সেলাই মেশিন পর্ব-৩+৪

0
201

সেলাই মেশিন
————-
(৩)

মৌরির বয়স যখন মাত্র পাঁচ, তার মা মরিয়ম মারা গেলো। খুব খারাপ জন্ডিস হয়েছিল তার, কাওকে জানায়নি, কষ্ট লুকিয়ে রেখে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে গেছে। মৌরির বাবা সামান্য চাকুরীজীবি, ডাক্তারের কাছে গেলেই এক গাদা খরচ। লোকের উপদেশে কী সব লতাপাতা খেয়ে জন্ডিস কমাতে চেয়েছিলো। ফল স্বরূপ মৌরিকে মা হারা হতে হলো। মৌরির এখন মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়। মরিয়ম যদি নিজের একটু যত্ন নিতো তাহলে এমন ছোট বাচ্চাকে ফেলে চলে যেতে হতো না। মা শুধু বাবার আর্থিক সংগতির কথা ভেবেছেন, মৌরির কথা একবারও মনে হয়নি? অবশ্য মানুষ নিজের মৃত্যুর জন্য কখনোই প্রস্তুতি নেয় না, মরিয়মও নেয়নি। ভেবেছে, এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে। জগতে এমনি এমনি কিছুই ঠিক হয় না, মৌরি এখন বোঝে।

মরিয়মের মৃত্যুর পর মৌরির বাবা বিপদে পড়লেন। মৌরি সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, কে তার দেখাশোনা করবে, এই চিন্তায় তার বাবা অস্থির হয়ে গেলেন। ছেলের বৌয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মৌরির দাদি তখন তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। বাবা তাকে আটকে রাখলেন, দাদা ফিরে গেলেন। গ্রামের বাড়িতে তার কৃষি কর্ম আছে, চাইলেও অন্য কোথাও গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না, কাজ আটকে যায়। দাদি মাসখানেক মৌরিকে আদর মমতায় মায়ের অভাব বুঝতে দিলেন না। দাদির সাথে ভালোবাসার সম্পর্কের সূত্রপাত ওখান থেকে। মৌরিকে স্কুলে দেয়া আনা গোসল করানো খাওয়ানো- সব কিছুর দায়িত্ব দাদির। কিন্তু দাদীকেও তো নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে, ওখানে দাদা একা, গেরস্থালির হাজার কাজ ফেলে ছেলের বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে দাদি বিদায় নিলেন।

এবার সত্যি সত্যি বুকের ভেতর কেমন করতে লাগলো মৌরির, বাড়িটা যেন অন্যরকম হয়ে গেলো। ছোট্ট মৌরি কাওকে বোঝাতে পারে না কী ভীষণ শূন্যতা তার মনটাকে সবসময় অন্ধকারে ঢেকে রাখে। মৌরিকে স্কুলে বাবা দিয়ে আসতেন কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আনবে কে? পাশের বাড়ির এক মহিলাকে অনুরোধ করে মৌরিকে স্কুল থেকে আনার ব্যবস্থা করা হলো। মহিলার ছেলেও মৌরির স্কুলে পড়ে, ছেলেকে আনার সময় মৌরীকেও নিয়ে আসতেন। মৌরি স্কুলের পরে ওদের বসার ঘরে একটা মোড়ায় চুপ করে বসে থাকতো। সেই মহিলা এক প্লেট ভাত মেখে ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, আর ক্ষুধার্ত মৌরি সেদিকে তাকিয়ে থাকতো। একদিন মহিলা বলেই ফেললেন, “মৌরি এভাবে তাকিয়ে থাকবা না, ছোটনের পেট ব্যাথা করবে।” তখন ওই অপমানের অর্থ বোঝেনি, এখন বোঝে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অফিস থেকে ফিরে বাবা মৌরিকে নিয়ে যেত। বাবার হাতে থাকতো এক প্যাকেট বিরিয়ানি অথবা হোটেল থেকে আনা ভাত আর মাছের তরকারি। মৌরিকে মুখে তুলে খাওয়ানোর মতো শক্তি তার থাকতো না, সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত বাবা প্লেটে খাবার দিয়ে পাশে চুপচাপ বসে থাকতেন। মায়ের কথা নিশ্চয়ই মনে হতো তার, ক্লান্ত বিষন্ন চোখদুটো দেখে মৌরির মন খারাপ হতো। বাবাকে বলতে পারতো না স্কুল থেকে ফিরে তার খুব খিদে পায়, বাবার জন্য এতক্ষন অপেক্ষা করতে তার কষ্ট হয়। ছোট হলেও ততদিনে জীবনের অনেক কঠিন চিত্র দেখা হয়ে গিয়েছিলো।

একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাবা মৌরিকে পাশের বাসা থেকে নিতে গিয়ে দেখেন মৌরি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহিলার মুখ রাগে থমথম। কটমট করে বললেন, “আপনার মেয়ের খাবার ব্যবস্থা কইরা যাবেন এখন থেকে। আপনার সমস্যা দেইখা ওরে স্কুল থেকে নিয়া আসতে রাজি হইলাম কিন্তু আজকে সে কী করেছে জানেন? ছোটনের জন্য বাটারবন আনছিলাম, ওইটা খাইয়া ফেলেছে। এই কেমন মেয়ে আপনার?”

অপমানে বাবার মুখ থমথম করছে। মৌরিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে বললেন, “ওই ছেলের খাবার ক্যান চুরি করলি? লোভী মেয়ে, এত খিদা তোর? একটু সহ্য হইলো না? দাড়া, আজকে তোরে ভাত রান্না কইরা খাওয়ামু, দেখি কত খাস।”

বাবাকে এত রেগে যেতে কোনোদিন দেখেনি মৌরি। ওর ছোট্ট হৃদপিন্ড ভয়ে ধুকপুক করছিলো। মনে হচ্ছিলো বাবা ওকে আজকে মেরেই ফেলবে। বলতেই পারলো না ছোটন নিজে থেকেই ওই বাটারবন ওকে খেতে দিয়েছিলো।

বাবা রান্নাঘরে প্রথমবারের মতো রান্না করতে গেলেন। রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছিলো, বসার ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলো মৌরি। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ আর বাবার আর্তচিৎকার শোনা গেলো! মৌরি ছুটে গিয়ে দেখে বাবা মেঝেতে পড়ে আছে আর চুলা দাউদাউ করে জ্বলছে।

গ্যাসের কোনো গোলযোগের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বাবার দুইটা হাতই পুড়ে গিয়েছিলো। আশেপাশের লোকজন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সে রাতেই দাদা দাদি গ্রাম থেকে আবার এলেন।

হাসপাতালে বাবাকে দেখতে গিয়েছিলো মৌরি। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কাঁদলেন! ফিসফিস করে বললেন, “ভালো হইছে, আগুন আমার উপরে দিয়া গেছে, আমার আম্মা তো ভালো আছে। ওর যদি কিছু হইতো?”

বাবা প্রায় দুই সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরলেন। দাদি দাদার আগমনে বাড়িটা মৃত্যুপুরী থেকে জীবন্ত হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। রান্না ঘর মেরামত করা হলো। বাবা অফিস থেকে পুরো এক মাসের ছুটি নিলেন। কিন্তু আবার সেই আগের মতো দাদির যাবার সময় হয়ে গেলো। এবার মৌরি ভীষণ কান্না জুড়লো, দাদিকে কিছুতেই যেতে দেবে না। উপায়ন্তর না দেখে দাদি বললেন মৌরিকে তার সাথে করে গ্রামে নিয়ে যাবেন। বাবা আঁতকে উঠে বোলো, “ওর পড়ালেখা কী হইবো? গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা হয়? পোলাপাইন সারাদিন গাঞ্জা খায়।”
দাদি বললেন, “ওই স্কুলে তো তুইও পড়ছস, গাঞ্জা কই তোর? সবখানেই ভালো মন্দ থাকে। এইখানে মাইয়াটারে ক্যামনে রাখবি? ওর দেখাশোনা কে করবো? কাজের লোক রাখার মতো অবস্থা তোর নাই। এক পাতিল ভাত রানতে গিয়া হাত পুইড়া শেষ। তুই একলা মাইয়াটারে ক্যামনে দেখবি?”
“তোমরা দুইজন এইখানেই থাকো না। গ্রামে গিয়া আর কী করবা?”

