সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব-১৬+১৭

0
180

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_১৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আবরারে’র কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।চোখের সামনে চেনা মুখ’টা নিমিষেই মিলিয়ে গেল।আবরার চাইলে-ও ধরতে পারলো না।তার ধরা ছোঁয়ার আগেই মানুষ’টা একটা গাড়িতে উঠে চলে গেল।আবরার ব্যস্ত পায়ে,ফুলের দোকানের কাছে গেল।হাতে সামান্য ব্যথা পেয়েছে।হাত ধরে নিয়ে বলল।

–মামা আপনার দোকান থেকে এখনই যে,মানুষ’টা ফুল কিনে নিয়ে গেল।উনার নাম কি?উনি কোথায় থাকেন?

–এইডা তো আমাদের আকাশ ভাইয়া।যখনই বউ রাগ করে, তখনই আকাশ ভাইয়া আমার কাছে আসে।ফুল কিনে নিয়ে যায়।তার বউ নাকি ফুল বড্ড ভালোবাসে,
ভালোবাসা করে নাকি,দু’জন বিয়ে করেছে।আকাশ ভাইয়ের সাথে,আকাশ ভাইয়ার বাবা-মায়ের পড়ে না।তাই আকাশ ভাইয়া বউ নিয়ে আলাদা থাকে।আপনি তার সম্পর্কে এতকিছু জানতে চাইছেন যে, আকাশ ভাইয়া কি আপনার কিছু হয়।আপনার মাথা দিয়ে তো রক্ত পড়ছে।ঔষধ লাগিয়ে আসেন।আবরার পাশে থাকা বেঞ্চে বসতে বসতে বলল।

–তোমার আকাশ ভাইয়া কোথায় থাকে তুমি জানো মামা?

–আগে আমাদের সাথে বস্তিতে থাকতো।এখন মেলা বড়লোক হয়ে গিয়েছে।তাই শহরে বাড়ি কিনছে।সেখানেই বউ নিয়ে থাকে।কোথায় থাকে এটা বলতে পারি না।যতটুকু জানি ততটুকুই বলে দিলাম।আকাশ ভাইয়া আপনার কে হয়?

–আমার বন্ধু হয়।অনেক দিন হলো ওর সাথে দেখা হয় না।ওর নাম্বার’ও নেই?ওর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে?

–আপনি তাহলে মাঝে মাঝে আমার কাছে আইসেন।আকাশ ভাইয়া আসলে,আমি তাকে জানাবো।আপনি আকাশ ভাইয়া’কে খুঁজতে এসেছিলেন।

–আচ্ছা মামা বলবেন।পারলে নাম্বার রেখে দিবেন।আমি আবার আসবো।এখন আমাকে হসপিটালে যেতে হবে।বলেই আবরার চলে গেল।দোকানদার অদ্ভুত ভাবে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল।

আয়াত ফুটপাতের রাস্তা ধরে জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছে।উদ্দেশ্য সে,আজকে হেঁটে বাড়ি যাবে।আব্রাহাম তার থেকে সব টাকা নিয়ে নিয়েছে।আয়াত হাঁটছে।আব্রাহাম আয়াতে’র পেছনে পেছনে ছুটছে।আব্রাহাম ক্লান্ত হয়ে বলল।

–আচ্ছা বাবা স্যরি আর কখনো এমন করবো না।তোমাকে কখনো গুরুত্ব কম দিব না।সব সময় বেশি বেশি গুরুত্ব দিব।আয়াত ফুল নিবে।আব্রাহামে’র কথায় আয়াত দাঁড়িয়ে পড়লো।রাগে হাসফাস করতে করতে বলল।

