সুখের নেশায় পর্ব-১২+১৩

0
381

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১২

ক্লান্ত দুপুর। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ নিয়ে মিম হেলেদুলে হেঁটে চলেছে। কলেজের জন্য নির্ধারিত সাদা ইউনিফর্ম টা ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে দেহে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বড্ড অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। হাঁটছে আর কিছু সময় পর পর টিস্যু দিয়ে ব্যস্ত হাতে ঘাম মুছে চলেছে। কিছু দূর হতে একটা ভারি কন্ঠ শোনা গেল।
‘ এই মেয়ে!’
পা দুটো থেমে গেল মিমের। কিন্তু পিছনে তাকালো না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে রাস্তায় অনেক মানুষের চলাচল। এই মেয়ে বলে কে ডাকল বা কাকে সম্বোধন করল কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই না দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। নয়ত রোদে পুড়ে শুঁটকি হতে সময় নিবে না সমস্ত শরীর। পূর্বের ন্যায় আবারও কানে ভেসে আসে।
‘ এই মেয়ে!’
তবে এবারের ডাকটা আগের থেকে জোরে ছিল। কন্ঠে ছিল তেজ। মিম পিছনে ফিরে তাকালো। দেখল দিহান গাড়ির পাশে দাড়িয়ে অনবরত ডেকে যাচ্ছে এই মেয়ে বলে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। দিহান যে তাকে এমন করে ডাকছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দিহান এগিয়ে আসছে না। অলসের মতো দাড়িয়ে চেয়ে আছে। বাধ্য হয়ে মিম হেঁটে এল কিছুটা কাছাকাছি। অবিশ্রান্ত নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে? এভাবে ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করছেন কেন?’
দিহান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ কি আমি ছাগলের মতো ডাকি?’
‘ অবশ্যই। ছাগলের ডাকও আপনার ডাক থেকে সুন্দর। ‘
‘ যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। দেখতে পিচ্চি অথচ বেয়াদবি তে সেরা।’
মনে চেপে রাখা রাগ তড়তড় করে বেড়ে উঠল মিমের। চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘আমি বেয়াদব?আর আপনি ভালো? আপনার মা ভালো তাই না?ভালো মানুষ যে অন্যদের আঘাত করে কথা বলে তা তো জানতাম না। আর আমি পিচ্চি অথবা এই মেয়ে না। আমার নাম মিম। কল মি মিম।’
মিমের কথার ধাঁচে যে তীব্র রাগ সেদিনের জন্য, তার মায়ের চৈত্রিকা কে অপমান করার জন্য তা অনায়সে ধরে ফেলল দিহান। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘ তো তোমার নাম মিম,ডিম। রাইট?’
‘ ডিম???হু ইজ ডিম?আপনাদের বাসায় ডিমের অভাব পড়েছে। রাস্তাঘাটে ডিম খুঁজতে বের হয়েছেন। তাই তো আমার নাম কে ডিমের সাথে গুলিয়ে ফেললেন। এটা শহর। গ্রাম নয় যে পুকুর পাড়ে অথবা ঝোপঝাড়ে হাঁস-মুরগি ডিম পাড়বে।’
মিমের রোষপূর্ণ কন্ঠের উপহাসে দিহান মনে মনে বললো,
‘ ধানিলংকা। আম্মুর এই মেয়েকেই পছন্দ করতে হলো?জীবন ছাড়খাড় করে দিবে একদম। ‘
মিম দিহানের কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তেতে উঠে বললো,
‘ কিসের জন্য ডেকেছেন?আবার এই রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে মাথা গরম করে দিচ্ছেন। অসহ্য তো আপনি!’
‘ অসহ্য কেই সহ্য করতে হবে তোমার।’
‘ কি?’
‘ কিছু না। গাড়িতে উঠো। বাসায় পৌঁছে দিব।’
‘ নো নিড। আমার দু’টো পা আছে। ‘
‘ দু’টো পা আছে তা আমিও দেখতে পাচ্ছি। আমারও দু’টো হাত আছে। যেতে না চাইলে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে উঠাবো নয়ত কোলে তুলে।’
দিহানের কথা কর্ণপাত হতেই মিমের চক্ষুজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। নাক ফুলিয়ে বললো,
‘ অসভ্য লোক।’
‘ আই নো। চলো এখন। নয়ত রোদে কালো হয়ে যাবো। পড়ে তো কালো বলে রিজেক্ট করে দিবা।’
দিহানের অকপটে সগতোক্তি তে মিমের রাগের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ। এই সুদর্শন ছেলেটা কে তার একটুও ভালো লাগে না। দেখলেই মস্তিষ্কে রাগ চাপে। দিহান কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাঁটতে শুরু করল। দিহান উঁচু আওয়াজে বলে উঠল,
‘ থামো বলছি। কিছু রাস্তা গিয়ে তো বেহুঁশ হয়ে যাবে। শরীরের যা অবস্থা। মনে হয় না খাবার খাও। পরে কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না। তাই ভালো ভালোই বলছি ফিরে এসে গাড়িতে বসো। সবে তো কলেজ থেকে বের হলে। আরো এক ঘন্টার রাস্তা তোমার বাসায় যেতে। নয়ত কোলে নেওয়ার জন্য আমি একদম প্রস্তুত।’
মিম পা দু’টো থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ ভালো হয়ে যান। এতে রাস্তা ঘাটে জুতা পে/টা খাও/য়ার হাত থেকে বেঁচে যাবেন।’
‘ কেউ জিজ্ঞেস করল বলব পিচ্চি টা আমার বউ হতে চায়। জোর করে আমার কোলে উঠেছে। তখন লোকে জুতা পে/টা নয়।বরং লাজুক লাজুক হাসি হাসবে।’
মিথ্যে মিথ্যে অপবাদ শুনে হতবুদ্ধি মিম। শরীর টা বড্ড ক্লান্তিতে ভরপুর। মাথা ব্যাথা করছে। গাড়ি করে যাওয়ার জন্য চৈত্রিকা ভাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা বাচিয়ে হেঁটে বাসায় যায় আজকাল মিম। সে চায় না আরাম আয়েশে বোনের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকা নষ্ট হোক। মন তো বলছে দিহানের কাছ থেকে লিফট নিয়ে নিতে। কিন্তু রাগ টা যে কমছে না। দিহান বড় বড় পা ফেলে কাছে এলো। গলার স্বর নরম করে বললো,
‘ চলো। তর্ক অন্যদিন করো। আজ তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। ‘

