সুখের নেশায় পর্ব-৬+৭

0
440

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৬

‘ আমার মা হয়ত অজ্ঞাত ছিল নিজের হাতে আগলে রাখা পরিবারের শয়তানি মুখোশ হতে! দাদি ব্যাতিত কেউই ভালোবাসার হাত টা বাড়ায় নি আমার দিকে এই পরিবারের। এমন মানুষগুলোকে আম্মু নিজের ছায়াতলে জায়গা দিয়েছে যারা কি-না তার ছেলেরই প্রাণ কেঁড়ে নিয়ে দখল করতে চায় সর্বস্ব। ‘

দিহান সচকিত নয়নে তাকালো সাফারাতের মুখের দিকে। গাঢ় তমসায় আবছা আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পারছে না সে সাফারাতের চেহারাটা। তবুও সাফারাতের মুখভঙ্গি বুঝার আপ্রাণ চেষ্টা তার। বিষন্ন,মলিন কন্ঠে বললো,

‘ চৈত্রিকাকে সেদিন এভাবে অস্বীকার করা ঠিক হয় নি তোর সাফারাত।’

‘ তুই ওকে আমার বাড়ির এড্রেস দিয়ে ভুল করেছিস।’

‘ মেয়েটা প্রচন্ড আ/ঘা/ত পেয়েছে।’

সঙ্গে সঙ্গে সাফারাতের সুদীর্ঘ ভারি নিঃশ্বাস দিহানের কর্ণকুহরে এলো। মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসল সাফারাত। নিষ্প্রভ স্বরে প্রতিউত্তর দিল,

‘ তার চেয়েও অধিক আ/ঘা/ত আমি পাচ্ছি। প্রতিনিয়ত কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে আমার মন।’

‘ কলেজ জীবনের সেই অভিমান কে আঁকড়ে এত বছর দূরে থেকেও তো পারলি না থাকতে। ঠিকি চলে এলি ওর টানে। তাহলে এখন কেন আ/ঘা/ত করছিস ওকে?’

সাফারাত গাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রক্তিম দৃষ্টি তাক করল দিহানের পানে। ঠোঁট বাকিয়ে অল্প হেসে বললো,

‘ অভিমান আছে। তাই বলে ওকে আমার আ/ঘা/ত করার সাধ্য নেই।

পুনরায় গম্ভীর স্বরে বললো,

‘সেদিন নিরুপায় ছিলাম আমি। বিন্দুমাত্র কেউ আমার দুর্বলতা আঁচ করতে পারলে ওকে ছেড়ে দিত না। তবুও আমার জন্য ওর বাবার এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল। পৃথক সন্দেহের উপর ভিত্তি করেই ওকে আ/ঘা/ত করে, ওর পরিবার কে আ/ঘা/ত করে আমাকে ভেঙে দিতে চেয়েছে। তখন তো আমি জানতাম না আমার উপর দুইবার এট্যাক পৃথক করেছিল। তা আজ যখন জানলাম তখনই তুই জানালি চৈত্রর বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে তাও পৃথকের গাড়ির নিচে।’

দিহান সূক্ষ্ণ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আজ অফিস হতে ফেরার পথে সে নিজ চোখে দেখেছে একটা গাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে একজন লোক কে ধাক্কা দিয়েছে,যার ফলে লোকটা তাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় ছিটকে পড়ে। দিহান তড়িঘড়ি করে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসার আগেই গাড়িটা লোকটার পায়ের উপর চাপা দিয়ে চলে যায়। হতবিহ্বল, দিশেহারা হয়ে পড়ে দিহান। গাড়িটার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখে সাফারাতের চাচাতো ভাই পৃথক ড্রাইভ করছে। দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল সে। গাড়ির পিছনে ছুটতে গিয়েও থেমে গেল। ফিরে এসে দেখল ইতিমধ্যে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। ভিড় ঠেলে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হালকা রক্তমাখা মুখ টা চিনতে একটুও অসুবিধে হয় নি তার। প্রথম দেখায় সে চৈত্রিকার বাবার মুখটা স্মৃতিতে গেঁথে নিয়েছিল,তাই মাত্র এক দু’দিনের ব্যবধানে ভুলল না। সবাই ধরাধরি করে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় যাবে কি-না ভেবেও যায় নি। গাড়িতে উঠে সোজা চলে এলো সাফারাত দের বাড়িতে।

