সেই তুমি পর্ব-২২

0
2965

# সেই তুমি
# সানজিদা সন্ধি
#পর্ব ২২

অদিতির মৃত্যুর আজ একমাস পূর্ণ হয়েছে। সবাই নিজের শোক সামলে আগের জীবনে ফিরেছে। আহনাফ আর জারিফও এর ব্যাতিক্রম নয়। তবে রাতের আঁধারে কোথাও যেন তারা বড্ড অসহায় অনুভব করে। বড্ড বেশি। এই অসহায়ত্ব কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোনো লিখিত রূপ দেওয়া যায় না। অসহায়ত্ব, খারাপ লাগাকে সঙ্গী করেই জীবন চলছে। একজন মানুষের জন্য দু’জনের হাহাকার।

সবকিছু জানাজানি হওয়ার পরেও আহনাফ আর জারিফের মধ্যে সব ঠিকঠাকই আছে। অদিতির বিষয়ে জারিফ আর জাহিনের সম্পৃক্ততা আহনাফকে খুব বেশি প্রভাবিত করেনি।এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জারিফের ফ্ল্যাটেও গিয়েছে আহনাফ।

সবাই নিজের জীবনে ফিরলেও জাফনা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আহনাফ অদিতিকে ভালোবাসতো এই বিষয়টা কেন যেন সে মেনেই নিতে পারছেনা। কিছুতেই না৷ আহনাফ যখন জাহিনদের বাসায় এসেছিলো তখন জাফনা আহনাফের থেকে দূরে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো৷ ভুলক্রমে মুখোমুখি হয়ে গেলেও মাথা নামিয়ে সালাম দিয়েই চলে গিয়েছিলো সে৷ একমাসে তার লেখাপড়াও ভালোভাবে হয়নি। কলেজেও খুব কম গিয়েছে। মোটকথা আহনাফের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছেই নেই তার। এটা কী কোনো রাগের কারণে? না কি মন প্রাণ থেকে অন্যকারো হওয়া আহনাফকে কখনো না পাওয়ার ভয় থেকে? কিন্তু জীবন তো বড় অদ্ভুত। জীবন নামের নদীতে চলতে গেলে ভীষণ শক্ত হতে হয় মানুষকে। এই নদী ভীষণ খরস্রোতা,গভীর। তাই বৈঠা বাইতে হয় শক্ত হাতে। মনে সাহস রেখে। প্রস্তুত থাকতে হয় সবরকম পরিস্থিতির জন্য। জাফনাও মন শক্ত করে আবার আগের মতো সবকিছু করার সিদ্ধান্ত নিলো।

কলেজে প্রবেশ করতেই মাঠের মধ্যে বড়সড় একটা জটলা চোখে পড়লো জাফনার। আজ কলেজ টাইমের আধা ঘণ্টা পরে সে এসেছে। ব্যাপারটা কী সেটা বুঝলো না সে। তবে কোনো ঝামেলা হয়েছে এটা সহজেই আন্দাজ করে নিলো। নয়তো মাঠের মধ্যে এরকম বিশৃঙ্খল ভাবে থাকার সাহস কারো নেই। গেটের দাড়োয়ান আঙ্কেলও লেট করে আসার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখলো না। জাফনা দৌড়ে গেলো মাঠের মধ্যে। সেখানে টিচারদেরকে দেখে আরো অবাক হলো সে। কিছু বুঝলো না বিষয়টা। পাশে থাকা এক মেয়ের কাছ থেকে সে জানতে পারলো তাকে নিয়েই কলেজের দু গ্রুপের ছেলেদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়েছে। কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো জাফনা। এ কেমন কথা! তাকে নিয়ে মারামারি কেন হতে যাবে! টিচাররা দাঁড়িয়ে আছে। আর দুপক্ষের লিডাররা একে অপরের কলার ধরে দাঁড়িয়ে। কারো কথাই শুনছে না তারা। কেউ এগিয়ে আসতে নিলেই এক পক্ষ অপরপক্ষকে মারতে এগিয়ে আসছে। আগামীর ভবিষ্যতের নৈতিক অবক্ষয় দেখে শিক্ষকেরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর এমন একটা কারণে কারণে মারামারি যেটা মেনেই নেওয়া যায়না৷ সবার মধ্যে ফিসফাস চললেও আহনাফ শুধু চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিচ্ছু বলছেনা সে। ভীড়ের মধ্যে হুট করে জাফনার দিকে চোখ গেলো তার। চিৎকার করে ডাক দিয়ে বললো, ” এই জাফনা এদিকে আসো।”

