স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-২১

0
5829

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-২১

গাড়ির শব্দ আর চারপাশে কোলা ব্যাঙ্গ ডাকার শব্দ ছাড়া এই মুহূর্তে কিছুই শুনা যাচ্ছে না।রাতের সুনসান নিরবতার বুক চিরে ছুটে যাচ্ছে ধবধবে সাদা একটি কার।সেই কারটিতে এখন আমি এবং আকাশ দুজনে পাশাপাশি বসে আছি।কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।দুজনেই উন্মাদ,হতভম্ব এবং নির্জীব,যেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুতি ছিলাম না।মোটেও না!এই যে গাড়ি ফিরতি সে তার গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে তা জানতে কোনোরকম কৌতূহল বোধ করিনি।একবারের জন্যে আকাশকে জিজ্ঞেসও করিনি,”আকাশ আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?”

গাড়ি ছুটছে,পুরোদমে ছুটছে।ছুটতে ছুটতে একটা মুহূর্তে গাড়িটি এসে একটা জায়গায় থামে।আকাশ গাড়ি থেকে নেমে আমার দিকে ফিরে খুবই শান্ত এবং স্বাভাবিক গলায় বললো,
“সানা?নাম।”
এবার আমার ধ্যাণ ফিরে।আমি নৈঃশব্দে ভদ্র মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নামি।সামনে তাকিয়ে বিস্তর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আকাশের দিকে কিঞ্চিৎ ফিরতেই আকাশ হেসে দিয়ে বললো,
“এটা আমাদের বাড়ি,সানা।”

আমার মাঝে কোনোরকম ভাবাবেগ হলো না।তারপর আমি হাটি হাটি পায়ে আকাশের সাথে বাড়ির মেইন ফটকের দিকে এগিয়ে যাই।আকাশ কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে কোনো একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দেয়।উনি আকাশের সাথে আমাকে দেখে অনেকটা খানিকটা চমকে যাওয়া অবস্থা।তা দেখে আকাশের মাঝে তেমন ভয় এবং দ্বিধার রেখা স্ফুটিত হলো না,পরিবর্তে সে কুটিল হেসে ফেললো।বললো,

“এতদিন না বললে একটা বউ চাই তোমার,একটা বউ চাই!এখন তোমার জন্যে বউ নিয়ে আসলাম!”

মুহূর্তের মধ্যে ভদ্রমহিলার চোখমুখে রাঙ্গা হয়ে যায়।ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে উৎফুল্ল মনে আওয়াজ করে বলতে থাকেন,
“আফিয়া,আসাফ তোরা কোথায়?তাড়াতাড়ি ডাইনিং এ আয়।দ্যাখ আকাশ কাকে নিয়ে এসেছে!”

দুজনে এক ঝটাকে এখানে এসে হাজির হয় ।দুইজনকে চিনতে আমার তেমন বেগ পেতে হয়নি।আকাশের থেকে আগেই শুনেছিলাম তার বাবা নেই। তারা ভাইবোন তিনজন।ভাই দুইটা এবং বোন একটা।আফিয়া দুই নাম্বার।আসাফ ছোট।আর সে সবার বড়।আফিয়া উৎসুক মুখ করে বললো,
“আরে এ ত সানা আপু,না ভাইয়া!”

মুহূর্তে একটা বিষম খাই। তারমানে আফিয়া আমাকে চেনে!কিন্তু কীভাবে?নিশ্চয়ই আকাশ আগে কখনো একে আমার ছবি দেখিয়েছিল এবং আমার ব্যাপারে কিছু বলেও ছিল।নাহলে এভাবে চেনার কথা না।আকাশের মা হেসে দিয়ে বললো,
“পরিচয় পর্ব সব পরে হবে।আগে বউমাকে ভেতরে নিয়ে আয়!”
আফিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে আসে।আনন্দের সহিত আমাকে যথাসম্ভব সাদরে বরণ করে।তবে আমি তাদের এই ব্যাপারটাতে খুব অবাক হলাম।হুটহাট আকাশ আমায় এভাবে নিয়ে আসলো, সেখানে ত উনাদের রাগ হওয়ার কথা।ছেলেকে বকাঝকা করার কথা।এই বিয়ে মানবে মানবে না বলে শরগোল সৃষ্টি করার কথা। তা না করে উল্টো উনারা…..!পৃথিবীতে এখনো এমন অমায়িক, নির্ভেজাল,শান্ত মনের মানুষ আছে তা আমার জানা ছিল না!সত্যিই আমি খুব অবাক!

