সুখের সন্ধানে পর্ব-৭+৮

0
293

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৭

– তোমার স্বামী তিন তিনটে বিয়ে করেছে তারপরও তুমি তাকে ঘরে জায়গা দাও?

– জায়গা দেবো না কী করব আপা? তিন তিনডা ছাওয়াল পাওয়াল। এইগুলারে বাপের ছায়া থাইকা কতক্ষণ দূরে রাখব?

– তুমি তো তোমার স্বামীর প্রথম বউ, তাই না?

– জি। আমারই বিয়া হইছিল পরথম তার সাথে। গ্রামের হুজুর ডাইকা একশ মানুষ খাওয়াইয়া আমারে বড় শখ কইরা উনার হাতে তুইলা দিছিল আব্বা। ঘরের ছোড মাইয়া আমি। আব্বার বড় আদরের ছিলাম। আব্বাও মরল আর আমার কপালও পোড়ল। বিয়ার পরে দুই বছর আমরা গ্যারামেই ছিলাম। নদী ভাঙ্গনে যখন সব শ্যাষ কিছুই আর নাই তখন ঢাকা শহরে আসলাম। ঢাকা শহরে আইসা গতর খাইটা দুইডা পয়সার মুখ দেখছি ঠিকই কিন্তু সেই গ্যারামের মত সুখটা আর পাই না। উনি যেন কেমন কেমন হইয়া গেল।
বড় মাইয়াডা হওনের কিছুদিন পর হইতেই তার এই তামশা শুরু হয়। হঠাৎ কইরা কিছুদিন ধরে নিরুদ্দেশ। আমরা তো সবাই হন্য হইয়া তারে খুঁজি। কোনো খানে তার খোঁজ নাই। কী যে কষ্ট কইরা চাইয়া চিন্তা আমি আমার গেন্দা মাইয়া লইয়া পেটটা চালাইছি সেই কথা মনে পড়লে এহনো দরদর কইরা চোউখ দিয়া পানি আসে। মাইয়ার বয়স যখন এক বছর তখন উনার খবর পাওয়া যায়। শুনি নতুন কইরা আবার সংসার পাতছে। ঢাকা শহর ছাইড়া চট্টগ্রামে থাকে বউ লইয়া।
আমি সেই কোলের মাইয়া লইয়া চট্টগ্রামে যাই। হাত পাও ধইরা কাইন্দা কাইটা কই ঢাকায় ফেরত আসতে। ওনার বউয়ের সহ আমি ঢাকায় লইয়া আসি।

– তুমি তোমার সতীনকে মেনে নিয়েছিলে? তোমার স্বামীকে কিছু বললে না?

– কী বলব? বললে কিছু তো হবে না। উলটা আমারে আর আমার মাইয়ারে থুইয়া আবার চইলা যাবে। সতীন লইয়া সংসারের জ্বালা যে কী হাড়ে হাড়ে টের পাইছি একটা বচ্ছর। বেডি ঘরের কোনো কাজকর্ম করবে না। গার্মেন্টসে কাম করত। নিজে পয়সা গোছাইত। সংসারে সারাদিন আমি খাটতাম আবার মাইনষের বাসায়ও কাম করতাম। আর নবাবজাদী রান্ধা খাওন খাইয়া আমার চোউখের সামনে আমার স্বামীরে লইয়া আলেদা বিছানে থাকত। আমি মাইয়াডা লইয়া আলেদা বিছানে খাটের উপ্রে থাকতাম। সেরা নিচে। আমার সাথে কোনোসময় বেডি ভালো মুহে কতা কইত না। এইয়া কিচ্ছু নালিশ করলে মাইয়ার বাপ তারে আলেদা বাসা লইয়া থাকনের হুমকি ধামকি দিত। আমার গায়ে হাত তুলত। সবাই আমারে কইত এমন সংসারে লাত্থি মাইরা আলাদা হইয়া যাইতে। কিন্তু আমি পারি নাই। মাইয়াডার দিক তাকায়া আমি কিছুই পারি নাই। সব অত্যাচার সহ্য করছি।

– তোমার সেই সতীন এখন কই?