জাফনার নাম শুনে সবাই চুপচাপ হয়ে গেলো। যেন সবাই বড়সড় সার্কাস দেখার অপেক্ষায়। এদিকে ভীড়ের মধ্যে নিজের নাম শুনে যতটা না বুক কেঁপে উঠলো জাফনার তার চেয়েও বেশি অসহায় লাগলো যখন সে বুঝতে পারলো যে তাকে ডাকছে সে আসলে আহনাফ। গুটিগুটি পায়ে আহনাফের কাছে পৌঁছালো জাফনা। গন্ডগোল বাঁধানো ছেলেগুলোও চুপ হয়ে গেলো। জাফনা আহনাফের কাছে পৌঁছুতেই আহনাফ ধমক দিয়ে সবাইকে ক্লাসরুমে চলে যেতে বললো। আর ছেলেগুলো প্রিন্সিপালের রুমে আসতে বললো।

প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সোফাতে মাথা নিচু করে বসে আছে জাফনা। আর আহনাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছেলেগুলো। প্রিন্সিপাল বসে আছেন তার চেয়ারটায়। আহনাফ ঠান্ডা অথচ কী ভীষণ গম্ভীর গলায় বললো, ” সমস্যা কোথায় তোমাদের? জাফনাকে নিয়ে কী সমস্যা?”

দুই গ্রুপের লিডার পরশ আর মুন প্রায় একসাথেই বলে উঠলো “আমি জাফনাকে পছন্দ করি।”

আহনাফ ঝড়ের বেগে গিয়ে দুজনের গালেই চড় বসালো। দুজনেই গায়ে হাত দিলো মুহুর্তেই। তাদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে জাফনা বুঝলো ছেলে দুটো ভালোই ব্যাথা পেয়েছে।

চড় দিয়েই আহনাফ বলতে লাগলো, ” এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি তোমাদের বাপের সম্পত্তি হ্যাঁ? এখানে যা খুশি তাই করবে? একটা মেয়েকে নিয়ে মারামারি কোন ধরনের অসভ্যতা? তোমরা যে বয়সে আছো সেখানে একজন মেয়ের প্রতি একজন ছেলের আকর্ষণ অনুভব করা স্বাভাবিক। আর একজন মেয়েকে একাধিক ছেলে পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে এটা জানাজানি হওয়ার পরে নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে? এটা তো অন্য কলেজের ছেলেও না। তোমরা তোমরাই। এভাবে ঐক্য বিনষ্ট হলে ফলাফল যে কী হবে বোঝাই যাচ্ছে। ” তারপরই সে বাকি ছেলেদের বলতে লাগলো, ” এই যে আমি গুণধরেরা বন্ধুর সাথে হুজুগে তাল মিলাতে গিয়ে যে বন্ধুরই চরম ক্ষতি করছো এটা কী জানো? শুনো ভালো কাজে পারলে সাহায্য করবে, সাহস দিবে। খারাপ কাজে কখনো না।”

জাফনা এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে শুনছিলো সবটা। ঘোরের মধ্যে থেকে কোথায় আছে এটা ভুলে গিয়ে সে বললো, ” আরে! তোরা কোন ধরনের ছাগল? আমাকে নিয়ে মারামারি করতে যাস? আর যখন আমাকে প্রপোজ করেছিলি তখন তো রিজেক্ট করেই দিয়েছিলাম তোদের দুজনকেই৷ তারপরেও আবার কেন এরকম করলি? হুস হুস। ”

