স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-১৪

0
4968

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-১৪||

গাড়ি থেকে নামার পর রহমত চাচা বললেন,
“তা মা,বই কেনা শেষ হলে আমাকে কল করে বলবে।আমি আবার এসে তোমায় নিয়ে যাবো।”

আমি অন্তঃগোপনে ছোট একটা ঢোক গিলে নিয়ে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললাম,
“চাচা,সমস্যা নেই।আপনার শুধু শুধু কষ্ট করে আসার দরকার নেই।আমি এখন মোটামুটি সব চিনি।আমি নিজেই যেতে পারবো।”

রহমত চাচা আমার কথাগুলো মনোযোগ দৃষ্টিতে শুনে নিয়ে তারপর দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন,
“তা বেশ।সাবধানে থেকো,মা।গেলাম আমি।”
“জ্বী,আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”

সালামের জবাব দিয়েই রহমত চাচা গাড়ি নিয়ে এক নিমিষে অনেকটা দূরে চলে যান।আমি সেদিকে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে থেকে দু’কদম পিছু হটে কিছুটা দূরে এসে দাড়াই।তারপর দৃঢ় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সি.এন.জি/রিক্সার খোঁজে চারপাশে টগবগ চোখে তাকাই।তাকাতেই আমার কপালের উপরের অংশটা গাঢ় ভাঁজের রেখা পড়ে।যেখানে চোখ যায় শুধুই মানুষের লম্বাকৃতি, গোলাকৃতি,ত্রি আকৃতির মাথাগুলো।এছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না।
কিঞ্চিৎ ফাঁক-ফোঁকরে জায়গাগুলোও এরা লুপে নিচ্ছে।কী উদাসীন এদের চোখমুখে,যেন ব্যস্ততাভিমুখে রণক্ষেত্রে অস্ত্র নিয়ে নেমেছে পায়ে পায়ে।

হঠাৎ একটা লোক আমার সামনে দিয়ে ক্রস করে যেতে নিলেই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

“এই যে আপু,পথিকদের পথভ্রষ্ট না করে একসাইড হয়ে দাঁড়ান। আর যদি বই কিনতে আসা তাহলে বুক স্টলে যেয়ে জায়গাটা ফাঁকা করুন।আপনার এটুকু জায়গা দখলেতে অন্যের বুক স্টলে ঢুকতে কষ্ট হচ্ছে। ”

লোকটির সাবলীল এবং মার্জিত গলার কথা শুনে আমি খানিকটা ধাতস্থ হই।পাশ ফিরে তাকিয়ে আমি বুক স্টলের সামনে,অর্থাৎ লোক চলাচলের একেবারে পথিমধ্যে দাঁড়ানো।মনে মনে একটা অপরাধ বোধ হয়।ইস এতক্ষণে ত মনে মনে অনেকেই আমাকে গালাগাল করেছে আর আমার চৌদ্দ গুষ্টিকেও ধোয়ামোছা শেষ করেছে!এমন জায়গায় এসে দাঁড়ালাম খেয়ালই করি না।ভেবেই
লোকটির দিকে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে
তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসতে নিলেই পেছনের কিছু লোভাতুর বস্তু আমাকে চুম্বকের মতো তাদের দিকে টানতে থাকে আর গুঞ্জন তুলে বলছে,
“এভাবে যেও না সানা!আমাদের তোমাকে সাথে নিবা না?তুমি না খুব সাহিত্যানুরাগী?”

বই কেনা আমার শখের জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।তাই এত সাতপাঁচ না ভেবে হুট করেই ডিসিশন নিয়ে নিই এসেছি যেহেতু একটা বই কিনেই নিই।তাই দেরী না করে হুড়মুঠ একটা স্টলে ঢুকে যাই।যেতেই দোকানদার উৎসুক মুখ করে বললেন,

“ম্যাম কোন বইগুলো আপনার পছন্দ?আর ক’টা নিবেন?”

আমি বলার আগেই দোকানদার আমার প্রশ্নের উত্তরের ঝুঁড়ি খুলে দিলো।ব্যাপারটা দেখে বেশ চমকিত হলাম।বললাম,

“উপন্যাস টাইপ বইগুলো দেখান।”

দোকানদার বিস্তর বইয়ের কালেকশন বের করতে শুরু করলো,আমি হম্বিতম্বি হয়ে বললাম,
“আরেহ,এত উপন্যাস বের করতে হবে না।আমি তাঁক থেকেই চোজ করে নিচ্ছি।”

তারপর আমি ক্ষীণ চোখে সবগুলো উপন্যাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে লাল চকচকে মুদ্রিত বইটির দিকে ইঙ্গিত করি,
“এটা শাহজানের তাজমহল বইটি তাই না?”
“জ্বী,ম্যাম।”
“ওকে,এটা দিন।”