– শয়তান মহিলা নিজেই বিদায় হইছে। গার্মেন্টসের আরেক বেডার লগে প্রেম পিরিতি কইরা ভাইগা গেছে।
বউয়ের শোকে আমার জামাইয়ের কত দুঃখ! কতদিন তামাত তার নাওয়া-খাওয়া কাজকর্ম সব বন্ধ হইয়া গেছিল। আমি খালি দেখতাম আর হাসতাম। হেতেও সে আমার দোষ বাইর করত। কইতো আমার অত্যাচারে নাকি তার পিরিতের বউ এই ঘর ছাইড়া গেছে।
তারপর ধীরে ধীরে বউয়ের শোক ভুলছে, সংসারে মনোযোগী হইছে। এরপর ছোড মাইডার জন্ম হইলো।
এরপর পোলাডা হইল। ততদিন উনি ভালোই ছিল।
হঠাৎ আবার কি হইছে কয়দিন আগে শুনি সে নাকি অন্য জায়গার আরেক খান বিয়া করছে। আমি আর পরথম বারের মত এইবার অবিশ্বাসও করিনাই। আর খোঁচাখুঁচিও করতে যাই নাই। যা করে করুক গা। বিয়া সে করতে পারে। আগের মত ঠিকঠাক ঘরে আসে না এখন আর। মাঝেমধ্যেই দুইদিন তিনদিন গায়েব অইয়া যায়। আমার ও নিয়া আর মাথা ব্যথা নাই। বিয়া করুক, নিকাহ করুক যা খুশি কইরা বেড়াক।

– তোমার স্বামী তো এখনো মাঝে মাঝে আসে। জিজ্ঞেস করো না তারে?

– আফা, যার এক কান কাডে হে ঢাইকা চলে। আর যার দুই কানই কাডে হে উদাম কইরা চলে। ওই ব্যাডার তো দুই কানই কাডা। লাজ-লজ্জা কিছু তো নাই। জিগাইলে যেসব ভন্ড দিয়া দিয়া উত্তর দেয় এই জন্য জিগাই না এহন আর। ভালো লাগে না। আমি এহন কামাইতে পারি। খাওন পরন না দিলে না দিক গা। মাইয়া পোলা লইয়া মরব না আল্লার দোয়ায়।

– আরেক জায়গায় যদি বিয়েই করে তাইলে তোমার কাছে আবার আসে কেন? আর তুমিই বা অ্যালাউ করো কেন? নিজে ইনকাম করো। স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করবে। এই সমস্ত মানুষের সাথে থাকার কোন মানেই হয়না।

– আসে মাইয়া-পোলার টানে। লোকটা আমার সাথে যেমন ব্যবহারই করুক মাইয়া-পোলারে আবার খুব ভালো পায়। ওরাও বাপ ছাড়া কিছু বোঝে না। আফা, যতই কামাই রোজগার করি পোলাপানের মুখে খাবার তুইলা দিতে পারব কিন্তু আমি ওগো বাপের আদর তো দিতে পারব না।

– এই সমস্ত ভুয়া কথা কই পাইছ? যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর সন্তান রেখে আবার একটার পর একটা বিয়ে করতে পারে সে তার স্ত্রীকেও ভালোবাসে না, সন্তানদের কেও ভালোবাসে না। তুমি তোমার বাচ্চাদের বোঝাও। ওরা যখন বাবার চরিত্র সম্পর্কে জানবে তখন নিজে থেকেই বাবার থেকে দূর হয়ে যাবে।

– না, আফা। লোকটা মাইয়া পোলারে খুব ভালো পায়। এইডা তো আমি জানি। এইডা মিছা কতা না। হয়তো আমারই কপাল খারাপ। দেখতে শুনতে হয়তো ভালা না। যে কারণে আমার দিক তার এখন নজর আসে না। ওরা বাপছাড়া হোউক আমি কোনোদিনও চাই না। তাছাড়া উনি যাই করুক আমি তো উনারে ভালো পাই।