–আমার বাবা টাকার কি অভাব পড়েছে।যে,পরের ছেলের থেকে আমাকে ফুল নিতে হবে।আমার মতো ফুলকে কষ্ট দিয়ে ফুল কিনে দেওয়ার কথা বলছো!তোমার লজ্জা করে না?আগে ফুল কিভাবে আগলে রাখতে হয়।সেটা শিখো।তারপরে ফুল কিনে দেওয়ার কথা বলবে।বলেই হাঁটতে শুরু করল।গরম ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে আয়াত।মুখ’টা লাল হয়ে উঠেছে।আব্রাহাম কি করবে বুঝতে পারলো না।আনমনে বলে উঠলো।আয়াত দেখো হিয়া আসছে।হিয়ার কথা শুনতেই আয়াত রাস্তার ওপাশে তাকালো।এই মেয়ে’টা এতটা নির্লজ্জ,যেখানেই আব্রাহাম’কে দেখবে।সেখানেই চলে আসবে।হিয়াকে আয়াতের একদম সহ্য হয় না।হিয়া রাস্তা পার হয়ে এসে বলল।

–আয়াত তুমি না সুস্থ হয়ে গিয়েছো?তাহলে একটা অচেনা ছেলের সাথে কি করছো?

–আপনি কে?এসব কি বলছেন।মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।আব্রাহাম মেয়ে’টা কে?আমাকে এসব বলছে কেনো?পাগল নাকি?আজকাল পাগল গুলো পাবনা না থেকে,রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়?এটা তো আমার জানা ছিল না।

–আয়াত তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো?

–তোমার অপমান আছে?

–আব্রাহাম হসপিটালে চলো।একটা জরুরি পেশেন্ট এসেছে।তোমাকে এখনই যেতে হবে।

–দেখতে পাচ্ছো না।আব্রাহাম একটা রোগী নিয়ে ঘুরছে।একটা ডক্টর কয়টা রোগী দেখবে।হসপিটালের’টা বরং তুমি দেখে নাও।চলো আব্রাহাম বলেই হাঁটতে শুরু করল।আব্রাহাম আয়াতে’র কথা শুনে,মনে মনে হাসলো।বাহিরে প্রকাশ করল না।হিয়া বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে।সারাদিন আয়াত আর আব্রাহাম ঘুরলো।বিকেলে আয়াত’কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আব্রাহাম হসপিটালে চলে গেল।

অন্ধকার রুমের মধ্যে বসে আছে দু’জন ব্যক্তি।তখনই কালো পোশাক পড়া একজন লোক এসে বলল।

–স্যার আপনার ছেলে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।ব্যক্তিটি কালো পোশাক পড়া ভারি দেহের লোকটি’র দিকে একবার তাকিয়ে,কপালে বিরক্তির ছাপ ফেলে বলল।

–তোমাকে কতবার বলছি।ও আসলে,আমাকে বলতে আসবে না।সরাসরি আসতে দিবে।তবু-ও বারবার কেনো বিরক্ত করো।এর পরে ভুলে হলে,গলা থেকে মাথা আলাদা করে দিব।আগন্তুকে’র কথা শুনে,লোকটি আর দাঁড়ালো না।সেকেন্ডের মধ্যে রুম ত্যাগ করল।একটু পর হনহন করে একটা ছেলে রুমে প্রবেশ করল। বিকট চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো।

–এভাবে আর কতদিন নাটক করতে হবে।আমি আর পারবো না।আমি যেভাবে বেঁচে আছি।এটা কোনো জীবন হতে পারে না।আমার এতকিছুর থাকার পরে-ও,আমাকে সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে,তুমি যদি ছেলের দায়িত্ব নিতে পারবে না।তাহলে তুমি সন্তান জন্ম দিয়েছিলে কেনো?ছেলেটি’র কথা শেষ হবার সাথে সাথে ছেলেটি’র বাবা ছেলেটি’র গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো।

–তুমি ভুলে যাচ্ছো,আমি তোমার বাবা হই।তোমার সাহস কি করে হয়।আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার।আমি তোমাকে এত সাহস দেয় নাই।কে দিলো তোমাকে এত সাহস।তোমার জীবনে আসা দু’দিনের মেয়ে’টা।তাহলে তাকে নিয়েই ভালো থাকো না।বারবার আমার কাছে আসছো কেনো?কুলাঙ্গার একটা।বাবার বিপদে বাবাকে সাহায্য করবে।তা না করে, আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলছো।আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলতে আসলে,তোমার উঁচু গলা টেনে ছোট করবো বেয়াদব একটা।এখনই মুখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও।ছেলেটি’র বাবার কথা শুনে,ছেলেটি’র আত্মা কেঁপে উঠলো।ভয়ে গাল হাত দিয়ে মাথা নিচু করে আছে।মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ’ও বের হলো না।ছেলেটি’র বাবা রাগ দেখিয়ে বলল।