দাদা দুই হাত তুলে না করলেন। তার অল্প বিস্তর ধানি জমি আছে, ওগুলোর চাষাবাদ তিনি নিজের হাতে করেন। কাজ পাগল ব্যস্ত মানুষ তিনি, অল্পতেই সন্তুষ্ট। গ্রামের কারবার ছেড়ে মফস্বল শহরে ছেলে বাড়িতে অকর্মন্য হয়ে পড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। তিনি নিজের ভিটেয় ফিরে যাবেনই। শেষে দাদি বলেই ফেললেন, “তুই আরেকটা বিয়া কর বাপ।”
“কী কও মা? সৎ মা আইসা আমার মাইয়াটারে যদি দেখতে না পারে?”
“আরে সব মাইয়া কি এক রকম? ভালো ঘরের নরম শরম একটা মাইয়া খুইজা বাইর কর। তোর কী এমন বয়স হইছে ? সারাজীবন কি আর একলা থাকবি? দেখ, যদি ভালো মাইয়া পাওয়া যায়।”

দাদির বিদায়ের সময় মৌরি রীতিমতো গলায় ঝুলে থাকলো। চিৎকার করে কাঁদছিলো ও। দাদি অনেক বোঝালেন, “তোর আর বেশিদিন কষ্ট হইবো না মৌরি পাখি, তোর বাপ নতুন একটা মা নিয়ে আসবো। অনেক আদর করবো তোরে।”
“আমার নতুন মা লাগবো না। তুমি থাকো।”
দাদি তবুও চলে গেলেন আর দাদির কথা সত্য হলো। তিনি যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাবা শাহেদাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন। কখন কিভাবে কেন তার সাথে এই মহিলার পরিচয় হয়েছিল, মৌরি কোনদিন জানতে পারেনি।

(ক্রমশ)
সেলাই মেশিন
————-
(৪)

সেদিন সকালে বাবা তাকে এক মামার বাসায় রেখে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় কাচুমাচু মুখে শাহেদাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। মামা মামী আগেই হয়তো সব জানতেন, মিষ্টি মুখ করিয়ে নতুন দম্পতিকে ঘরে তুলে নিলেন। রাতে পোলাও রোস্টের আয়োজন ছিল। কিন্তু মৌরির কেমন কষ্ট লাগছিলো, তার বাবা যেন আগের মতো নেই। কেমন লাজুক মুখে আড়ে আড়ে ওই মহিলার দিকে তাকাচ্ছে! মামী বললেন, “মৌরি, আজকে থেকে উনি তোমার মা। মায়ের কোলে গিয়ে বসো।”

মৌরি শক্ত হয়ে শাহেদার কোলে বসলো। কেউ বললেই মাত্র কয়েক মুহূর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত কাওকে মা হিসাবে মেনে নেয়া সম্ভব? অথচ মামা মামী বারবার বলতে লাগলেন, “মা বলে ডাক, গলা জড়িয়ে ধরো।” কেউ বুঝতে পারলো না মৌরির বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। এমন জোর জবরদস্তি করে মায়ের জায়গা অন্য কেউ দখল করতে পারে না।

