সুখের অ-সুখ পর্ব-০৩

0
488

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ তিন

হঠাৎ করে জ্বলতে থাকা জায়গা গুলোতে ঠান্ডা অনুভব হতেই চমকে উঠে সুখ।তার ব্যাথার স্থানে ব্যাথা দেওয়ার মানুষ তো অভাব নেই কিন্তু ব্যাথা দূর করার মানুষের যে ভীষণ অভাব।সেই অভাব হীনতার মরুভূমিতে এমন মলম লাগানোর মানুষ কে এলো?

সুখ অনুভব করলো একটা রুক্ষ শুষ্ক হাত অনবরত তার পিঠে,ঘাড়ে কিছু একটা মালিশ করে দিচ্ছে যার জন্য এতক্ষণ জ্বলে যাওয়াটা হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে গেলো। সুখের মনে পরলো এখনো তার বাড়িতে একজন মহিলা বাকি আছে যার রুচি থেকে এখনো সুখ নাম মানুষটা উগড়ে যায় নি।ষাটোর্ধ্ব মনোয়ারা বেগম আজও সুখোবতীর সুখের আশায় দ্বার খুলে বসে থাকে।আজও নিজের কুঁচকে যাওয়া শরীর আর বার্ধক্যের ভাড় নিয়েও সুখকে সমস্ত দুঃখ থেকে আড়াল করতে চায়।তার দাদীজান আজও তাকে আগলে রাখতে চায় দুঃখ নামক বড় হিমালয় থেকে।

রুমে সুখ আর তার দাদী বাদে আরেকজনের উপস্থিতিও টের পায় সুখ কিন্তু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না।একটা বিশাল কামরায় নীরবতার জালে জড়িয়ে থাকে তিনটি মানুষ,তিনটি মানবী।একজন বয়সের ভাড়ে বৃদ্ধ প্রায়,একজন দুঃখের ভাড়ে ক্লান্ত আর,আরেকজনে পাপের ভাড়ে কুঁজো।

নীরবতা ভেদ করে অনেক বছরের জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মহিলাটা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো
-‘মাইয়া মানুষের জীবন মানেই খড়ঁকুটো, সময়ের স্রোতে গাঁ ভাসাইয়া চলতে হইব তাদের।কখনো মাইনা নিতে হইবো,কখনো মানাইয়া নিতে হইবো কিন্তু এই মাইনা নেওয়া আর মানাই নেওয়ার মাঝখানে যখন সমীকরণ অমিল হইয়া যায় তখন সেই স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানোই উচিৎ।তুমি সারাজীবন সব মাইনাই নিবা আর কেউ তোমার দিক দেখবো না হেইডা তো হইতে পারে না।মাইয়া বইলা কী বাঁচার শখ জাগে না? কহনো কহনো বাঁচার লাইগ্যা স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো উচিত। হ,হয়তো স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসাইয়া হাল শক্ত না রাখতে পারলে তুমি অথৈ জলে হাবুডুবু খাইবা হয়তো একসময় তলায় যাইবা গভীর সমুদ্রে কিন্তু যদি বিপরীতে গাঁ ভাসাইয়া কূল পাইয়া যাও তাইলে তুমিই রাজা।কি কইছি বুজছো সুখোবতী?’

সুখ কিছু বলে না দাদীজানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে।কথা গুলা জেনো সে অনুভব করতে ব্যস্ত।আচ্ছা দাদী স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো বলতে কী বুজিয়েছে? এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা? কিন্তু আদৌও সে টিকতে পারবে তো? স্রোতের বিপরীতে হাল শক্ত করে না ধরলে যে অতলে হারিয়ে যাবে।আচ্ছা এমন বাঁচা থেকে একবার নিয়ম ভেঙে নাহয় হারিয়েই গেলো আর নাহয় রাজার মতন বাঁচলো।

ঘরের মাঝে এবার রিনরিনে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।এই বিভীষিকাময় কালো আধাঁর রাতে এই কান্নাটা জেনো কেমন ভয়ানক শোনাচ্ছে।সুখ এই কন্ঠের অধিকারীাে চেনে।

