#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১৪
,
,
দরজা আটকে বসে আছি আমি।বাইরে আপার ডাক শোনা যাচ্ছে। রাতের খাবার জন্য আপা ডাকছে।শুভ সেই সকালেই প্রিতমকে তাড়িয়ে নিজেও অফিসে চলে গেছে।ফিরেছে কিনা আমি জানিনা।জানবোই বা কিভাবে?সকাল থেকে ঘরের দরজা আটকে বসে আছি আমি!কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার!
যেই প্রিতমের জন্য আমি বাড়ি ছেরেছিলাম,যেই প্রিতমের জন্য আমি এখনো অপেক্ষায় আছি তার সাথে কিনা কথাও বলতে পারলাম না?সামনাসামনি দেখেও তাকে আবার হারিয়ে ফেললাম?তাও আবার শুভর জন্য?কেনো করলো এমনটা শুভ?ও প্রথম থেকেই যখন জানতো আমি প্রিতমকে ভালবাসি,তারপরেও কেনো বিয়ে করলো আমায়?এখন আবার কেনো প্রিতমের সাথে এমন ব্যবহার করছে?
আমি মাথা চেপে ধরলাম দু-হাত দিয়ে।
মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রনা করছে।এতো চিন্তা করতে পারিনা আমি।কিন্তু আফসোস! সব দুশ্চিন্তাই সবসময় আমার পিছনে ঘোরে।
বাইরের দরজায় টোকার পরিমান বাড়ছে।আপা হয়তো ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে দরজায় জোরে জোরে বারি দিচ্ছে।
আমি কান চেপে ধরলাম খুব করে।
কারও ডাকে সাড়া দিতে চাইনা আমি।এই মুহূর্তে আমি একা থাকতে চাই।একা,থাকটা খুব দরকার।
নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো।
কিন্তু প্রিতম?তাকে তো হারিয়ে ফেললাম?কিকরে ফিরে পাবো আমি তাকে?
তার জন্য যে আমায় এ বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।
আমি চটজলদি উঠে দাড়ালাম।
রুমের পেছনের বেলকনিতে গিয়ে আশপাশটায় একবার কড়া নজর বুললাম।নাহ কেউ নেই এখানে।
তাড়াতাড়ি একটা শাড়ি নিয়ে এসে বেলকনির গ্রীলে আটকে নিচে ছেড়ে দিলাম।
শাড়িটা নিচে মাটির একটু উপরে ঝুলছে। এটা,ধরে নামলে আরামছে নিচে পৌছাতে পারবো আমি।
ভাবার সাথে সাথেই কাজে নেমে পরলাম।
সঙ্গে কিছুই নেই নি।এসব কিছুই শুভর কিনে দেওয়া জিনিস।ওর জিনিস আমি কেনো নেবো?যে কিনা আমার ভালবাসাকে আমার থেকে সেচ্ছায় আলাদা করেছে?তবুও কেন যেনো শুভর কথা ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ওর দুষ্টুমি গুলো মাথায় জেঁকে বসে আছে।
ভেতরটায় অজানা এক কষ্ট চিনচিন করে উঠলো।
তবুও আমি মনকে শক্ত করলাম।
এই মুহুর্তে আমি কারো কথা ভাববো না,কারও কথাই না।শুধুমাত্র প্রিতম ছাড়া।
সাবধানে নিচে নেমে আমি রাস্তায় এসে দাড়ালাম।
মানুষজনের পরিমান একেবারেই অল্প।
রাত অনেক হয়ে গেছে।নিজের প্রতি আমার এখন রাগ হলো খুব।এমন বোকামো আমি কিকরে করলাম?এই রাতে আমি প্রিতমকে কোথায়,খুঁজবো?
ওর ঠিকানাও তো জানিনা।
তবু হাটতে লাগলাম।ওই বাড়ি থেকে একবার যখন বেরিয়েছি তখন আর ফেরত যাবোনা।শুধু আপার জন্য মন খারাপ লাগলো।আমাকে কতো ভালবাসেন উনি!তাকে এভাবে কষ্ট দিলাম?আর শুভ,সেও কি কষ্ট পাবে?
পরমুহূর্তেই আমি মাথা ঝাড়া দিলাম।উহু,কষ্ট পাক শুভ,সে তো আমাকেও কষ্ট দিয়েছে,প্রিতমকেও দিয়েছে।তার বেলায়?