লোকটি বইটি প্যাকিং করে দেয়।আমি বইটি হাতে নিয়ে সামনে এগুতেই সামনে একটা রিক্সা পেয়ে যাই।রিক্সাতে উঠে চল্লিশ মিনিট নাগাদ জ্যাম-জাফলা সয়ে অতঃপর হাসপাতালে এসে পৌঁছাই।হাসপাতালে ঢুকে আকাশের চেম্বারে যাই।সে মুখে তরল হাসি টেনে আমায় বসতে বলে।আমি টেয়ার টেনে বসি।বললো,

“খুব যে লেট করেছিস?”
“জ্যাম ছিল খুব।”
“ইট’স ওকে।তুই এসেছিস আমার ডিউটির সময়ও শেষ হয়ে এসেছে।”
“ওহ।”
“তা একটা সেড নিউজ আছে, সানা!”
“কী!”
“আজ সকাল থেকে সার্ভারে একটু প্রবলেম হচ্ছে তাই রিপোর্ট বেরুতে খুব সময় লাগছে।কখন বেরুবে তাও ঠিক বলতে পারছি না।এই দ্যাখ,ঘড়িতে এখন একটা পাঁচ চল্লিশ। দেড়টা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।পাঁচ মিনিট পর আমার ডিউটি শেষ হয়ে যাবে।”

আমি আহত চোখে আকাশের দিকে তাকাই।আকাশ ফোঁড়ন কেঁটে বললো,

“আচ্ছা তোর কাল যদি আসতে কষ্ট হয় তাহলে আমি নিজে গিয়েই তোকে দিয়ে আসবো।আসলে বুঝতে পারিনি এরকম কিছু হবে।তোকে অনেকবার কল করে জানাতেও চেয়েছি।তার আগেই তুই রওনা করে দিয়েছিস। তাই কিছু বলতেও পারি নি।”
বলেই আকাশ অসহায় চোখ করে আমার চোখের দিকে তাকায়।

আমি স্ট্রেট দাঁড়িয়ে যেয়ে বললাম,

“তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। ”
“আরেহ চলে যাবি মানে?”
“রিপোর্ট পাবো না।তো থেকে আর কি হবে।”

আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখের চশমাটা চোখে ভালোভাবে এঁটে নিয়ে দু’ঠোঁট কোণে মৃদু হাসির চেপে বললো,
“সেদিন আন্টিকে নিয়ে আসার পর তোকে একটা রিকুয়েষ্ট করেছিলাম আমি।মনে আছে?”
“আছে।”
“তা লাঞ্চটা আজ আমার সাথে করবি ত?আচ্ছা তুই আন্টিকে সাথে করে নিয়ে আসিস নি কেন?”
“মা অসুস্থ। ”

আকাশ বার দুয়েক জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“হুম।অসুস্থ শরীর নিয়ে হার্ট উয়িক রোগীদের গাড়ি জার্নিটা ডিফিকাল্ট ।যাইহোক,আরেকদিন নিয়ে আসিস,ওকে?”

“দেখা যাবে।”
“আচ্ছা চল।আমার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে।”
বলেই আকাশ উঠে যেতে নিলেই টেবিলের উপর রাখা লাল চকচকে মুদ্রিত বইটির দিকে তাকিয়ে কৌতূহল চোখে বললো,

“শাহজানের তাজমহল!এটা আমার জন্যে গ্রিফট আনলি নাকি?”
আমি রতিপতি হয়ে টেবিলের উপর চোখ রাখি।বইটা এভাবে ফেলফেল সামনে রেখে দিয়ে ব্যাকুবের মতো কাজ করে ফেলি।তখন এখানে আসার আগেই ভেবে নিলাম ওর চেম্বারে ঢোকার আগে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিব,কিন্তু চিন্তাগ্রস্ত আর উদাসীন মন তা আর মাথায় রাখতে দিল?

তড়বড় বইটা টেবিলের উপর থেকে এক সপাটে হাতে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলি।আকাশ খিলখিল হেসে দিয়ে বললো,

“আচ্ছা আগে লাঞ্চে চল তারপর এই বইটার ব্যাপারে কথা বলবো।”
আমি কিছু বলিনি।নিশ্চুপ থাকি।

আকাশ আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে।বললো,
“কি খাবি,এবার বল!”
“তোর পছন্দ মতো যেকোনো একটা অর্ডার কর।”
“তাহলে ভেজিটেবল,চিকেন আর বিফ অর্ডার দিই,হু?”