দাদী এবার সুখের হাতটা ধরে উঠিয়ে বসালো,একটা কৌটা থেকে মলম টুকু বের সুখের হাতের মাঝে ঘষতে লাগলো আর সেখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলতে লাগল
-‘মাইয়া মানুষের অলঙ্কার কী জানো সুখোবতী? তার চরিত্র।সেই চরিত্ররে পরিষ্কার রাখতে হইবো পানির মতন।চাঁদ এত সুন্দর জিনিস কিন্তু আমরা চাঁদের মতন চরিত্র পরিষ্কার রাখার কথা কহনো বলমু না কারণ চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। পানির কোনো কলঙ্ক নাই কেবল আছে পবিত্রতা তাই পানির মতন রাখবা চরিত্র।আর যদি চরিত্রের থাইকাও তোমার কাছে অন্য কোনো জিনিস বড় হইয়া যায় তাহলে তোমার কাল বিলম্ব না কইরা সেই দিনই মইরা যাওয়া উচিত।গলায় কলসি বাইন্ধা পানিতে ঝাঁপ দেওয়া উচিত। শরীর যেমন বস্ত্রহীন নগ্ন তেমনই চরিত্রহীন নারী নগ্ন।এই নারীর বেঁচে থাকা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।’

সুখ চোখ তুলে এবার দাদীজানের দিকে তাকায়।অতঃপর তার খাটের সাথেই দাঁড়ানো লীলবতীর দিকে তাকায়।দাদী কখনোই তাকে এমন ধারা কথা বলবে না তাহলে দাদী কি লীলাবতীকে এসব বলছে? সুখ আৎকে উঠে, না না সে কলঙ্কীনি হোক কিন্তু লীলার শরীরে সেই তকমা লাগতে দিবে না।

সুখ কিছু বলার আগেই লীলাবতী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দাদীজান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং আরেক দফা মলম নিয়ে সুখের হাঁটুর মাঝে মেখে দিচ্ছে।সুখ অবাক কন্ঠে বলল
-‘দাদীজান তুমি ওসব কী বললে?’

দাদীজান পায়ের দিকে তাকিয়েই বলল
-‘তোমার থেইকা জীবনডা আমি বেশি দেখছি।আর এত বেশী কিছুই দেখছি যে মাঝে মাঝে অনেক কিছু প্রকাশ না করতে পারার কষ্টে মইরা যাইতে ম্যালা মন চায়।লীলাবতী সেদিন ডিম ভাজির গন্ধ শুইনা বমি করছিলো,কাইল যখন তোমার বিয়ের রান্নাবান্না চলছিলো তখনও মাংসের ঘ্রাণ শুইনা বমি করছে।গত পরশু অর্ধেক আমের আঁচাড় সে শেষ করছে।কি ভাবছো তুমি? চুল গুলা আমার বাতাসে পাঁকছে? তোমার চেয়ে বেশি এই দুনিয়া দেখছি তাই “ক” কইলে কলকাতা বুঝি।’

সুখ জেনো এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো না।দাদীজান সবটা বুঝতে পেরেছে? যাক অন্তত এই মানুষটা টাকে ভুল বুঝে নি।

সুখ দাদীকে জড়িয়ে ধরে।দাদীর শরীর থেকে কেমন জেনো একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসে।আচ্ছা এটাকেই কী মা মা ঘ্রাণ বলে?

সুখ দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল
-‘দাদী এই মিথ্যে অপবাদ টা কে ছড়ালো গো?’
-‘আমি জানিনা।হঠাৎ কইরাই বাড়িতে গুঞ্জন উঠলো তুমি নাকি পোয়াতি। আর তারপরই তোমার ডাইনী মায়ের অত্যাচার।’

সুখ আর কিছু বললো না কেবল ছোট্ট শ্বাস ফেলল।কে করেছে এই নিকৃষ্ট কাজ?কার এতে লাভ?

দাদী সুখের মাথাটা বুলিয়ে দিয়ে বলে
-‘এত মাইর খাইয়াও তুমি প্রতিবাদ করো না ক্যান?আমি তো বুড়া মানুষ, কয়দিন পর কবরে চইলা যামু তাই ঝামেলা করতে ভয় হয় যদি বাইর কইরা দেয় কিন্তু তুমি তো মাত্র যৌবনে পা দিছো নিজের হইয়া প্রতিবাদ করতে পারো না? এখনকার যুগের মাইয়া হইয়াও এসব সহ্য করো?জানো তোমার দাদাজান অনেক খারাপ মানুষ আছিলো।হেই অহন মইরা গেছে এইসব কওন ভালা না কিন্তু তোমার লাইগা কইতাছি।তোমার দাদাজানের কর্মের জন্যই তো তোমার এ’দশা।সে-ই তো তোমার বাপেরে বিয়ার আসর থেইকা তুইলা আনছিলো।টাকার লোভ আর নারীর লোভ ছিলো তার প্রচুর।”যে পুরুষের নারীর প্রতি থাকে ঝোঁক,সে পুরুষ কোনো নারীর না হোক” সেই পুরুষ মানুষ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো।যখন তোমার ফুপি পেটে তখন শুনি সে আরেকটা বিয়া করবো তারপর আমি ঝামেলা কইরা আমার বাপের বাড়ি চইলা আহি। হেই আমলে এত গুলা ছেলেমেয়ে লইয়াও যদি আমি এমন প্রতিবাদ করতে পারি তাইলে তুমি পারবা না কেন?’