হাটতে হাটতে কিছুদুর এগোতেই কিছু বখাটে গোছের লোকদের দেখা গেলো।
রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে তারা আড্ডা দিচ্ছে।
আমি সামনে এগোনোর সাহস ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি।লোকগুলো আমার দিকেই ঘুরে তাকিয়েছে।মুখে তাদের বিশ্রী হাসি আর চোখে লোলুপ দৃষ্টি।
তাদের দৃষ্টি দেখেই গলা শুকিয়ে এলো আমার।সামনে তাকিয়েই একপা দুপা করে পিছে হটছিলাম।
লোকগুলো একে অন্যের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে কথা বিনিময় করলো।মুখের হাসি বিস্তৃত হলো।
ফটাফট আমার সামনে এসে দাড়ালো সবাই।বললো,
—কি গো সুন্দরী? একা একা কই যাও?
আরেকজন বললো,
—সঙ্গী খুজছো নাকি?এতো কষ্ট করে খোঁজার কি দরকার? আমরাও তো হতে পারি সঙ্গী। তো কিসের সঙ্গী চাই,চলার সঙ্গী? নাকি বিছানা সঙ্গী?
সাথেসাথে সবগুলো জোরে জোরে হাসি শুরু করলো।
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি।পা যেন আটকে আছে এখানে।নড়ার শক্তিও পাচ্ছিনা।তবে মন বলছে এখান থেকে আমায় পালাতে হবে,সামনে খুব বিপদ!
আর কিছু না ভেবেই আমি উল্টো পথে দৌড়ে যেতে লাগলাম।পেছনে লোকগুলো আসছে নাকি জানিনা,পেছনে তাকানোর মতো সময় পাইনি।শুধু জানি আমায় পালাতে হবে।নিজেকে বাঁচাতে এখান থেকে দুরে যেতে হবে।
গলি পেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায়,এসেছি জানিনা।
তবে বুঝতে পারছি লোকগুলো আমার পেছনে আর নেই।পেছনে তাকিয়ে আরেকবার চোখ বুলিয়ে সিওর হয়ে নিলাম।
দাড়িয়ে বড়সড় হাফ ছাড়লাম।
অন্তর আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।এর আগে তো একবার শুভ আমায় বাঁচিয়েছিলো,কিন্তু আজ কি হতো?কে বাচাতো আমায়?
ভাবতে ভাবতেই চোখ গেলো সামনে রাখা গাড়ির ওপর।
রাস্তার ওপারে একটা ক্লাব। তার সামনেই অনেক গাড়ি পার্ক করে রাখা।তবে সব গাড়ির ভেতর একটা গাড়ির দিকে নজর পরলো আমার।গাড়িটি শুভর।কিন্তু সে এখানে কেনো?বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছে সে?
প্রচন্ড কৌতুহল হলো আমার।কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে ক্লাবে ঢুকে পরলাম।
ক্লাবের সামনে দেশি বিদেশী মদ সাজানো।মাঝে অনেকগুলো টেবিল বিছানো আছে।অনেকেই টেবিলে বসে নেশা করছে।
আমি অবাক হলাম খুব,শুভ এখানে আছে দেখে।
তবে তারচেয়েও বেশি অবাক হলাম শুভর সাথে প্রিতমকে দেখে।
আমি আড়ালে গিয়ে দাড়ালাম।
তাদের কথাবার্তা পুরোটাই আমার কর্নগোচর হলো।
শুভ টেবিলের ওপর মাথা রেখে ছিলো।তাকে কেমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো,চোখ লাল,শার্টের বোতাম খোলা।
সে করুন নয়নে প্রিতমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—পিহুকে ছেড়ে দেনা প্রিতম,আমাদের পেছন ছেড়ে দে প্লিজ! কেনো লেগে আছিস আমাদের পেছনে,কেনো?কি চাস তুই?
প্রিতম শব্দ করে হাসলো।কি অদ্ভুত ভয়ংকর হাসি।যে হাসির শব্দে শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে।আমি চমকে তাকালাম।
আমার প্রিতমের হাসি এতোটা ভয়ংকর?