সত্যিই শরীর টা খারাপ লাগছে। কথা না বাড়িয়ে মিম গাড়িতে গিয়ে বসল। দিহান কে কেন যে ভালো মনে হলো এক মুহুর্তের জন্য। পরমুহূর্তেই ওর মায়ের কথা মনে বিষ ঢেলে দিল। মিমের কাছে দিহান অপছন্দের মানুষ কেবলই তার মায়ের চৈত্রিকা কে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে। ড্রাইভিং সিটে বসে দিহান একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয়। মিম এক পলক তাকিয়ে বিনা বাক্যে বোতল টা হাতে নিয়ে নিল। কয়েক ঢোক পান করে রেখে দিল গাড়িতে। কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন ছুড়ল দিহানের দিক।
‘ আপনি তো মনে হয় সামনে কোথাও যাচ্ছিলেন। আবার আমার জন্য উল্টো যাচ্ছেন কেন?’
‘ অফিসে যাচ্ছিলাম। কলেজ গেইটের দিকে নজর পড়তেই দেখলাম তুমি হেঁটে যাচ্ছো। কিছুটা সিক মনে হচ্ছিল। ভাবলাম বাসায় পৌঁছে দেই।’

মিম আর কোনো কথা বলল না। চুপ করে মাথা হেলিয়ে দিল সিটে। দৃষ্টি বাহিরের দিকে। ইট পাথর কোলাহলের ভিড় চারপাশে। সবুজ গাছপালার দুস্থিতি পড়েছে যেন। মাঝে মাঝে এক দু’টো দেখা যায়। মিমের ভালো লাগে না এই শহর৷ এই শহরের এতো কোলাহল।