সাফারাত তখন পৃথকের কলার ধরে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। দিহান আগে থেকে সাফারাতের এমন কান্ডের কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। বিচলিত স্বরে বলে উঠল,

‘ চৈত্রিকার বাবা কে পৃথক গাড়ি চাপা দিয়েছে সাফারাত। তুই কি সেটা জানিস?’

সাফারাত একটা টু শব্দও করে নি। একবার ঘাড় কাত করে চাইল শুধু। এক মুহুর্তের জন্য ভড়কে যায় দিহান। তার বলা কথাটায় সাফারাতের আঁখিজোড়ায় আগুন জ্বলে উঠেছিল যেন। অতঃপর এলোপাথারি মারতে শুরু করে পৃথক কে। কেউ যখন থামাতে পারছিল না,দেখছিল অবস্থা খুবই বেগতিক তখন উপায় না পেয়ে পুলিশ কে ফোন দেয় দিহান। কারণ পৃথক মারা গেলে সাফারাতের বিষাক্ত, বিষাদ ভরা জীবনটা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। দিহান ভেবেছিল উক্ত কারণেই হয়ত সাফারাত মেরেছে কিন্তু দিহান তখন একদমই বুঝে নি এই কারণ তো পরে যোগ হয়েছে পৃথকের পূর্বের করা কু কর্মের সাথে।

দিহান ভাবনা ভঙ্গ করে দ্রুতবেগে বলে উঠল,

‘ সেদিন চৈত্রিকা আমার অফিসে না এলে তো তোর অতীতের অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত। চৈত্রিকা নামক সুন্দরী আমার বন্ধুর এতো ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড, কাছের কেউ তা তো জানতেই পারতাম না। মা যদি চৈত্রিকা কে পছন্দ করে ফেলত তাহলে না জেনেই তো বন্ধুর ঘনিষ্ঠ মানুষ টা আমার হয়ে যেত। আহারে!’

দিহানের ঠাট্টার স্বর শুনে ভ্রুঁ যুগল কুঞ্চিত হলো সাফারাতের। বিরক্ত বোধ করল প্রচন্ড। দিহান সাফারাতের চোখে মুখে বিরক্তি দেখে মিটমিট করে হাসল। চোখ রাঙাল সাফারাত। হাসি বন্ধ করে দিহান ধাতস্থ কন্ঠে বললো,

‘ জার্মান থেকে আসার পর তোর হাতে যে গুলি করেছিল ওইটা পৃথক ছিল তা কিভাবে জানলি তুই?’

‘ পৃথক নিজে করে নি,অন্যকে দিয়ে করিয়েছে। করিয়েছে আমার অফিসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে। এছাড়া আমার খাবারে একবার বিষ মেশানো হয়েছিল। সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। গ্রামের বাড়িতে ছিল সকলে। আমিই ছিলাম শুধু বাড়িতে। বাহির থেকে খাবার খেয়ে আসার কারণে আমি আর রাতে খাই নি। আমার বাড়ির কাজের লোক কে আমার জন্য সার্ভ করা খাবারটা খেয়ে নিতে বলি। কিন্তু আমি কখনও কল্পনাও করি নি আমার বদলে সে তার জীবন হারাবে। সেদিন অনেক খুঁজেও রাঁধুনি কে পাই নি। তখন বুঝতে পারি এর মধ্যে জড়িত ছিল রাধুনি। কিন্তু একজন রাঁধুনির আমাকে মে/রে ফেলার মতো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার উপর জার্মান থেকে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যে এতো বার আমাকে মা/রা/র চেষ্টা আমার নিকটবর্তী মানুষ ছাড়া কে করবে! আমার জানামতে বাহিরে কোনো শত্রু পালছি না আমি। দ্বিতীয় বার চেষ্টা টা যখন আমার বাড়িতেই করা হলো,বুঝতে পারলাম দাবার গুটি আমার পরিবারের কেউই চালছিল। লোক লাগিয়ে অনেকদিন পরে সেই রাঁধুনি কে খুঁজে পেলাম। তার মুখ থেকেও শুনলাম পৃথকের নাম। আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিল পৃথকের উপর এবং তা মিলেও গেল।’