–তোমার রুপ দেখার জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয় নাই।আব্রাহামে’র বিয়ের দিন।তুমি আব্রাহাম’কে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাবে।বাকিটা আমরা করে নিব।আব্রাহাম যেনো ভুলে-ও টের না পায়।আব্রাহাম খুব চালাক।

–কত চালাক জানা আছে।না হলে নিজের ভাইকে খোঁজার জন্য,নিজের প্রিয় মানুষ’কে ছেড়ে দিতে রাজি হয়।বলেই বাবার দিকে তাকালো।ছেলেটি’র বাবা রক্ত চক্ষু নিয়ে,ছেলেটি’র দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটি’র ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

–আব্রাহাম পুড়ছে।ভেতর থেকে গভীর ভাবে পুড়ছে।তাই তো এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল।আব্রাহামে’র মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ,এত সহজে সবকিছু মেনে নিল।এটা তোমাকে ভাবাচ্ছে না।তোমার মতো উজবুকে মাথায় এটা আসবে না।সেটা আমি ভালো করেই জানি।যাও গিয়ে দেখো আব্রাহাম কি করছে।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলো আবরার।কপালে ব্যান্ডেজ করা।সারাদিনের ক্লান্তি চেহারায় ফুটে উঠেছে।মলিন কণ্ঠে রজনী’কে ডাকলো।রজনী বিরক্ত হয়ে এসে বলল।

–সমস্যা কি তোমার?বাসায় এসে এভাবে ডাকাডাকি করো কেনো?আমাকে ডাকা ছাড়া তোমার কোনো কাজ নেই।

–এক গ্লাস পানি দিবে?

–একটা গ্লাস পানি নিজে নিয়ে খেতে পারো না।এই সামান্য কাজের জন্য আমাকে ডাকতে হবে।

–আচ্ছা থাক লাগবে না।তুমি তোমার কাজে যাও।নিজের’টা আমি নিজে করে নিচ্ছি।বলেই উঠতে যাবে।তখনই আবরারের মা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল।ছেলেকে মুখে তুলে পানি খাইয়ে দিয়ে বলল।

–তোর মাথায় কি হয়েছে বাবা।তুই যখন রুমে প্রবেশ করছিলি।আমি তখনই তোর দিকে খেয়াল করলাম।শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।রজনী পড়তে বসেছিল।তাই আমি পানি নিয়ে আসলাম।এখন দেখি রজনী রুমেই আছে।তুমি একটু পানি এনে দিতে পারলে না বউমা।

–আম্মু তেমন কিছু হয় নাই।তুমি আমার পাশে একটু বসো।রজনী তুমি পড়তে বসো যাও।রজনী এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না।স্টাডি রুমে চলে গেল।তা দেখে আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আবরারের মা আবরারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভালো মন্দ কথা বলতে লাগলো।

ঘড়ির কাটায় রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই।আয়াত বারোটার দিকে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।আয়াতে’র ফোনে মেসেজ আসার টুংটাং শব্দ বেজে উঠলো।আয়াত এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।হঠাৎ করেই আয়াতে’র ফোন বেজে উঠলো।এক কেটে যাবার পরে আবার বেজে উঠলো।আয়াত ঘুম ঘুম চোখ ফোন তুলল।ফোনের ওপাশ থেকে যা শুনলো।তার জন্য আয়াত মোটে’ও প্রস্তুত ছিল না।দ্রুত ফোন কেটে মেসেজ দেখতেই আয়াতে’র হাত থেকে ফোন’টা পড়ে গেল।

চলবে…..