– এ সমস্ত ভুয়া কথা বাদ দাও তো! রাগে গায়ে জ্বালা ধরে খুব। এই যে তোমার ভাগ্য খারাপ এসব কথা বলোনা একদম! ভাগ্য খারাপ তো ওনার। তোমার মতো বউ রেখে আবার বিয়ে করে। চৌদ্দটা বিয়ে করা পুরুষ মানুষের কোন ভাগ্য আছে নাকি ? এ তোমার আর তোমার সন্তানদের ভালোবাসার যোগ্য না। তুমি যদি বল তোমার স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করি। তাহলে বিয়ের সাধ একদম মিটে যাবে।

– ছি, ছি, আপা। একি সর্বনাশে কথাবার্তা বলেন? উনার আমি পুলিশে দেবো কেন? উনি আমার বাচ্চাকাচ্চার বাপ, আমার স্বামী। উনারে জেলহাজতে পাঠাইয়া আমি এই পোলাপানের কাছে কী জবাব দিব?
উনি আমার কদর একদিন ঠিকই বুঝব।আমি সেই দিনের আশায় আছি। মানুষ মাত্রই ভুল করে । মানুষ তো আর ফেরেশতা না। দোষে গুণে মানুষ। উনি উনার দোষ নিশ্চয়ই একদিন বোঝবে। উনারে কোন বিপদে ফেলার আগে আমি দশবার ভাবি আমার পোলাপানের কথা। তাই আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন সে ঠিকই বুঝব।

– হ্যাঁ, সেই আশাতেই থাকো। তোমার মরার পরে উনি ঠিকই বুঝবে। ওই একই রকমের কাজ যদি তুমি করতা তাহলে কি তোমার স্বামী তোমারে ঘরে তুলত?

– আমি ওই কাজ করতে যাব ক্যান? জন্মের পর হইতেই দেখে আসতেছি মাইয়া মানুষের সবকিছুতেই দোষ। জোরে হাসা যাবে না, জোরে কাশা যাবে না জোরে কথা বলা যাবে না, আরো কত কত নিয়ম আমাগোর জন্য। আর পুরুষ ছাওয়ালের কোন নিয়ম নাই। এরা এগো ইচ্ছামত চলবে কোন সমস্যা হয় না তখন। আমার স্বামী তিন চারটে বিয়া করতেই পারে আমার তো সেইসব করার অধিকার নাই। আমাগো ধর্মেও নাই। নাউজুবিল্লাহ।
উনি নিজের ভুল বোঝবেই। আমি ধৈর্য ধরব।

– বুঝতে পেরেছি। পতিব্রতা পত্নী তুমি। এখন কি করবে ভাবছ?

– ওনার মন জয় করার চেষ্টা করব যাতে উনি আমারে আর ছাইড়া না যায়। আমি যদি উনারে ছাইড়া যাই তাইলে পরে তো সাহস আরো বাইড়া যাবে। ইচ্ছামতো আকাম কুকাম করব। এখন তো কিছুডা লুকাই চাপাই রাহে। তখন একদম উদাম হইয়া যাবে। আমি উনার ধারে থাইকা, পাশে থাইকা মন জয় করতে চাই।

– সেটাই করতে থাকো। এত বছরে পারলা না। এখন কী করবা তুমি জানো। দেখো কোন ফলাফল যদি মিলে।

রহিমা বিবি আর মমতাজ আপার কথোপকথনগুলো আমি এত সময় ধরে শুধু শুনেই গিয়েছিলাম। ভাবছি আমাদের দেশের মেয়েদের কথা, মায়েদের কথা! যারা সন্তানের একটু সুখের জন্য দিনের পর দিন যুগের পর যুগ এমন অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে।

