স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-১৬

0
5871

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৬

চারদিকে ফজর আযানের পড়তেই আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের পাতা খুলে যায়।অবসাদ শরীর নিয়ে উঠতেই নিলেই মার দিকে নজর যায়।মা চোখজোড়া ফকফকে খুলে রেখে উপরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছেন।আমি খানিকটা অবাক হয়ে মার মাথায় আলতো হাত রেখে শান্ত গলায় বললাম,

“মা?”

মা আচমকা আমার কন্ঠস্বর শুনে হন্তদন্ত চোখের পাতা আবার বুঁজে নেন।

মুহূর্তেই আমার দু’চোখ টলমল করে উঠে।বুঝতে আর বাকি রইলো না মা যে কালকের ঘটনাটি নিয়ে সারারাত ভেবে ভেবে নির্ঘুম কাটিয়েছেন ।মনে মনে কষ্টগুলোকে নিজের মাঝে অনুভব করেছেন!আমি যাতে এর কিছুটি না বুঝতে পারি তাই আবার আমার শব্দ পেয়ে ঘুমের ভাণ ধরেছেন!

কিছুক্ষণ মার দিকে নিরব তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।তারপর বিছানা থেকে নেমে ওযু সেরে ফজরের নামাজে দাড়াই।মোনাজাতে থাকা অবস্থায় চারদিকে আস্তে আস্তে ফর্সা কণা নামে।দুই তিনটা কাক কিছুক্ষণ কা কা ডেকে পশ্চিম আকাশে উড়ে যায়।

আমি জায়নামাজ টা ভাঁজ করে রেখে বিছানার কোণে রাখি।মার কাছে গিয়ে নরম গলায় বললাম,
“মা?ও মা?ফজরের ওয়াক্ত চলে গেছে।ওঠবে না?”
মা কিছু বললেন না!আমি আবার ডাকলাম।মা এবার ভাঙ্গা গলায় জবাব প্রদান করলেন,

“উঠতেছি মা,উঠতেছি।”

বলেই উঠার চেষ্টা করেন।আমি মাকে উঠতে সাহায্য করি।মা দাঁড়িয়ে বুকে হাত টেনে আমাকে বলেন,
“বুকের ব্যথাটা হঠাৎ এমন বাড়ছে!উহুহু।”
“বেশি বেড়েছে,মা?”
“তা জানি নারে মা।তবে বুকটায় প্রচন্ড ভার ভার লাগছে।”

বলেই মা বাথরুমে চলে যান।আমি জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যাই।আমার এবং মার যাবতীয় সবগুলো রুমের অন্ধ্রেরন্ধ্রে থেকে বের করে করে বিছানার উপর জড়ো করি।গোছাগোছির কাজ প্রায়ই শেষের পর্যায়ে।মারও নামাজ শেষ হয়।জুতো একজোড়া বেলকনিতে রেখে এসছি ওটা আনতে বেলকনির দরজা বরাবর যেতেই হঠাৎ মা একটা আর্তনাদ করে উঠেন!

আমি চমকে পেছন ফিরে তাকাই।মা বুকে হাত চেপে আধ বসায় চোখমুখ কুঁচকে কাতরাচ্ছেন!আমি দৌড়ে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি!
“মা,তোমার কিছু হয়েছে?এমন করছো কেন তুমি?”
“মারে ব্যথাটা খুব জোড় বেড়েছে সহ্য করতে পারতেছি না আর!আহ্..দম..দম ফালাতে পারছি না।”

“মা তুমি এখানে একটু কষ্ট করে বসো।আমি এক্ষুণি ওষুধ নিয়ে আসছি।”
বলেই দ্রুতপদে বক্স থেকে একটা ওষুধ নিয়ে এনে পানি সম্মেত তা মার মুখে ফুরে দিতেই মা একগাল বমি ওয়া ওয়াক করে নিচে পুরোটা ঢেলে দেন!আমি হতভম্ব চোখজোড়ায় এক্ষুণি যেন কেঁদে ফেলি।মার হঠাৎ এ কি হলো!?মার ত এর আগে তীব্রভাবে এমনকি কখনো হয়নি!হে আল্লাহ,কী করবো আমি?গিয়ে খালামণিকে বলবো…আকাশকে?হ্যাঁ হ্যাঁ আকাশকে!!