সুখ নিস্তেজ কন্ঠে বলল
-‘কারণ তোমার বাবার বাড়ি নামক জায়গা টা শক্তি ছিলো আর আমার সেটা দুর্বলতা।’

মনোয়ারা বেগম আর কোনো কথা বললেন না।সুখের পাশে শুয়ে পড়লেন।সুখ বৃদ্ধ দাদীর উষ্ণ বুকে মুখ গুঁজে রইল একটু শান্তির খুঁজে।এই সম্বলহীন বৃদ্ধাই যে এই তরুণীর সম্বল।

দরজার বাহিরে এমন দৃশ্য দেখে কেউ একজন অনুশোচনায় কেঁপে উঠলো।সুখোবতীর সুখের বীজটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে তো সেই।নিজের কাছের মানুষের পাপ ঢাকতে এক আকাশ সমান পাপ সে করে ফেলেছে।

_________

মাথার উপর সূর্য যখন তার উত্তপ্ত তেজ ঝাড়তে ব্যস্ত তখন সেই তেজী সূর্যের নিচে থাকা এক নিস্তেজ মানবী তার জীবনটা আবার স্রোতের বিপরীতে ভাসানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত।

দু’তলার রুমটা দিয়ে বাড়ির উঠানটা খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে।কাল এখানেই বাবার লাশটা রাখা ছিলো।হঠাৎ বুকের মাঝে চিনচিনে কষ্ট হানা দিলো সুখের।তার এই পৃথিবীতে কেহ নেই।হঠাৎ সুখের পাশে তার ফুপি লিলুয়া এসে দাঁড়ালো।

সুখ ফুপিকে দেখে চোখের জলটা মুছে ফিরে তাকালো।লিলুয়া পরম যত্নে ভাইয়ের মেয়ের চোখটা মুছে আলতো হাতে মুখটা দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলল
-‘কাঁদছিস কেন সুখপাখি? তোর বাবা নেই তো কী হয়েছে এই যে আমি আছি।তোর দাদী আছে।পৃথিবীতে তুই একা নেই।কিন্তু তোর গর্ভে যে শিশুটা বড় হচ্ছে তার কী হবে? বাবা বিহীন সে এই পৃথিবীতে আসবে কী পরিচয়ে?’

সুখের কলিজায় কথা গুলো তীরের মতন লাগে।যে কলঙ্ক সে করে নি সেই কলঙ্কের কালি দিয়েই তার সারা শরীর লেপানো। পরক্ষণেই আরেকটা কথা তার মাথায় আসে,সত্যিই তো তার না হোক লীলাবতীর সন্তানের কী পরিচয় দিবে সে?খুব দ্রুতই মসৃন যে জায়গায় থাকে সেখানে যেতে হবে।লীলাবতীর সন্তানকে পরিচয় দিতে হবে।

সুখ তাড়াতাড়ি নিজের উড়না টা নিয়ে শরীরে জড়িয়ে টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে যেই না ঘর থেকে বের হতে যাবে অমনিই তার ঘরের সামনে হাজির হয় তার ফুপাতো ভাই রেদোয়ান।সুখ আকষ্মিক রেদোয়ানকে দেখে থমকে যায় অবাক কন্ঠে বলে
-‘আপনি?’

রেদোয়ান বাঁকা হেসে ফিসফিস কন্ঠে বলল
-‘তোমার সর্বনাশ দেখতে এলাম সুখপাখি।মা যখন বলল তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে, আর তুমি গর্ভবতী বিশ্বাস করো নিজেকে এত খুশির সময় আর আটকে রাখতে পারলাম না।চলে আসলাম তোমার বিধ্বস্ততা দেখতে।’

সুখ দু’কদম পিছিয়ে যায়। এই যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুশ্রী হৃদয়যুক্ত মানুষটা তার ফুপির ছেলে।মানুষ না জেনো জানোয়ার।

ততক্ষণে সুখের ফুপি এগিয়ে এসে বলল
-‘কোথায় যাচ্ছিস সুখপাখি? আর রেদোয়ান তো কাল বিকেলেই এসেছিল তুই তখন রুমে ছিলি বিধায় দেখিস নি।’

সুখ থমকে গেলো।দুঃখ বুঝি কম ছিলো যে নতুন করে আরেকটা দুঃখ হাজির হলো?

#চলবে