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_১৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

হিম শীতল হওয়া,সকালে’র ঠান্ডা আবহাওয়া কাঁপিয়ে তুলছে,শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা। ভোরের আলো ফুটতেই আয়াত গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দৌড় দিল আরহাদে’র বাসায়। রাতে খবর পেয়েছিল। আরহার বাবা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। আয়াত রাতেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাসা থেকে অনুমতি না পাবার কারণে, রাতে আসা হয় নাই। সারারাত ছটফট করেছে। ভোরের আলো ফুটতেই আরহাদের বাসায় ছুটে এসেছে। পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষ গিজগিজ করছে।কান্নার প্রতিধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে, বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল। আয়াত আরহার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আরহা আয়াত’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। আয়াত ‘ও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। আরহা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। পৃথিবীতে বাবা নামের বটগাছের ছায়া যার মাথার ওপরে নেই। একমাত্র সেই বুঝে বাবা না থাকার কি যন্ত্রনা।বাবা না থাকলে,বোঝা যায়। দুনিয়া’টা কতটা কঠিন।বাবার টাকা নয়?বাবা থাকাটাই সৌভাগ্যের ব্যপার। আরহা’কে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা আয়াতে’র জানা নেই। বাবা নামক ছায়া’টা আরহার মাথার ওপরে থেকে উঠে গেল। এখন মেয়ে’টা হারে হারে উপলব্ধি করতে পারবে। দুনিয়া’টা কতটা কঠিন। পরিচিত মানুষ গুলো হয়ে উঠবে অপরিচিত। প্রিয় মানুষ গুলো হয়ে উঠবে অপ্রিয়।দু’পয়সার শান্তনা সবাই দিবে।কিন্তু ভালো রাখার দায়িত্ব কেউ নিবে না। আরহার বাবার জানাজা শেষ হলে,আয়াত বাসায় চলে আসলো। আয়াত আজকে আরহার কাছে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সামনে আয়াতে’র বিয়ে,তাই আজাদ শিকদার কোনোরকম ঝামেলা চান না। তাই মেয়ের কষ্ট’কে উপেক্ষা করে,বাসায় নিয়ে চলে আসলো।

গভীর রাতে কারো কাতরানোর আওয়াজ পেয়ে,ঘুম ভেঙে গেল রজনী’র। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো আবরার রীতিমতো কাঁপছে। ঘুমের মধ্যে বিরবির করে কিছু বলছে। রজনী আবরারের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করল। আস্তে করে আবরার’কে ডাক দিল। কঠিন কণ্ঠে বলল।

–রাত করে কি নাটক শুরু করলে,এভাবে বিরবির করছো কেনো?পাশের রুমে বাবা-মা আছেন। নিশ্চয়ই তাদের শোনাচ্ছো। তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে দেখছি না। রজনী’র কথায় আবরারে’র কোনো হেলদোল আসলো না। আগের ন্যায় কাতরে যাচ্ছে। রজনী বিরক্ত হয়ে বালিশ চাপা দিয়ে শুইয়ে পড়লো।

“পরের দিন সকাল বেলা,আব্রাহাম আবরারের কাছে এসেছিল। কোন ফুলের দোকানদার আবরারে’র নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। আবরার’কে এখনো ঘুমিয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল আব্রাহাম। তার জানা মতে,তার ভাই সকাল সকাল উঠে,আজকে এত বেলা হয়ে গেল,এখনো বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কিছু’টা ভয় পেয়ে গেল আব্রাহাম। দৌড়ে ভাইয়ের কাছে আসলো। আবরারের শরীরে হাত দিতেই চমকে উঠলো। পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জ্বর আসার কারণে আবরার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। আব্রাহাম চিৎকার করে রজনী’কে ডাকলো। রজনী শান্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলল।”

–কি হয়েছে আব্রাহাম? আমাকে ডাকছো কেনো?

–ভাবি ভাইয়া’র জ্বর এসেছে,এটা তুমি দেখোনি।ভাইয়া কাল রাত থেকে সেন্সলেস হয়ে আছে। আর তুমি আমাদের একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না। কেমন বউ তুমি? স্বামীর দিকে খেয়াল রাখতে পারো না!