তড়িৎ হাতে আকাশের নাম্বারে টাচ করি।একে একে চারবার রিং হয়,রিসিভ হয়নি!!!
নাউ আই’ম এক্সট্রিমলি হ্যাল্পলেস!নো ওয়ান হ্যাজ বিসাইজ মি!”ভাবতে ভাবতে হাতজোড়া দিয়ে মাথার দু’পাশে চেপে ধরে ফ্লোরের উপর ধপসে বসে পড়ি!আমার কান্নার বেগের সাথে মার কিছু কাঁতর জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা ধ্বনি শুনতে পাই,

“সা-না?মারে মা, আমায় ক্ষমা করে দিস!আজ আমার জন্যে তোর এ অবস্থা হলো!ক্ষমা করে দিস আমাকে!আমি বড্ড অপরাধী রে,বড্ড অপরাধী!! আমাকে বদদোয়া দিস না।তাহলে আমি জান্নাত পানো না!”

আমি মাথা তুলে এবার মার দিকে তাকাই।মা অসাড় শরীর নিয়ে প্রচন্ড ব্যথায় ছটফট করছেন।আমি ুক টপকে উঠে দাড়িয়ে মাকে গিয়ে জোরে জড়িয়ে ধরে উঠানোর চেষ্টা করি।মা বললেন,
“হাসপাতাল নিচ্ছিস আমাকে?আমি ত আর মনে হয় বাঁচবো না মা।আমাকে খামোখা কষ্ট করে হাসপাতালে নিস না মা।”

আমি মার কথা শুনেছি কি শুনি নি তা ঠিক জানি না।তবে এখন এসব শোনার হাতে একদম সময় নেই।শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মাকে ধরে বাইরে নিয়ে যেতেই ভাগ্যে পরিক্রমায় রহমত চাচাকে সামনে পাই।মার কি হয়েছে কি হয়েছে বলে আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।তারপর মাকে সি.এন.জি করে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে আসি।প্রাইভেটে চিকিৎসা করাতে নিলেই ডাক্তার বলেন,মা হার্ট অ্যটাক করেছে।মাকে ইমার্জেন্সি আইসিইউতে রাখতে হবে।তারজন্যে লাখের মতো লাহবে!নাহলে উনারা মায়ের চিকিৎসা করতে পারবেন না!

তবে এই মুহূর্তে আমার কাছে ওত টাকা নেই!কোথায় পাবো আমি ওতগুলো টাকা?কে দিবে আমাকে?ওদিক দিয়ে মার অবস্থা খুবই বেসামাল!অন্তত এই মুহূর্তে একটা চিকিৎসা ত মার দরকার!

“আচ্ছা,রহমত চাচা?সরকারি হাসপাতালে মাকে নিয়ে গেলে? ”
“আরেহ তুমি সরকারি হাসপাতালের কথা কেন ভাবছো?সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কোনো লাভ হবে না!খামোখা সময় নষ্ট!তুমি দেরী আর না করে তোমার খালামণিকে কল করো!”

“উনার কাছে কল? সম্ভব নয়!!!”
“মারে কাল আমি সব দেখেছি।একটা কথা বলি তোমাকে বিপদের সময় সব অপমান গায়ে মাখতে নেই রে।আগে নিজের মাকে বাঁচাও!!”

রহমত চাচা মন্দ বলে নি।হ্যাঁ হ্যাঁ পরে আমি উনাদের সবটাকা পরিশোধ করে দিব!যত কষ্ট হবে আমার!এই আমার প্রমিজ!মনে মনে ভেবেই
কল করবো এমতাবস্থায় আমাদের কাছে কেউ একজন এসে বললো,

“আপনারা যাকে নিয়ে এসছেন উনি ত মনে হয় মারা গেছেন!”

কথাটি শুনামাত্র জোরে একটা আর্তনাদ করে উঠি।আর্তনাদে চারপাশে থাকা সবাই আমার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং অবাক চোখে তাকায়!আমি এক দৌড়ে রোগ নির্ণয় রুমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি।
“মা? ও মা?মাগো?মা তুমি বেঁচে আছো।কথা বলো মা।কথা বলো!কথা বলো!!!!”