চৈত্রিকা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিষন্ন মন নিয়ে। ভিতর জুড়ে প্রলয় হচ্ছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। বাবা-মার মুখের দিকে চেয়ে বুকে পাথর তো চেপেছে কিন্তু এখন কোনো রকমেই শান্তি পাচ্ছে না। শেষ কবে শান্তি অনুভব করেছিল মনে আছে চৈত্রিকার। ওই গভীর রাতে রিকশায় পাশাপাশি বসে সাফারাতের সাথে কাটানো সময়টা ছিল সুখের,শান্তির।
চৈত্রিকা বাড়িওয়ালার জন্য অপেক্ষা করেছিল এতক্ষণ গেইটের কাছে। তিনি রেগুলার একবার আসেন এ বাড়িতে। একটু আগেও এসেছিলেন। চৈত্রিকা ভেবেছিল আজ হয়ত ওদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু তার চিন্তা নিঃশেষ করে দিয়ে বাড়ির মালিক জানান-তার যখন মন চায় ভাড়া দিলে হবে। নিস্তব্ধ হয়ে যায় চৈত্রিকা এ কথা শুনে। যেই লোক গতকাল অব্দি থ্রে/ট দিয়েছে ভাড়া না পেলে ধা/ক্কা দিয়ে বের করে দিবে,সেই লোকই বলছে যখন ইচ্ছে দিলেই হবে। কথাটা ঠিক হজম করতে পারে নি চৈত্রিকা। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বাড়িওয়ালা তাড়া দেখিয়ে প্রস্থান করে। তখন থেকেই ঠাঁই দাড়িয়ে আছে সে। টিউশনির সময়ও হয়ে এসেছে। গেইটের সামনে একটা গাড়ি থামতেই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিম। তা দেখে চৈত্রিকার অবাকতা যেন আকাশচুম্বী। অপরপাশ হতে দিহানও বেরিয়ে এসেছে। আচমকা বোন কে দেখে মিম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভাব ঠিক চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার অবস্থা। চৈত্রিকা স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ দিহান ভাইয়ার সাথে আসলি যে?তোকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। ‘
‘ তার জন্যই তো তোমার বোন কে জোর করে নিয়ে এলাম। আমার গাড়ি করে আসতে রাজি হচ্ছিল না।’
সহজ গলায় বললো দিহান। চৈত্রিকা ঠোঁট ছড়িয়ে প্রতুত্তর করে,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া। মিম বাসায় যা।’

মিম মাথা দুলিয়ে চলে গেল। দিহান সেদিক থেকে নজর সরিয়ে চৈত্রিকার দিকে চেয়ে বললো,
‘ স্যরি চৈত্রিকা। আমার মায়ের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত আমি।’
চৈত্রিকা অস্বস্তিতে পড়ে গেল তৎক্ষনাৎ। দিহান হুট করে এমন বলে বসবে ভাবে নি সে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
‘ স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। আমার আন্টির প্রতি কোনো রাগ নেই। ‘
এতটুকু বলে ক্ষীণ শ্বাস ফেলল। থেমে থেকে দ্বিধান্বিত চাহনি নিয়ে বললো,
‘ সাফারাত সন্ধ্যায় বাসায় থাকে ভাইয়া?’
‘ থাকে। তোমার জন্য চব্বিশ ঘণ্টাই ফ্রী।’
‘ জ্বি?’
‘ কিছু না। চলে যেও। আসি আমি।’
কথাটা বলে দিহান গাড়িতে উঠে পড়ল। চৈত্রিকা ডুবে গেল ভাবনায়। সাফারাতের বাসায় দ্বিতীয় বার পা রাখবে কি-না তা ভেবে।
_________________

একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে। দারোয়ান তাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সন্ধ্যে বেলার আবছা রক্তিম আলোয় পিছন দিকটা অস্পষ্ট। চৈত্রিকা থম মেরে রইল। মেয়েটাকে ঢুকতে দিচ্ছে না তাকে দিবে তো!নাকি আবার অপমান করবে?কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল মেয়েটা দারোয়ান কে থ্রে/ট দিচ্ছে। চাকরি খে/য়ে দিবে বলে রাগ দেখাচ্ছে। কন্ঠে তেজ,অহংকার। দারোয়ান বলছে– সাফারাত স্যার আপনারে ঢুকতে দিতে নিষেধ করছে ম্যাম। আপনে চইলা যান। মেয়েটা ত্যাড়ামি করে পাল্টা বলে উঠল-
‘আমার মামার বাড়ি আমাকে ঢুকতে দিবি না। দেখে নিব তোদের। সাফারাত নিজেই আমাকে নিবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’