রাতে আর ভালো ঘুম হল না। ভাবনায় রাত পার হলো। শুধু রহিমা বিবির কথাগুলো কানে বাজছিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। ড্রাইভারকে পরেরদিন আসতে বললাম।

আমি নাস্তা শেষ করেই ঢাকা সিলেট এয়ার টিকেট করে ফেললাম। আমিও হারতে চাই না। অধিকারের জন্য লড়তে হবে। এত সহজে এতদিনের অধিকার ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করার মতো এখনো কিছুই হয়নি। রহিমা বিবি, মালিহা ঠিকই বলেছে নিজের অধিকার, নিজের জায়গা নিজেরই করে নিতে হয়, করে নেয়া জানতে হয়।
এই বস্তিতে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে জীবনবোধের ধারণা দিয়েছে, চোখ খুলে দিয়েছে। সমাজের উঁচুতলার মানুষের মাঝে এই শিক্ষা বিলিয়ে দেয়াটা খুব জরুরী। বিলকিস বানু, রহিমা আপা, আদরি সবার কাছে অনেক অনেক শিক্ষা নিলাম। এদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অসীম।

চলবে……

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৮

সেলিম যা করছে সেটা জানার পর ওর কাছে যাবার এক বিন্দুও ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু কিছুই করার নেই। এভাবে হেরে যেতে চাই না আমি। চেষ্টা না করেই এভাবে হেরে যাবার কোনো মানে হয় না।

আমি রামপুরা থেকে সরাসরি রওয়ানা হলাম পুরান ঢাকাতে আমার ছোট বোনের বাসার উদ্দেশ্যে । কত বছর পর আমি ওর কাছে যাচ্ছি। ও আমাকে দেখে রাগ করবে নাকি খুশি হবে জানি না। আমি ওর বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। বাচ্চা দুটি নিশ্চয়ই আমাকে চিনবে না। সেই যে ছোট ছোট দেখেছি শেষবার। এ ক’বছরে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার যে পরিমাণ অলিগলি তাতে এক হিসেবে ওর বাসার ঠিকানাও ভুলে গেছি। তবে স্মৃতির খাতা এতটা অমলিন এখনো হয়নি। জিজ্ঞেস করে করে ঠিকই পৌঁছে যেতে পেরেছি।
পুরানো আমলের ছোট একটা তিনতলা বাড়ি। নিচ তলাতে কারখানার জন্য ভাড়া দেওয়া আর দোতলা তিনতলা মিলিয়ে ওরা থাকে। বাড়িটা ঠিক আগের মতই আছে। কোনো মেরামতের কাজবাজ করানো হয় না বোধ হয় বহু বছর। বাসার গেটটাও বদলায়নি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গেলে মাথায় গুতা খেতেই হবে। আমি যতদিন এসেছি খেয়েছি। এ নিয়ে কতবার বলেছি, তোদের গেটটা পালটা তো। এই আদিম যুগের গেইট কি এখন চলে? মাথা নিচু করে বাসার ভেতর ঢুকতে হয়।
অবশ্য যারা প্রতিদিন যেতে অভ্যস্ত তাদের কোনো সমস্যা হয় না। আমার মতো নতুনদেরই যত জ্বালা।

এ কথা বলার পরে আমার ছোট বোন টুম্পা আমাকে হেসে হেসে বলত , তোর জামাইয়ের মতো তো আর জামালের কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সা নেই যে চাইলেই খরচ করতে পারবে। দাদা শ্বশুর এই ভাঙ্গাচোরা বাড়িখান রেখে গেছেন বলে তাও থাকছি। কোনোদিন হাতে টাকা পয়সা হলে বদলাব। এখন কষ্ট করেই নিচু হয়ে আয়। তুই আসিসই বা কয়দিন! এই নিয়ে হাতেগোণা তিন চার বার তোর পায়ের ধুলা পড়েছে এই গরিবের দুয়ারে। আর বড়লোক দুলাভাই তো সেই যে বউ ভাতে এলো আর কোনোদিন দেখতে এলো না তার শালিটা কই আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে। তাও ভাগ্য ভালো যে বৌভাতটা বাসার ছাদে করেছিল। কমিউনিটি সেন্টারে করলে তো তার আর এ বাড়ির চৌকাঠ মারানো হতো না দুলাভাইয়ের।