রাত দশটার দিকে আফিয়া আমাকে রুমে নিয়ে আসে।আমি বিছানার দিকে তাঁকিয়ে দেখি পুরো বিছানা ফুলের বাহারে সজ্জিত!আফিয়া খানিক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ভাবী,আমি এবং আসাফ তাড়াতাড়ি কী সাঁজালাম না সাঁজালাম ওতোটা সুন্দর হয়নি।প্লিজ কিছু মনে করো না।”
আমি নৈঃশব্দ্যে আফিয়ার দিকে তাকাই।আফিয়া আবারো হাসে।তারপর একটা দৃঢ় শ্বাস ছেড়ে বললো,
“যাইহোক ভাবী সবকথা কাল হবে।আমি এখন গেলাম।খুব রাত হয়ে গেছে।থাকো। ভাইয়া চলে আসবে।আবার ভয় পেও না কিন্তু।”
আমি আফিয়ার কথায় না চাইতেও হেসে ফেলি।আফিয়া আমার নাকের সাথে তার নাকটা ঢলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

এবার আমার ভেতরটা নড়ে উঠে।এতক্ষণে মনের সব রাগ,জেদ,কষ্ট,অভিমান,দুঃখ সবকিছু ধুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।দু’চোখ দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে।এটা কী হয়ে গেল?এটা ত হওয়ার কথা ছিল না!এমনটা ত আমি কখনই ভাবী নি!!মুহূর্তে ঝটকা তুফানের মতো সবকিছু লন্ডবন্ড করে দিয়ে গেল!হে আল্লাহ,আমার জীবনের সাথে কেন এমন করো?কেন আমায় এত অগ্নি পরিক্ষায় ফেলো!
কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ি।এরমাঝে আকাশ ভেতরে ঢুকে।আমি বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তরহর চোখের পানি মুছে নিই।আমি মন খারাপ করেছি কি করিনি তা আকাশ বুঝলো কিনা জানি না।তবে সে খানিক সময় চুপ থেকেছিল দৃষ্টিটা আমার দিকে স্থির রেখে।তা আমি না দেখে নিলেও অনুভব করতে পেরেছি। নিস্তব্ধতার মাঝেই আকাশ গলায় খাঁকারি টেনে শান্ত গলায় বললো,

“সানা?”
আমি জবাব দিই নি।আমার নিশ্চুপতা দেখে আকাশ আবারো খানিক চুপ থাকলো।তারপর বললো,
“আমি খুবই দুঃখিত,সানা!আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সত্যি আমি কখনোই ভাবি নি!”.

বলেই আকাশ এবার কিছুটা ইতস্তত বোধ করে।গলার স্বরটা শিশুসুলভ করে অত্যন্ত অপরাধ ভঙ্গিতে বললো,
“আমি জানি তারজন্যে তোর মন খুব খারাপ।আর হ্যাঁ মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। হুটহাট এরকম একটা পরিস্থিতি যে কারো পক্ষেই সহজে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।এ ট্রমাটা কেঁটে উঠতে হয়তো তোর সময় লাগবে,আবার হয়তোবা কেঁটে উঠবেও না। প্লিজ তারজন্যে তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।আমি আসলেই দুঃখিত! আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা!তুই হয়তো ভেবেছিস তোর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বিধায় আমি তোর সামনে স্বামীর অধিকার খাটাবো!তোকে আমি ভালোবেসেছি সেই কলেজ থেকে এটা মানলাম। তাই বলে এমন কিছু করবো ওইরকম ছেলে আমি নই,সানা। তুই তোর সিকিউরিটি ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত থাকিস।যতদিন তুই আমাকে মন থেকে না চাইবি ততদিন আমি কখনোই তোর কাছে স্বামীর অধিকার নিয়ে আসবো না!আগে যেমন বন্ধু ভেবেছিস এখনও ঠিক সেইম সেইভাবেই থাকবো।তবে হ্যাঁ আমি অপেক্ষা করবো সেদিনের জন্যে যেদিন তুই আমাকে মন থেকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবি।আর তুই খুব ক্লান্ত।উঠে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আস।আমি একটু বেলকনিতে যাচ্ছি।”

বলেই আকাশ বেলকনির দিকে যায়।আমি ছলছল চোখে আকাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।কয়েক সেকেন্ড পর সন্তপর্ণে উঠে দাঁড়াই।ফ্রেশ হতে বাথরুমে যাই।বাথরুম থেকে বেরুতেই আকাশ বললো,

“তুই বিছানায় ঘুমা।আমি সোফায় ঘুমাচ্ছ।আর যদি কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলবি।ঠিক আছে?”
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলে আকাশ বিছানা থেকে একটা বালিশ টেনে নিয়ে সোফায় যেয়ে ওপাশ হয়ে শুয়ে পড়ে।
আমি আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ি।তারপর ধীরভাবে বিছানায় যেয়ে ড্রিম লাইট অন রেখেই শুয়ে যাই।।