–দেখো তোমার ভাই কোথায় থেকে কি করে নিয়ে এসে,জ্বর বাঁধিয়েছে। তার দায় আমার নাকি। এক ভাই সারারাত ঘুমোতে দেয় নাই। আরেক ভাই সকাল সকাল ডেকে মাথা খাচ্ছে।

–তোমার মতো বাজে অর্ধাঙ্গিনী আমি দুটো দেখি নাই। বলেই পানি নিয়ে আসতে চলে গেল।আগে আবরারের শরীর থেকে জ্বর নামানো প্রয়োজন।আব্রাহাম বেশ কিছুক্ষণ আবরারের সেবা যত্ন করে,কিছু’টা জ্বর নামাতে সক্ষম হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে,আবরার’কে নিয়ে হসপিটালে যাবার জন্য বিছানা থেকে তুলতেই আবরারের মা রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল।

–আব্রাহাম আবরারের কি হয়েছে? তুই ওকে ওভাবে ধরে আছিস কেনো? আমি জানতাম তুই যতদিন বাড়িতে থাকবি! একটা না একটা অঘটন ঘটবেই।

–আম্মু এসব কি বলছো? আমি তো জানতামই না ভাইয়ার জ্বর এসেছে। এখন ভাইয়ার কাছে এসে বুঝতে পারছি। এখন কথা বলার সময় নয়। এখন ভাইয়া’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। শরীর থেকে দ্রুত জ্বর নামাতে হবে। ভাইয়া হসপিটালে যে,সেবা পাবে। সেটা বাসায় থেকে পাবে না।

–তোর এত ভাবতে হবে না। আবরার’কে নিয়ে ভাবার জন্য আমি,রজনী,তোর বাবা আছি। নতুন করে আর ছেলেটা’র ক্ষতি করে দিস না।

–তোমরা কত আছো সেটা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছি।ভাইয়া ভোর রাত থেকে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।তুমি দূরে থাকো,তোমার ছেলের বউ পাশে থাকে। তা-ও তোমার ছেলেকে তাকিয়ে দেখে নাই। এই মেয়েকে কি দেখে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছো? আবরার ভাইয়া আরো ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করে। স্বার্থপর মেয়ের জন্য পাগল হয়েছিল। এই মেয়ের সাথে সংসার করবে কিভাবে? বিরক্তিকর একটা মেয়ে! আমার কাজে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। বলেই আবরার’কে নিয়ে চলে গেল।

সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে এসেছে। রোদের প্রখরতা সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। উত্তপ্ত রোদরে মাঝে,ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে আয়াত। মন’টা ভিষণ খারাপ। খুব করে নিজের কথা গুলো কাউকে বলার জন্য,একটা মানুষের অভাববোধ করছে। রোদের তাপ আয়াত’কে পুড়িয়ে তুলছে। ললাট বেয়ে ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। গরমে পুরো শরীর আগুন হয়ে, যেতে শুরু করল। রোদের প্রখরতার কাছে হার মেনে, আয়াত নিচে নেমে আসলো।

দুপুরের পরে আবরারের জ্ঞান ফিরলো। দু-চোখ পিটপিট করে মেলে তাকালো। চারিদিকে সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। আবরার সময় নিল,আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। নিজের পাশে আব্রাহাম’কে দেখে থমকে গেল। তার থেকে বেশি অবাক হলো,নিজেকে হসপিটালে দেখে, আবরার কিছু বলতে যাবে। তার আগেই আব্রাহাম বলল।

–কিছু বলতে হবে না। তোমার বাবা-মা, বউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার জন্য অনেক কথা শুনেছি। আর কথা শুনতে পারবো না। দেখো তুমি অসুস্থ বলে,আলগা দরদ দেখাতে পারবো না। এই খাবার টুকু খেয়ে নাও। আর আমাকে উদ্ধার করে দাও। এমনিতেই সকাল থেকে তোমার মা আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছেন।আব্রাহামে’র কথায় হাসলো আবরার।

–তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। তুই গিয়ে বিশ্রাম কর। সকাল থেকে অনেক আমার পেছনে ছুটেছিস। যে, মানুষ’টা তোর ভালো থাকাটাই কেঁড়ে নিল। তুই তার জন্য এত কিছু করছিস। এতটা ভালো না হলে-ও পারতি আব্রাহাম।