আমি দু’পাশে মাথা নাড়ি।আকাশ ওয়েটারকে ডেকে নিয়ে অর্ডার দেয়।ওয়েটার সায় জানিয়ে চলে গেলে এবার আকাশ আমার দিকে ফিরে।স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

“আমার ওই অনুরোধ টাও রাখিস নি,তাই না?”
আমি নিশ্চুপ থাকি।আকাশ একদন্ড নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বললো,

“বইটা একটু দিবি?আমি দেখব।”
আমি আলতো ভাবে ব্যাগের চেইন খুলে বইটা ওর দিকে এগিয়ে দিই।আকাশ ঘোর মাখা চোখে বইটা নেড়েচেড়ে একটা তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে মুখ তুলে বললো,

“আমিও কোনোকালে শাহজাহান ছিলাম হয়তো আছিও”
বলেই আকাশ হাসার চেষ্টা করে।
“আচ্ছা,সানা আমায় একটা সত্য কথা বলবি?”

ভ্রু কুঁচকে তাকাই।বললো,
” তোর মাত্র একজন খালামণি।তাও ঢাকায় থাকেন।আর ওই খালামণির ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে।বললি না কলেজে থাকতে?”

আমি এ কথার পিঠে কী বলবো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।আকাশ সাডেন এসব কথা বলার মানে কী?আর কেনইবা এসব কথা তুলছে?কী লাভ?কী হবে?
ভাবনার মাঝেই আকাশ বললো,

“সত্যি করে বল ত সানা তোর আসলেই বিবাহিত জীবন সুখে যাচ্ছে ত?আমি ত জানি একটা মেয়ের হাসবেন্ড পাশে থাকলে তার কোনো জবের চিন্তা থাকে না। নিজেকে ওটাসেটার জন্যে নড়তে হয় না।আর নড়তে হলেও হাসবেন্ড সাথেই খুটি হয়ে পাশে থাকে।তাছাড়া,তোর সাথে যতদিনই কথা হলো একবারও শুনি নি তুই তোর হাসবেন্ডের সাথে কথা ফোনে বলছিস অথবা কথা বলাতে ব্যস্ত আছিস।আর সব থেকে বড় কথা,তোর প্রাপ্ত বয়স হলে তোর খালামণি তোকে ঘরে তুলবে।আমি ত ভেবেছি এতদিনে তুলেছেও।ওদিন তোকে তাই বললাম তুই হ্যাঁ বললি।তবে প্রশ্ন তুই কুমিল্লাতে কেন?প্লিজজ তুই সুখে আছিস ত আমায় বল সানা?!”

আকাশের এসব কথা শোনামাত্রই নিজেকে সরল করার চেষ্টা করি।বললাম,
“কী বলছিস এসব?আই’ম ওকে এন্ড মাই ফ্যামিলি!”
“মিথ্যে বলতেছিস!প্লিজক প্লিজজ মিথ্যে বলিস না।প্লিজজজজজ…?
বলেই আকাশ তার দু’হাত দিয়ে আমার ডানহাতটা জোরে চেপে ধরে।মুহূর্তেই আমার সারা শরীরের রি রি করে উঠে।দু’চোখ আগুনের মতন লাল হয়ে যায়।
এবার এই দিকটা খুব খুব বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল!মানুষ আবেগ, মায়া দেখায় তাই বলে পরনারীর হাত স্পর্শ করে নয়!এতটা লিমিট ক্রস করার সাহস পেল কিভাবে ও!!!

চোখ-দাঁত খিঁচে এক ঝটাকে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে লাফ মেরে দু’পা পিছিয়ে যাই।
ক্রুদ্ধ এবং জোর গলায় বলে উঠলাম,

” তোকে বন্ধুর জায়গায় দেখে এসেছি কলেজ থেকে।কখনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্কের রেখা টানতে দিই নি।তা তুই ভালো করে জানিস!তারপরও আজ কোন স্পর্ধায় আমার বাহু চেপে ধরলি?আমার স্বামী আছে,স্বামী!তারপরও তোর এতটা সাহস হলো কিভাবে?ওহ তোর কাছে অসহায় মনে সাহায্যের হাত পেতেছি বলে আমার সুযোগের সৎ ব্যবহার নিচ্ছিস তাই না?তোকে এতদিন খুব ভালো ভেবে এসেছি।আর আজ তুই!ছিঃ!”

“প্লিজ,সানা এরকম কিছু নয়।তা যা ভাবছিস তা নয়!”
“তুই আ কথা বলবি না আমার সাথে!যে আমার হাত চেপে ধরে সে আরো কি কি করতে পারে আমার সব জানা আছে!বই দে আমার!”

বলেই এ সপাটে ওর হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসি।আর মুহূর্তেই পুরো রেস্টুরেন্ট জুড়ে আমাকে এবং আকাশকে নিয়ে একটা সমালোচনা মুখর হয়ে যায়।

চলবে….