়, টেনশন প্রাচীর স্বাস্থ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ধীর পায়ে উঠে গিয়ে প্রাচীর সামনে দাড়াতেই প্রাচী মাথা তুলে তাকায়‌। সমুদ্রের চোখ মুখ রক্তিম হয়ে আছে, চোখ দু’টো অশ্রুসিক্ত। হয়তো অনেকক্ষণ যাবৎ কান্না করেছে তাই। ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রাচী কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সমুদ্র গিয়ে ছোট বিড়াল ছানার মতো প্রাচীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে‌।
প্রাচী উপলব্ধি করে সমুদ্র আবারো অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত।
– “আ’ম সরি মেহু পাখি! আমি কাল রাতে তোমাকে ইচ্ছে করে হার্ট করতে চাই নি‌। আমি সত্যি বলছি; আমি আমাদের বেবিদের কোনো ক্ষতি করতে চাই না। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে হারানোর ভয় জেঁকে বসেছিল। কি করব বলো? ডক্টরের‌ কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার তাইতো নেশায়, রাগে কাল রাতে ওসব বলেছি। আ’ম রিয়্যালি সরি মেহু পাখি! প্লিজ মাফ করে দাও। আই প্রমিজ আর কখনো তোমাকে, বেবিদের হার্ট করব না। প্লিজ!”
বলেই ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সমুদ্র। প্রাচীও নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের চক্রের; সামনে কি ঘটবে তা আদৌ কারো জানা নেই।…………

#চলবে 🍂

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষট্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৩)

৭৫.
সেদিনের পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই সমুদ্র প্রাচীর পাশে থেকেছে। প্রাচীর প্রেগন্যান্সির কম্প্লিকেশন সম্পর্কে মিসেস কোহিনুর চৌধুরী অবগত হতেই প্রাচীর বিশেষ খেয়াল রাখা শুরু করেছেন। কোন সময় কোনটা লাগবে তা নিয়ে সবসময় নজরে রাখেন তিনি। সমুদ্র ও সবসময় চোখে চোখে রাখে প্রাচীকে আর এটাও খেয়াল রাখে যাতে কোনো প্রকার টেনশন না করে সে। আর এতসব পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রাচীও আগের চেয়ে বেশ খানিকটা ই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
আর এসবের জন্য অফিস থেকে তিন মাসের ছুটিও নিয়েছে সমুদ্র; কেননা সাদাত চৌধুরী নিজেই তাকে এ আদেশ দিয়েছেন। এভাবেই আরো কেটে গিয়েছে চার মাস। এই তিন মাসে প্রাচীর শরীরেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। টুইন বেবি থাকার কারণে পেট আগের চেয়ে দ্বিগুণ বড় হয়েছে, হাত পায়ে পানি এসেছে, মুখের লাবন্যতাও‌ বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ কয়েক গুণ। যার ফলস্বরূপ হাঁটাচলা করতেও বেশ অস্বস্তিতে ভুগতে হয় প্রাচীর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী‌। তখনই এক প্লেট ভর্তি বিভিন্ন ফল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। আয়নার সামনে উদাসীন চেহারায় প্রাচীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে যায় প্রাচীর দিকে।

– “কি হয়েছে মেহু পাখি? চেহারায় এমন উদাসীন উদাসীন ভাব কেন? মন খারাপ?”
পেছন থেকে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে বেশ আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে সমুদ্র।
– “মন খারাপ হবে না কেন? দেখুন না দিন দিন কি হাল হচ্ছে; গাল দুটো ফুলে কেমন টমেটোর মতো হয়েছে!”
বেশ মন খারাপ নিয়ে নিচু কন্ঠে বলে উঠে প্রাচী।
– “কে বলেছে আমার মেহু পাখিকে খারাপ দেখা যায়; আমার মেহু পাখি তো দিন দিন আরো বেশি কিউট হয়ে যাচ্ছে।
লিসেন‌ প্রাচী প্রেগন্যান্সির সময় এগুলো খুবই কমন বিষয়‌। আর এটা ভুলে যেও না তোমার ভেতর একটা না বরং দু দুটো বেবি বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তাই মন খারাপ করো না। এখন লক্ষী মেয়ের মতো এগুলো খেয়ে নাও।
বিকেলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