গেট থেকে ঢুকতেই চোখ পড়ল কারখানার ভেতরের দিকে। খেয়াল করতেই দেখলাম ভেতরে জামালের মত কাউকে দেখতে পেলাম যেন! আমি আর উঁকিঝুঁকি না মেরে সরু অন্ধকার গলি মাড়িয়ে সিড়ির দিকে চললাম। হাতড়াতে হাতড়াতে এগুতে লাগলাম। এখানে একটা লাইট পর্যন্ত লাগায় না। এত হিসেব এদের! বিশেষ করে টুম্পার শ্বশুর । হাড়কিপ্টে যাকে বলে।
কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ । দরজা না খোলায় দ্বিতীয়বার বাজাতে যাব ঠিক সে সময়ে দশ বারো বছরের মত বয়সের একটা মেয়ে এসে দরজাটা খুলল।

– কে আপনি?

– আমাকে তো চিনবে না মামণি। টুম্পা বাসায় নেই?

– আম্মু বাসায় আছে । আপনি দাঁড়ান আমি ডেকে দিচ্ছি।

– তুমি মিথিলা ,মামণি? আমি অবাক হয়ে ভাবছি নিজের ভাগ্নী অথচ চিনতে পারছি না। কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা।

– জি , কিন্তু আপনি আমার নাম জানেন কী করে?

– আমাকে চিনতে পারছিস না , মা। আমি তোর খালামণি। তোর রূম্পা খালামণি।

– রুম্পা খালামণি? উনি এখানে কেন আসবেন? উনারা তো বেশ বড়লোক । উনারা এখানে আসেন না। আপনি দাঁড়ান। আমি আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসছি।

মেয়েটা এক ছুট দিয়ে চলে গেল। মাত্র মিনিট খানেকের ব্যবধানে ও ওর মাকে নিয়ে আসলো। আমি টুম্পাকে দেখে চিনতেই পারছি না। কী শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটির নিচে কালি পড়েছে। আমার সামনে এসে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে । ও হয়তো বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর চোখ দুটি ছলছল করছে। আমি এত বছর পর ওকে দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। হাতের ব্যাগগুলি নিচে পড়ে গেল মুহূর্তেই। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই টুম্পা আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আমিও টুম্পাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। মনে হলো বহুদিন পরে আম্মুর শরীরের গন্ধ অনুভব করলাম। খুব আপন গন্ধ। কতদিন এই গন্ধ টের পাই না আমি। আমি কী করে এই মায়া মাখা গন্ধকে উপেক্ষা করে এত দূরে পড়ে ছিলাম। দু’বোন মিলে এতদিনের জমানো কষ্ট কেঁদে কেটে কতক্ষণ চোখের পানিতে দূর করলাম। দু’জনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। টুম্পা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। সোফায় বসিয়ে আমার হাত দু’খানা ওর হাতের ভেতর চেপে রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, এই বুঝি মনে পড়ল আমার কথা , আপা? খুব কী তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না?

আমি একটা হাত ছাড়িয়ে ওর চোখ মুছতে মুছতে বললাম, কাঁদছিস কেন রে পাগলী? বাচ্চারা দেখ তাকিয়ে আছে। কী ভাবছে ওরা? আমি তো তবু এসেছি। তুই তো ভেবেছিলি আপা বুঝি মরেই গেছে। কোনো খোঁজখবর নিস নি কোনোদিন।

– কী বলছ , আপা? আমি এমন কেন ভাবব?