মেয়েটা সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গাড়িতে উঠে চলে গেল। এবার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেল চৈত্রিকা। এটা তো তাকে থাপ্পড় দেওয়া সেই মেয়েটা। এ বাড়ির সদস্যই তো মনে হয়েছিল। কিন্তু তাকে ঢুকতে দিতে নিষেধ কেন করল সাফারাত!অবাক ব্যাপার। চৈত্রিকা মাথা না ঘামিয়ে গেইটের কাছে যেতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিল। জিজ্ঞেস অবধি করল না কিছু। এটাই চৈত্রিকাকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। চমকপ্রদ দৃষ্টিতে গুটি গুটি পায়ে ভিতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা গম্ভীর স্বর কর্ণগোচর হতেই মৃদু কেঁপে উঠল পুরো দেহ।
‘ ভিতরে ঢুকে সোজা সিঁড়ি বেয়ে বাম দিকের প্যাসেজওয়ে ধরে কর্ণারের রুমে চলে আসবেন । আপনাকে কেউ আটকাবে না।’

চৈত্রিকা চোখ তুলে তাকাল উপরের দিকে। সাফারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কানে মোবাইল। বুঝতে পারছে না তাকে বললো নাকি অন্য কাউকে। সাফারাত যেন তার দ্বিধান্বিত চাহনি বুঝে গেল। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে চৈত্রিকার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ আপনাকেই বলছি চৈত্র। ‘

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১৩

ড্রইং রুমে কয়েকজন সার্ভেন্ট উপস্থিত। তারা সকলে যার যার কাজে মগ্ন। চৈত্রিকা পুরো বাড়ি জুড়ে এতো নিরবতা দেখে প্রচন্ড অবাক,নিস্তব্ধ। ধীর পায়ে ভীত সন্ত্রস্ত মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। অতঃপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে বাম দিকের প্যাসেজওয়ে ধরে সাফারাতের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। অজানা কারণেই বুক টা ক্ষীণ ক্ষীণ কাঁপছে তার। পা দুটো ভেঙে আসছে। কঠিন হয়ে পড়ছে দাঁড়িয়ে থাকা। দরজা হালকা ভেজানো। নক করবে নাকি সরাসরি ঢুকে যাবে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে মন। সংকোচবোধ কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। শুষ্ক ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে হাত উঠিয়ে নক করার জন্য উদ্যত হওয়া মাত্র দরজা খুলে গেল। তাল হারিয়ে হাত গিয়ে ঠেকে কারো বুকে। নিমিষেই নিঃশ্বাস আঁটক যাওয়ার উপক্রম চৈত্রিকার। নির্নিমেষ চেয়ে থাকল নিজের হাতের দিকে,যা এই মুহুর্তে কারো বুকে অবস্থান করছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে কপোল। গরম নিঃশ্বাস তার সারা মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ বেড়ে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে। সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তির কর্ণকুহরেও হয়ত পৌঁছে যাচ্ছে শব্দগুচ্ছ। ঝটপট হাত টা সরিয়ে আনল চৈত্রিকা। মাথা না তুলেই বললো জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,

‘ স্যরি। আসলে আমি বুঝতে পারি নি আপনি হুট করে এসে দরজা মেলে দিবেন। ‘
সাফারাতের অভিব্যক্তি এতো সময় অব্দি স্বাভাবিক থাকলেও,এখন বিরক্তি জেঁকে ধরেছে। নত মস্তকে থাকা চৈত্রিকার দিকে চেয়ে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,
‘ মাথা উঠান তো।’
‘ জ্বি?’
‘ মাথা উঠান। আমার দিকে তাকাবেন৷ চোখ সরাবেন না একদম।’