প্রিতম বললো,
—ছেড়ে দেবো?এতো সহজেই?তোর মনে আছে শুভ?যেদিন প্রথম আমরা পিহুকে দেখেছিলাম?ওদের কলেজের নবীনবরন অনুষ্ঠানে। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিহিতা পিহুকে কি দারুণ লাগছিলো সেদিন!তোর চোখ বারবার ঘুরেফিরে ওর দিকেই পরেছিলো,তুই ছিলি পিহুর চোখের প্রেমে বিভোর হয়ে, আর আমি ছিলাম মুগ্ধ ওর খোলা পেটের!
তোর আর আমার মধ্যে এটাই পার্থক্য বুঝলি?তুই সাথে সাথেই আমাকে বললি তোর ভালো লাগার কথা,কিন্তু আমি রাখলাম মনের ভেতর।
তুই আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড মানলেও আমি কক্ষনো মাননি,উহু,কক্ষনোই না।
তোকে দেখে জ্বলতাম আমি বুঝলি?জ্বলতাম।
কেনো তুই সব ক্লাসে ফাস্ট হবি?কেনো সব মেয়েরা তোকে দেখে ফিদা হবে?কেনো সব সাফল্য তোর পায়ের দোরগোরায় কড়া নারবে?আমি কেন নই?
তাই যেদিন শুনলাম তুই পিহুর সাথে মেসেন্জারে কথা বলিস,সেদিন তোর আইডি হ্যাক করলাম।ততদিনে তোদের প্রেম মাখোমাখো পর্যায়ে।
আমি তুই সেজে কথা বলতে শুরু করলাম।তবে পিহু হয়তো কিছুটা সন্দেহ শুরু করেছিলো। তাই আমার নামটা বললাম।তোর ভুলটা কোথায় জানিস শুভ?তুই এতোদিন কথা বলেও নিজের নামটা পিহুকে কখনো জানাসনি,আর এই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমি।
নিজের নামটা বলে দিলাম।ও ভাবলো এতোদিন যার সাথে কথা বলেছে তার নামটা হয়তো প্রিতম,কিন্তু ও তো বুঝলোই না ও এতোদিন শুভকে ভালবেসেছে।নাম না জেনেই।
বলেই আবার শব্দ করে হাসলো সে।
শুভ শান্ত স্বরে বললো,
—কিন্তু এখন তো ও আমার বউ!
প্রিতম তাচ্ছিল্য মাখা হাসি হাসলো।
—আরে রাখ তো তুই!বউ!ও তোকে স্বামী হিসেবে মানেই না।আমি যতোটুকু জানি ওকে,ও আমাকে ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা।কাউকে না।
আমি বললে এক্ষুনি ও ছুটে তোকে ফেলে আমার কাছে চলে আসবে।
দেখতে চাস?
শুভ চুপচাপ বসে রইলো।হয়তো সে বুঝতে পেরেছে প্রিতমের কথার জোর আছে।
আমি পাশে দাড়িয়ে সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলাম।মাথাটা খুব ঘুরছে আমার।চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে চলেছে।
শুভর করুন মুখটা দেখে ভেতরে আমার সুনামি বইছে।
আমি কি সত্যিই এতোটা বোকা?এতোটা?নিজের ভালবাসার মানুষটাকে সামনে পেয়েও আমি চিনলাম না?এক ধোঁকাবাজ বেইমানকে ভালবাসার মানুষ ভেবে ভুল করলাম?
দাড়িয়ে থাকার শক্তি যেনো লোপ পেলো।মাথা ঘুরে পরতে গেলেই পাশের চেয়ার আকড়ে ধরলাম।
ধীরপায়ে পায়ে তাদের সামনে গিয়ে দাড়াতেই প্রিতম শুভ চমকে উঠে দাড়ালো।তারা হয়তো এখানে আমাকে মোটেও আশা করেনি।
শুভ এগিয়ে এসে বললো,
—তুমি এখানে কি করছো পিহু?
আমি তার কথার জবাব দিলাম না।শুভকে পাশ কাটিয়ে প্রিতমের সামনাসামনি দাড়িয়ে চোখে চোখ রাখলাম।
প্রিতম চোখ রাখতে পারছেনা।ভেতরে অন্যায় পুষে রেখে কেউ নির্দিধায় চোখে চোখ রাখতে পারেনা। সে নিজের পক্ষে হয়তো সাফাই গাইতে চাচ্ছিলো।কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তার গালে হাত রাখতে হলো।
নিজের সর্বশক্তি আমি তার গালে প্রয়োগ করলাম।
,
,
চলবে……