‘ তোর চাচা-চাচীও তো হতে পারে! ‘

অকপটে কথাটা বলে বসল দিহান। কোনো কিছু না ভেবেই। সাফারাত কপালে ভাঁজ ফেলে চাইল। সরব করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল,

‘ হতে পারে। মা-বাপ,ছেলে সবই তো এক জাতের। মাঝখান থেকে শুধু প্রিয়ন্তী টা ভিন্ন। ‘

গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পদে পুলিশ স্টেশনের ভেতরে ঢুকল সাফারাত। তার পিছু পিছু দিহান। সাফারাতের চাচা হামিদ বসে আছে ছেলের জন্য। ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে চাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছেন উনি, যা দেখে সাফারাতের ঠোঁটের কার্ণিশে প্রতীয়মান হলো বিদ্রুপের হাসি। চেয়ার টেনে সাফারাত তার চাচার পাশে বসল। তিনি চেয়েও পারছেন না সাফারাতের কাছে ছেলের জন্য আকুতি করতে। করলেও সাফারাত শুনবে না। এই ছেলেটাকে একটা সময় প্রচন্ড আঘাত করেছে তারা সুযোগ পেয়ে। তারই প্র/তি/শো/ধ হয়ত ভিন্ন ভাবে কড়ায়-গণ্ডায় নিচ্ছে সাফারাত।

হামিদের করুন চাহনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পুলিশের হাতে একটা মেমোরি কার্ড তুলে দেয় সাফারাত। এতে পৃথকের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ আছে। অফিসের ওই কর্মচারীর মুখ থেকে সত্য বের করতে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে তাকে। মেয়েটা পৃথকের গার্লফ্রেন্ড লিজা। লিজা পৃথকের কথায় জব নিয়েছিল সাফারাতের অফিসে। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর ও স্মার্ট। তার উপর সন্দেহ করার মতো কোনো সুযোগ কাউকে দেয় নি। তবে যেদিন মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা হতে বাহিরে গিয়েছে এবং লিজা পানি কিনার জন্য গাড়ি থেকে নেমে যায়,ঠিক সেসময় গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করে বুলেট এসে লাগে সাফারাতের বাম হাতের বাহুতে। তারই কিছু সময় পর লিজা ফিরে আসে। সামান্য পানি কিনার উছিলায় এতো সময় বিলম্ব করা ভালো ঠেকে নি সাফারাতের কাছে। নিজের সন্দেহ জনক নজর সুস্থ হওয়ার পর হতে একদমই কাউকে বুঝতে দেয় নি। লোক লাগিয়ে লিজার উপর নজর রাখতেই জানতে পারে পৃথকের গার্লফ্রেন্ড সে। সাফারাত চুপ ছিল। অপেক্ষায় ছিল পরবর্তী হামলার জন্য। তারপর একে একে লিজা ও ওই রাঁধুনির মুখ থেকে সব বের করে। তারা বেশি কিছু বলে নি, কেবল পৃথকের নামটা নিয়েছিল। মানুষের মতামত কোন সময় পাল্টে যায় তা তো বলা যায় না। তাই উভয়ের জবানবন্দি রেকর্ড করে রেখেছে সাফারাত। আর চৈত্রিকার বাবা কে ড্রাংক অবস্থায় চাপা দিয়েছে পৃথক। ইচ্ছেকৃত কি-না তা বুঝা মুশকিল। সাফারাতের কাছে তা সম্পূর্ণ ইচ্ছেকৃত মনে হলো।