ভড়কে গেল চৈত্রিকা। মাথা উঠিয়ে সাফারাতের দিকে তাকালো। কিন্তু চোখ রাখতে পারছে না। দৃষ্টি বারংবার এলেমেলো,অবিন্যস্ত হয়ে পড়ছে। গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমেই।

সাফারাত চৈত্রিকার হাত টেনে ধরল। বড় বড় নেত্রে তাকালো চৈত্রিকা। কিন্তু তোয়াক্কা করে নি সাফারাত সেই দৃষ্টি। টেনে রুমে নিয়ে এলো চৈত্রিকাকে। একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। দুই দিকের হাতলের উপর দুই হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে চৈত্রিকার কাছাকাছি,অতিশয় নিকটস্থে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া থেমে গেল চৈত্রিকার ক্ষণিকের জন্য। শ্বাস ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ। অধর যুগল কাঁপছে তিরতির করে। সাফারাত না চাইতেও দৃষ্টি আঁটকে গেল কম্পমান গোলাপি ঠোঁট জোড়ায়। এক নিদারুণ যন্ত্রণায়,মাদকতায় বদ্ধ হতে শুরু করে মন। দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে মেলে ধরল। পরক্ষণেই চৈত্রিকার মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল,

‘ আমি কি আপনার প্রেমিক চৈত্র? ‘
সাফারাতের প্রশ্নে চৈত্রিকার বুক টা ধুক করে উঠল। মন বললো,প্রেমিক হলেও পারতেন। সাফারাত হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করল চৈত্রিকা ঠাওর করতে পারছে না। মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। সাথে সাথেই কর্ণে প্রবেশ করল সাফারাতের গাঢ়,মাদকতাময় স্বর।

‘ তাহলে এতো সংকোচ কেন আমার সাথে?মানুষ তো প্রেমিকের সাথেও জড়তা-সংকোচ অনুভব করে না। আমি তো আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড। তবে আমার সাথে ইজি হতে পারছেন না কেন?আমাকে আবার প্রেমিকের নজরে দেখছেন না তো?’

সাফারাতের নিরলস কথায় চৈত্রিকার অভ্যন্তরে প্রকান্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চেহারায় অস্থিরতা লুকিয়ে,দুই ঠোঁট প্রসারিত করে বললো,
‘ আপনাকে প্রেমিক প্রেমিক নজরে দেখতে যাবো কেন?আমার কি এতোই দুর্দিন এসেছে?’
নিমিষেই সাফারাত আরেকটু ঝুঁকে গেল। দু’জনের ওষ্ঠ প্রায় ছুঁই ছুঁই। চৈত্রিকার চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ে এসে সাফারাতের মুখে পড়ছে। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সাফারাত। এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,
‘ তাহলে কাকে দেখবেন?’
‘ নিজের বর কে দেখব। বিয়ের পর বর তো আমার প্রেমিকই হবে।’

সাফারাত চৈত্রিকার কাছ হতে সরে গেল। সোজা হেঁটে গিয়ে দরজার কাছে পড়ে থাকা ব্যাগ টা হাতে তুলে নিয়ে রুমে এলো। চৈত্রিকা ঘাবড়ে গিয়ে ব্যাগ টা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল। এতে জ্যাকেট দু’টো। চৈত্রিকা সেদিকে অপলক তাকিয়ে থেকে বললো,
‘ আপনার জ্বর সেড়েছে? ‘
‘ কাছে আসুন।’
সাফারাতের দৈবাৎ,আদেশমূলক বাক্যে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল চৈত্রিকা। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
‘ মানে?’
‘ আসলেই বুঝবেন।’
চৈত্রিকার সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। বক্ষস্থল কেঁপে কেঁপে উঠছে। শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে হৃদপিণ্ডে। টলমলে পায়ে সাফারাতের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। নিমেষে একটু ঝুঁকল সাফারাত। কপাল বাড়িয়ে দিয়ে ভরাট কন্ঠে আওড়ালো,
‘ নিজে চেক করে নিন।’
নিজের কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে সাফারাতের কপালে ঠেকাল চৈত্রিকা। মুহুর্তেই শরীরে ঝংকার অনুভব করে। হাত নামিয়ে নিম্নস্বরে বলে,
‘ জ্বর নেই। ‘
সাফারাত দুর্বোধ্য হাসলো। হাস্যরসাত্মক কন্ঠে বলে উঠল,
‘ পাক্কা একটা দিন পর আপনার ইচ্ছে হলো জ্বরের কথা জানতে?আপনার কাছে আমার নাম্বার ছিল। চাইলেই একটা কল দিয়ে খোঁজ নিতে পারতেন। কল না হোক এট লিস্ট একটা মিসডকল দিতেন,আমি ব্যাক করতাম। আপনি ঠিক আগের মতোই রয়ে গেলেন চৈত্র। আজও আমি আপনার জীবনের অবহেলিত অংশে বিরাজমান। ‘