মা কথা বলেনি!হাত-পা অসাড় পড়ে আছে ওটিতে।চোখজোড়া বুঁজে আছে।এতক্ষণে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় বলে কাঁতরিয়েছিল এখন সেই নিঃশ্বাসটুকু হারিয়ে গেছে!মা একদম সোঁজা হয়ে শুয়ে আছে।খুব নিবিড় ঘুম!যে ঘুমে মা কখনোই জাগবে না!!”

“এ্যাঁ চাচা?আমার মা কি ঘুম থেকে আর জাগবে না?চাচা চাচাগো?ও চাচা!এ্যাঁ মা উঠো উঠো…!”

ঠিক খেয়াল নেই কখন জ্ঞান হারালাম।যখন চোখ মেলি তখন দেখি আমার চারপাশে অনেকগুলো পরিচিত মুখ।এই যেমন-খালামণি,তুরাব ভাইয়া,আকাশ।খালামণি বলে উঠলেন,

“ওই ত সানা জেগেছে!এই সানা?আমাকে কিছু জানালি না যে বুবুর এ অবস্থা হলো?তুই চলে যাবার মিনিট দশেক পর বাড়ির কাজের লোকের থেকে শুনলাম তুই বুবুকে এই অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেছিস।পাগল হয়ে তুরাবকে কল করলাম!আর এসে দেখলাম আমার বুবু!”

বলেই খালামণি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন! আকাশ বললো,
“সানা,আমি খুবই দুঃখিত!তোর বিপদের সময় আমি তোর পাশে থাকতে পারিনি!প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে সানা!প্লিজ?আন্টির রিপোর্ট যখন হাতে পেলাম দেখলাম রিপোর্ট খারাপ!পাগল হয়ে তোকে কল দিই আন্টিকে ইমার্জেন্সি ওখানে নিয়ে যেতিস। আর কলটা কেউ একজন রিসিভ বললো আন্টি আর নাই!তুই আন্টিকে আমার ওখানে না নিয়ে এখানে কেন নিয়ে আসলি!এই সানা?কথা বল!”

সবকথা মাথার মধ্যে ঢুকলো কিনা জানি না।তবে মাকে এখানে এখন দেখতে পাচ্ছি না।মাকে এরা কোথায় নিয়ে গেছে!
জোর গলায় চিৎকার দিয়ে বললাম,

“আমার মা কই?”
“সানা,বুবু এখন এম্বুলেন্সে।এম্বুলেন্স বাইরে দাড়িয়ে।এতক্ষণ তোর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম।চল!”

আমি কথার জবাব না দিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে দাড়াই। আর টালমাটাল পায়ে এম্বুলেন্সের দিকে অগ্রসর হতে থাকি।পেছন পেছন উনারাও আসছেন।আমি এম্বুলেন্সের কাছাকাছি আসতেই কেউ একজন পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বললো,

“ভেতরে ঢুকেন আপু!”

লোকটির কথায় সম্মতি দিয়ে আমি ভেতরে আসি। ভেতরে ঢুকতেই নিজেকে স্থবির না রাখতে পারলেও অসাড়ভাবে বসে থাকি পলকহীন চোখে।মা আমার সামনে সাদা কাপড়ে আবৃত শুয়ে আছে।স্বর্গের ঘুম ঘুমাচ্ছে মা!!!

খালামণি তুরাব ভাইয়াকে কিছু একটা বলে এম্বুলেন্সের ভেতরে আসতে চাইলেই এবার আমার টনক নড়ে উঠে।গম্ভীর গলায় বললাম,

“খালামণি,তোমাদের কারো যেতে হবে না আমার সাথে!আমি মাকে নিয়ে একাই যেতে পারবো!আর একটা কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট কুমিল্লা আসবেন না।”

“সানা,তুই এসব কী বলছিস?!আমার বুবু মারা গেছে আর আমি যাবো না!এরে বুবু আমার রক্তের বোন।এমন কথা বলিস না!”

“মা একা।সময়ের ব্যবধানে থেকেও আপনজন থাকলো না।ভালো থাকবেন খালামণি!খুব কষ্ট দিয়েছি আপনাদের আমি এবং মা!মাফ করবেন!”

বলেই ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলি।ড্রাইভার সম্মতি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে।আমি উনাদের থেকে অনেকটা দূরে চলে আসি।আর উনার নিথর চোখে এম্বুলেন্সের দিকে তাকিয়ে আছেন!

চলবে…..