– এমন না ভাবলে খোঁজখবর তো নিতিস।

– আমি অনেকবার সাহস করেছি , আপা। কিন্তু অন্যায় তো আমিই করেছিলাম তোমার সাথে। কত বেশি বেশি বলেছি তোমাকে। ভেবেছিলাম যদি তুমি ফিরিয়ে দাও। সেই ভয়ে আমি আগাতে পারিনি।

– দূর বোকা! কিসের অন্যায়? এমন কথা কাটাকাটি কাদের না হয়? কিন্তু আমিও তোকে কত কীই না বলেছি। অথচ তোর খোঁজখবর নেইনি একবারের জন্যও। মাফ করে দিস বোন। আমার চোখ খুলে গেছে। আসল সমস্যা হচ্ছে আমাদের ইগো। আমাদের ইগোর কারণে আমরা এতটা দিন দূরে সরে থেকেছি। কিন্তু আর না। কিন্তু তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেন রে? আজকাল মানুষ সব মিষ্টিকুমড়ার মতো গোলগাল হয়ে যাচ্ছে আর তুই হচ্ছিস পাটকাঠি। ব্যাপার কী?

– আমার ডায়াবেটিকসের কারণে খুব নিয়মের মধ্যে চলি রে আপা। খাবার দাবার খুব সীমিত। আরো নানান সমস্যা আছে। সবই বলব। এত ব্যস্ত হোস না। তুই তো এখনো কুড়ি একুশে আছিস । যে কেউ বলবে তুই আমার ছোট বোন আর আমি তোর বড়। আচ্ছা, দুলাভাই , প্রিয় ওরা কোথায়? নিয়ে আসলি না কেন?

– তোর দুলাভাই ব্যস্ত মানুষ। সিলেটে আছে এখন।আর প্রিয় হোস্টেলে। ক্যাডেটে পড়ছে। জানিসই তো!

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাদের দিকে চোখ পড়ল। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলাম। ছেলেটা মনে হয় পাঁচ বছর হবে। কী যে কিউট হয়েছে বাচ্চা দুইটাই দেখতে , মা শা আল্লাহ! ওরা গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে এসে বসল। ছেলেটাকে কোলে আর মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে আদর করলাম। টুম্পা আমাকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। টুকটাক কথা বলতে বলতে আধা ঘণ্টার মধ্যেই খাতির হয়ে গেল দুইজনের সাথে। আমি ব্যাগ খুলে ওদের সামনে সব খেলনা , চকলেট বের করে দিলাম। কী খুশি ওরা দু’জনই। আমি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি কী করে এতগুলি দিন আমি এদের থেকে দূরে থেকেছি। আসল ভালোবাসা ছেড়ে আমি নকল দুনিয়াদারী নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এতদিন।

টুম্পা টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে আমাকে সেখানে নিয়ে বসাল।

– কী করেছিস বোকা? এতকিছু কখন রেডি করলি?

– করাই ছিল কিছু আপা। তুমি খাও তো!

– তোর শশুর শাশুড়ি আর দেবর কই ? দেখছি না যে!

– টুম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, উনারা উপরে থাকেন । নিচে আসেন না বললেই হয়। সব ভাগাভাগি করে দিয়েছে দুই ছেলের মধ্যে। উনারা ছোট ছেলের সাথেই থাকেন। অনেক অনেক কাহিনী আপা। শোনাব সবই। কত কষ্টের কথা জমা আছে। বুকটা খুলে যদি দেখাতে পারতাম। কষ্ট জমে জমে কলিজা পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে। কাউকে বলতে পারলে হয়তো জমানো কষ্ট কিছুটা হালকা হতো। এখন তোকে পেয়েছি মনের সব কষ্ট বের করে হালকা হবো।

– কেন রে? কী হলো এমন? তুইই তো দেখতি সবাইকে। আর জামালকে মনে হলো নিচে কারখানায় দেখে এলাম। ও চাকরি করছে না এখন? আজ তো হলিডে না।