পুলিশ অফিসার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

‘ আপনার কাজিন তো স্বীকার যাচ্ছেন না উনি কেন আপনাকে মারার চেষ্টা করেছেন। সম্পত্তির জন্য কি-না তাও বলছেন না।’

সাফারাত নিজের চাচার দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। রাশ ভারি কন্ঠ তার,

‘ মুখ খুলতে হবে না, প্রয়োজন নেই। ‘

পুলিশ অফিসার অবাক চোখে তাকালেন। সাফারাত সেই অবাকতা বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল মৌন মুখে।গাড়ি স্টার্ট দিল। দিহান পাশে বসে শঙ্কিত নেত্রে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ কারণ জানার প্রয়োজন নেই তোর?পৃথক কেন মারতে চাইল তোকে? ‘

‘ প্রয়োজন নেই। ‘

ভরাট শুনালো সাফারাতের কন্ঠস্বর। দিহান দিরুক্তি করে বলে উঠল,

‘ কেন?’

‘ কারণ আমার জীবনের প্রতি মায়া নেই। পৃথক আমাকে মা/র/তে চেয়েছে তাতে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি। আমার হিংস্রতা জেগেছে তোর মুখের বলা চৈত্রর বাবার এক্সিডেন্টের কথা শুনে। উনাকে মারার অপরাধে পৃথক কঠোর শাস্তি ডিজার্ভ করে।’

দিহান চমকালো,থমকে রইল অল্প সময়। বিহ্বল স্বরে আওড়ালো,

‘ তুই তো বলেছিস চৈত্রিকার বাবা চৈত্রিকাকে আ/ঘা/ত করে, দেখতে পারেন না। তাহলে উনার জন্য এতো হিংসাত্মক কেন হয়ে উঠলি?’

‘ কারণ চৈত্র ভালোবাসে ওর বাবা কে।’

‘ আর তুই? তুই ভালোবাসিস চৈত্রিকা কে?নাকি কেবল বন্ধুত্বের জন্যই এতো পাগলামো? ‘

সাফারাত শান্ত চোখ এক পলক চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে রাখল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না দিহানের প্রশ্নে। দিহান পুনরায় বললো,

‘ কোথায় যাচ্ছি? ‘

‘ কবরস্থানে। আম্মুর কাছে। ‘

সাদামাটা, নিরলস জবাব সাফারাতের। দিহান একটুও চমকালো না। শুধু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ভারি শরীরটা এলিয়ে দিল সিটে।
____________

ছোট বাটন ফোনটায় সময় দেখে নিল চৈত্রিকা। রাত এগারোটা বাজছে। বাবার জ্ঞান ফিরেছে প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে এসেছে। কিন্তু তিনি একটা বারও চৈত্রিকার কথা জিজ্ঞেস করেন নি। করেছে মিমের কথা। এতে একটুও কষ্ট অনুভব হয় নি তার। উল্টো বাবার একটুখানি সুস্থতায় আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করল। গোলগাল চেহারার গড়নের একটা মেয়ে এগিয়ে এলো চৈত্রিকার দিকে। পেশায় নার্স সে। চৈত্রিকার মুখের সামনে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলে উঠল,

‘ এই ওষুধ গুলো এখনই লাগবে ম্যাম। আমাদের হসপিটালের ফার্মেসী থেকে আনিয়ে নিব নাকি আপনি আনবেন? ‘
মেয়েটার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন টা চৈত্রিকা নিজের হাতে নিয়ে নিল। হসপিটাল থেকে ওষুধ আনলে দ্বিগুণ দাম পড়বে। ব্যাগে থাকা পাঁচ হাজার টাকা তো বাবার চিকিৎসায় লেগে যাবে। আজ বাদে কাল হয়ত পথে জায়গা হবে পুরো পরিবারের। মলিন স্বরে বললো সে,

‘ আমি নিয়ে আসছি।’