সেদিন রাতে মৌরি আলাদা রুমে একা ঘুমাতে গেলো। বাবার পাশে শুয়ে এতদিন ঘুমাতে ঘুমাতে বাবার গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, একদিনের মধ্যেই বাবা তাকে সরিয়ে দিলো? বাবার গায়ের গন্ধ ছাড়া ও ঘুমায় কেমন করে? ছোট্ট মৌরি সে রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছিলো, কেউ ওকে সান্তনা দিতে আসেনি।

শাহেদা মৌরিকে বকা দিতো, মারতো- এমনটা না। সময় মতো স্কুলে নেয়া আনা, খাওয়ানো সবই সে করতো কিন্তু বয়স কম হলেও মৌরি বুঝতো, তার নতুন মা এসব করতে অসম্ভব বিরক্ত বোধ করে। শীতল একটা দূরত্ব তৈরি করে রাখে যা অতিক্রম করার সাধ্য ছোট্ট মৌরির ছিল না। শাহেদাকে ও ভয় পেতো, আপন করে নিতে পারতো না। ওর ইচ্ছা করতো নতুন মায়ের মমতা পেতে, কিন্তু ওর চাওয়া অপূর্ণই থাকলো। বাবা যদি মৌরির জন্য বিশেষ কিছু করতো বা কিনতো, শাহেদা তারপর বেশ কয়েকদিন মৌরির সাথে কথাই বলতো না, মৌরি সামনে এলে মুখ ঘুরিয়ে রাখতো, যেন মৌরি বিরাট কোন অপরাধ করেছে। মৌরি একদিন শুনে ফেললো শাহেদা তার বাবাকে বলছে, “ওই মেয়ের জন্য সব খরচ কইরা ফেললে আমার বাচ্চাদের জন্য কী থাকবো? কয়দিন পরপর নতুন জামা, জুতা, জন্মদিনের কেক, এইসব কী?”
মৌরি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাবা ওর হয়ে কোনো কথাই বললো না। অফিস থেকে ফেরার পথে চকলেট আনা বন্ধ হয়ে গেলো, ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়াও বন্ধ হলো। মৌরি ধীরে ধীরে সব কিছুর সাথে মানিয়ে জীবন চালাতে শিখে যাচ্ছিলো। আগের মতো সব কিছু নিয়ে কষ্ট পায় না। বুঝতে পারে, ওকে নিয়ে বাবা আর নতুন মায়ের মাঝে মনমালিন্য সবসময় চলছে। বাসায় মন টেকে না মৌরির। স্কুল বন্ধ হলেই দাদির কাছে যাওয়ার আবদার জুড়ে বসতো আর বাবাও তাকে কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়ে স্বস্তি পেতো।

দাদির কাছে কাটানো ছুটির দিনগুলো মৌরির শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। দাদী তাকে এতটাই ভালোবাসতো, মনে হতো ও দেশের রাজকন্যা! দাদা বাজার থেকে কত কিছু কিনে আনতো, কত পদের রান্না যে দাদি করতো! দাদির পুরোনো সেলাই মেশিনে কত রকম জামা ওকে বানিয়ে দিতো।

তখন ও ক্লাস সিক্সে পড়ে। চিকেন পক্সে একেবারে নাজেহাল হয়ে গেলো সে বছর। মৌরির সামনে কিছু প্রকাশ না করলেও বাবা আর নতুন মায়ের মাঝে ঝগড়া তখন তুমুল। শাহেদার গর্ভে তখন রুনু। তার ধারণা এই অবস্থায় যদি মৌরির ছোঁয়াচে রোগ তাকে ধরে তাহলে অনাগত শিশুর বিরাট ক্ষতি হতে পারে। প্রতিদিনের অশান্তি ত্যেকে রক্ষা পেতে একদিন বাবা ওর ঘরে এসে বললো, “মা রে, এইখানে তুই ভালো থাকতে পারবি না। কয়দিন পরে তোর একটা ভাই বোন আসবো, তোর মা ব্যস্ত হইয়া যাইবো। তোরে দাদির কাছে রাইখা আসি?”

“কিন্তু আমার স্কুল? আমার সব বন্ধুদের ফালায় চলে যাবো?”