– চাকরি বাকরি সব শেষ রে আপা। বললাম না কাহিনী আছে অনেক। পরে শুনিস। আগে খাবার মুখে দে। জামাল এখন এই কারখানা চালায়। আর ওই যে বললি শ্বশুর শাশুড়ির কথা। একটা কথা জানিস আপা, যে করে বেশি , তার বদনাম বেশি। এখন আমার পায়ে পায়ে দোষ খোঁজে তারা। আমি একদমই ভালো বউ না তাদের চোখে। আমি অপারগ তাদের মন জয় করতে। দেবরের বিয়ের পরও বেশ কিছুদিন ছিলাম একসাথে। নানান ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে গেলাম। চেষ্টা করেছিলাম সংসারটা একসাথে রাখার । পারিনি। আচ্ছা , ওইসব কথা বাদ দে। এবার বল দুপুরে কী খাবি?

– আমি তোর হাতের ভর্তা ভাত খেতে এসেছি রে। কিছুই তড়িঘড়ি করিস না। হালকা কিছু কর। আর জামালকে ডাক। একটু দেখা করি। আমি আবার চলে যাব খুব তাড়াতাড়ি। সিলেট যাচ্ছি । এয়ার টিকেট করা । তোর এখান থেকেই সরাসরি চলে যাব এয়ারপোর্টে। তাই হাতে কিছু সময় নিয়ে বের হতে হবে। রাস্তায় যা জ্যাম জানিসই তো।

– এটা কী হলো ? এত অল্প সময় নিয়ে এসেছিস কী করতে?

– আরে বোকা ! সিলেট থেকে ফিরে আবার আড্ডা হবে। এটুকু যে তোর সাথে দেখা হয়েছে তাতেই বুকের ভেতর কতটা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে তুই বুঝতে পারবি না। আচ্ছা, তোর শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দেখা করা দরকার তো! উনাদের কাছে নিয়ে চল।

– এখন যেতে হবে না। ফের যখন আসিস তখন যাস। উনারা বাসাতে নেই। শুধু দেবরের বউ আছে। ওর সাথে দেখা করতে যাবার দরকার নেই। আস্ত একটা বেয়াদব।

– আচ্ছা, তবে জামালকে ডাক দেখা করি। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই।

– ওকে খবর পাঠিয়েছি। আমি ফোন করেছিলাম। বাজার সদাই নিয়ে আসছে। তুই রুমে যেয়ে বস। আমি দ্রুত তোর জন্য কিছু খাবার দাবার রেডি করি।

ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম ওখানে। টুম্পার কাছ থেকে বেরিয়ে আসার পর কী যে নির্ভার লাগছে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নামিয়ে ফেললাম। কী যে ভালোলাগা কাজ করছে। চোখদুটি ভিজে আসছে বারবার। ইস, ঠিক এভাবেই জয় করতে পারতাম সব সমস্যাকে। মমতাজ আপার কাছে কী যে কৃতজ্ঞ আমি। উনি সেদিন ওভাবে জোর করে বস্তিতে নিয়ে না গেলে জীবনবোধের অনেক জ্ঞান সম্পর্কেই অজ্ঞাত থাকতাম।

সেলিমরা যে রিসোর্টে থাকছে আমি সেখানে পৌঁছে জানলাম সেলিম রিসোর্টে নেই। সে কী একটা কাজে সুনামগঞ্জে গেছে। ফিরতে বেশ রাত হবে। তবে আজ যে ফিরবে এটা নিশ্চিত। এবং হেলেন নামের ওই ডাইনি যে তার সাথে যায়নি এটা নিশ্চিত হলাম। ডাইনি তবে রিসোর্টেই আছে । যাক , ভালোই হলো। সেলিম আসার আগেই ওকে একবার ডোজ দেওয়া গেলে ভালোই হবে। আমি উনাদেরকে জানালাম আমার কথা সেলিমকে না জানাতে। আমি তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। একজন আমাকে সেলিমের রুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি রুমের সামনে পৌঁছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে মোচড় দিতেই খেয়াল করলাম ভেতর থেকে লক করা। কয়েকবার নক করার পর দরজা খুলল। দরজা ধাক্কা দিতেই দেখি ভেতরে একটা মেয়ে। বুঝতে পারলাম এটাই ওই ডাইনি। রুম সার্ভিস চলে গেল লাগেজ রেখে। আমি লাগেজ হাতে নিয়ে তাকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে হরহর করে ঢুকে যাচ্ছি দেখে সে অবাক হলো।

– হেই, কে আপনি? এখানে কি চাই?