সারপ্রাইজের কথা শুনতেই খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠে প্রাচী। সমুদ্রের বলা কথাগুলো উপলব্ধি করাতে মন খারাপ নিমিষেই কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। বাধ্য মেয়ের মত চেয়ারের উপর বসতেই পিহু দৌড়ে প্রাচীর কাছে চলে আসে। প্রাচীও‌ আগলে নেয় পিহুকে‌।
রাতে ক্লান্ত শরীরে বেঘোরে ঘুমাতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। বিকেলের দিকে বেশ অনেকদিন পর প্রাচীকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়েছিল সে। প্রাচীকে খুশি রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সারা বিকেল ঘোরাঘুরি করার পর রাতের ডিনার করেই বাসায় ফিরেছে।

হঠাৎ পাশ থেকে কারো কান্নার আওয়াজ পেতেই ঘুমের মধ্যেই ধড়ফড় করে উঠে বসে সমুদ্র। দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই খেয়াল করে প্রাচী উঠে বসে চুপচাপ কান্না করেই‌ যাচ্ছে। এতে ভয়ে আতকে উঠে সমুদ্র। বিচলিত হয়ে দ্রুত প্রাচীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– “প্রাচী কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো? শরীর খারাপ লাগছে? হসপিটালে যাবে?”
প্রাচী মাথা দু’পাশে নাড়িয়ে না বোঝায়। প্রাচীর উত্তর পেয়ে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ থাকে সমুদ্র। অতঃপর চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে উঠে,
– “খিদে পেয়েছে?”
প্রাচীও ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে সম্মতি জানায়‌। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাচীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে দেয় সমুদ্র। এ কয়েক মাসে প্রাচী আরো অনেকবার এমন করেছে‌। রাতবিরেতে হুটহাট উদ্ভট সব আবদার করেছে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হবে না বোধহয়।
– “কি খাবে?”
– “আইসক্রিম!”
প্রাচীর উত্তর শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে নেয় সমুদ্র। ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। এত রাতে আইসক্রিম কোথায় পাবে সে? ফ্রিজে রাখা সব আইসক্রিম ও তো বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছে। মুখটাকে যথেষ্ট অসহায় করে প্রাচী বলে উঠে,
– “আইসক্রিম? এত রাতে? বলছিলাম কি মেহু পাখি এত রাতে আইসক্রিম খাওয়া মোটেও ঠিক না; ঠান্ডা লেগে গেলে বেবিদের প্রবলেম হতে পারে। আর বাইরে থাকা বাদবাকি সব দোকানপাট ও বন্ধ। আমি না হয় অন্য কিছু নিয়ে আসি।”
অন্যসব দিন হলে সমুদ্রের কথা শুনে প্রাচীর মেজাজ বিগড়ে গেলেও আজকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ই ঘটলো‌। সমুদ্রের উত্তর পেয়ে প্রথমে মন বিষণ্ন হলেও পরমুহূর্তেই তা কাটিয়ে প্রাচী পুনরায় বলে উঠে,
– “আচ্ছা ঠিক আছে; আমি যেকোনো একটা ডেজার্ট খাব!”
প্রাচীর কথা শুনে অবাক হলেও সম্মতি জানিয়ে ধীর পায়ে খাট থেকে নেমে দ্রুত রুমের বাইরে চলে যায় সমুদ্র।

৭৬.
শুক্লাদ্বাদশীর‌ রাত্রি। জানালা থেকে হিমশীতল শো শো বাতাস ক্রমেই রুমে প্রবেশ করছে‌। শরীরে বেশ শীত অনুভূত হওয়ায় বিরক্ত হয় প্রাচী। বিছানা থেকে ধীর পায়ে নেমে সামনের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ডোরমেটে‌ পা পিছলে যেতেই নিচে পড়ে যায় প্রাচী। নিচে পড়ে যেতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রাচীর। যন্ত্রণায় শরীর অচেতন, অসাড় হয়ে আসছে ক্রমশ। চোখ দিয়েও নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে,
– “স,স্,সমুদ্র!”

বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে খুশিমনে রুমে প্রবেশ করে সমুদ্র। কিন্তু রুমের কোথাও প্রাচীকে দেখতে না পেয়ে তার ভেতরটা ধক করে ওঠে। প্রাচী ঠিক আছে তো? দ্রুত পায়ে এগিয়ে রুমের লাইট অন করতেই সামনে প্রাচীকে পড়ে থাকতে দেখে হাত থেকে বিস্ময়ে বাটি পড়ে যায় মেঝেতে সমুদ্রের। অবাক চাহনিতে প্রাচীর দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতেও ভুলে যায় সে।

রাত ৩ টা বেজে ৪৫ মিনিট। হসপিটালের করিডোরের সামনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সমুদ্র। দ্রুত হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তার। পাশেই কোহিনুর চৌধুরী, সাদাত চৌধুরী ও আছেন। পুরো চৌধুরী পরিবার ই বিষাদগ্রস্ত। আনোয়ার সাহেবকে ও ফোন করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একটু আগেই প্রাচীকে হসপিটালে এনে ইমার্জেন্সি অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানো হয়। ডক্টর, নার্স সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রাচীকে নিয়ে।
হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে ডক্টর আয়েশা বের হতেই সমুদ্র দ্রুত এগিয়ে যায় তার কাছে।

– “ডক্টর? কি হয়েছে? প্রাচী কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?”
– “নো মিস্টার জুনায়েদ! শি ইজ নট ফাইন। প্রাচীর অবস্থা অনেক ক্রিটিক্যাল। আপনাকে আমি আগেই ওয়ার্ন করেছিলাম যে প্রাচীর প্রেগন্যান্সিতে বেশ কম্প্লিকেশন‌ আছে; তারপরও এত বড় একটা এক্সিডেন্ট!
উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট মিস্টার জুনায়েদ। বাট,,”
ডক্টর আয়েশা আরো কিছু বলতে যাবে তখনই ভেতর থেকে আরো একজন নার্স বেরিয়ে আসে।
– “ডক্টর তাড়াতাড়ি ভেতরে চলুন। মিসেস প্রাচীর পালস রেট কমে যাচ্ছে।”
– “ওহ শিট! দিস কেস ইজ গোয়িং টু বি ভেরি ক্রিটিক্যাল! মিস্টার জুনায়েদ, এক্সকিউজ মি!”
বলেই আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না ডক্টর আয়েশা। দ্রুত ওটির ভেতরে চলে গেলেন।

দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে সবাই ওয়েট করছে‌। ইশরাক, আনোয়ার সাহেব ও এসে উপস্থিত হয়েছেন ইতোমধ্যে। ইশরাক সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র তার অনুভূতিহীন পাথর শরীরটাকে নিয়ে এক কর্ণারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সময় যেন ফুরাচ্ছেই না।
– “এখানে মিসেস প্রাচীর হাজবেন্ড কে?”
একজন নার্সের কথায় মাথা তুলে তাকায়। নার্স হাতে ফাইল নিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে।

– “জি আমি। আমি প্রাচীর হাজবেন্ড। নার্স প্রাচী ঠিক আছে? আমার বাচ্চা?”
– “মিস্টার জুনায়েদ প্লিজ সাইন হেয়ার! আমাদের হাতে সময় খুবই কম।”
বলেই হাতে থাকা ফাইলটি সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয় নার্স।
– “সাইন? কিন্তু কেন?”
– “মিস্টার জুনায়েদ আপনার ওয়াইফ এবং বেবিদের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। এখন শুধু যেকোনো দুজনকেই বাঁচানো যাবে। আপনি এখানে সই করে দিন আর বলুন মা ও বাচ্চাদের মধ্যে কাদের বাঁচাতে চান।
আর পেপারটাতে লিখা আছে অপারেশন চলাকালীন সময়ে মিসেস প্রাচীর কিছু হয়ে গেলে তার দায়ভার হসপিটাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে না।”
নার্সের কথা কর্ণপাত হতেই শরীর হিম হয়ে আসে সমুদ্রের। এক মুহূর্তের জন্য তার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে। বাকি সবার অবস্থাও বেশ নাজেহাল।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে সমুদ্র। ঠিক কি করবে, কি সিদ্ধান্ত নিবে তার জন্য মাথা কাজ করছে না। কি করে পারবে মা ও বাচ্চাদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে বাঁচাতে।