–ভাষণ দেওয়া শেষ হলে, আস্তে করে উঠে বসো। তোমাকে খাইয়ে দিয়ে, আমি’ও খেতে যাব।আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে। ভাগ্য করে একটা বউ পেয়েছো। মরে গেলে’ও তাকিয়ে দেখবে না। আব্রাহামে’র কথা শুনে,আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপরে আব্রাহামে’র সাহায্যে উঠে বসলো। আব্রাহাম আবরার’কে খাইয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল ।তখনই আবরার পিছু ডাকে,আব্রাহাম শোন। আবরারের কথা শুনে, আব্রাহাম পিছু ফিরে আসলো। পকেটে দু-হাত গুঁজে গম্ভীর মুখ করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

–আয়াত মেয়ে’টা অনেক ভালো। তোকে অনেক ভালোবাসে, ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না। আগলে রাখিস। কিছু জিনিস জীবনে বারবার আসে না। আমি আয়াতে’র চোখে তোর জন্য গভীর ভালোবাসা দেখেছি। আয়াতে’র কাছে পুরো দুনিয়া একদিকে,আর তুই একদিকে।আয়াত’কে যদি বলা হয়। দু’টোর একটা বেছে নিতে,তাহলে আমি কথা দিয়ে বলতে পারি। আয়াত তোকে বেছে নিবে। মেয়েটা’কে হারিয়ে যেতে দিস না। খুব যত্ন করে মনের গহীনে আগলে রাখিস।আবরারের কথা শুনে আব্রাহাম বিরক্ত প্রকাশ করল।

–আগে নিজের ঘর সামলাও! তারপরে অন্যকে জ্ঞান দিবে। এই সব সস্তার জ্ঞান আমাকে দিবা না। আমি নিজ হাতে যে, জিনিস গুলো নষ্ট করেছি।তার মধ্যে আমার জীবন’টাই অন্যতম।বলেই এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করল। আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

–তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তোর জীবন থেকে আর কিছু হারিয়ে যেতে দিব না। নিজের সবটুকু দিয়ে, তোকে আগলে রাখার চেষ্টা করবো। বলেই শুইয়ে পড়লো।ললাটে হাত দিয়ে দু-চোখ বন্ধ করে রাখলো। তখনই রুমের মধ্যে আবরারের বাবা-মা,আর রজনী প্রবেশ করল। আবরার চোখ বন্ধ রেখে বলল।

–আমি একটু একা থাকতে চাই।আম্মু তুমি শুধু আমার কাছে থাকো। বাকি সবাই চলে যাও। আব্রাহাম আগেই বলেছিল, বাহিরে তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। তাই আবরারের বুঝতে বেগ পেতে হলো না।যে,কে এসেছে তার রুমে, রজনী মুখ কালো করে বেড়িয়ে গেল। সবকিছু তার কাছে বিরক্ত লাগছে। আবরারের বাবা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল।আবরারের মা ছেলের পাশে বসে রইলো।

গোধুলী লগ্ন ডুবে গিয়ে,রাতের আঁধার নেমে এসেছে। আয়াত নামাজ শেষ করে,বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই আয়াতে’র দু-চোখ আঁটকে যায়!বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকার আব্রাহামে’র দিকে,হাতে তার একগুচ্ছ গোলাপ। আব্রাহাম ইশারা দিয়ে আয়াত’কে নিচে নামতে বলছে। আয়াত এক মুহুর্ত দেরি করল না। অধরের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে, দৌড়ে নিচে চলে গেল। হয়তো আব্রাহামে’র জন্যই চাতক পাখির ন্যায় বসেছিল। বাসার নিচে এসে বলল।

–বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?ভেতরে চলো। আয়াতে’র কথা শুনে, আব্রাহাম হাসলো। অধরের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখে বলল।

–আজকে যাব না। আবরার ভাইয়া অসুস্থ। আমাকে হসপিটালে যেতে হবে। এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। আমি ভেবেছি তুমি আমার ওপরে রাগ করেছো। কথা বলবে না। এই দেখো তোমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছি। আয়াত খুশি হয়ে ফুল গুলো হাতে তুলে নিল। হাসিমাখা মুখ করে আব্রাহাম’কে উদ্দেশ্য করে বলল।