নত মস্তকে ক্লান্ত দেহটা নিয়ে চৈত্রিকা নিচে এলো। মনে মনে নিজেকে শক্ত রাখলেও,দেহটা বড্ড নেতিয়ে পড়ছে। সকাল হতে না খাওয়ার দরুন প্রবল দুর্বলতা জেঁকে ধরছে। অসাড় হয়ে পড়ছে পা দুটো। নড়বড়ে হচ্ছে প্রত্যেক টা কদম। হসপিটালের নিচে অবস্থিত ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনল না সে। এখানে অন্যান্য জায়গার তুলনায় দাম বেশি রাখে। কিছু টাকা বাঁচানোর নিমিত্তে অবিশ্রান্ত দেহ টা কে এগিয়ে নিয়ে চলে এলো কিছু দূর। রাস্তা পেরিয়ে ডান পাশ হতে বাম পাশে আসল। এখানে সারি বেঁধে ফার্মেসীর দোকান। ভিড়ও প্রচুর। চৈত্রিকা এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে প্রেসক্রিপশন বাড়িয়ে দিল একটা লোকের কাছে। অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল ওষুধ পাবার। অনেক মানুষ হওয়ায় একটু আকটু দেরি হচ্ছে। আচমকা চোখ খিঁচে নেত্রপল্লব বুঁজে ফেলল চৈত্রিকা। শরীর টা কেঁপে উঠল থরথর করে। কাধের নিচের দিকে হাত রাখতেই কন্ঠনালি গলিয়ে বেরিয়ে এলো,

‘আহ!’

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৭

হাত সরিয়ে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে পিছনে ঘুরে তাকালো চৈত্রিকা। কি আশ্চর্য!পিছনে কেউ নেই। কয়েকটা ছেলে পাশে এসে দাঁড়াল। মনটা কু-ডাকছে তার। যা বুঝার বুঝে গেল। চক্ষু জোড়া থেকে কার্ণিশ ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। তা হাতের পিঠে মুছে নিল চৈত্রিকা। অধর যুগল চেপে চেষ্টা করল মনের ব্যাথা টুকু সহ্য করে নেবার। ওড়না টা ঠিকমতো টেনে পিঠ,ঘাড়,চুল ঢেকে নিল। কাপুরুষ গুলো এতো মানুষের মাঝেও সুযোগ পেয়ে নিজের থাবা বসিয়ে দিল নারী দেহের উপর। চৈত্রিকার ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছেলেগুলো কে কষিয়ে থাপ্পড় লাগাতে। হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিল সে। ওষুধ গুলো নিয়ে একপাশে সরে এলো। রাস্তা পেরিয়ে ডান পাশে এসে খেয়াল করল ছেলেগুলো পিছন পিছন চলে এসেছে। বিপদের আঁচ করতে পেরে তৎক্ষনাৎ পা দুটো থামিয়ে দিল। সামনের দিকটায় মানুষের আনাগোনা কম। চৈত্রিকা আর এক পাও না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। ছেলেগুলোও দাড়িয়ে আছে কিছুদূরে। আঁড়চোখে বার বার নোংরা দৃষ্টি ফেলছে চৈত্রিকার দেহে। তা চক্ষে বিধঁতেই পুরো শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করল চৈত্রিকার।

সাদা ড্রেস পড়ে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো দিহান। মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। চোখ জোড়ায় ফুটে আছে অসহায়ত্ব। মেয়েটাকে চিনতে সময় নিল না দিহান। উঁচানো স্বরে বলে উঠল,

‘ সাফারাত ওই দেখ চৈত্রিকা।’

সাথে সাথেই গাড়ি থেমে গেল। দিহান কিছু বুঝে উঠার আগেই সাফারাত দরজা মেলে বেরিয়ে পড়েছে।