সাফারাতের রহস্যময় কথার মানে বুঝতে অক্ষম চৈত্রিকা। অবহেলিত কেন বললো?সাফারাত তো তার জীবনের সবটুকু অংশ জুড়ে বসবাস করছে বছরের পর বছর। নিজের অনুভূতি ব্যক্ত না করতে পারার কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে চৈত্রিকাকে। প্রতিনিয়ত ইচ্ছে হয় সামনে দাঁড়ানো মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলতে-‘ ভালোবাসি আপনাকে সাফারাত। ‘
কিন্তু তা যে অসম্ভব। ভিতরকার সত্তার কাছে হেরে যায় বারংবার। অবক্ত থেকে যায় অনুভূতি। চৈত্রিকার এই মুহুর্তে নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল,

“রাত্রিভর স্বপ্ন দেখে
ভোর সকালে ক্লান্ত।
যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা,
সে যদি তা জানত!”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে চৈত্রিকা একটু পিছিয়ে গিয়ে বললো,

‘ কি বলছেন আপনি সাফারাত? ‘
‘ এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ান। আপনার হাতের চা টা ভীষণ ভালো। সুখ সুখ অনুভূতি দেয় ‘

সাফারাতের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় নির্বাক চৈত্রিকা। সাফারাত কে তার চা খোর মনে হচ্ছে। ছোট্ট করে প্রশ্ন করে,
‘ আমি আপনার বাসায় চা বানাবো?’
‘ অভ্যেস করে নেন।’
প্রতুত্তরে চৈত্রিকার চেহারায় একরাশ বিস্ময় ফুটে উঠল। অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করল,
‘ কি?’
‘ তাড়া না থাকলে এক কাপ করে দিন প্লিজ। পারলে দু কাপ। মাথা টা ধরেছে খুব। বাসায় কেউ নেই। লজ্জা পাবেন না। দাদী ও কাজিন সিলেট গিয়েছে গ্রামের বাড়িতে। চাচা চাচী পুলিশ স্টেশন। আর দ্বিধা নেই তো?’
‘ পুলিশ স্টেশন কেন?’
‘ চাচাতো ভাই জেলে বেড়াতে গিয়েছে তাই।’

চৈত্রিকার ঠোঁট দুটো আলগা হয়ে গেল আপনাআপনি। জেলখানায় বেড়াতে গিয়েছে?সিরিয়াসলি?সাফারাতের কথার ধাঁচ চৈত্রিকার দ্বারা বুঝা সম্ভব নয়। আবার কেমন অর্ডার দিচ্ছে চায়ের জন্য। মনে হচ্ছে যেন তার বিয়ে করা বউ। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চৈত্রিকা কিচেন রুমে এলো। অনেক বড় একটা কিচেন রুম। কোথায় কি রাখা কিছুই তো জানে না চৈত্রিকা। চারদিকে চোখ বুলাতেই কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে হুট করে উপস্থিত হলো। বয়স ষোলো কিংবা সতেরো হবে। মেয়েটা আড়দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো। অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,