৭৭.
– “আচ্ছা সমুদ্র কখনো যদি এমন হয়; ডক্টর আয়েশার কথা সত্যি হয় তখন আপনি কি করবেন?”
প্রাচীর বলা কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়‌ সমুদ্র।
– “হুসস! এমন কথা আর মুখেও আনবে না। এমনটা কখনোই হবে না।”
– “আচ্ছা মানলাম। কিন্তু কখনো যদি এমনটা হয় প্লিজ কথা দিন আপনি সবার আগে আমাদের বাচ্চা দুটোকে বাচাবেন‌।”
– “প্রাচী!!”
সেদিন প্রাচীর জেদের কাছে হার মেনে কথা দিয়েছিল সমুদ্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিনিয়ত।

চার মাস আগের কথা মনে পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা শুরু করে সমুদ্রের। কে জানত তার দেয়া কথাটা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে।

– “স্যার, প্লিজ জলদি করুন। আমাদের হাতে সময় নেই।”
নার্সের কথা শুনে ভাবনার সুতো কাটে সমুদ্রের।
– “বেবি! বেবিদের বাঁচান!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলেই হাতে থাকা পেপারটাতে সাইন করে দেয় সমুদ্র। সমুদ্রের এহেন সিদ্ধান্তে চৌধুরী আর হোসেন পরিবারের সবাই হতবাক। তবে কি প্রাচী ফিরবে না আর কোনোদিন?………

#চলবে 🍂

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তবিংশ_পর্ব (অন্তিম পাতা)

৭৮.
নিস্তব্ধ কোলাহলহীন পরিবেশ। চারপাশে দূর দূরান্তেও‌ কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। শুধু আছে মানুষের সমাহিত করা কবরস্থান।
তেমনি বেশ পুরনো একটা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। মুখশ্রী তার বেশ গম্ভীর। হাতে থাকা ফুলের তোড়া টা কবরের পাশে থেকে পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে সে। প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটা দিনেই এখানে আসা হয় তার। প্রতিবছর বলতে বিগত তিন বছর ধরেই আজকের দিনে এখানে এসে কবর জিয়ারত করে কিছু স্মৃতিচারণ করে যায় সে।
মোনাজাত শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় সমুদ্র। চোখদুটো তার অশ্রুসিক্ত। কবরস্থান থেকে বের হয়ে রোডসাইডে‌ যেতেই গাড়ির কাছে দেখতে পায় দু দুটো বাচ্চাকে‌। বাচ্চা দুটো সমান বয়সেরই‌। তিন বছর বয়সী বাচ্চা দুটো সমুদ্রকে দেখতে বেশ উৎফুল্লতার‌ সাথে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে।

– “বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা মেয়ে আর ছেলে দুজনে একসাথেই প্রশ্ন করে সমুদ্রকে‌। সমুদ্র ও মুচকি হেসে বাচ্চা দুটোকে কোলে তুলে বলে উঠে,
– “স্নিগ্ধ, মীরা বাবা বলেছিল না আজকের দিন টা বাবার কাছে অনেক স্পেশাল‌। তাইতো বাবা প্রতিবছর এই স্পেশাল‌ জায়গায় এসে টাইম স্পেন্ড করে।”
– “কিন্তু বাবা আজকে কি এমন ইসপেশাল‌(স্পেশাল)? আজকে তো আমাল আর ভাইয়ুর জনমোদিন‌(জন্মদিন)।”
– “হ্যাঁ, আজকে তো আমার প্রিন্স আর প্রিন্সেস দুজনের ই বার্থডে। কিন্তু সেটা ছাড়াও আরো একটা দিন আজকে। সেটা হলো,,”