নিজের নরম হাতের ভাঁজে শক্ত একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করল চৈত্রিকা। ধরাস করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। পাশ ফিরে তাকাতেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া থেমে গেল ক্ষীণ সময়ের জন্য। সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে অতি কাছে। খুবই ঘনিষ্ঠে। তার বলিষ্ঠ হাতের ভাঁজে চৈত্রিকার কোমল হাত বন্দী। ল্যামপোস্টের জ্বলন্ত ছটা হালকা ভাবে বিচরণ করছে সাফারাতের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত ফর্সা চেহারায়। চৈত্রিকার গলা শুকিয়ে আসছে। অকস্মাৎ সাফারাতের ঘনিষ্ঠ স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেহের সর্বাঙ্গ। হাত টা ছুটিয়ে আনার চেষ্টা করল। বহুতর চেষ্টা। কিন্তু পেরে উঠছে না সাফারাতের শক্তির সাথে। হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করল সাফারাত। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাল চৈত্রিকার মুখের দিকে।

চৈত্রিকা হকচকালো,থমকালো। কিছু সেকেন্ড অপলক,অনিমেষ চেয়ে রইল প্রগাঢ় সেই চাহনিতে। একটা সময় নিজেকে আবিষ্কার করল সাফারাতের অতীব কাছে। যতটুকু ছিল দূরত্ব, তা ঘুচিয়ে নিয়েছে সাফারাত। চৈত্রিকা কে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ নজর ফেলল দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিক। ছেলেগুলা ভড়কে গেল নিমেষে। কিন্তু নড়ল না। সাফারাত চৈত্রিকার হাত টা টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। এতো সময় পর হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেল চৈত্রিকা। প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,

‘ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’

‘ আপনি যেখানে যেতে চান।’

‘ আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে চাই না।’

‘ আপনি আমাকে ছাড়া এখান থেকে এক পাও নাড়াতে পারবেন না চৈত্র। ‘

চৈত্রিকা টলমল আঁখিজোড়া সাফারাতের দিকে নিক্ষেপ করল। এতগুলো বছর পর প্রিয় মানুষটার মুখ থেকে এই ডাকটা শুনতে পেয়ে এক প্রকান্ড ঝড় বয়তে শুরু করল হৃদয়পটে। বড্ড আবেগি হয়ে পড়ছে মন। মেয়েরা বোধ হয় এমনি। একটা মানুষ যতই আঘাত করুক তবুও তার একটু মধুর ডাকই যেন সেই আঘাত ভুলে মনটা গলতে শুরু করে মোমের ন্যায়। চৈত্রিকা জানে সাফারাত তাকে চেনে,তবে সেদিন অস্বীকার করার কারণ টা তার অজানা। চৈত্রিকা কথা বাড়াল না। উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনল সাফারাত। চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই টেনে এনে গাড়ির পেছনের দরজা মেলে বসিয়ে দিল তাকে।

নিজে পাশে বসে দিহানের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বললো,

‘ তুই ড্রাইভ কর দিহান।’

দিহান অসহায় চোখে তাকালো। কেমন করে এক মুহুর্তে তাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিচ্ছে সাফারাত। নেমে ড্রাইভিং সিটে বসে চৈত্রিকার দিকে চেয়ে বললো,

‘ কোথায় যাবো?’

চৈত্রিকা করুন দৃষ্টি নিবদ্ধ করল দিহানের পানে। কন্ঠে তেজ এঁটে বললো,

‘ সামনের হসপিটালে।’

‘ হসপিটালে কেন?’

দিহান এমন ভান করল যেন চৈত্রিকা না বুঝে। নিষ্প্রাণ স্বরে প্রতুত্তর করে চৈত্রিকা,

‘ বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

‘ ওহ। এখন ঠিক আছেন আংকেল? ‘

‘ কিছুটা।’

দিহান আর কথা বাড়ালো না। চৈত্রিকা সাফারাত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসল। কিন্তু সাফারাত হাত ছাড়ছে না কোনো ক্রমেই। গাড়িতে উঠেও হাত টা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। হুট করে চৈত্রিকা অনুভব করল ভীষণ ঠান্ডা লাগছে তার। দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে বক্ষস্থল জুড়ে। আচমকা সাফারাতের অন্য একটা রূপ মানতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ছোট্ট করে নিচু স্বরে বললো,