– এই প্রশ্ন আমার করার কথা। তুমি কে? এখানে তুমি কী করো?

– হাউ ডেয়ার ইউ। আমাকে উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করছ? জাস্ট গেট আউট ফ্রম হিয়ার।

– এক্সকিউজ মি! ইউ জাস্ট গেট আউট।

– হাউ রুড! ডু ইউ নো হু এম আই?

– নো! ইউ টেল মি , প্লিজ! হু আর ইউ? প্রাইম মিনিস্টার অর প্রেসিডেন্ট?

– ডিসগাস্টিং! কোথা থেকে এসব পাগল ছাগল চলে আসে। আমি মিঃ সেলিমের পি এস!

– ওয়াও । তাই নাকি! তো ওনার বেড রুমে কী করছ তুমি, ব্লাডি বিচ!

– হাউ ফানি! ডোন্ট ইউজ এনি চিপ ওয়ার্ড! আমি মিঃ সেলিমের সাথে এই রুমেই থাকছি। এবার বল তুমি কে? কল গার্ল? সেলিম ডেকেছে?

এমনটাই চেয়েছিলাম। ও রেগে যেয়ে আমাকে দু’একটা বাজে কথা বলবে দেন আমি আমার পরিচয় দিব। আমি একদম প্রস্তুতি নিয়েই ছিলাম। হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ একদম বসিয়ে দিলাম মেকাপ করা গোলাপি গালটার ডানপাশটায়।

একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন নাস্তা জুটবে কপালে বেচারি আন্দাজই করতে পারেনি। এক থাপ্পড়ের ঝটকা কেটে ওঠার আগেই বাকী গালটাও দিলাম লাল করে। দুই থাপ্পড় খেয়ে সুন্দরীর দাঁত খুলে পড়ে যাবার অবস্থা। যারপরণাই অবাক হয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি আমি চিৎকার করে উঠলাম ।

– কাদের, কাদের?
কাদের আমার মোটামুটি বিশ্বস্ত লোক। বেশ পুরানো। সেও আছে এখানে। কাদেরর কাছে এসেই সবকিছু শুনেছি। কাদের এতদিন সেলিমের ভয়ে আমার কাছে সব লুকিয়ে রেখেছিল। কাদেরকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিলাম। দুই ডাক দিতেই ভেতরে চলে আসল।

– ইয়েস ম্যাডাম!

– এসব নোংরা ডাস্টবিন সেলিমের রুমে কী করছে? তোমরা সবাই কী করছ? ধাক্কা মেরে এটাকে এখনই এখান থেকে বের করে দাও। ওর মুখ দেখতে চাই না। পারলে ওকে সিলেট ছাড়া করে দাও।

– ইয়েস ম্যাডাম। বাট উনি আমাদের ইমপ্লয়ী। স্যারের অনুমতি ছাড়া উনাকে বের করা সম্ভব না।

– ওকে ফাইন। তবে ওটাকে রিসোর্টের বাইরে রাখো আপাতত। আমি যেন ওর ছায়াও না দেখি।

– ইয়েস ম্যাডাম।

হেলেনের এবার বোঝা হয়ে গেল আমার পরিচয়। চোরের মত কুতকুত করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি চোখ গরম করে তাকাতেই সে উধাও। সেই তেজ একদম গায়েব। দুই থাপ্পড়েই বেচারির খারাপ অবস্থা।

চলবে…….