সমুদ্রের আর কিছু বলার পূর্বেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
– “আজকে তোমাদের বড় দাদুর মৃত্যুবার্ষিকী! আর সেটার জন্যই বাবা প্রতিবছর এখানে আসে।”
মেয়েলি কোনো কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই পেছনে ফিরে তাকায় সমুদ্র। স্নিগ্ধ আর মীরাও সমুদ্রের কোল থেকে নেমে দৌড়ে সামনে থাকা রমণীর দিকে এগিয়ে যায়।
– “মাম্মাম!”
বাচ্চাদের কথায় রমণীও মুচকি হেসে বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে।
– “প্রাচী তুমি? তুমি না ব্যাংকে গিয়েছিলে?”
– “হ্যাঁ, ব্যাংকের কাজ আজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় ভাবলাম এখানেই ডিরেক্ট চলে আসি।”
– “আচ্ছা তাহলে চলো বাড়ি ফেরা যাক। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সমুদ্রের কথায় সম্মতি জানিয়ে স্নিগ্ধ আর মীরাকে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে প্রাচী।

চৌধুরী বাড়িতে বাচ্চাদের জন্মদিন উপলক্ষে বেশ আয়োজন করা হয়েছে। পিহু, স্নিগ্ধ আর মীরা; বাড়ির তিনটে বাচ্চাই বেশ হইচই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে‌। রুমে দাঁড়িয়ে পার্টির জন্য তৈরি হচ্ছিল প্রাচী। ব্ল্যাক এন্ড গ্রিন কম্বিনেশন এর শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, অর্নামেন্টস। খোলা চুল গুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেয়া। শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করা শেষ হতেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে প্রাচী। বাড়িতে বিশাল ব্যস্ততা। তার উপর অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
তন্মধ্যে কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই কিঞ্চিৎ পরিমাণ কেঁপে উঠে প্রাচী। তবে চমকায় না কেননা এ স্পর্শ তার চিরচেনা।
– “কি করছেন সমুদ্র? ছাড়ুন আমাকে। বাড়িভর্তি মেহমান; কেউ এসে পড়বে।”
– “কি করব বলো? আমার ওয়াইফি দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছে যে তার থেকে দূর হতেই মন চায় না।
এমন একটা ওয়াইফি থাকলে কি করে দূরে থাকি বলো? নিজের রূপ দিয়ে আমাকে ঘায়েল করার ইচ্ছে আছে নাকি!”
সমুদ্রের আগ্রাসী কন্ঠ শুনে লজ্জায় মিইয়ে যায় প্রাচী।
– “দু বাচ্চার বাপ হয়েও মুখে কিছু আটকায় না নাকি! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বসেছেন দেখছি‌। ছাড়ুন আমাকে; মা নিচে ডেকেছে আমাকে।”
বলেই চোখ রাঙিয়ে নিজেকে সমুদ্রের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রাচী। এদিকে প্রাচী চলে খানিকটা দূরে যেতেই হো হো করে হেসে উঠে সমুদ্র। ভাবে জীবন তার অদ্ভুত সুন্দর!

৭৯.
পশ্চিমা আকাশে সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশের লাল আবিরের রেখা নিশ্চিহ্ন প্রায়! বিহঙ্গের দল ও নীড়ে ফিরে যাচ্ছে এক এক করে।
সায়াহ্ন মাখানো খোলা আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রাচী। আজকের দিনটা তার বেশ ভালোই কেটেছে। কাটারই কথা। দিনটাকে নিয়ে অনেক দুর্বিষহ স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় প্রাচী। সমুদ্র ও বিনিময়ে স্মিত হাসে।

– “কি হয়েছে মেহু পাখি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিলে‌?”
– “এইতো ভাবছিলাম জীবনের এই অল্প সময়টুকুর‌ মধ্যে কত কিছু হয়ে গেল। কত পরিবর্তন, কত স্মৃতি রয়ে গিয়েছে এই তিন বছরে তাইনা?”
আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বলে উঠে প্রাচী। প্রাচীর কথা শুনে সমুদ্র ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রাচী যা বলছে তা তো ফেলনা নয়।
– “আজকের দিনটার কথা মনে পড়ে সমুদ্র? আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। যেদিন,,”