‘ হাত টা ছাড়ুন।’

সাফারাত ছাড়ল না বরং কাছে এগিয়ে এলো। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,

‘ দুঃখিত আমি চৈত্র মাস। ভীষণ দুঃখিত। সেদিনের ব্যবহার টা একদমই ইচ্ছাকৃত ছিল না। ‘

চৈত্রিকার নয়নজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। সাফারাতের সহজ স্বীকারোক্তি তার অন্তরে বিঁধছে প্রখরভাবে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অভিমান নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ আর এতগুলো বছর? সেদিন না বলে চলে যাওয়া?’

সাফারাত তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়াময় দৃষ্টি স্থির করল চৈত্রিকার দিকে। তার একটা হাত ঠেকল চৈত্রিকার নরম গালে। মেয়েটার রক্তিম আভায় সিক্ত মুখশ্রী তে পূর্ণ দৃষ্টি বুলালো সে। বললো,

‘ মাঝে মাঝে জীবনের সমীকরণ গুলো মেলানো বেশ জটিল হয়ে যায় চৈত্র। আপনজন যখন শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বেঁচে থাকা টা মুশকিল হয়ে পড়ে। আপনাকে কখনও মিস করি নি আমি। একদমই মিস করি নি জটিল এই জীবনে। কারণ আপনি সবসময় আমার মনে বাস করতেন এবং করবেন।’

চৈত্রিকা কাঁদল না। তবে আবেগি হয়ে পড়ল ক্ষণিকের জন্য। নরম স্বরে বলে উঠল,

‘ আমি আপনাকে খুঁজেছি সাফারাত। অনেক খুঁজেছি। ‘

সাফারাতের হৃদপিন্ডে শীতল স্রোত বয়ে গেল। স্থির দৃষ্টি ফেলে মাথার পিছনে হাত গলিয়ে বুকে চৈত্রিকার মাথা টা চেপে ধরল। নিমিষেই চৈত্রিকার শিরা উপশিরায় কাঁপুনি ধরে গেল। তীব্র থেকে তীব্র সুখ অনুভূত হলো। সুখের নেশায় কাতর চৈত্রিকা চক্ষু মুদে শুনল সাফারাতের হৃদস্পন্দন। সাফারাত কতটা নিঃসংকোচ ভাবে আগলে নিল তাকে। কিসের টানে এতোটা কাছাকাছি? চৈত্রিকা সরে এলো। আড়ষ্ট হয়ে পড়ল লজ্জায়। কর্ণে এলো সাফারাতের নির্বিকার কন্ঠ,

‘ আমরা তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম চৈত্র।’

চৈত্রিকা সময় নিল না। প্রতিউত্তরে বলতে চাইল,

‘ আপনি টা-ই এখন ভীষণ প্রিয় মনে হচ্ছে। ‘

কিন্তু অভিমান চেপে রেখে মনের কথাটা ব্যক্ত করল না। সাফারাত সেদিন যেই কারণেই তাকে অস্বীকার করুক না কেন তবুও মেনে নিতে পারছে না সে। মানতে পারছে না সেই কলেজ জীবনে না জানিয়ে সাফারাতের হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়া।

দিহান লুকিং গ্লাসে সবটা দেখল। স্মিত হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। পিছনে বসে থাকা মানুষ দু’টো আদৌ বুজছে কি-না সে জানেনা,তবে সে উপলব্ধি করে ফেলেছে দু’টো মনের অব্যক্ত প্রেম,অনুরাগ,অনুভূতি।
____________

হসপিটালের সামনে গাড়ি থামতেই চৈত্রিকা নেমে পড়ল। দিহান কে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে। উদ্দেশ্য সাফারাত কে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া। শোধ নিবে সে। সেদিনের ফিরিয়ে দেবার শোধ। কিন্তু পারল কই!মুহুর্তেই কর্ণগোচর হলো সাফারাতের ভরাট,গাম্ভীর্যের স্বর।

‘ দাঁড়ান চৈত্র। উপেক্ষা করার সাহস করলেন কিভাবে?’