কথাগুলো বলার পরই আহনাফের চোখে চোখ পড়লো জাফনার। তার রাগান্বিত চোখ দেখে সে মুহুর্তেই জিবে কামড় দিয়ে চুপ হয়ে গেলো।

প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে ওয়ার্নিং দিয়ে চলে যেতে বললো।

জাফনা আর আহনাফও এক সাথে বেড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। অনেকদিন পরে তারা কাছাকাছি আছে। একমাসের মধ্যে তো জাফনা আহনাফের মুখোমুখিই হয়নি৷ যেদিন যেদিন ক্লাস রুটিনে আহনাফের ক্লাস ছিলো সেদিন করে সে আসেইনি। তেমনি আজকেও আহনাফের ক্লাস নেই। মানে জাফনাকে আহনাফের কাছাকাছি থাকতে হচ্ছে না।

অন্যদিন হলে জাফনা কথা তো বলতোই৷ তবে আজ একদমই কিছু বলছে না। আর আহনাফ একটা বিষয় নোটিশ করেছে জাফনা তার ক্লাস যেদিন থাকে সেদিন আসে না। বাকি দিন ঠিকই আসে। বিষয়টা কী সেটা সম্পর্কে ধারণা নেই আহনাফের। সে নিজেই ট্র্যাজেডির মধ্যে ছিলো তাই কারো দিকেই খুব বেশি একটা লক্ষ্য রাখতে পারেনি।

সবকিছু বিবেচনা করে আহনাফ নিজেই গলা খাঁকারি দিয়ে কথা শুরু করলো। ” কী ব্যাপার ম্যাম? তোমাকে দেখা যায় না ইদানীং? খুব বেশি ফাঁকিবাজ হয়ে গিয়েছো। আমি পড়া জিজ্ঞেস করি সেই ভয়েই আসো না না কি?”

জাফনা বোকা হয়ে গেলো। সে আহনাফের ক্লাস এটেন্ড করে না অন্য কারণে আর আহনাফ কী ভেবে নিয়েছে।

তড়িঘড়ি করে জাফনা বললো, ” আমি মোটেই ফাঁকিবাজ নই স্যার। আপনার ক্লাস ভালো লাগে না, তাই আসিনা। ”

আহনাফ খানিকটা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরেই বললো, ” আমার ক্লাস করার জন্য ছেলে মেয়ে সবাই পাগল হয়ে থাকে আর তোমার ভালো লাগে না? কী অদ্ভুত! আসলে কী বলো তো কুকুরের পেটে তো ঘি সহ্য হয়না। এ আর নতুন কী।”

আহনাফের ট্যারা ট্যারা কথা শুনে জাফনা ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো, “স্যার আপনি কী আমার সাথে ঝগড়া ছাড়া কিছুই করতে পারেন না?”

জাফনাকে অপ্রস্তুত করতে আহনাফ ঠোঁট কামড়ে বললো, ” সে কী জাফনা! আর কী করবো। ”

আহনাফ যে তাকে অন্য কিছু মিন করেছে এটা সে ভালোই বুঝলো। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অপ্রস্তুত হলেও শক্ত মুখে বললো, আর কিছু বলতে বুঝিয়েছি ভালো ব্যাবহার৷
আমার সাথে সবসময় বুড়ো মানুষের মতো খ্যাঁকখ্যাঁক করেন কেন? আপনি কী তিনবেলা তিতা করলা খান? মুখ থেকে শুধু তিতা ঝড়ে।”

জাফনার কথা শুনে আহনাফ হেঁসে ফেললো। এই চঞ্চল মেয়েটা চুপচাপ থাকলে তার নিজেরই কেমন যেন লাগে। আহনাফ ভাবলো একসময় সে জিজ্ঞেস করে নেবে কী হয়েছিলো জাফনার।”

আহনাফের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে লাফাতে লাফাত ক্লাসরুমে গেলো জাফনা। আজকে তার ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে।

চলবে,,,,,