–এত সুন্দর ফুল নিয়ে আসলে, কেউ রাগ করে থাকতে পারে। ফুল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। ফুল নারীদের দুর্বলতা। বিশেষ করে, আমি ফুলের কাছে ভিষণ দুর্বল। ফুল আমাকে খুব করে আর্কষণ করে চম্বুকের ন্যায়। তাই তো সব রাগ ভুলে, ছুটে তোমার কাছে চলে আসলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে, মানুষ কি বলবে? তুমি বাসায় চলো। আম্মু জানলে আমাকে বকবে। তুমি এসেছো? আর আমি তোমাকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।আয়াতে’র হাসিমাখা মুখখানা দেখে আব্রাহামে’র ভেতরটায় প্রশান্তিতে ভরে গেল। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করল। আব্রাহাম যখনই মেয়েটা’র সাথে থাকে,সব সময় ভালো থাকে। দিনশেষে মানসিক শান্তি দিবে।এমনই একজন মানুষই তো সে, চেয়েছিল।সে, পেয়েছে। আয়াত’কে আগলে রাখতে পারবো তো’। ভাবতেই আব্রাহামে’র পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। অজানা ভয় এসে মনে হানা দিল। মেয়েটা ছোট ছোট জিনিস পেলে, কতটা খুশি হয়। তার এই হাসিমাখা মুখখানা দেখে,আমি প্রশান্তির স্বাদ গ্রহণ করি।এই মেয়েকে আমি কিভাবে কষ্ট দিব। ভাবতেই আব্রাহামের ভেতর’টা হাহাকারে ভরে উঠলো। আব্রাহাম’কে ভাবতে দেখে, আয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আয়াত’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আব্রাহাম হাসলো। গাড়ি থেকে আরো কিছু জিনিস বের করে আয়াতে’র হাতে দিল। আয়াত অবাক নয়নে আব্রাহামে’র দিকে তাকিয়ে আছে।

–এগুলো সব আমার আয়াতপাখির জন্য। তোমার পছন্দ হয়েছে। অনেক খুঁজে খুঁজে তোমার জন্য পছন্দ করে নিয়ে এসেছি।

–তোমার পছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না। তোমার সবকিছু আমার ভালো লাগে। আয়াতে’র কথা শুনে আব্রাহাম হাসলো। গাড়ি থেকে কয়েক মুঠো চুড়ি বের করে, আয়াতে’র হাতে পড়িয়ে দিল।আয়াত অবাকের ওপরে অবাক হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত হাসি যেনো মেয়েটা’র মুখে ধরা দিয়েছে। আব্রাহাম আয়াতে’র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল।

–সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।এবার বাসায় যাও।আমি রাতে ফোন দিব। আব্রাহাম চলে যাবে। ভাবতেই আয়াতে’র মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ করে মাথা নত করে নিল। আব্রাহাম গম্ভীর হয়ে আয়াতে’র দিকে তাকালো।আয়াত মন খারাপ করে বলল।

–জানো কি হয়েছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আরহা আছে না। ওর বাবা মারা গিয়েছে। ওর জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে, যার বাবা নেই। সে, বুঝে দুনিয়াটা কতটা কঠিন।আব্রাহাম আয়াতে’র কথা শুনে, কিছুক্ষণ নিরব রইলো।

–একদিন সবাই’কে চলে যেতে হবে। আমরা কেউ সারাজীবন থাকতে আসি নাই। আল্লাহ তায়া’লার জিনিস আল্লাহ তায়া’লা নিয়ে গিয়েছেন। এতে আমাদের খুশি হওয়া দরকার। মৃত্যু প্রতিটি মুসলমানদের জন্য উপহার স্বরুপ। তুমি মন খারাপ করো না। যার কেউ নেই। তার জন্য আল্লাহ তায়া’লা আছেন। সবাই তোমাকে নিরাশ করলে-ও, উনি কখনো তোমাকে নিরাশ করবেন না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি। বলেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আয়াত আব্রাহামে’র কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে গেল। বাসায় আসতেই আয়াত ভয়ে জিনিস গুলো লুকিয়ে ফেলল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।কথাই আছে, যেখানে বাঘের ভয়। সেখানে সন্ধ্যা হয়।

চলবে…..