মৌরির হাত ধরে বাবা বলেছিলো, “তোর দাদি তোমাকে অনেক আদরে রাখবো রে মা। এইখানে তুই ভালো থাকবি না।”

মিশ্র অনুভূতি নিয়ে দাদির কাছে পৌছালো মৌরি। একদিকে দাদির কাছে পাকাপাকি থাকার আনন্দ আরেকদিকে স্কুলের বন্ধুদের ফেলে আসার কষ্ট। গ্রামের হাই স্কুলে মানিয়ে নিতে ওর খুব একটা কষ্ট হলো না। দাদি তাকে স্কুলে দিয়ে আর নিয়ে আসার জন্য এক ষণ্ডা মত লোক রেখে দিলেন, কবির নাম। দাদার জমিতে কাজ করতো লোকটা। মৌরি তাকে ডাকতো কবির চাচা। কবির কথা বলতে পারতো না ,কুচকুচে কালো গায়ের রং, বড় বড় উজ্জ্বল চোখদুটো ভাটার মতো জ্বলতো। মাথা ভর্তি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। সকালে বাড়ির উঠানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতো কবির। মৌরি স্কুলে হেঁটেই যেত, পিছনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকতো কবির। স্কুল থেকে বেরিয়ে গেটের কাছের কবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো। আবারো অস্বস্তিকর নীরবতায় মৌরির পেছন পেছন আসতো কবির। রাস্তায় কেউ মৌরির সাথে কথা বলার সাহস করতো না। বাজারের মধ্যে বাড়ি ফেরার রাস্তায় চায়ের দোকানে অল্প বয়সী ছেলেপিলেরা আড্ডা দিতো। তারা মৌরির দিকে ঘুরেও তাকাতো না, কবিরের ভয়ে। এই জন্যেই কবিরকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন দাদি।

এর কিছুদিন পরেই মৌরি জানতে পারলো তার একটা বোন হয়েছে। মৌরির খুব আনন্দ লাগছিলো। ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে ও সময় কাটাবে, খেলবে, ভাবতেই ওর কিশোরী মন বাবার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলো। দাদি তখন সেলাই মেশিনে ছোট বাবুদের জামা বানাতে বসলেন, কয়দিন পরে ছেলের বাড়িতে যাবেন সদ্যজাত নাতনীকে দেখতে, তার আয়োজন। মৌরি তখন বললো বোনের জন্য ও নিজের হাতে জামা বানাবে। ওই প্রথম দাদির কাছে সেলাইয়ের হাতে খড়ি।

দাদি দাদার সাথে বাসায় ফিরেছিল মৌরি। এসে দেখে ওর পুরোনো ঘরটা পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়েছে। দেয়ালের রং বদলে গেছে, খাট সরিয়ে তোষক পেতে রাখা হয়েছে। মৌরির ছোট্ট খাট নিয়ে যাওয়া হয়েছে শাহেদার ঘরে, রুনুর জন্য আলাদা জায়গা দরকার। শাহেদা রুনুকে কোলেই নিতে দেয় না, মৌরি নাকি কোলে নিতে পারবে না। মৌরি সারাদিন বাবুর পাশে ঘুরঘুর করে, কিন্তু রুনুকে কোলে নেয়ার সুযোগ পায় না। একদিন বিকেলে শাহেদা ঘুমাচ্ছিলো, রুনু ছিল দাদির কাছে। দাদি বললো নামাজ পড়বে, মৌরি যেন কিছুক্ষন বাবুকে দেখে। মৌরি মহা আনন্দে রুনুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে রাজ্যের গল্প জুড়লো, গ্রামের গল্প, স্কুলের গল্প, কবির চাচার গল্প, যেন ছোট্ট রুনু ওর সব কথা শুনছে আর বুঝতে পারছে। চেয়ার পেছন দিকে দুলিয়ে গল্প করতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি।

(ক্রমশ)