পা দুটো আপনাআপনি থমকে গেল। ঘাড় কাত করে চাইল চৈত্রিকা। সাফারাত দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। রাগ সংযত করে বললো,

‘ চলুন’

‘ আপনি কোথায় যাবেন?’

চমকিত কন্ঠে প্রশ্ন করল চৈত্রিকা। এতেই যেন বেশ বিরক্ত হলো সাফারাত। চেহারায় রুষ্ট ভাব। কাঠ কাঠ গলায় বললো,

‘ আপনার বাবা কে দেখতে। ‘

‘কিন্তু?’

‘কি?কিশোরী থাকতে তো পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করালেন না। আজও কি করাবেন না?ঠিক আছে মানবতার খাতিরে নাহয় আপনার বাবা কে এক পলক দেখব।’

চৈত্রিকা চুপ মেরে হাঁটতে লাগল। পাশে হাঁটছে সাফারাত পায়ে পা মিলিয়ে। কেমন ঠেস মেরে বাক্যগুলো উচ্চারিত করল সাফারাত। কয়েক বছর আগে বাবার প্রতি ভয়টা একটু বেশিই ছিল চৈত্রিকার। ভয়ে কোনোদিন নিজের বাড়ির সীমানায়ও সহ্য করতে পারত না সাফারাত কে।

লিফটে উঠার সময় চৈত্রিকা কে আগে উঠতে জায়গা করে দিল সাফারাত। আকস্মিক তার নজর গিয়ে পড়ল পাতলা সাদা ওড়না ভেদ করে ফর্সা কাঁধে। নিমেষে সাফারাতের অক্ষি যুগল জ্বালা করে উঠল ভীষণ। লিফটে উঠে পিছন থেকে চৈত্রিকার ওড়না টা সরিয়ে দিল একপাশে। চৈত্রিকা হতভম্ব, হতবাক। পুরো লিফটে ওরা দু’জন। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সাফারাতের দিকে। চোয়াল শক্ত সাফারাতের। নেত্রদ্বয় টকটকে লাল। চৈত্রিকা আমতা আমতা করে বললো,

‘ কি করছেন?’

‘ আপনার কাঁধে নখের আঁচড় কেন চৈত্র?’

‘ কিছু না। দূরে সরুন প্লিজ।’

‘ মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যাবাদী তে পরিণত হয়েছেন। বলতে হবে না আপনার।’

সাফারাতের আক্রোশ ভরা কন্ঠে চৈত্রিকা অবাক হলো প্রচন্ড। ফোন বের করে সাফারাত দিহান কে কল দিল। কন্ঠে তার অতিশয় রাগ। বললো,

‘ আমি জানি তোর মেমোরি অনেক ভালো। ছেলেগুলোকে দেখেছিস নিশ্চয়! উপরে আসার প্রয়োজন নেই। যতক্ষণ না ওই জানোয়ার গুলোকে খুঁজে বের করতে পারবি আমার সামনে আসার প্রয়োজন নেই। ‘

চৈত্রিকা বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল। বন্ধুকে কেন এমন করে থ্রেট দিল এই লোক!চৈত্রিকা কোনোভাবেই এই লোকের মাঝে কিশোর বয়সের সেই সাফারাত কে খুঁজে পাচ্ছে না। এ যেন নতুন কেউ!

পকেটে ফোন ঢুকিয়ে চৈত্রিকার আহত স্থানে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে আনল সাফারাত। রাগে মাথা ব্যাথা ধরেছে খুব। চৈত্রিকা নড়ছে না বিন্দুমাত্র। দাঁড়িয়ে আছে স্থির,অটল। লিফটের দরজা ওপেন হতে না হতেই সাফারাত এমন এক কান্ড করে বসল,যার ফলে শিরশির করে উঠল চৈত্রিকার সমগ্র কায়া,অন্তর,মন।

#চলবে,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)