– “হ্যাঁ মনে আছে। ভুলি কি করে? সেদিন তো চাইলেও ভোলা অসম্ভব!”
৩ বছর পূর্বে,,
সমুদ্রের এহেন সিদ্ধান্তে উপস্থিত সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। সমুদ্রের কথা শুনে আনোয়ার সাহেব রাগে ক্ষোভে সমুদ্রের দিকে একপ্রকার তেড়ে গেলেন,
– “সমুদ্র!! কি যা তা বলছো তুমি! ওটিতে আমার মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আর তুমি বলছো বেবিদের বাঁচাতে? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?”
– “বাবা আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা কেমন। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমি প্রাচীকে কথা দিয়েছি এমন কোনো পরিস্থিতি আসলে আমি আমার বাচ্চাদের বাঁচাব। আর যদি আমি প্রাচীকে দেয়া কথা না রাখি তাহলে কোনোদিন ও প্রাচীর মুখোমুখি হতে পারব না। আর যাই হোক আমি প্রাচীর ঘৃণা আর অবহেলা কোনোদিন সহ্য করতে পারব না।”
সমুদ্রের এমন দৃঢ় কথায় কিছু বলতে যেয়েও থেমে যান আনোয়ার সাহেব।
নার্স ফাইল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে সমুদ্র। শুনেছে পুরুষ মানুষদের নাকি কাঁদতে নেই কিন্তু আজ সে নিয়মও যেন ভেঙে গিয়েছে সমুদ্রের কাছে। ভেতরে ভেতরে যেন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত সে। চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রু গুলো চিবুক গড়িয়ে পড়ছে। জীবনে আজ পর্যন্ত এমন কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয় নি। ভেতরেও ডাক্তার রাও তাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সবার অধীর আগ্রহের সমাপ্তি ঘটে ভেতর থেকে আসা দুটো বাচ্চার কান্নার আওয়াজে। একটু পর নার্স এসে তোয়ালে জড়ানো দুটো বাচ্চা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দিতেই সমুদ্র কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেয় বাচ্চা দুটোকে। ফর্সা মুখশ্রীতে লাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

– “কংগ্রেচুলেশন, মিস্টার জুনায়েদ! আপনার টুইন ছেলে মেয়ে হয়েছে।”
নার্সের কথা শুনে বাচ্চাগুলোর দিকে পুনরায় তাকায় সমুদ্র। কি নিষ্পাপ তাদের মুখশ্রী!
– “প্রাচী? প্রাচী কেমন আছে নার্স?”
নার্সকে প্রশ্নটা করতেই মুহূর্তের মধ্যে নার্সের মুখ কেমন ফ্যাকাশে, মলিন হয়ে যায়।
– “কি হয়েছে নার্স? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি; আমার ওয়াইফ কোথায়?”
সমুদ্রের প্রশ্ন শুনে পরমুহূর্তেই নার্স যা বলে তাতে যেন বিস্ময়তার চরম পর্যায়ে চলে যায় সমুদ্র সহ বাকি সকলেই।

৮০.
– “আপনার এই ভালোবাসার কাছে কিভাবে হেরে যেতাম সমুদ্র? কিভাবে ছেড়ে চলে যেতাম আপনাকে?
আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার; আপনার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার সাধ্যি আমার নেই সমুদ্র। তাইতো সেদিন ফিরে এসেছিলাম আপনার কাছে। ছুটে এসেছিলাম আবারো আপনার এই ভালোবাসার কাছে।”

সমুদ্রের কাঁধে মাথা রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে প্রাচী। সেদিনের ঘটনা মনে পড়লেই এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে তার।
সেদিন,,
– “ইউর ওয়াইফ ইজ এলাইভ‌! মিসেস প্রাচী বেঁচে আছেন। তবে মিসেস প্রাচীর হেল্থ কন্ডিশন এখনো বেশ ক্রিটিক্যাল। তাকে অবজারভেশনে রাখা হবে। আগামী ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না মিস্টার জুনায়েদ।”