সকালবেলা আফিয়ার কন্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।তাকিয়ে আফিয়া কৌতূহল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।জিহ্বায় দিয়ে গলা ভিঁজিয়ে বললো,
“কী ভাবী,বাসরটা কেমন হলো?”
আমি খানিকটা ধাতস্থতা বোধ করি।চোখমুখ কুঁচকে আনতেই আফিয়া হেসে দিয়ে বিষয়টাকে সহজাত করে বললো,
“আরেহ বলতে চাইলাম যে তোমার ঘুম কেমন হলো?”
আমি চোখমুখ এবার স্বাভাবিক করে হেসে দিয়ে মাথা নাড়ি।আফিয়া বললো,
“তোমাকে ভাইয়া সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালোবাসে এসেছে।ভাইয়াকে প্রায়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করতাম।জানো কি বলতো?বলতো- জানি না!জানি না, জানি না বলে সেই অজানাকে আজ আমাদের সামনে হাজির করলো!আহা ভাবী, ভাইয়া যে কি একটা সারপ্রাইজ আমাকে দিল আমি কত্ত খুশি হলাম তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।আর সবথেকে বড় কথা হলো ভাইয়া তার ভালোবাসাকে এতবছর পর নিজের করে পেল।আচ্ছা,আগে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং আসো।মা সেই কখন তোমার জন্যে নাস্তা নিয়ে বসে আছে!আর জানো বলদ ভাইয়াটা কি করছে?”

আমি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আফিয়ার দিকে তাকাই।বললো,
“বলদ টা নিজে আগেভাগে খেয়ে নিয়ে হাসপাতালে ডু মারলো।একটু অপেক্ষাও করলো না তোমার জন্যে!”
“এখন ক’টা বাজে?”
“ন’টা এখনো বাজে নি।তবে কয়েক মিনিট পর ন’টার কাঁটায় টিকটিক করবে।”
“আমার জন্যে বসে থেকে হাসপাতালের দেরী হয়ে যেত না?হয়তো এজন্যে চলে গেছে।” বলেই হাসলাম।
“দেরী হলে হত!নতুন বউকে কেউ এভাবে রেখে চলে যায়?আজ আসুক বাসায় আচ্ছামত মারবো!বলদের যম!”

আমার হাসি পেয়ে যায় খুব আফিয়ার এহেন কথায়।আফিয়া যে খুব দুষ্ট,আর মিশুক টাইপের আমি বুঝতে পারলাম!তরপর আফিয়ার সাথে কথা শেষ করে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসি।আকাশের মা আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে চেয়ারে বসান।নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলেন,

“জানো,মা?আকাশ যখন ডাক্তারিতে জয়েন করে তখন ওকে প্রায়ই বলতাম একটা বিয়ে করার জন্যে,নিজের সংসার ধরার জন্যে!অথচ এই মাথামোটা ছেলেটা আমার কথা পাত্তাই দিত না।আর শুধু এটাই বলতো,বিয়ে করলে ত দেখবা!তখন এই কথাটা কোন মায়েরই শুনতে ভাল্লাগতো বলো ত!তবে এখন আমার খুব ভালো লাগছে তোমাকে দেখে!আমার ইচ্ছেটা পূরণ করলো!তবে হ্যাঁ,আর কয়েকমাস পর আমি কিন্তু তোমার এবং আকাশের বিয়েটা আবার পুনরায় ধুমধাম করে দিব!আশপাশের সবাইকে দাওয়াত করবো।আমার আদরের ছেলে বলে কথা!”
আমি হাসি ছাড়া একথার পিঠে অন্যকথা বলতে পারি নি!

সন্ধের পর আকাশ বাসায় ফিরে।হাতে রাখা ব্যাগটা সোফার উপর রেখে ঘাম ভেজা শার্টটা খুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
“দ্রুত বই নিয়ে বস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

কিঞ্চিৎ অবাক হলেও আমার স্টাডির প্রতি ওর সিরিয়াসনেস দেখে বেশ ভালো লাগলো।আমি সাবলীলায় বই নিয়ে চেয়ার টেনে বসি।কম্পিটিটিভ বইটা খুলে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর এরইমাঝে আকাশ বেরিয়ে আসে।ওর অস্তিস্তে আমার ভেতরটায় অজানা এক সংকোচ, লজ্জা ভেতরটায় তোলপাড় হচ্ছে।আকাশ আমার সাইড থেকে চেয়ারে বসে নিয়ে খানিক্ষন জিকে বইটা ঘাটাঘাটি করে আমার দিকে দৃষ্টি এঁটে।বললো,
“সানা,তুই খুব আনইজি ফিল করছিস?”

আমা কাঁপা চোখের পাতায় আকাশের দিকে তাকাই।বার দুয়েক ঢোক গিলে বললাম,
“নাহ,নাহ আমি ঠিক আছি।”
আকাশের আমার কথা বিশ্বাস হলো না।বললো,
“সানা,আমি কাল রাত তোকে বললাম না তুই আগে আমাকে যেমন বন্ধু ভেবে এসেছিস এখনও তাই ভাবিস।এভাবে হলে তুই প্রিপারেশনে এগুতে পারবি না।বললি না ভালো জব করবি?ভালো জব করতে হলে কষ্ট করতে হবে!খুব কষ্ট!”

আমি ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।আকাশের কথাগুলো খুবই নর্মাল ছিল।চোখমুখে কোনো রকম ভঙ্গিমা ছিল।একদম সাদামাটা!!

তারপর থেকে আকাশের সামনে প্রতিদিন বই নিয়ে পড়তে বসি।একটা মুহূর্তে ধীরস্থির ভাবে মনের সব জড়তা,সংকোচ কেঁটে যেতে থাকে।

চলবে….