‘ আপনি কি এই বাড়িতে নতুন চাকরি নিছেন আপা?আমার নাম মিনা। দাদীর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। এহন দাদী নাই তাই আজাইরা আছি। আহেন আপনেরে সব দেখাই দেই।’
চৈত্রিকা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। নম্রস্বরে বলে উঠল,
‘ দেখিয়ে দাও।’
মিনা এক এক করে সবকিছু বের করে দিল চা বানানোর জন্য। চৈত্রিকা চায়ের পানি বসিয়ে ভাবনায় পড়ে গেল। সাফারাত সবার কথা বললো। কিন্তু তার মা-বাবার কথা বলে নি। তারা কোথায়?সাফারাত তো বলেছিল তার মায়ের সাথে দেখা করাবে। কই এতো বছর পর তার বাবা-মায়ের ব্যাপারে একটা শব্দও তো উচ্চারণ করে নি। পাশে দাঁড়ানো মিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ আচ্ছা সাফারাতের বাবা-মা কোথায়?এই বাড়ির কাউকে দেখছি না যে।’
সঙ্গে সঙ্গে মিনা ভয়ার্ত চোখে চাইল। ফিসফিস করে বললো,
‘ আপা ভুলেও স্যারের বাপের নাম লইয়েন না। স্যার শুনলে ছাড়ব না আপনেরে। ওই লোকের কথা শুনলে স্যারের মাথায় রক্ত চাপে। ‘
চৈত্রিকা ভ্রুঁ যুগল কুঞ্চিত করল। হতভম্ব কন্ঠে বলে উঠল,
‘ কেন?’
‘ স্যার কইছে ওই বেডা নাকি স্যারের মা’র খু/নি। আমার আম্মা এই বাড়িত কাজ করত। আম্মার কাছ থেকে শুনছি স্যার বহুত কষ্ট পাইছে। মা’র লা/শ টাও দেখবার পারে নাই। আর এই বাড়িত কতডি অসভ্য বাস করে আপা। এডি স্যার রে একা পাইয়া আ/ঘা/ত করছে। স্যারের মা পোয়াতি আছিল ম/রা/র সময়ে।’

কারো পায়ের শব্দে চুপ মেরে গেল মিনা। কথাগুলো ভিতরে চেপে নিল। গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বের করল না। চৈত্রিকার মস্তিষ্কে শুধু এটাই ঘুরছে সাফারাতের মা মা/রা গেছে। চৈত্রিকা তার মা’কে কখনও না দেখলেও এটা জানত সাফারাত ঠিক কতটা ভালোবাসত মা’কে। কষ্টে ছেঁয়ে যেতে শুরু করে চৈত্রিকার অন্তর,মন। গম্ভীর একটা স্বর শোনা গেল তৎক্ষনাৎ,
‘ চা বানাতে বানাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন চৈত্র? ‘
চৈত্রিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সেই সাথে মিনা। দরজায় দাঁড়িয়ে সাফারাত মিনা ও চৈত্রিকার ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এনিথিং রং?’
মাথা নাড়িয়ে না করল চৈত্রিকা। সাফারাত স্বাভাবিক স্বরে মিনার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ মিনা ওর নাম চৈত্র। আমার কাছের মানুষ। বে,,’
সাফারাত কিছু বলার আগেই মিনা ফোঁড়ন কেটে বলে উঠল,
‘ আপা কি আমাগো ম্যাডাম? ‘
সাফারাতের সহজ সরল উত্তর,
‘ তোমাদের ম্যাডাম। তবে আপাতত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ‘
চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ চা নিয়ে ড্রইং রুমে আসবেন চৈত্র। ‘
সাফারাত চলে যেতেই মিনা মিনতির স্বরে বলে উঠল,
‘ আপা স্যার রে কিছু কইয়েন না। আমি যা যা আপনেরে বলছি। আমি জানতাম না আপনে স্যারের বন্ধু।’
চৈত্রিকার মনে হাজারো প্রশ্নের উদয় হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
‘ বলব না।’

চা নিয়ে ড্রইং রুমে যেতেই থমকে গেল চৈত্রিকা। মিহিতা বসে আছে সোফায়। সাফারাত একটা ফাইল চেক করছে। এই ভর সন্ধ্যায় মিহিতা তাকে সাফারাতের বাড়িতে দেখলে সন্দেহ করবে তাতে কোনো ভুল নেই।

#চলবে,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেক করা হয় নি।)