নার্সের কথা শুনতেই বিস্ময়তার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় সমুদ্র। তবুও তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে প্রাচীর কথা ভেবে সমুদ্রের। প্রাচীকে পাশের কেবিনে বেশ কিছুক্ষণ পর শিফট করতেই কেবিনের গ্লাসের অপর পাশ থেকে প্রাচীকে পরখ করে নেয় সমুদ্র। হাতে ক্যানেলা, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। এক রাতের মধ্যেই চেহারার রং বেশ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।

ভোরের আলো ফোটা শুরু করে দিয়েছে। একটু আগেই ফজরের আজান দিয়েছে। ইশরাক, আনোয়ার সাহেব, সমুদ্র আর সাদাত চৌধুরী সবাই মিলে উপরের মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করে নেয়। সমুদ্র ও রবের নিকট শোকর আদায় করে আর প্রাচীর সুস্থতা কামনা করে।
সকালের আলো ফোটার পর পরই সমুদ্র সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় একপ্রকার জোর করে।
এর পরের তিনদিন টানটান উত্তেজনায় কেটেছে সমুদ্রের। ৬২ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু প্রাচীর হুঁশ ফিরে আসে নি এখনো। একটু আগেই কোহিনুর চৌধুরী আর সাদাত চৌধুরী এসে উপস্থিত হয়েছেন হসপিটালে। পিহু ও এসেছে সাথে করে। মায়ের কথা শুনতেই কান্না করতে করতে চোখ মুখ লালচে হয়ে গিয়েছে তার।

– “মিস্টার জুনায়েদ? প্লিজ কাম ইন মাই কেবিন!”
ডক্টর আয়েশার কথা শুনে সমুদ্র হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত এগিয়ে যায় কেবিনের দিকে।

– “মিস্টার জুনায়েদ, ৬২ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এখন পর্যন্ত মিসেস প্রাচীর সেন্স ফিরে আসে নি। এভাবে কোন ইমপ্রুভমেন্ট না হলে মিসেস প্রাচীর কোমায় চলে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি।”
ডক্টর আয়েশার কথা শুনে ঠিক কি রিয়্যাক্ট করবে তা বুঝে উঠতে পারে না সমুদ্র। একটু আগেও তো সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মাথা নাড়িয়ে ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে প্রাচীর কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সমুদ্র।

– “আমি জানি মেহু পাখি তুমি আমার কথা শুনতে পারছ! আমি জানি তুমি ঠিক আছো; প্লিজ চোখ খুলো! দেখ আমি, মা বাবা সবাই তোমার অপেক্ষা করছে। আমাদের বেবি! আমাদের বেবি ও তোমার ওয়েট করছে। এবার তো প্লিজ ফিরে আসো। আমি আর পারছি না তোমাকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ মেহু পাখি, প্লিজ!”
প্রাচীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সমুদ্র। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পেছনে ঘুরে তাকাতেই সাদাত চৌধুরীর মুখশ্রী চোখে পড়ে তার‌। সেও এগিয়ে গিয়ে সাদাত চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে।

বিকেল নেমে এসেছে। কেবিনের বাইরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। একটু আগেই কেবিনে নার্স গিয়েছে প্রাচীর চেকআপ করতে। হঠাৎ ই কেবিন থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে ডক্টর আয়েশা সহ নার্স।
– “মিস্টার জুনায়েদ, আপনার ওয়াইফের‌ জ্ঞান ফিরেছে।”
ডক্টরের কথা শুনে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সমুদ্র।
– “সত্যি ডক্টর? আমি কি দেখা করতে পারব আমার ওয়াইফের‌ সাথে?”
– “জি তবে বেশি কথা বলা যাবে না।”
ডক্টরের অনুমতি পেতেই দ্রুত কেবিনে প্রবেশ করে সমুদ্র। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল প্রাচী‌। পাশেই বাচ্চা দুটোকে রাখা হয়েছে দোলনাতে‌। কারো উপস্থিতি টের পেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রাচী। সমুদ্রকে দেখতে পেয়েই অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
– “স,স্‌,সমুদ্র!”
– “মেহু পাখি? তুমি ঠিক আছো? জানো কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি! তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় বারবার আমাকে ঝাপ্টে ধরছিল। এই মনে হচ্ছিল তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তাই না!”
– “সরি সমুদ্র! আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি চাইনি এমনটা হোক। সরি?”

প্রাচীর চোখ দুটো অশ্রুভেজা। ঠোঁট যুগল কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে আরো কিছু বলতে যাবে তখনই রুমে প্রবেশ করে নার্স সহ সাদাত চৌধুরী, কোহিনুর চৌধুরী। নার্স এসে দোলনা থেকে বাচ্চা দুটো কোলে নিয়ে প্রাচীর দিকে এগিয়ে যায়। প্রাচীও বাচ্চা দুটোতে দেখতে পেয়ে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেয়।
নিজের সন্তানকে প্রথমবারের মতো স্পর্শ করতেই তার চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

৮১.
– “মেহু পাখি?”
সমুদ্রের ঘোর লাগা কন্ঠ শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় প্রাচী। এই মানুষটা এমন সুন্দর কেন? তার ভালোবাসাই বা এত অদ্ভুত সুন্দর কেন?
– “হুম বলুন সমুদ্র!”
– “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ প্রেয়সিনী আমার জীবনটাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেয়ার জন্য। নিজের থেকে কোনোদিন আলাদা করো না আমায়। তাহলে যে আমার অস্তিত্ব ই বিলীন হয়ে যাবে। এই প্রাচী বিহীন সমুদ্র একদম শূন্য, অস্তিত্বহীন!
এই সায়াহ্ন মাখানো আকাশকে সাক্ষী রেখে বলছি আজীবন ভালোবেসে যাব প্রেয়সিনী‌!”

সমুদ্রের কথা শুনতেই প্রাচীর ঠোঁটে সেই মায়াবী হাসি ফুটে ওঠে। আসলেই তো! এই মানুষটা তার সাথে থাকলে অনায়াসেই এক যুগ পার করে দেয়া যাবে।

– “আমিও ভালোবাসি প্রিয় আর আজীবন ভালোবেসে যাব!”
বলেই ধীরে নিজেকে সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে ফেলে প্রাচী।

“_গোধূলি রাঙানো মেঘমল্লার
ব্যস্ত নীড়ে ফিরে যাওয়া বিহঙ্গেরা;
মহাশূন্যের বিশালতার নিচে দুজন মানব মানবীর কিছুটা কোলাহল!
ঢল নামে দূর পশ্চিমা আকাশপানে,
ফুরিয়ে আসে যে সময়
তবুও থেমে যাক না কিছুটা;
এ তো যেন #সায়াহ্নেরই‌_প্রণয়!
(ইনায়াত আহসান)_”

জীবন হলো এমন একটা পৃষ্ঠার সংমিশ্রণ যেখানে একাকিত্ব, বিষন্নতা, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সবকিছুই থাকবে। তবে যদি ভালোবাসা পাওয়ার আশায় আপনি বাকি অংশ গুলো মুছে ফেলতে চান তাহলে কখনোই সম্ভব হবে না সেটা। তার চেয়ে বরং অনুভব করুন প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা অধ্যায়!
দেখবেন দিন শেষে আপনার ভালোবাসার মানুষটি ঠিক আপনার সাথেই রয়েছে।
এভাবেই না হয় বেঁচে থাকুক সব ভালোবাসা।

সমাপ্ত।

(আসসালামু আলাইকুম। 🌼
কেমন আছেন সবাই? দীর্ঘ একটা সময় পর সমাপ্তি ঘটল উপন্যাসটির। উপন্যাসটিতে সবকিছুর সংমিশ্রণ ই ছিল। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আমি মাঝে থেকে গ্যাপ দিয়েছিলাম কেননা আমার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল।
তবে যাই হোক লাস্ট মুহূর্তে এসে আমি শুধু এটুকুই আশা করব পুরো উপন্যাস পড়ে আপনাদের কেমন অনুভূতি তা সম্পর্কে দু চারটে লাইন লিখবেন।
আবার ইনশাআল্লাহ ফিরে আসব আপনাদের মাঝে। ততদিন ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤)